গত ১২ বছর মহারাষ্ট্রের মুম্বাই শহরের বাসিন্দা আমরা। মুম্বাই এর প্রায় অধিকাংশ দর্শনীয় স্থান আমরা একাধিক বার কোনো না কোনো ছুটিতে বা অনুষ্ঠানে পরিদর্শন করেছি । অনেক দিন ধরে সেই দর্শনীয় স্থানের তালিকায় একটি প্রধান স্থান ছিল এলিফ্যান্টা নামক গুহা , যা “এলিফ্যান্টা কেভ” নামে সুপরিচিত। যাবো যাবো করে অনেক গুলো বছর এভাবে কেটে যাওয়াতে, এবার সুদূর বেঙ্গালুরু থেকে কাকার ছেলে মুম্বাই ঘুরতে আসায়, একদম পাক্কা করে ফেললাম এলিফ্যান্টা যেতেই হবে।

কাকার ছেলে শুভ , এসেছিলো ২০১৯ এর বড়দিন মানে ক্রিস্টমাস এর সময়। প্রথম কদিন ওকে মুম্বাই এর অন্যান্য নাম করা দর্শনীয় স্থান দেখানোর পর , ঠিক হল তারিখ ২৬শে ডিসেম্বর , বৃহস্পতিবার। সকাল সকাল উঠে , কিছু খাবার বানিয়ে নিলাম ,সাথে নিলাম চা ও। সবাই মিলে প্রথমে ট্রেন এ করে ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাল স্টেশন এ নামলাম , সেখান থেকে ব্যক্তিগত ট্যাক্সি ভাড়া করে পৌঁছে গেলাম “গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া” র কাছে। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে ভাই কে দেখলাম ” এশিয়াটিক সোসাইটি, মুম্বাই “.”গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া”, জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারি ইত্যাদি ; বন্ধু বান্ধব- আত্মীয়রা মুম্বাই ঘুরতে আসলে এগুলি তাদের প্রধান দর্শনীয় আকর্ষণ। এখানে কিছু ছবি তুলে , আসল গন্তব্যের উদ্যেশে রওনা দিলাম। আসল গন্তব্য “এলিফ্যান্টা কেভ” যেতে গেলে ‘গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া’র মুম্বাই পোতাশ্রয় ধরে আরব সাগরের মধ্য দিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে স্টিমারে রওনা দিতে হয়। বলতে গেলে “এলিফ্যান্টা কেভ” একটি ছোট দ্বীপের মতো, যেখানে এই জলপথ একমাত্র যোগাযোগ স্থাপনের ভরসা।

আরব সাগরের সেই তীরে

‘গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া’র কাছে আরব সাগরের সেই তীরে থাকে অজস্র স্টীমার বা ফেরি, যার বেশিরভাগ মহারাষ্ট্র সরকারের পর্যটনকেন্দ্রের অন্তর্গত (MTDC -Maharastra Tourism Development Corp ) .এই ফেরির জায়গাটাকে এলিফ্যান্টা ফেরি পয়েন্ট ও বলা হয়ে থাকে। এলিফ্যান্টা কেভ পরিদর্শনের সময়কাল সকাল ৯:৩০ থেকে বিকেল ৫:৩০ অবধি, তাই দিনের প্রথম ফেরি সকাল ৯টাই ছাড়ে, যা এলিফ্যান্টা যেতে সময় নেয় কম করে ১ ঘন্টা। এর পর প্রতি ৩০ মিনিটে একটি করে ফেরি ছাড়ে, এবং শেষ ফেরি ছাড়ার সময় দুপুর ২ টো।সোমবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন এই এলিফ্যান্টা কেভ পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে, সময় সকল ৯:৩০ থেকে বিকেল ৫:৩০।

