(১) 


নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলেছে একটা সাদা ঘোড়া তার সওয়ার-কে নিয়ে। অনেক পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে তাকে পৌঁছতে হবে সেই গুহা-টায়, যেখানে অপেক্ষা করছে চারভি। কয়েক’শো মাইল পথ অতিক্রম করে জঙ্গলের দুর্গম অভ্যন্তরে একটি গুহার সামনে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন মধ্যবয়স্ক তূর্যবর্মণ। সাতবাহন বংশের অবসান ঘটিয়ে সিংহাসনে বসা-ই যার একমাত্র লক্ষ্য। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে গুহার মুখ যেন এক মায়াবী দানবের আগ্রাসনের সম্মোহনী আকর্ষণ, যেখানে প্রবেশ করা যায়, কিন্তু বেরিয়ে আসা অসম্ভব। তূর্যবর্মণ অতি সাবধানে গুহার মধ্যে প্রবেশ করলেন। একহাতে তরোয়াল আর আরেক হাতে গুহার দেওয়ালে আটকানো একটি মশাল তুলে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর পৌঁছলেন নিজের গন্তব্যস্থলে। এটি গুহার প্রায় শেষ প্রান্ত, হালকা আলোয় প্রায় অন্ধকার গুহার মাত্র ২ হাত দূরের বস্তুও চোখে দেখা দুষ্কর।  কিছুটা দূরে দেওয়ালের গায়ে আটকানো মশালের আলো- তে দেখা গেল একটি বিকট, ভয়ংকর পাথরের নারী মূর্তি। হয়ত কোনো ভগবান কিংবা, শয়তান!  মূর্তির সামনে খোলা চুলে প্রায় অর্ধনগ্ন একজন নারী দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু মন্ত্রপাঠ করছে আর তার সাথে পাশের পাত্রে রাখা তাজা রক্তে ভেজানো ফুল, সেই মূর্তির উদ্দেশ্যে অর্পণ করছে। তূর্যবর্মণ শান্ত গলায় ডাকলেন – চারভি! ঘূরে তাকাল সেই পূজারিণী। অল্প আলোতেও তার চোখের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা বুঝতে একমুহূর্ত সময় লাগল না তূর্যবর্মণের। 
– তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। মা-এর পায়ে আহুতি দেওয়ার সব আয়োজন সমাপ্ত। এদিকে এসো- বলল চারভি। 
– এতে কি সত্যিই আমি যা চাইছি সেটা পাবো?  জিজ্ঞাসু চোখে প্রশ্ন করলেন তূর্যবর্মণ। 
– তোমার কি আমার উপর ভরসা নেই?  একমাত্র আমিই পারি তোমাকে সিংহাসন লাভের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।  তবে, তোমাকেও একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে, বলে চলল চারভি।  রাজা হওয়ার পর প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে একজন করে সামর্থ্ পুরুষ -কে তুমি আমার কাছে পাঠাবে মা-এর পায়ে বলি দেওয়ার জন্য। আমার  সাধনার জন্য ,আমার অমরত্ব লাভের জন্য এইটুকুই আমার দাবি। 
অবাক হলেন তূর্যবর্মণ। “তার মানে এটা একরকম ব্যবসায়িক চুক্তি? আর নরবলি? মানুষ হত্যা? এতবড় পাপ করব আমি?”
“পাপ?” হাসতে থাকল চারভি। “রাজত্ব লাভ করতে চাওয়া, সিংহাসন দখলের জন্য আমার কাছে আসা, এগুলো পাপ নয়? আর ব্যবসা? কোনো কিছুই নিঃস্বার্থ ভাবে হয়না। আজ তোমার ইচ্ছাপূরণ- এর জন্যও কাউকে মা-এর পায়ে সমর্পণ করতে হচ্ছে, কাল আমার নিজের ইচ্ছাপূরণের জন্য তুমি সেই ব্যবস্থা করবে। “
এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এবার তূর্যবর্মণের চোখ গেল মূর্তির বেদীর দিকে, যেখানে বছর ২৫-এর এক যুবক -কে শোয়ানো আছে। তূর্যবর্মণের মাথা কাজ করছিল না, একটা গরম স্রোত ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে রাগের অন্তিম স্তরে পৌঁছে দিচ্ছিল। নিজেকে কোনোরকমে শান্ত রেখে সে বলল, “কিন্তু তুমি আমাকে শুধুমাত্র সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে। নরবলি বা সাহায্যের পরিবর্তে প্রতি- সাহায্যের কথা তুমি আগে বলনি।”
– অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল চারভি, “তুমি এখন আমার ফাঁদে পড়ে গিয়েছ। তোমাকে আমার সব কথা মানতেই হবে। নচেৎ রাজার কাছে আমি তোমার সব কথা জানিয়ে দেবো আর তার ফল কি হবে সেটা তুমি ভালোভাবেই জানো।”
তরোয়ালটা এতক্ষণ হাতেই ছিল, এবার সেটা নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেল, একবার, দু’বার…… রক্তাক্ত অবস্থায় পেট-এ হাত দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল চারভি।  বিকট চিৎকারে কেঁপে উঠল গুহার প্রতিটি কোণা। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিজের রক্তে রাঙিয়ে দিল সেই বিকট দর্শন মূর্তির বেদী, আর তূর্যবর্মণের উদ্দেশ্যে শেষবারের মত বলতে লাগল, “প্রতি জন্মে আমি ফিরে আসব ….. বার বার…… তোর ধ্বংসের কারণ হয়ে…. “
যুবকের হাতের বাঁধন খুলে তাকে সঙ্গে নিয়ে  তূর্যবর্মণ গুহা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এগোতে লাগল। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বেরোনোর পথ খুঁজে পেল না।  কোনো অদ্ভুত ক্ষমতাবলে চারভি যেন তাদের বেরোনোর সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। 

