ভারত উপমহাদেশের সুদূর পশ্চিমে মহারাষ্ট্র রাজ্যের নাসিক জেলার একটি ছোট্ট পাহাড় ঘেরা জায়গা ত্রিম্বক, বা ত্রম্ব্যকেশ্বর। ত্রম্ব্যকেশ্বর-এর জ্যোতির্লিঙ্গ অর্থাৎ দেবাদিদেব মহাদেব ভগবান শিবের মন্দির উল্লেখযোগ্য মন্দির, বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম প্রসিদ্ধ একটি। এই জ্যোতির্লিঙ্গের কিন্তু তিনটি মুখ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রদেব। নাসিককে প্রাচীন কাল থেকেই পবিত্র স্থান বলে মনে করা হয়। আর ত্রম্ব্যকেশ্বর মন্দির ভক্তকূলের আরাধ্য স্থল। ত্রম্ব্যকেশ্বরের মাটি বিশুদ্ধ রূপে জ্ঞান করা হয়; এখানে শ্রাদ্ধাদি, পিণ্ড দান, বাস্তু পূজা, কালসর্প দোষ লঙ্ঘন পূজা, পিত্রু দোষ ইত্যাদি ভীষণ নিষ্ঠার সাথে পণ্ডিত বা পুরোহিতরা সম্পন্ন করে থাকেন। ত্রম্ব্যকেশ্বরের মূল মহাদেবের মন্দিরে ভিড় তত নেই, আপনি পূজার সামগ্রী সব বাইরে পেয়ে যাবেন, নিষ্ঠা ও ভক্তি ভরে প্রার্থনা করবেন মন থেকে; আমি মনে করি মন থেকে ভগবানকে ডাকলে তিনি ভক্তের আকূল আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারবেন না। আর যে স্রোতস্বিনী নাসিককে জীবন প্রবাহ দান করেছে সেটি হলো গোদাবরী নদী। গোদাবরী নদী ব্রহ্মগিরি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুশাবর্ত কুণ্ডের মধ্য দিয়ে অন্তঃসলিলা রূপে বয়ে গেছে। আমরা যে সময়ে গিয়েছিলাম, তখন গোদাবরী নদীতে স্রোত তেমন ছিল না। গোদাবরীকে দেখে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হলো, “নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো?” সেও তার উত্তর যেন প্রস্তুত রেখেছিলো, “মহাদেবের জটা হইতে।” প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই কুশাবর্ত কুণ্ডকে ঘিরে কুম্ভ মেলাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাই ধর্ম স্থানের পাশাপাশি দর্শনীয় স্থান তো বটেই। 

হাওড়া থেকে গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস ধরে পাড়ি দিলাম এক নতুন যাত্রা পথের উদ্দেশ্যে, যদিও আমি তেমন ভ্রমণপ্রেমী নই, তবু মাঝে-মধ্যে কাছে কিংবা পুজো, বা গরমের ছুটিতে যখন দীর্ঘকালীন একটানা বেশ অনেকদিনের ছুটি পাওয়া যায়, তখন তল্পিতল্পা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে বৈকি! যাওয়ার সময়ে আমাদের ট্রেন টাইম দুপুরের দিকে ছিলো, খাওয়া-দাওয়া সেরে ট্রেনে উঠে চারপাশের ছুটে চলা দৃশ্য অবলোকন করতে করতে চললাম। এভাবেই যাওয়া ও আসার পথের ভালো-মন্দ সব ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ঝুলি ভর্তি করি; যখন প্রয়োজন পড়ে সেই ঝুলি থেকে স্মৃতির মণি-মুক্তো বের করে মেলে ধরি সকলের সামনে। আমার লেখার রসদও সংগ্রহ হয়ে যায় এর থেকে। তাই দু’চোখ ভরে যতটা পারি স্মৃতির কোঠায় জমিয়ে রাখি, আর কিছুটা রাখি ক্যামেরার লেন্সে বন্দি ক’রে।

ভ্রমণে আমার সঙ্গী ছিলেন আমার বাবা, পরিবারের বাকি সদস্যাদের যাওয়া হয়ে ওঠেনি সময়াভাবে ও কিছু কারণে, তাই বাপ-বেটি মিলে দু’জনেই অজানা পথে চলতে শুরু করলাম। ও হ্যাঁ, সদস্যা বললাম কারণ বাড়িতে বাবা বাদে বাকি সবাই স্ত্রী লিঙ্গের, মানে আমি, মা ও আমার বোন । এদের সাথে অন্য কোনো জায়গার ভ্রমণের গল্প আরেকদিন নাহয় বলবো। আজকাল যেরকম সোলো ট্রিপ উঠেছে সেরকমই বাবা ও আমি মিলে ডুয়াল ট্রিপ সেরে ফেলেছি তিন বছর আগের দুর্গা পুজোর ছুটিতে। আমাদের অভিজ্ঞতা ভীষণই সুখকর হয়েছে ত্রম্ব্যকেশ্বরে তথা নাসিকে। মারাঠিরা কিন্তু যথেষ্ট ভদ্র এবং ওদের ব্যবহারও খুব ভালো। ওখানকার বাসিন্দারা সবাইই মারাঠিতেই কথা বলে, তবে আপনি মারাঠি না জানলে কোনো অসুবিধা নেই, মারাঠিরা হিন্দিতেও স্বচ্ছন্দ, আপনার সাথে হিন্দিতেই কথা বলবে।