সঙ্গী হয়েছিল শঙ্খচিলের দল

ফেরি ছাড়ার সাথে সাথে আমাদের সঙ্গী হয়েছিল শঙ্খচিলের দল, তারা এতটাই কাছে উড়ে আসছিলো , যে ফেরিতে থাকা মানুষ তাদের নিজের হাতে খাবার খাওয়াচ্ছিল। প্রায় এক ঘন্টার ওপর সময়ের পর আমরা অন্য প্রান্তের উপকূলে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা গুহার অস্তিত্ব অনুভব করি, বলা যায় একটি ছোট দ্বীপের মাঝে “এলিফ্যান্টার গুহা”। “এলিফ্যান্টা” দ্বীপে পা দিতেই সামনে চোখে পরে কু ঝিক ঝিক করা টয় ট্রেন এর শব্দ , দূরত্ব পা এ হাঁটার মতো হলেও কেউ এই টয় ট্রেন-এ চড়ার লোভকে সংবরণ করতে পারছিলো না। টয় ট্রেন থেকে নেমে পারে ১২৫টি সিঁড়ির ধাপের ওপরে ছিল “এলিফ্যান্টা’র ইতিহাসিক গুহা। সিঁড়ির দুপাশ দিয়ে স্হানীয় বাসিন্দাদের দোকান, যেখানে খাবার থেকে ঘর সাজানোর জিনিস-এলিফ্যান্টা র সংশ্লিষ্ট পণ্য পাওয়া যাচ্ছিলো। এছাড়া অসংখ্য বাদর ও হনুমানের সঙ্গ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়নি।ওপরে সিঁড়ি তে উঠতে উঠতে প্রায় লুকিয়ে আমরা আমাদের বাড়ি থেকে আনা খাবারে মধ্যাহ্নভোজ শেষ করি। কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে পৌঁছে যায় “দ্য এলিফ্যান্টা কেভ’ এ। এখানে পৌঁছনোর আগে বাড়ি বসে অনেকটা ইতিহাস পড়ে এসেছিলাম, যা আমাদের সাহায্য করেছিল জানতে ও চিনতে, গুহার এক একটি খোদাই করা ভাস্কর্য্যকে। প্রাণ দিয়েছিলো সেদিনের সেই প্রাণহীন মূর্তিগুলিকে। মাত্র ৩০ টাকা মূল্যের এন্ট্রি ফি (প্রবেশ মূল্য) তে আমরা এক ইতিহাসের সাক্ষী হয় খুব সহজে।

কি এই “দ্য এলিফ্যান্টা কেভ” আর কি তার ইতিহাস ?
এলিফ্যান্টার ইতিহাস নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে, রয়েছে অনেক বিতর্ক। কে বা কারা, কি ভাবে এই গুহাগুলি নির্মাণ করেছিলেন তার আসল তথ্য সেভাবে আজ অজানা। কবে এই গুহাগুলি নির্মিত হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে অনেক মতবাদ, অনেক তথ্য ও প্রমান। এলিফ্যান্টা আগে ঘাড়াপুড়ি নামে পরিচিত একটি দ্বীপ ছিল। পরে পর্তুগীজ এর রাজত্ব কালে পর্তুগীজ দ্বারা এর নাম এলিফ্যান্টা কেভ রাখা হয়, কারণ হিসাবে জানা যায়, এলিফ্যান্টা দ্বীপের উপকূলে একটি বিশালাকায় পাথরের তৈরী হাতির (৭.৪ ফুট উচ্চ ও ১৩ ফুট লম্বা) মূর্তি (যেটি পরে ধংস হয়ে যায়, এবং এখন সেটি মুম্বাই এর ‘জিজামাতা উদ্যানে”/Victoria Garden Zoo,Mumbai সংরক্ষিত ) থাকায় এই জায়গাটির নাম “এলিফ্যান্টা কেভ” রাখা হয়েছিল। আবার অনেক তথ্য অনুযায়ী, এই গুহাতে অনেক হাতির মূর্তি খোদাই থাকার কারনে এই গুহার নাম “এলিফ্যান্টা” রাখা হয়েছিল।

এলিফ্যান্টা গুহা

এলিফ্যান্টা গুহার এই ঘাড়াপুড়ি দ্বীপটিতে দুটি সরু উপত্যকা দ্বারা পৃথক দুটি টিলা রয়েছে। ছোট দ্বীপটি বহু প্রাচীন একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ, যা এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অতীতের একমাত্র সাক্ষ্য। এই প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরু থেকে দখলের প্রমাণ প্রকাশ করে। শিলা-কাটা এলিফ্যান্টা গুহাগুলি খ্রিস্টীয় পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয়েছিল বলা হয়ে থাকে। এর তত্ত্বগুলির মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ় বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বলছে যে এলিফ্যান্টা গুহাগুলি ৪৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে তৈরী করা হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, এই সময়কালে ভারতে বৌদ্ধধর্মের অবনতি এবং ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণেরও চিহ্ন রয়েছে।