(২) 


“দ্যাখ common জায়গাগুলো তে সবাই ঘুরতে যায়। আমরা একটু uncommon, virgin place -এ ঘুরবো”,  সিগারেট টা গাড়ির জানলা থেকে ফেলে দিয়ে আমার দিকে তাকালো নীল। “হ্যাঁ ভাই, আর কোথায় যাব ? ২৫ বছর বয়সেও virgin আছি যখন virgin place-এ ই যাবো।”  পাশ থেকে বলল ঋচিক।  ওর কথা শুনে আমরা চারজন -ই হাসতে থাকলাম। আমরা চারজন মানে নীল, ঋ, রাহুল আর আমি শুভ জীবনের প্রথম ট্রিপ- এ এসেছি অন্ধ্রপ্রদেশ ঘুরতে। আপাতত Borra cave দেখে ফেরার পালা। পাহাড় আর জঙ্গলের অসাধারণ সৌন্দর্য ,সাথে জুন মাসের বর্ষার প্রথম বৃষ্টি আর মাঝেমাঝে হালকা রোদের উঁকি ঝুঁকি পুরো ব্যাপার -টা কে আরো মোহময় করে তুলেছে। তেলেগু গানের volume টা একটু কমিয়ে দিয়ে রাহুল আমাদের ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া ইঁয়াহা পে ভার্জিন প্লেস কিধার মিলেগা?”ওর প্রশ্ন শুনে আর ড্রাইভারের মুখ দেখে আমাদের আরেকপ্রস্ত হাসার পালা। ড্রাইভার বছর ৩৫ এর যুবক, সে ও আমাদের সাথে হাসতে লাগল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “হুকমপেটা অর পডেরু কে সাইড মে আপকো বহত আচ্ছা জায়গা মিলেগা ফটোগ্রাফি কে লিয়ে। লোগ উস তরফ কম হি যাতে হ্যায়।  জঙ্গল অর পাহাড় ভি বহত বড়িয়া হ্যায়।”আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিতনা টাইম লগেগা? “” আপলোগ যাঁহা রুকে হো ওয়াঁহা সে করীব ৯০ কিলোমিটার  কা রাস্তা হ্যায়। তিন ঘন্টা লগ হি যায়েগা” – বলল আমাদের ড্রাইভার বিরজু। চারজন -ই মোটামুটি একমত ছিলাম তাই আর নতুন কোনো plan এর প্রশ্ন- ই এলো না। এখন শুধু রাতে একটু net ঘেঁটে ঋ-এর পড়াশোনা আর তার সাথে প্রচুর জ্ঞান দেওয়াটা বাকি। 
পরদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম  sight seeing এর জন্য, সেই off beat destination এর উদ্দেশ্যে।  আমরা অনেক গল্প, ইয়ার্কি মারলেও ঋ আজ চুপচাপ। হয়ত প্রকৃতির সব সৌন্দর্য টুকু নিংরে নিয়ে উপভোগ করছে। প্রায় তিন ঘন্টার উপর আমরা চলেছি। যত যাচ্ছি ততই যেন জঙ্গল আর পাহাড়ের সৌন্দর্য আকর্ষণ করছে। আমরা সবাই এখন একদম চুপ। মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ উপভোগ করছি। আর…..জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমাদের সাদা mahindra গাড়িটা , ঠিক যেন একটা সাদা ঘোড়া, যে তার সওয়ারিদের নিয়ে ছুটে চলেছে। 

