আগের পৃষ্ঠা : জাপান পর্ব ৩ ৪য় মার্চ থেকে ১১ই মার্চ
এক সপ্তাহ কেটে গেলো। উফফ কবে যে এ কটা মাস কাটবে। এই উফফ টা কেন , তা বাপু আমাকে জিগেস করে লাভ নেই। সে এক স্বপ্নের মতো , আমি এয়ার এশিয়া ধরে ইন্ডিয়া যাচ্ছি , কবে যে সে দিন আসবে। দেশে ফিরে কি কি করবো , আর কি না করবো , সব ভেবে নিয়েছি এই গত এক সপ্তাহে। বুঝতেই তো পারছেন , অঢেল সময়।শুধু ভাবার আর কিছু না করার। হা হা।
এই সপ্তাহটা আমার নিজের মতো করে গোছানো। মেয়ের সকালে স্কুল , বরের অফিস আর অনেকটা সময় আমার। যা গত পাঁচ বছরে আমার পাওয়া হয়নি। তাই বেরিয়ে গেছি হেঁটে বা সাইকেল এ, এদিক ওদিক , যেদিক মন প্রাণ চাই তা ঠিক নয় , যতদূর পথ চিনি আর কি। হারিয়ে গেলে , নতুন নতুন ফিরে আসা মুশকিল 🙂
কিয়োটো শহরটি আগে জাপানের রাজধানী ছিল , এখন রাজধানী টোকিও , সবাই জানে।Shugakuin (শাগাকুনি) কিয়োটোর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় একটি শান্ত এলাকা । যেন সুন্দর করে সাজানো। অনেকের ঘরের ভেতর ও এতো সাজানো আর পরিকল্পিত থাকে না। মাঝে সাঝে বসার জায়গা , মাঝ বয়েসি – পুরাতনিদের প্রায় দেখি বসে থাকতে। আমার জানলা দিয়ে যত দূর দেখতে পাই , তাতে বেশির ভাগ একতলা দোতলা বাড়ি , (ছাদ গুলো যেন আলাদাই সৌন্দর্য দিয়েছে ) , আর মাঝ খান দিয়ে পাহাড় (অনেক স্তরে ) .সকালে উঠে প্রায় দেখি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মেঘেদের ভিড়। এই দৃশ্য দেখার জন্য মনে আছে সিকিমের দিন গুলো। সকালে উঠে তখনও দেখতাম হিমালয়কে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রঙে। যখন মন ঘর ছুঁয়ে যাই , বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে , এই সৌন্দর্যর মাঝে নিজের মনকে অন্য পথে নিয়ে যাই। মনে মনে রবি ঠাকুর , গেয়ে উঠি
“তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপ-কথার,
পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপ্-কথার–”
বারান্দা থেকে সন্ধ্যে |
ছাদ যেন সৌন্দর্য বাড়িয়েছে |
যতদূর চোখ পরে একটা কমলা রঙের দোতলা বাড়ি যা আমাদের দেশের মতো, বলতে পারো কলকাতার কাঠামো-তে বানানো। ভালো লাগে। ভালো যে লাগতেই হবে। সুগাকুইন(শাগাকুনি) ইন্টারন্যাশনাল হাউসের পাশ ঘেঁষেই বাচ্চাদের খেলার পার্ক , আমার মেয়ের প্রিয় জায়গা। বারান্দা দিয়ে সব সময় দেখি ছোট থেকে মাঝারি বয়েসের বাচ্চাদের ভিড়।মেয়ের বায়নায় অনেক বিকেল এখন ওখানেই কাটে আর আগামীতেও কাটবে।
একদিন মেয়েকে স্কুলে দিয়ে ফেরার পথে ঢুকলাম একটি ঘর সাজানোর জিনিসের দোকানে।আমার ছবি তোলার থেকে ছবি লাগানোর খুব শখ। ঘরটা কে একরকম ফটোগ্যালেরি করে রেখেছি মুম্বাইতে। কোথাও কোনো ভালো ফটোফ্রেম দেখলে লোভ সামলাতে পারিনা।ভাস্কর প্রায় আমাকে বলে ,”এতো ফটো লাগিও না , বা কাউর জন্য ফটো ফ্রেম কিনো না , তোমার ভালো লাগলেই যে সবার ভালো লাগবে , তার কি মানে।” আসলে আমার প্রিয় মানুষটির ও এতো অত্যাধিক ছবি ছবি ভরা ঘর ভালো লাগে না বোধহয় , কিন্তু ভয়ে বা আমার ভালো লাগার জ্বালাতে কিছু মুখ ফুটে সোজাসুজি বলে উঠতে পারে না। হা হা। যাইহোক ,সেই দোকান থেকে ফটো ক্লিপ কিনলাম, ফ্রিজের গায়ে ছবি সেটবো বলে।মনে করবেন না , যে এখনো আমার ফ্রিজ সম্মুখ ফাঁকা পরে আছে , তা এখনো পুরোনো ছবিতে ভরা। টাকা দিয়ে যখন ফিরে আসছি,পেছন থেকে দোকানের মালিক মহিলা , এসে এ, আমার হাতে একটা ব্যাচ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলো , এটা গিফট। অচেনা নতুন দেশে, এরকম একটা অনুভূতি , মন কে একটু হলেও চঞ্চল করে দিলো।মন কিছু বলল , ভালো লাগলো। ব্যাচটা তে কিছু লেখা , মানে জানিনা।জানার চেষ্টাটাও করে ওঠা হয়নি।