এলিফ্যান্টা দ্বীপপুঞ্জটি খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ শতাব্দীকাল থেকে প্রায় অর্ধ ডজন শক্তির বা রাজার রাজত্বের – আধিপত্যের-অধীনে এসেছিল।এর মধ্যে রয়েছে কঙ্কনের মৌর্য, ত্রিকুটকাস, বাদামির চালুক্য, সিলাহারস, রাষ্ট্রকূট, কল্যাণী চালুক্যস, দেওগিরির যাদব, গুজরাটের শাহী রাজবংশ, পর্তুগিজ, মারাঠা এবং ব্রিটিশরাও। কিছু তথ্য অনুযায়ী এই গুহা গুলি সিলাহারস বংশের রাজা দ্বারা নির্মিত (যারা ৯ থেকে ১৩ শতাব্দী পর্যন্ত এখানে রাজত্ব করেন)।

ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ হীরানন্দ শাস্ত্রী এর ‘ A Guide to Elephanta’ অনুযায়ী এই শিবের গুহাগুলি কঙ্কনের মৌর্য এর রাজত্বে (সম্ভবত ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে) তৈরী করা হয়েছিল, ডঃ আর. এস. গুপ্ত গবেষণা অনুযায়ী এগুলি চালুক্য বংশে, ডঃ মিরাশির মতে এগুলি কালাচুরি রাজবংশ এর সমকালীন।

একটি প্রধান ও প্রাচীন বাণিজ্য প্রবেশপথ হওয়ায় সম্ভবত এটির পৃষ্ঠপোষকরা কোনও নির্দিষ্ট রাজার চেয়ে ধনী ব্যবসায়ী-বণিকরা ছিলেন বলেও মনে করা হয়ে থাকে।

এখানে রয়েছে মোট ৭টি গুহা যার মধ্যে ৫টি হিন্দু ও দুটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। বৌদ্ধ গুহাগুলি ‘স্তুপ হিল’ নামে পরিচিত। প্রধান গুহা বা ‘মহেশ মূর্তি’ গুহা এই এলিফ্যান্টা কেভ এর আসল আকর্ষণ। গুহাগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হ’ল এই প্রথম গুহা, যা ‘গ্রেট কেভ ১’ নামেও পরিচিত, যা সামনে প্রবেশ পথ থেকে পিছনের দিকে ৩৯ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। বলা হয়, পশ্চিমের পাহাড়ের এই গুহাটির সাথে ইলোরার কিছু গুহার খুব মিল রয়েছে। তিনটি খোলা বারান্দা এবং পিছনের করিডোর বাদ দিয়ে গুহার মূল অংশটি ২৭ মিটার বর্গক্ষেত্র এবং প্রতিটি ছয়টি কলামের সারি দ্বারা নির্মিত।

এখানে ৭ মিটার উঁচু “সদাশিব” (২৩-২৪ ফুট লম্বা , ১৭ ফুট উঁচু) এর মূর্তি প্রথম গুহার প্রবেশপথকে এক অনবদ্য মাত্রা দান করে। ভাস্কর্যটি শিবের তিনটি দিককে উপস্থাপন করে: যথাক্রমে স্রষ্টা, সংরক্ষণকারী এবং ধ্বংসকারী [ আঘোরা বা ভৈরব (বাম অর্ধেক), তপ্তপুরুশ বা মহাদেব (কেন্দ্রীয় পুরো মুখ), এবং ভামদেব বা উমা (ডান অর্ধেক)]।

প্রথম গুহার একদম মাঝখানে রয়েছে শিব লিঙ্গ , যাকে চারদিক থেকে পাহারা দিচ্ছে চার সুঠাম প্রহরীর (দ্বারপালা) মূর্তি। এটি এই গুহার প্রধান আরাধনার জায়গা।

