<< আগের পৃষ্ঠা: জাপান পর্ব ২ মার্চের প্রথম সপ্তাহ -২০১৮
১ম মার্চ ,
আজ আমাদের ওয়ার্ড অফিস মানে মিউনিসিপালিটি অফিসে যাওয়ার কথা। এয়ারপোর্টে আমার যে রেসিডেন্সিয়াল কার্ড হয়েছিল , তার পরবর্তী পর্যায়ের কিছু সরকারি কাজের জন্য। সুগাকুইন থেকে ৫ কিলোমিটার। আমরা যাবো আমাদের সাইকেল এ। আগে বলা হয়নি , ভাস্কর আগে থেকে দুটো সাইকেল কিনে রেখেছিল আমি পৌঁছানোর আগেই , আমাদের দৈনিন্দিন যাতায়াতের সুবিধার্থে।এখানে সাইকেল র রেজিস্ট্রেশন হয় , আর সাথে insuarance ও। রেজিস্ট্রেশন র পর সাইকেল তোমার নাম হবে, খরচ, ৫০০ ইয়েন (Yen জাপানীস মুদ্রা )আর insurance করতে খরচ ২০০০ থেকে ১০০০০ এর মধ্যে (সাইকেল র পরিস্থিতি ওপর নির্ভরশীল ) . আমাদের সাইকেল দুটোই সাধারণ মানে gear নই। প্রতিটির মূল্য তাতেই ৪০০০ ইয়েন (২nd hand ),আসল মূল্য ১০০০০ এর ওপরে। এখানে সাইকেল বেশির ভাগ সেকেন্ড হ্যান্ড পাওয়া যায়। gear সাইকেল সেকেন্ড হ্যান্ড ৯০০০ এর কাছাকাছি মূল্য। আমাদের রোজকার বাজার আর টুকিটাকি ঘোরার জন্য সাধারণ সাইকেল এ যথাযোগ্য মনে হয়েছিল ।
এখনো পর্যন্ত আমার মেয়ের বেবি সিট্ লাগানো হয়নি সাইকেল এর পেছনে। এখানে সাইকেল-এর সামনে পেছনে বিভিন্ন রকম বেবি সিট্। আমাদের দেশের মতো ক্যারিয়ার এ বসিয়ে নিয়ে যাওয়া আইনত বারণ।
এই প্রথম সুট বুট পরে সাইকেল চালানো , তার ওপর এতো ঠান্ডা , যে, চোখ টা ছেড়ে বাকি সব কিছুই টুপি দিয়ে ঢেকে ফেললাম , বুঝতে পারছিলাম একদম জঙ্গি লাগছি , কিন্তু দূর দেশে কোনো ঝুঁকি নিতে পারবনা। আমার বড্ডো ঠান্ডার ধাঁচ। তার পরে বয়সটাও তো কম হলো না।
আমাদের এখনো My Number হয়নি (অনেকটা ভারতের আধার কার্ডের মতো), তাই আমাদের মোবাইল সিম নেওয়াও হয়নি।আর এখানে অলিগলি যেতে জিপিএস দেখে যেতে হয়। ভাস্করকে আগে থেকেই অফিস গাড়িতে করে ওয়ার্ড অফিস নিয়ে যাওয়া হয়েছিল (আমি জাপানে আসার আগে), ভাস্কর সেই বিশ্বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। অনেকটা পথ যাওয়ার পরে হারিয়ে গেলাম যথারীতি (ভাস্করের স্মৃতি শক্তির ওপর আমার কেন ওর ও ঠিক ভরসা নেই ), অগত্যা,এদিক দেখি ওদিক দেখি ,কাউকে পাইনা , জিগেস করার।
অনেক কষ্টে বাস ডিপো তে একজন কে ধরে ভাস্কর কি যে বললো জানিনে , সে তো ইংলিশ কিছুই বুঝছে না আর ভাস্কর ও বুঝিয়েই যাচ্ছে। সে এক হাস্যকর ব্যাপার। শেষমেশ বুঝে সে একটা ছবি এঁকে তাতে জাপানীস কিছু লিখে দিলো , যা দেখিয়ে দেখিয়ে আমরা ওয়ার্ড অফিস পৌঁছলাম।
