Photo Indiatales

ভক্তি,বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা-এই তিনের মেলবন্ধন আমরা যে কোন প্রার্থনা স্থলে দেখতে পাই। প্রার্থনা স্থলের সাথে আমাদের অনেক আবেগ, বিশ্বাস ও সংস্কার জড়িয়ে থাকে। প্রাচীন ভারতবর্ষে এরকম অনেক প্রার্থনাস্থল আছে যা সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে এখন‌ও বর্তমান। মন্দির স্থাপত্য প্রাচীন ভারতের এক গৌরবময় অধ্যায়। ভক্তি বা শ্রদ্ধা ছাড়াও এর শিল্পমূল্য অপরিসীম।
এরকম‌ই এক দুর্লভ স্থাপত্যের কথা এখানে আলোচনা করব।এই মন্দিরটি দ্রাবিড় রীতির স্থাপত্য অনুসারে গঠিত।তাই এই রীতির কিছু বৈশিষ্ট্য জানা খুব‌ই দরকার।ভারতের দাক্ষিণাত্যের মন্দিরগুলি দ্রাবিড় রীতির অনুসারে গঠিত।এই রীতির মূল বৈশিষ্ট্য গুলি হল-

ক) সাধারণত মন্দিরগুলি একটি প্রাকার দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে।
খ) মন্দিরের প্রবেশ দ্বারকে গোপুরম বলা হয় এবং এটি খুব‌ই গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
গ) মূল মন্দিরের উর্দ্ধাংশটিকে বিমান বলা হয়।এই বিমান ধাপে ধাপে ওপর দিকে উঠে যায়।সাধারণত দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের বিমানগুলি সু উচ্চ হয়।
ঘ) বিমানের চূড়ায় যে অষ্টকোন আকৃতির বস্তুটি থাকে, সেটি শিখর নামে পরিচিত।
ঙ )গর্ভগৃহের সামনে দ্বারপালের ভাস্কর্য্য দেখা যায়।প্রচলিত মত অনুযায়ী দ্বারপালেরা মন্দির রক্ষা করেন।
চ) মন্দিরের সীমানার মধ্যেই জলাশয়ের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

সারা দাক্ষ্যিণাত্য জুড়ে বিভিন্ন শক্তিশালী রাজবংশ রাজত্ব করেছে ও অসংখ্য মন্দিরের স্থাপনা করেছে।সেই সকল মন্দির নিজেদের স্থাপত্যরীতির প্রভাবে শুধু ভক্ত নয়, পর্যটক ও ঐতিহাসিকদের মনে স্থান করে নিয়েছে। সেই রকম একটি মন্দির হল বৈকুন্ঠ পেরুমল মন্দির, যেটি কাঞ্চীপুরমে অবস্থিত।কাঞ্চীপুরম শহরটি বর্তমানে তামিলনাড়ু রাজ্যে অবস্থিত। এই মন্দিরের সঙ্গে যে কাহিনীটি জড়িত আছে তা হল- ঋষি ভরদ্বাজ এবং এক অপ্সরার বিবাহসূত্রে একটি পুত্রসন্তান জন্মায়।কিন্তু তার পিতা মাতা দুজনেই তাকে পরিত্যাগ করায় শ্রীবিষ্ণু এবং শিব তাকে পালন করেন। সেই সময় এক পল্লভ নৃপতি সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে শ্রী বিষ্ণুর উপাসনা করলে ,ভগবান তাঁকে এই সন্তান উপহার দেন।এই সন্তানের নামকরণ হয় পরেমেশ্বর ও পরবর্তী কালে ইনিও সিংহাসনে বসেন।এই মন্দিরের আরেক নাম পরমেশ্বর ভিন্নিগরম।

এবার আসি বাস্তবধর্মী ইতিহাসে।মনে করা হয় এই মন্দির পল্লভ রাজবংশের নৃপতি দ্বিতীয় নরসিংহবর্মন দ্বারা স্থাপিত। তাই এইবার পল্লভ রাজবংশ সম্বন্ধে একটু আলোচনা দরকার।মূলত সাতবাহন বংশের পরবর্তী সময়ে দাক্ষ্যিণাত্যে এই পল্লভ বংশের উত্থান হয়। ষষ্ঠ শতক থেকে নবম শতক-এটাই এই রাজবংশের সময়কাল।স্থাপত্য ও ভাস্কর্য্যে পল্লভ নৃপতিদের অবদান অনস্বীকার্য।মহাবলীপুরমের শোর টেম্পল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কাঞ্চীপুরম পল্লভদের রাজধানী ছিল।তাই স্বাভাভিক ভাবেই এই স্থানটিকে তাঁরা মন্দির,প্রাসাদ ও অন্যান্য ভাস্কর্য্য দিয়ে সাজিয়েছিলেন।এই রাজধানী শহরের অন্যতম গর্ব বৈকুন্ঠ পেরুমল মন্দির।