এছাড়া গুহার বিভিন্ন্য দেওয়ালে নটরাজ, যোগীশ্বর, অন্ধকাসুরবধ, অর্ধনারীশ্বর,উমা মাহেশ্বরা মূর্তি, কল্যাণসুন্দরমূর্তি, গঙ্গাধরমূর্তি, এবং রাবণানুগ্রাহামূর্তি – তাদের রূপ, মাত্রা, উপস্থাপনা, বিষয়বস্তু, প্রান্তিককরণ এর জন্য লক্ষণীয়।এছাড়া এখানে শিব পার্বতীর বিবাহের নানা খোদাই মূর্তি লক্ষ্য করা যায়।

যোগীশ্বর/মহাযোগী : শিবের এই মূর্তি টি শিবের সর্বপরিচিতি রুদ্র স্বভাবের একটু বিপরীত। এখানে শিব ধ্যানে বা যোগাসনে বসে আছেন।এই মূর্তির চারপাশে আরো অনেক ছোট ছোট মূর্তি খোদিত রয়েছে, যেগুলির মধ্যে বিষ্ণু -ব্রম্ভা অন্যতম। এই মূর্তিটির সাথে ইলোরা গুহার কৈলাশের মূর্তির অনেক মিল পাওয়া যায়।

নটরাজ : এটি শিবের নৃত্য পারদর্শিতাকে মাথায় রেখে বানানো। মূর্তিটি ঠিক যোগীশ্বর মূর্তির উল্টো দিকে মুখ করে বানানো। এই মূর্তির বাঁ পাশে রয়েছে পার্বতীর মূর্তি, যা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। ডান দিকে কার্তিক-গনেশ-ব্রম্ভা -বিষ্ণুর মূর্তি দেখা যায়।

রাবণানুগ্রাহামূর্তি: রাবণানুগ্রহ-মুর্তিতে সর্বশক্তিমান শিবের হাতে রাবনের অবমাননার কাহিনী এবং তাঁর বর্ননা চিত্রিত করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে কৈলাশ পর্বতে যখন শিব পার্বতীকে নিয়ে বসে ছিলেন , রাক্ষসরাজ রাবন তখন হঠাৎই কৈলাশ পর্বতকে কাঁপাতে শুরু করেন। তখন শিব শুধু তার পা আস্তে করে মাটিতে চেপে , যেমন সেই কাঁপানো কমান, তেমন পাহাড়ের নিচে রাবন কে বন্দী বানান। এই মূর্তি অনুযায়ী শিব শান্ত ভাবে কৈলাশের ওপরে বসে, আর পায়ের নিচে কৈলাশকে মাথায় নিয়ে শিবের কাছে করুণাভিক্ষা করছেন রাবন। রাবণানুগ্রহ বা রাবণানুগ্রহ-মুর্তি হিন্দু দেবতার একটি পরমার্থাত্মক দিক। ভাস্কর নিপুণ দক্ষতার সাথে এটিকে এলিফ্যান্টা গুহাতে চিত্রিত করা হয়েছিল।এলিফ্যান্টের রাবণানুগ্রহ-মুর্তি খুব খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

উমা মাহেশ্বরা মূর্তি: এই মূর্তিটি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত।এখানে শিব ও পার্বতী দুজনে কৈলাশ পর্বতে বসে আছেন, সেই চিত্র খোদিত রয়েছে।

অর্ধনারীশ্বর: এই মূর্তিতে শিবের ও পার্বতীর দুজনের মূর্তির মিশ্রণ চোখে পরে। বাঁ দিকে পার্বতী , ডান দিকে শিব. এই মূর্তি বোঝায় শিব ও শক্তি অভিন্ন। শিব ও যা , শক্তিও তাই। শিবপুরান অনুযায়ী, ব্রম্ভা যখন সৃষ্টির বিকাশের জন্য শিবের স্তব করেছিলেন , শিব তার ফলস্বরূপ অর্ধনারীশ্বর রূপ ব্রম্ভাকে দেখিয়ে বোঝান যে সৃষ্টির বিকাশের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েরই সমান প্রয়োজন। এলিফ্যান্টা গুহার এই অর্ধনারীশ্বর মূর্তি সবথেকে মার্জিত একটি সৃষ্টি বলা যেতে পারে।