নাসিকে থাকার জন্য আপনি অনেক হোটেল, বা লজ পেয়ে যাবেন ন্যায্য মূল্যে। আমরা সেরকমই একটি জায়গায় ছিলাম, তবে এটি ঠিক হোটেল নয়; একটি ট্রাস্ট পরিচালিত আশ্রম, গজানন আশ্রম। এখানে সুলভে সকালের জল-খাবার থেকে শুরু করে দুপুরের লাঞ্চ, বিকেলের টিফিন এবং ডিনার সারতে পারবেন। খাবার কিন্তু সব নিরামিষ, কারণ ত্রম্ব্যকেশ্বর ভারতবর্ষের পুণ্য দেবভূমি, তাই এখানে কোনো প্রকার আমিষ খাবার কেউ খায় না। তবে একটা ব্যাপার না বললেই নয়, ত্রম্ব্যকেশ্বর মন্দির থেকে বেরিয়ে অনতিদূরে এবলেবালের চায়ের দোকান, ওই স্পেশাল চায়ের স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে, বিশেষ মেশিনের সাহায্যে ওরা চা প্রস্তুত করে, ত্রম্ব্যকেশ্বর গেলে ওদের চা খেতে কিন্তু ভুলবেন না। হাতে সময় নিয়ে গেলে নাসিক থেকে যেতে পারেন প্রায় একশো কিলোমিটার দূরত্বে শিরডিতে সাই বাবার আশ্রমে। নাসিকের প্রধান শহর থেকে একটু দূরবর্তী এলাকায় কার্পাস ও আঙুরের চাষ হয়। কিন্তু স্থানীয়দের থেকে জানতে পারলাম, আঙুরের দাম এখানে বেশ চড়া। ত্রম্ব্যকেশ্বরে সেরকম বড় বাজার নেই, কেনাকাটা করতে চাইলে আপনাকে মহারাষ্ট্র পরিবহণ নিগমের বাসে করে, বা, অটোতে যেতে হবে নাসিকের মেন মার্কেটে। এখানেই আমি মায়ের জন্য নাসিকের নেবলে নামক জায়গা থেকে তৈরি মারাঠি নেবলে শাড়ি নিয়ে এসেছি। দামটা যদিও একটু বেশি ছিল, তবুও কোথাও ঘুরতে গেলে সেই স্থানের বিখ্যাত কিছু জিনিস বাড়ি নিয়ে আসি স্মৃতি হিসেবে, চেষ্টা করি সবার জন্যই কিছু না কিছু আনতে, যারা যেতে পারে না তাদের মনও খুশিতে ভরে ওঠে; আর এতে ক’রে আমার বাড়ি ধীরে ধীরে সংগ্রহশালায় পরিণত হচ্ছে। 

পাহাড়ের কোল ঘেঁষা একটা সুন্দর ছোটো শহর ত্রম্ব্যকেশ্বর, যদিও স্থানীয়রা এটাকে গ্রাম বলে থাকেন; চারিদিকে পাহাড়। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত সৌন্দর্যটুকু ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছে। ত্রম্ব্যকেশ্বর মন্দির যেখানে অবস্থিত এবং গোদাবরী নদীর উৎসস্থল হচ্ছে ব্রহ্মগিরি পাহাড়। ব্রহ্মগিরির চারিধারে অনেক ছোটো ছোটো পাহাড় রয়েছে, তার সবগুলোর নাম আমার জানা হয়ে ওঠেনি। দূর থেকে তার অপরূপ দৃশ্য দেখে মোহিত না হয়ে কেউ পারবে না। পাহাড়ের গায়ে অনেক ছোটো ছোটো বাড়ি, স্থানীয় মন্দির এমনকী ছোটোখাটো হোটেল পর্যন্ত আছে। সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যায়, রাতের ব্রহ্মগিরি পাহাড় এক অন্য মোহময় পরিবেশের উপহার দেয়। সবুজে ঘেরা এই দৃষ্টি নন্দন পাহাড় আমাদের ক্লান্ত জীবনে যেন এক ফালি খোলা বারান্দায় রোদ্দুরের উঁকি-ঝুঁকি, বেঁচে থাকার অক্সিজেন। ফেরার দিন ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, ঠিক করেছি এরপর আবার সবাইকে নিয়ে ত্রম্ব্যকেশ্বর যাবো। আসার সময়ও গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস ধরেই ফিরেছি। হরিত্ শ্যামলিমায় মোড়া ব্রহ্মগিরি হাতছানি দিয়ে এখনও যেন আমাকে ডেকে চলেছে। নাগরিক জীবন থেকে কয়েকটা দিন ধার করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসলে বুঝতে পারবেন, প্রকৃতি আপনাকে দ্বিগুণ পরিমাণে সমস্ত পরিশোধ করে দেবে। তাই ব্যস্ততা কাটিয়ে ঘুরতে যেতে চাইলে চলে যেতেই পারেন নাসিক। আশা করি নিরাশ হবেন না, আর আপনার অভিজ্ঞতাও ভাগ করে নেবেন সবার সাথে।

কলমে সুপ্রিয়া মণ্ডল , মুর্শিদাবাদ

লিখতে খুব ভালবাসি; এছাড়াও কবিতা আবৃত্তি, গল্প পাঠ ইত্যাদিও অন্তরের অনুভূতি দিয়ে করি। লেখালেখির যাত্রাপথ সবে শুরু, আপনাদের সকলের আশীর্বাদ ও সমর্থন নিয়ে অনেক দূর চলতে চাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here