(৩)

 
ঋ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “বিরজু ভাই গাড়ী রোকো।” গাড়ী দাঁড়িয়ে গেল ব্রেক কষে। “ইঁয়াহা কোই গুফা কে বারে মে আপ জানতে হো?” -বলল ঋ। ড্রাইভার অবাক হয়ে জানাল সে জানেনা। ঋ তখন সামনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “উনসে পুছিয়ে”সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একজন আদিবাসী মহিলা মাথায় কলসি আর হাতে কিছু কাঠ নিয়ে এগিয়ে আসছে। তার গলায় মাকড়ি, কানে বেশ বড় পোড়ামাটির দুল, শাড়ী টা বেশ অদ্ভুত ভাবে পরা, মানে আমাদের বাঙালিদের মত না।  বিরজু তাকে তেলুগু ভাষায় কিছু জিজ্ঞেস করল। সে ও হাত নেড়ে কিছু বলল। আবার গাড়ী স্টার্ট দিয়ে চলতে লাগল। পিছনে তাকিয়ে একঝলক সেই মহিলা -কে দেখলাম, সে ও পিছনে ঘুরে আমাদের দেখছে। হয়ত এরকম গাড়ী এখানে কম- ই আসে! “অর আধা ঘন্টা লাগেগা” -ড্রাইভার বলল। আমরা ঋ-কে গুহার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে ও বলল আগের দিন রাতে জায়গা-টা সম্পর্কে  net ঘাঁটতে গিয়ে ও কিছু information পেয়েছে। যাই হোক, বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর গাড়ী থামল।  ড্রাইভার বলল এরকম জায়গার কথা-ই বলেছিল ঐ আদিবাসী মেয়েটি।  আমরা খাবার carry করছিলাম। আসার পথে খাবার আর জল কিনে নিয়েছিলাম। সেগুলো খেয়েই গাড়ী থেকে নেমে চারদিক-টা দেখলাম! “কি view রে! পারলে সারাজীবন এখানেই থেকে যাবো!” সিগারেটে টান দিয়ে বলল নীল। পাশ থেকে ছবি তুলতে তুলতে রাহুল বলে উঠল, “কিন্তু সাবধান, আশপাশে একটাও সিগারেটের দোকান নেই কিন্তু! আর ফোনে টাওয়ার ও নেই”ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৪টে ছুঁই ছুঁই। বিগত ১ ঘন্টায় আমরা অনেক টা হেঁটেছি আর প্রচুর ছবি তুলেছি।গাছপালা ঘেরা প্রান্তর, জঙ্গল পেরিয়ে এখন যে জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছি, সেটা প্রায় কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত স্বল্প ঘাসের ফাঁকা জমি, ডানদিকে আবার জঙ্গল আর বড় গাছ। বাঁদিকে সম্ভবত দূরে একটা জলাশয় আর তার চেয়েও দূরে পাহাড়ের সারি। এই নিস্তব্ধ জঙ্গলে, অচেনা অজানা পাহাড়ের কোলে আমরা পাঁচটা প্রাণী যেন ইস্টার আইল্যান্ডের মোয়াই স্ট্যাচু। 