ওয়ার্ড অফিস এক কথায় মিউনিসিপ্যালিটি অফিস। চার তোলার অফিস , তা কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি থেকে কম নয়। যেমন সংগঠিত, পরিষ্কার আর তেমন সুন্দর। অগুনিত লোক কাজ করছে , অনেক লোকের ভিড় আমাদের মতো। কিন্তু কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। প্রতি ডেস্ক এ একজন করে হেল্পার আছে আর আছে একটা নম্বর মেশিন , যেখান থেকে নিজের নম্বর নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। সব কিছু যেন সুপরিকল্পিত। চাইল্ড কেয়ার কাউন্টার এর কাছে অনেক খেলনা রাখা , অনেক মা বাবার ভিড় , কিন্তু ছোট বড়ো বাচ্চা থাকলেও শোরগোল কম। যে যার খেলনা নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের কাজ সারতে ২ ঘন্টার ওপর লাগলো , ফেরার পথে আরো কিছু দোকান আর mall ঘুরে ঢুঁ মেরে এলাম।
২য় মার্চ ,
আমার বাবি (মেয়ে), আজ প্রথম অনেক ক্ষণের জন্য আমাকে ছেড়ে থাকবে।এখনো পর্যন্ত সে স্কুলে ২.৫ ঘন্টার বেশি কাটায় নি। খাওয়া নিয়ে তার জন্ম থেকে অসুবিধা। তার খেলার স্কুলএ ও সে সামান্য বিস্কুট বা ফ্রুট শেষ করে আসেনা। আজ সে একা লাঞ্চ করবে , ভেবেও পাগল পাগল অবস্থা। মন কে সকাল থেকে বুঝিয়ে চলেছি , পারবে পারবে , একদিন তো মা র থেকে দূরে যেতে হবে , সাবলম্বী হতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি (যা আমার মা আমাকে না করাতে , আজ ও মনে খুব ছোট ছোট কারণে দুঃখ পাই ) .
সকল ৮:৩০ থেকে দুপুর ২:২০ , বেশ অনেকটা সময়। রাস্তাটা ঠিক চিনতে পারবো নাকি নিশ্চিত করতে , ১০:৩০ এ একবার ঘুরে এলাম স্কুল থেকে। স্কুলের শিক্ষিকা রা আমাকে দেখে একটু হতবম্ব , অনেক বার বললাম , আমি এমনি এসেছি , মেয়ে ঠিক আছে নাকি দেখতে। সে বাপু বোঝে আর কই। হাজার ইংলিশ বলো কেউ বোঝে না। মাঝে মনে হচ্ছিলো বলি বাংলাতেই , হিহি। ব্যাঙ তো বুঝছে। পর পর তিন তিনজন শিক্ষিকা আসার পর , একজন এলেন , যিনি অল্প স্বল্প ইংলিশ বলতেও পারেন আর বুঝতেও পারেন। পরে জানলাম , ইনিই বাবি র ক্লাস এ থাকে।মেয়ের খবর নিয়ে ফিরে এলাম।
২টো থেকে গিয়ে অপেক্ষা , কখন ছুটি হবে।আমার মতো অনেক মায়েরা অপেক্ষায় ছিল, সবাই নিজেদের গল্পে, হাসি ঠাট্টাতে মশগুল। সবার চোখ আমাকে এড়ালো না , সবাই অভিবাদন জানালো , মিষ্টি হাসিতে মাথা নত (এটা জাপানীস সংস্কৃতি, কাউকে অভিবাদন জানানোর ) . আমিও সম -অভিবাদন জ্ঞাপন করলাম , কখনো Hi বা Konnichiwa (こんにちは) বলে। এদের মধ্যে কয়েকজন আমার সাথে কথা বলার চেষ্টাও করলো , অল্প স্বল্প জাপানীস ইংলিশ মিশিয়ে ,একে অপর কে বোঝালাম কিছু কথা, এখানে কোথায় থাকি,কবে এসেছি ইত্যাদি। দুজন ছিল এর মধ্যে যারা জাপানীস হওয়া সত্ত্বেও ভালো ইংলিশ বলে , একজন এর নাম মাইক , আর জনের নাম জিগেস করিনি। আমার নাম ও ওদের কাছে খুব কঠিন , তাই কেও চাইলো ডাক নাম। বললাম পল বলো। আর একটা আশ্চর্য জিনিস লাগলো ,ওরা সবাই জানে আমি আধ্যার মা , সবাই আধ্যার কথা জিগেস করলো আর বললো তাদের বাচ্চারা বলেছে , একটি নতুন মেয়ের কথা আধ্যা চা। হাহাহা।
এখানে ছোট বাচ্চাদের নামের সাথে “চা ” আর বড়োদের নামের সাথে “সন ” যোগ হয়। যেমন আধ্যা এখন আধ্যা চা আর ভাস্কর এখানে ভাস্কর সন।
এখানে সাত বছরের আগে কোনো প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়না। আমার মেয়ে এখন পাঁচ বছর চার মাস ,তাই ওকে ও ওরা কিন্ডার গার্ডেন এ ভর্তি নিয়েছে। মোট কটা ক্লাস ঘর সেভাবে গোনা হয়নি।তবে বয়েস অনুযায়ী তিনটে ক্লাস , তিন বছরের নিচে,৬ বছরের নিচে আর তার উর্দ্ধে। সাথে আছে খেলার ঘর ,নাচের আর ঘর।
সামনে ছোট্ট মাঠের মতো যেখানে পার্কের সরঞ্জাম।
দূর থেকে দেখলাম ,সব ছোট্ট ছোট্ট পুতুলের দল , একসাথে লাইনে বেরিয়ে , নিজেদের জুতো-জ্যাকেট পড়ছে। এলেন আমার মেয়ে ,সাথে আরো মিষ্টি মিষ্টি জাপানীস বাচ্চাদের সাথে লাইন করে।একটি মেয়ের হাত ধরে , নাম হিনানা।
৩য় মার্চ
আজ ইন্ডিয়া তে দোলযাত্রা মানে হোলি।ডাস্ট এলার্জি র জন্য সেভাবে আর এখন রং খেলা হয়না। হঠাৎ সকালে শুনলাম এখানেও (কিয়োটো তে )নাকি ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন আছে , তারা আজ দোল উদযাপন করবে। যাবো যাবোনা ভেবে শেষমেশ রাজি হলাম। আজ এখানে ট্রেন এ চড়ার পালা , গেলাম একদম পাশের সুগাকুইন রেলস্টেশন এ। জানিনা কি করে টিকেট কাটবো। সর্বত্র শুধু জাপানীস লেখা।ট্রান্সলেটর দিয়ে কোনোক্রমে বুঝলাম , প্রাপ্তবয়স্ক ২৪০ আর শিশু ১২০(yen)। বুঝে তো গেলাম, কিন্তু কাটবো কি করে টিকিট , এখানে সব কাজ নিজে করতে হয় শুনেছিলাম , হ্যা নিজের টিকিট নিজে, মুম্বাইতে ও এই সিস্টেম আছে বেশির ভাগ স্টেশন এ কিন্তু প্রক্রিয়া আলাদা। coin ফেললাম , হিজিবিজি যেখানে মন চাইলো কয়েকবার টিপাটিপিতে বেরিয়ে আসলো টিকিট। সাথে সাথে ট্রেন ও হাজির।
অনেক লোক আগে দাঁড়িয়ে ছিল। দেশের অভ্যেস সহজে কি বদলায় , আমি সবাইকে ডিঙিয়ে যেতেই পেছন থেকে ভাস্কর বললো , আরে দাঁড়াও , লাইনএ এসো। কত লোক, কিন্তু কি নিস্তব্ধতা। তাও রেল স্টেশনে , ভাবা যায় !!!!