বিখ্যাত তামিল কবি এবং সাধক যাঁরা মূলত বিষ্ণু উপাসক ছিলেন, তাঁরা আলভার নামে পরিচিত।সেইরকম এক প্রখ্যাত সাধক থিরুমনগাই এর রচনায় এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে তিনি এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার ভূয়সী প্রশংসা করেন।তাই বোঝাই যাচ্ছে দাক্ষ্যিণাত্যের সংস্কৃতিতে এই স্থাপত্যের যথেষ্ঠ গুরুত্ব আছে।এবার এই মন্দিরের গঠনশৈলী নিয়ে আলোচনা করা যাক।এই মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। দ্রাবিড়ীয় রীতি অনুযায়ী মন্দিরের দক্ষিণ পশ্চিম কোনে একটি জলাশয় আছে।মন্দিরে ঢোকার মুখে যে প্রবেশদ্বার বা গোপুরমটি আছে, তার উচ্চতা খুব‌ই কম, কারণ শুধুমাত্র নিম্নাংশটি রয়েছে।গোপুরমের যে প্রচলিত সু উচ্চ উর্ধাংশটি দেখে আমরা অভ্যস্ত,তা এখানে নেই। গবেষকরা মনে করেন মহারাজ নন্দীবর্মনের সময়কালে নির্মিত গোপুরমটি কালের প্রকোপে নষ্ট হয়ে যায়,তাই পরবর্তীকালে এই গোপুরমটি গঠিত হয়। তামিলনাড়ুতে এই রকম গোপুরমকে মোট্ট গোপুরম বলা হয়।এরপর মন্দিরের মহামন্ডপ অংশের পার্শবর্তী এলাকায় দেবী বৈকুন্ঠবল্লীর মূর্তী লক্ষ্য করা যায়।কিন্তু এই মূর্তী পরবর্তী কালে গঠিত হয়।পল্লব রাজবংশের সময়কালে এটি ছিল না।আসলে মূল মন্দির বেলেপাথরে নির্মিত হলেও এই নতুন সংযোজন গুলি গ্রানাইট পাথরের কারণ সেগুলি চোল সাম্রাজ্যের সময়ে তৈরি।মন্দিরের মহামন্ডপ অর্থাৎ মূল অংশ যা ‘হল’ বলে ইংরেজীতে অভিহিত, সেখানে দেবতার উদ্দেশ্যে নৃত্য ও গীত পরিবেশীত হত। এই মন্ডপটির পূর্ব ও পশ্চিম দিক খোলা।এই মহামন্ডপ পেরিয়ে গিয়ে প্রবেশ করতে হয় অর্ধমন্ডপে মানে সেই অংশে যা অন্তরাল ও মহামন্ডপের সংযোগ স্থাপন করে। এই অর্ধমন্ডপে আটটি স্তম্ভ আছে যা যালি মূর্তী দ্বারা অলঙ্কৃত। এবার বলি এই যালি মূর্তী কি। এটি এমন এক পৌরাণিক প্রাণী যার কিছু অংশ সিংহের, কিছু ঘোড়ার আবার কিছু অংশ হাতির।দাক্ষ্যিণাত্যের মন্দির স্থাপত্যে এই মূর্তি বহুল প্রচলিত।এইবার আসি গর্ভগৃহের বর্ণনায়।
এই মন্দিরের সবচেয়ে উল্লেখ যোগ্য বিষয় হল এখানে শ্রী বিষ্ণুর তিনটি রূপ দেখা যায়।প্রথম তলে বিষ্ণু বসে আছেন যা তামিল ভাষায় ইরুন্দন ভঙ্গী বলে পরিচিত, দ্বিতীয় তলে বিষ্ণু শয়নমুদ্রায় রয়েছেন যা তামিল ভাষায় কিদান্দান বলে অভিহিত আর তৃতীয় তলায় বিষ্ণু দন্ডায়মান যাকে নিনরান বলা হয়।এই মন্দিরের বিমান বা উর্ধাংশটি চারটি ধাপে বিভক্ত।এই বিমানটির আটি অংশ বা অঙ্গ আছে বলে একে অষ্টাঙ্গ বিমান‌ও বলা হয়।স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী এই ধরনের বিমান কম দেখতে পাওয়া যায়।এর আটি অঙ্গ হল-অধিষ্ঠান, তিনটি পাদ,প্রস্থান,গ্রীব, শিখর,ও স্তুপি । মন্দিরের প্রথম তলে দুটি প্রদক্ষিণপথ বা প্রাকার আছে যেখানে প্রবেশ করতে গেলে একটি অষ্টস্তম্ভ যুক্ত অন্তরালের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।এখানে বলে রাখি অন্তরাল শব্দটি গর্ভগৃহ ও মন্ডপের মধ্যবর্তী অংশকে বলা হয়।