“চলিয়ে নিকলতে হ্যায়” -বলল ড্রাইভার”Sunset দেখনে দিজিয়ে, আভি তো সির্ফ সাড়ে চার বজে হ্যায়।” -বলল নীল। ঋ এখন আর আগের মত চুপচাপ নেই। ড্রাইভার বলল -“আজ অমাবস্ হ্যায়, আন্ধেরা যাদা হোগা। জঙ্গল কা রাস্তা হ্যায়”কথাটা logical মনে হলেও sunset দেখার লোভ সামলানো গেল না। এরকম সুযোগ তো বারবার আসেনা! আরো কিছুটা এদিক ওদিক ঘোরার পর দূরের পাহাড়টা লাল হল, সূর্য নেমে গেছে দিগন্ত রেখার নীচে। আর তখনই অঘটন টা ঘটল। নীল ছবি তোলার জন্য একটা জংলি গাছে ঢাকা ঢিবির উপর উঠেছিল। কোনোভাবে সেটা ভেঙে বেশ কিছুটা নিচে ঢুকে গেল। একটু ওঠার চেষ্টা করলেও পারল না। পুরোটাই ঢুকে গেল। আমরা খুব তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে নীল -কে ডাকলাম। অনেকটা নীচ থেকে নীল এর গলা পাওয়া গেল। মোবাইলের  টর্চ জ্বেলেছে। একা বেরোনো অসম্ভব, অনেকটা নীচু। ড্রাইভার ওর ব্যাগ টা আমাদের হাতে দিয়ে বলল, “হাম দেখতে হ্যায়” বলে সে ঐ ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে নীচে নামতে লাগল। 
ঝুপ করে অন্ধকার নেমে গেল, বাতাস ভারী, যেন খারাপ কিছুর পূর্বাভাস। হালকা বাতাসের সিরসিরানি যেন কোনো মায়াবিনী-র তীক্ষ্ণ হাসি। যেন কানে কানে ফিসফিস করে কয়েক যুগের অপেক্ষার গল্প বলতে চায়। -“ঠিক আছিস?” -ভিতর থেকে উত্তর এল “হাত কেটে গেছে”হঠাৎ নীল আর ড্রাইভার দু’জনের চিৎকার, নীল কিছুটা উঠেছে, বিরজু ওকে ধরে তুলে দিয়েছে অনেকটা উপরে। একটা পাথরে ভর দিয়ে বেরোনোর আগে শেষবার পিছন ফিরে তাকালো নীল, ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমরাও তাকালাম সেই গহ্বরের ভিতরে।
ভিতরটা হাল্কা লাল আলোতে ভরে গেছে, অল্প আলোয় স্পষ্ট দেখা না গেলেও  দেখতে পেলাম একটা আবছা নারী মূর্তি, গলায় মাকড়ি, কানে বড় দুল…যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাদের ড্রাইভার বিরজু-র  দিকে। হয়ত একঝলক তাকালো আমাদের দিকে!! হাত ধরে নীল-কে টেনে বের করার আগে শেষবার আমার চোখ গেল গুহার ভিতরের দেওয়ালে। হালকা আলোতে  ভিতরের দেওয়ালে মনে হল কোনো দেবতার মূর্তি। 
না, ড্রাইভার বেরোতে পারেনি। নীল কে আমরা হাত ধরে টেনে তোলার সাথে সাথেই সেই গহ্বরের মুখ  ধস নেমে ঢাকা পড়ে যায়। আমরা ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠে কিছুক্ষণ সেই গহ্বরের মুখ খোঁজার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হই। তারপর উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়ে এসে কোনোরকমে আমরা ৪ জন গাড়িতে পৌঁছাই। 

(8)