ট্রেন থামতে (২ বগি ) , সামনে ড্রাইভারের দরজা খুলে চালক , নেমে দাঁড়ালো। আমরা সবাই পেছনের গেট দিয়ে চড়ে বসলাম। এখানে নিয়ম অনুযায়ী , পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকা আর সামনের দরজা দিয়ে বাহির। তাই আমাদের দেশের মতো ঠেলাঠেলি র ব্যাপার টা নজরে এলো না। নামার সময় একটা বাক্স রাখা যার মধ্যে তুমি তোমার টিকেট ফেলতে পারো আর যদি টিকিট না কাটো , চালক-কে টাকা দিয়ে নেমে যেতে পারো। এরকম অনেক স্টেশন আছে যেখানে টিকিট কাটার মেশিন বসানো নেই , সেখানে ট্রেনে উঠে , নামার সময় , চালকের হাতে টাকা দিয়ে নেমে যেতে পারো। আর একটি ব্যাপার সত্যিই তারিফ করার মতো , তা হলো বিশ্বাস , এরা এতটাই সৎ (আশা করা যায় , আমার অনুমান ঠিক ), যে তুমি কত টাকা দিলে চেক না করেই বক্সে ফেলে দেবে।
আমাদের কলকাতার মেট্রোর মতো , পরবর্তী স্টেশনের নাম সহিত ঘোষণা হচ্ছিলো, জাপানীস আর ইংলিশ দুটোতেই। আমাদের তৃতীয় স্টেশনে গন্তব্য।Mototanaka Station । এটি ভাস্করের ইউনিভার্সিটি র নিকটতম রেল স্টেশন। ঠিকানা হাতেই ছিল , এদিক ওদিক দেখে পৌছালাম হোলি উৎসবে।
অনেকের সাথে আলাপ এর সাথে বেশ ভালো খেলাম ও। লুচি, কপির তরকারি, মিষ্টি , জুস র চা। আমার আধ্যা যাওয়ার সাথে সাথেই পেয়েছিলো এক ফিলিপিন বন্ধু Pauline কে। অনেক নাচানাচি ,ফটো আর অনেক রং , সব মিলিয়ে দারুন কাটলো সময়। আলাপ হলো ভাস্করের এখানে এসে বেশ পরিচিত আসিফ এর সাথে ও। ভাবিনি প্রথম সপ্তাহে হবে এতো হৈচৈ।
৪য় মার্চ ,
প্রথম রবিবার। সকল থেকে চললো ঘর গোছানো। হ্যাঁ , আগামী কিছু মাসের জন্য এটাই আমাদের ঘর। আমার মতে , যেখানেই থাকি , সেটাকে নিজের মতো না গোছালে সে আর ঘর হয়না।
আজ ঘুরলাম, এদিক সেদিকের দোকান গুলো , সাথে সাইকেল। আমাদের রোজকার খাদ্যতালিকা কে সঠিক করে নিতে গবেষণা করে দেখলাম কি কি পাওয়া যাচ্ছে।
<< আগের পৃষ্ঠা :জাপান পর্ব ২ পরবর্তী পৃষ্ঠা :জাপান পর্ব ৪>>
[…] আগের পৃষ্ঠা : জাপান পর্ব ৩ ৪য় মার্চ থেকে ১১ই মার্চ এক সপ্তাহ কেটে গেলো। উফফ কবে যে এ কটা মাস কাটবে। এই উফফ টা কেন , তা বাপু আমাকে জিগেস করে লাভ নেই। সে এক স্বপ্নের মতো , আমি এয়ার এশিয়া ধরে ইন্ডিয়া যাচ্ছি , কবে যে সে দিন আসবে। দেশে ফিরে কি কি করবো , আর কি না করবো , সব ভেবে নিয়েছি এই গত এক সপ্তাহে। বুঝতেই তো পারছেন , অঢেল সময়।শুধু ভাবার আর কিছু না করার। হা হা। […]
[…] << আগের পৃষ্ঠা :1 >>পরবর্তী পৃষ্ঠা :৩ […]