এই প্রদক্ষিণপথ থেকেই সিঁড়ি উঠে গেছে দ্বিতীয় তলার উদ্দেশ্যে।মন্দিরের একটি পুরনো নকশায় বিমানের গ্রীবা অংশে আরেকটি প্রকোষ্ঠ দেখা যায় যা বর্তমানে বন্ধ অবস্থায় আছে।সম্ভবত এই প্রকোষ্ঠে বিষ্ণুর ত্রিবিক্রম মূর্তি প্রতিষ্ঠার ভাবনা ছিল যা কোন কারণে হয়ে ওঠে নিই।এই গ্রীবার অংশে আগে চারটি সিংহমূর্তি ছিল যা সাধারণ ভাবে সব পল্লভ স্থাপত্যেই দেখা যায়।কিন্তু পরবর্তীকালে সিংহমূর্তি নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তার জায়গায় গড়ুর মুর্তি স্থাপন করা হয়।আমাদের মনে রাখা উচিত শ্রী বিষ্ণুর বাহন গড়ুর।
 তৃতীয় তলা থেকে ওঠা নামার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি সিঁড়ি আছে।এছাড়াও তিনটি গর্ভগৃহকে ঘিরেই প্রদক্ষিণপথ আছে যাতে পুণ্যার্থীরা রীতি অনুযায়ী ভক্তি নিবেদন করতে পারেন।এই মন্দিরের আরেকটি বিশেষত্ব হল এর অসাধারণ ভাস্কর্য্য যা ছড়িয়ে আছে সারা মন্দির জুড়েই। প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকেই যদি প্রদক্ষিণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে পল্লভ রাজাদের বিভিন্ন কীর্তি পাথরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ করা হয়েছে।প্রদক্ষিণ পথটিকে ঘিরে একসারি স্তম্ভ আছে যার নিম্নাংশে সিংহমূর্তী আছে।এটি পল্লভদের বহু প্রচলিত একটি স্থাপত্যরীতি। উল্টো দিকের দেওয়ালে আমরা দু সারি প্যানেলের মধ্যে ভাস্কর্যগুলি দেখতে পাই।ওপর ও নীচের প্যানেলের মধ্যে অল্প জায়গা ছাড়া আছে ভাস্কর্যগুলির বিবরণ দেওয়ার জন্য কিন্তু এই কাজ সম্পূর্ণ করা হয়নি।যেহেতু ভাস্কর্য্যগুলি বেলে পাথরে নির্মিত তাই বর্তমানে সেগুলি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত।কিন্তু পল্লভ নৃপতিদের তাম্রপট্ট অনুশাসনগুলিতে এই ভাস্কর্য্য গুলির বর্ণনা দেওয়া আছে ।তাই সেখান থেকে পুরাতত্ত্ববিদরা মূর্তিগুলি বিশ্লেষণ করতে পারেন। মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরের দেওয়ালে বিভিন্ন প্রকষ্ঠে শ্রীবিষ্ণুর নানা রূপের মুর্তি উৎকীর্ণ করা আছে।এছাড়াও মন্দিরের বিভিন্ন দেওয়ালে ভাগবত পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী ভাস্কর্য্য দেখা যায়।সমগ্র মন্দির প্রাঙ্গণটি একটি ইঁটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা যেটি অনেক পরবর্তী সময়ের
পরিশেষে এইটুকু বলা যায় যে বৈকুন্ঠপেরুমল মন্দির কাঞ্চীর আর এক মন্দির কৈলাসনাথের মত আলোকবৃত্তে না এলেও, এই মন্দির নিজ গুণে অনন্য।শুধু ধার্মিক কারণেই যে এর মাহাত্ম্য তা নয়, এর ঐতিহাসিক ও শিল্পমূল্য‌ও অসাধারণ। আজ থেকে তেরো বছর আগে প্রাচীন ভারতীয় মন্দিরের স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে এই মন্দিরের প্রতি যে মুগ্ধতা তৈরী হয়েছিল তা আজ‌ও অমলিন হয়ে আছে। নীচে মন্দিরের ছবি, ভাষ্কর্য্যের ও নকশার নমুনা দিলাম।

কলমে সঙ্গীতা চ্যাটার্জী, দুর্গাপুর

Previous articleফিরে পাওয়া
Next articleভাবুক মন
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here