 
একটু ধাতস্হ হয়ে নীলের হাতটা ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে দেখা গেল ক্ষত বেশ গভীর। অনেকটা রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে ফুলে আছে।  “কি করব আমরা এখন? “- জিজ্ঞেস করল রাহুল। “গাড়ীতে বসে থাকা ছাড়া আর কি করার আছে? “- আমি বললাম। “সারারাত এইভাবে এখানে থাকা possible নয়। নীল তুই ড্রাইভ করতে পারবি?”- জিজ্ঞেস করল রাহুল। নীল বলল -,”atleast এখান থেকে বেরোতে হবে। পারব আমি! ” আমাদের মধ্যে একমাত্র নীল- ই ড্রাইভ করতে পারত। গাড়ি start নিয়ে চলল অজানা রাস্তা দিয়ে এই অভিশপ্ত জঙ্গল থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে।  প্রায় ৩ ঘন্টা এদিক ওদিক ঘোরার পর অবশেষে আমরা বড় রাস্তা খুঁজে পেলাম। এই সময় – টার প্রতিটা মূহুর্তে মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমাদের তার অদৃশ্য চোখ দিয়ে লক্ষ্য রাখছে। পেট্রল প্রায় শেষের দিকে।  মোবাইলে টাওয়ার এসেছে দেখে থানা-য় ফোন করে সবটা বলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। কাছের ফলকে জায়গার নাম দেখে জানানোর পর  থানা থেকে আমাদের ওখানেই থাকতে বলা হ’ল। ওরা আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নিয়ে যেতে। 
বৃষ্টি নামল। আমরা গাড়িতে বসে আছি। একঝলক ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিল  আমাদের।  ঋ বলতে শুরু করল , 
“১৮০০ সালের প্রথম দিকে যখন উইলিয়াম জর্জ আর তার দলবল Borra cave খুঁজে পান, শোনা যায় নাকি তারও ১০-১২ বছর আগে কোনো বৃটিশ আর্কিওলজিস্ট হুকমপেটা আর পডেরু -র মাঝামাঝি কোনো জায়গার সম্পর্কে জানতে পেরে ওখানে কোনো গুহার খোঁজ চালান। তবে তাদের দলের একজন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় আর সাহেব নিজে অসুস্হ হয়ে পড়ায় পুরো দলটা ফিরে আসে। শোনা যায় প্রায় ২০০০ বছর আগের কোনো ঘটনার কথা শুনে জায়গা টা মোটামুটি locate  করার চেষ্টা করেছিলেন সাহেব। “
থামল ঋ।  আমি জিজ্ঞেস করলাম “২০০০ বছর আগের কোন ঘটনা?  আর ঐ বৃটিশ সাহেবের ই বা কি হ’ল?”ঋ বলল  “এতকিছু তো পাইনি। এইটুকুই জেনেছিলাম।”
পুলিশ অফিসার আর উদ্ধারকারী দল এসে পড়ল। আমরা মোটামুটিভাবে location টা বোঝাতে পারলাম। উদ্ধারকারী দল জঙ্গলের ভিতরে চলে গেল। আমরা জিপ্-এ উঠলাম। আরেকজন অফিসার বিরজু-র গাড়ি-টা নিয়ে কাছাকাছি কোথাও থেকে পেট্রল ভরে থানায় আসবে। 
যাওয়ার পথে অফিসার-কে প্রায়  সবটাই খুলে বললাম আর ঐ বৃটিশ সাহেবের কথা যেটুকু জেনেছি সেটাও বললাম। সবটা শুনে উনি যা বললেন তার সারাংশ দাঁড়াল, সেই বৃটিশ সাহেব কোনো প্রাচীন পুঁথি থেকে কিছু একটা জেনে এখানে আসেন। বছর ২৫-এর বৃটিশ সাহেব এখানকার লোকাল কিছু লোক কে নিয়ে জঙ্গলে যান। কিন্তু সেখানে কোনোভাবে তাদের দলের মধ্য তিরিশের  এক যুবক নিখোঁজ হয়ে যায়। সাহেবের হাতের কোনো একটা  গভীর ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ ও সেটা থেকে ঘা হতে শুরু করলে সাহেব অসুস্হ হয়ে পড়েন, ফলে তারা ফিরে আসেন।  সাহেব এর কিছুদিন পর থেকেই পাগলের মত আচরণ শুরু করেন। হঠাৎ হঠাৎ রক্ত, পূজার বেদী, এইসব বলে চেঁচিয়ে উঠতেন আর বিরবির করে কিছু বলতেন। এর পর হঠাৎ একদিন তিনি নিখোঁজ হয়ে যান।  আর তাকে দেখা যায়নি। 
আমরা নীল- এর হাতে first aid করিয়ে রাত টা থানা -তেই কাটালাম। পরদিন দুপুরে খবর এল আমাদের বলা জায়গা মত তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো ঢিবি, গুহা বা তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।   অফিসার আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে গেলেন কিছু query, id proof -এর copy নিজের কাছে রেখে। আজ রাতের ট্রেনে- ই  ফিরব আমরা। 
ট্রেনে উঠে সব luggage রেখে seat -এ বসলাম।  অল্প আলোতে গুহায় দেখা নারীমূর্তি আসলে আমাদের ভ্রম ছিল, বা আলোছায়ার খেলা ছিল, এমনটাই আমরা ধরে নিয়েছিলাম তাই অফিসার-কে এই বিষয়টা জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি। 