গঙ্গাধর মূর্তি: এই মূর্তিটি মহেশের মূর্তির ঠিক পাশে রয়েছে। এখানে গঙ্গা নদীকে শিব নিজের চুলের মধ্যে ধারণ করেছিলেন সেই গল্প দেখানো হয়েছে। এই ছবিতে দেখা যায় শিব দাঁড়িয়ে আছেন ডান পা এলিয়ে আর তার বা পাশে ত্রিভঙ্গি তে দাঁড়িয়ে দেবী পার্বতী। এই মূর্তি টি বলা হয়ে থাকে এই এলিফ্যান্টা গুহার সেরা শিল্পকর্ম এর একটি।

কল্যাণ সুন্দর মূর্তি : এটি সর্বোত্তম একটি সৃষ্টি , যেখানে শিব ও পার্বতীর বিবাহ দেখানো হয়েছে। যেখানে বিবাহ অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়েছে ভগবান ব্রম্ভা দ্বারা, যিনি শিবের বাঁ পাশে বসে সম্ভবত বিয়ের মন্ত্র পাঠ করছেন। পার্বতীর হাত শিবের হাতে এবং পার্বতীর সর্বাঙ্গ অপ্রমিত সুন্দর গয়নায় ঢাকা। এই মূর্তিতে শিব-পার্বতীর যৌবনের রূপ দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পার্বতীর ডান দিকে রয়েছেন তাঁর মা মেনকা , যিনি পার্বতীকে সম্প্রদান করছেন।

অন্ধকাসুরবধ: এই ভাস্কর্য এ শিবের আক্রমণাত্মকরূপ দেখানো হয়েছে। এখানে শিবের ৮টি হাত দেখানো হয়েছে। তার বাঁ হাতের পাত্রে তিনি বিন্দু বিন্দু রক্ত জমা করছেন , যেন সেই রক্ত বিন্দু মাটিতে না পরে , কারণ রক্তের বিন্দু মাটিতে পড়লেই তা থেকে জন্ম নেবে এক একটি রাক্ষস।

প্রধান বা প্রথম গুহার দক্ষিণ পূর্বে রয়েছে দ্বিতীয় গুহা যার অনেকটা ধ্বংস হয়ে গেছে। যেখানে রয়েছে কিছু মূর্তি তবে তার বেশিরভাগই অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত।
তৃতীয় গুহার সামনে রয়েছে ৬টি স্তম্ভ। এর ভেতরে দুটি ছোট ঘর আছে। এই গুহাটি সম্পূর্ণ নয়।
চতুর্থ গুহা র দুদিকে দুটি ঘর , মাঝে একটি বড় প্রবেশ দ্বার। এই গুহাতে এমন কিছুই নেই যা দর্শনীয়।

হিন্দু গুহা গুলি ছাড়া যে দুটি বৌদ্ধ গুহা রয়েছে সেখানে সমস্ত মূর্তি খুব বেশি মাত্রায় পর্তুগিজ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত, কারণ তারা এই গুহার মূর্তি গুলিকে তাদের লক্ষ্য অনুশীলন করার কাজে লাগতো। মূর্তি গুলিতে গুলির চিহ্ন আজও বর্তমান।

২৪ স্তম্ভ সহ গুহাগুলির বিন্যাস, সর্বাতোভদ্রা পরিকল্পনার অভয়ারণ্য, বিস্তৃত এলাকা জুড়ে শিলা কাটা স্থাপত্যের বিস্তার দেখা যায় এখানে। এলিফ্যান্টা গুহাগুলি একটি দীর্ঘ শৈল্পিক ঐতিহ্য থেকে উত্থিত হওয়া সত্বেও আধুনিকতার সতেজ উদ্ভাবন প্রদর্শন করে আজও। নন্দনতাত্ত্বিক সৌন্দর্য এবং ভাস্কর্য শিল্পের সংমিশ্রণ, এলিফ্যান্টা গুহাগুলিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে ইতিহাসে। গুহাগুলির সামগ্রিক পরিকল্পনায় হিন্দু আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও প্রতীকতত্ত্বগুলিকে (সিম্বোলজি) সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