ট্রেন ছাড়তে তখনও ১০ মিনিট বাকি। গতকালের ক্লান্তি-তে একটু চোখ বুজল নীল। 
চোখের সামনে ভেসে উঠল গত রাতের ছবিটা। একটা বিকটদর্শন মূর্তি, আছাড় খেয়ে পড়ার সময় ঠিক যার বেদী-র উপর পড়ে  হাতটা থেঁতলে গিয়ে রক্ত পড়েছে ওর, 
আর…… ভেসে উঠল আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগের একটা ছবি। এক ২৫ বছরের যুবকের হাত কেটে রক্ত নিয়ে সেই রক্তে ভেজানো ফুল দিয়ে এক মহিলা পূজা করছে একটা মূর্তির।  এক বছর ৩৫- এর যুবক সেই মহিলা-কে মেরে হাতের বাঁধন খুলে দিচ্ছে ঐ যুবকের। তারপর প্রায় ২ দিন ধরে একটা গুহা থেকে বেরোনোর প্রাণপন চেষ্টার পর সেই বছর ৩৫-এর যুবক তূর্যবর্মণ কোনোরকমে বাইরে বের করতে সক্ষম হয় সেই যুবক কে।  যুবক বেরিয়ে আসলেও তূর্যবর্মণ বেরোতে পারেননি। সেই গুহাতেই আটকে যান।  বছর ২৫-এর সেই যুবক, হাতে গভীর ক্ষত নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে আসলেও সেই জঙ্গল, সেই দেবতার মূর্তি তাকে জঙ্গল ছেড়ে বেরোতে দেয়নি, কারণ তার রক্তে সেই ভগবান পূজা পেয়েছিল, তার হাতেই তিনি পূজা পেতে চান, বারবার।  না, সেই যুবকের আর ফেরা হয়নি। ঐ জঙ্গলের- ই রূপ, রস গন্ধে সে ঐ নাম না জানা ভগবানের মূর্তির প্রতি নিজেকে সমর্পণ করেছে। সে পারেনি জঙ্গলের আর ঐ দেবতার হাতছানি উপেক্ষা করতে। জীবনের বাকি সময়টা সে……. 
ট্রেনের হুইসেলের আওয়াজে চোখ খুলল নীল।  হাতের ব্যান্ডেজ করা কাটা জায়গাটার উপর একবার হাত বুলিয়ে নিল।  ওকে যে ফিরে যেতে হবে! ফিরতেই হবে ওকে। খুব সাবধানে  luggage টা নামিয়ে নিল। বাকি বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। সবাই ক্লান্তিতে ঘুমোচ্ছে।  মনেমনে বলল, “থ্যাংস ঋ”। ট্রেন-টা সবে গড়াতে শুরু করেছে। লাফিয়ে স্টেশনে নেমে পড়ল নীল।  নীল-কে তার সঠিক গন্তব্যে পৌছে দিয়ে পিছনে ফেলে রেখে ফিরে চলল ধাতব জন্তু টা। 
-সমাপ্ত-

কলমে হিমবন্ত দত্ত, বারুইপুর

বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কর্মরত। লেখালেখির শখ ছোটবেলা থেকেই আছে, তাই একটু আধটু চেষ্টা করে থাকি নিজের কল্পনাশক্তি গুলো প্রকাশ করার জন্য।

SOURCEকলমে হিমবন্ত দত্ত
Previous articleতিন কাপ চা
Next articleদুই বসন্ত
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here