স্মৃতিসৌধের কাঠামোগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত ফলক এবং স্তম্ভগুলির নির্দিষ্ট মেরামত করার কাজ চলছে আজও। গুহাগুলি ছাড়াও, এলিফ্যান্টা দ্বীপ খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে এবং পর্তুগিজ সময়কালের থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক অবধি রয়েছে, যা প্রত্যক্ষভাবে দেখা যায়, পাহাড়ের পূর্ব দিকের দিকে সমাহিত স্তূপ এবং তার শীর্ষে অবস্থিত একটি ক্যানন। শিলালিপি থেকে, দর্শকদের অভিজ্ঞতা ও এই ইতিহাসিক স্থানের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে এবং সাইটটি সংরক্ষণের জন্য বেশ কয়েকটি হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পথের নির্মাণ,  ভাঙা স্তম্ভের সংরক্ষণ, পতিত ও ধসে পড়া অংশের সংরক্ষণ, কাস্টোডিয়ানদের কোয়ার্টারে মেরামত করা এবং সাইট তথ্য কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি।

এলিফ্যান্টা গুহাগুলির সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি তাদের প্রাকৃতিক বিন্যাসে সংরক্ষিত। পুরাতাত্ত্বিক উপাদান প্রকাশ এবং প্রোথিত বা সমাহিত স্তূপগুলির খুঁজে তথ্য বাড়ানোর আরও সুযোগ রয়ে গেছে আজও। বর্তমানে, পাথরের লাবনিক প্রকৃতি এবং পাথরপৃষ্ঠের সাধারণ অবনতি গুহাগুলিকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করছে।

কিছু মনে রাখার বিষয় :

এক : মূল এলিফ্যান্টা গুহায় শিব লিঙ্গকে ঘিরে পনেরোটি কারুশিল্প কেবল ভারতীয় শিল্পের অন্যতম উদাহরণই নয়, বরং শিবের বা শিবলিঙ্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ।গুহাগুলি পশ্চিম ভারতের শিলা-স্থাপত্যর ইতিহাসে চমৎকার এক কৃতিত্ব। ত্রিমূর্তি এবং অন্যান্য নান্দনিক বিন্যাস সহ অন্যান্য ভাস্কর্যগুলি অনন্য শৈল্পিক সৃষ্টির উদাহরণ।

দুই : ১৯৮৭ এ এই এলিফ্যান্টা কেভ UNSECO এ দ্বারা বিশ্ব ঐতিহ্য এর সম্মান দেওয়া হয়েছে এবং এটিকে গুহার শহর বলা হয়ে থাকে।

তিন: এখানে ভিডিও রেকর্ড নিষিদ্ধ হলেও ফটো তুলতে পারেন অনায়াসে।চার : যদিও কি ভাবে এই বিশালাকায় পাহাড় কেটে এই গুহা বানানো হয়েছে তা আজ অজানা , তবে পুরাণবিজ্ঞান অনুযায়ী ‘বায়ু মাস্টার’ নাম একটি যন্ত্র ব্যবহার করে এই গুহা বানানো হয়েছিল, যে যন্ত্র পাথরকে বাষ্পায়িত করার ক্ষমতা রাখতো এবং পাথর কে বাস্পে পরিণত করে নাকি এখানে পাথরের গায়ে এরকম অভূতপূর্ব নকশা খোদাই করা হয়েছিল ।

পাঁচ : এলিফ্যান্টা গুহার দেওয়ালে বিভিন্ন মূর্তির খোদাইয়ের সাথে সাথে অনেক কিছু লেখাও ছিল , যা পর্তুগিজ সৈন্যরা নষ্ট করে ফেলে বা সরিয়ে ফেলে। মনে করা হয় এই লেখা গুলি থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেত ওই গুহার সম্পর্কে।

সম্পূর্ণ গুহা ও গুহাগুলির চারপাশের অঞ্চল ভালো করে ঘুরে দেখতে দেখতে কখন সময় এর কাটা এগিয়ে গেছে টের পাইনি আমরা কেউই। ফেরার পথে একইভাবে স্টিমারে বসে শঙ্খচিলের সঙ্গে পাড়ি দিলাম বাড়ির উদ্যেশে। পেছনে ফেলে আসা মূর্তিগুলি ছেপে গেছিলো মস্তিষ্কে , ভাবনারা অনেকদিন ধরে ভাবিয়েছিলো এতো পরিশ্রমে- নিষ্ঠা – শিল্পপ্রেম – এতো সূক্ষ কারুকার্য্য , এ সবই মানুষের অবদান।

কলমে মৌসুমী কুন্ডু , মুম্বাই

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here