এই সেই ব্যাচ |
রোজকার দিন কাটছে বেশ নিয়মমাফিক। এখন মেয়েকে স্কুলে আনতে গেলে , প্রায় সবারই মুখ চেনা। আগের সপ্তাহে যাদের সাথে আলাপ হলো ,এখন তাদের সাথে অল্প হলেও গল্প হয়। একদিন তো এক জাপানীস ভদ্র মহিলা দিব্যি জাপানীস এ আর আমি ইংলিশ এ মিনিট পাঁচ গল্প দিলাম। হ্যাঁ সত্যি। বেশ কিন্তু , দুজন দুজনের ভাবনা বুঝতে পেরেছিলাম। স্কুলে এখন আমার বেশ পরিচিত তিন মা বন্ধু জুটেছে ,Mike,Aiko,Naymi, এরা সবাই ইংলিশ বলতে পারে। এর মধ্যে মাইক আমাকে বেশ সাহায্য করে , স্কুলের নোটিশ বোর্ড পড়তে বা স্কুলের কোনো প্রজ্ঞাপন বুঝতে। আমাদের এখন ফোন নম্বর ও আদান প্রদান ঘটেছে 🙂
Nyami with her Son |
এই সপ্তাহে শনিবার, আগে থেকে পরিকল্পনা ছিল, আসিফ আসবে লাঞ্চ করতে। কথা মতো খেয়ে , সবাই বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। গন্তব্য Shugakuin Imperial Villa . আমাদের ইন্টারন্যাশনাল হাউস থেকে বাম হাতের রাস্তা ধরে একটু চড়াই।
Shugakuin Imperial Villa র পথে |
বসতিপূর্ণ এলাকা অলিগলি দিয়ে ১০-১২ মিনিটের পথ। পৌঁছলাম Imperial Villa এ। একি কান্ড , ভাস্কর আমার আর মেয়ের রেসিডেন্সিয়াল কার্ড আনতে ভুলে গেছিল।আর প্রবেশ করতে সেই কার্ড অনিবার্য। এছাড়াও আরো এক বাধা হলো ,১৮ বছরের উর্দ্ধে শুধু প্রবেশের অনুমতি , তাই কন্যাকে রেখে যাওয়ার কোনো মনই ছিল না। এতো দূর এসে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ইতিমধ্যে আসিফ-র গুগল ম্যাপে ধরা দিলো একটা মন্দির। ওর নির্দেশ মতো পথে এগোতে থাকলাম। এসেই যখন গেছি অন্তত মন্দিরটি নয় দেখে যাই।
Sekizan Zen-in Temple
সেকেজান জেন- Shugakuin (শাগাকুনি )র দক্ষিণ-পশ্চিম পাদদেশে অবস্থিত।সঠিক অবস্থান: 18 কাইকোংবো-কো, শাগাকুঈন, সিকিও-কি, কিয়োটো ।
দর্শকদের প্রয়োজনীয় তথ্য :
প্রবেশদ্বার খোলার সময়: 06:00 -18:00
দর্শকদের জন্য সময়: 09:00 ~ 16:30
প্রবেশ মূল্য :বিনা মূল্য
কি করে পৌঁছবেন * 7 মিনিট সাবওয়ে Karasuma লাইন এর Matsugasaki স্টেশন থেকে ট্যাক্সি* ২0 মিনিট হাঁটুন বা 5 মিনিট ইজান ইলেকট্রিক রেলওয়ে এর Shugakuin স্টেশন থেকে ট্যাক্স দ্বারা* 15 মিনিট হেঁটে বাস স্টপ থেকে শগাকুইন রিকুইমাইচি (ময়মনসিংহ বাস লাইন 5, 31, বা 65)বা বাস স্টপ থেকে 15 মিনিট হাঁটা Shugakuin Michi (মিজানিজ বাস, Kita লাইন 8)
গাড়ী পার্কিং: পাওয়া যায় না। দেখার জন্য পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করুন
যোগাযোগ: ফোন : 075-701-5181 (সিকিযান জেন-ইন) তথ্যের জন্য
তথ্যকেন্দ্র |
Sekizan Zen-in
অসাধারণ পরিবেশে সূচ ফেলার ও শব্দের অভাব। ঢুকতেই চোখে পড়লো , একটা বাসের তৈরি নলের ব্যবস্থা। লেখা আছে মন্দিরে ঢোকার আগে হাত ধোয়ার জন্য ব্যবহার করুন। এই ব্যবস্থাকে chozuya বা temizuya বলে। জাপানী মন্দির ও তীর্থস্থানে শুদ্ধকরণের জন্য এটি একটি চেজুইয়া বা টেম্পুইয়া পানি সরবরাহের প্যাভিলিয়ন। উপত্যকায় পানি দিয়ে ভরাট করা হয় এবং উপাসনাকারীদের হাত, মুখ এবং শুচি করার জন্য, কপালের ধোয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।
চেজুইয়া বা টেম্পুইয়া |
চোখে পড়ল সেই ঘন্টা আর একটা সাদা ফ্রেমের মতো জিনিস। যার পাশে দাঁড়িয়ে আমরা তো দিব্যি ছবি তুললাম , কিন্তু জানতে পারিনি ওটা আদৌ কি। আমার কাছে জায়গাটা ফিল্মি লোকেশন থেকে কম কিছু নয়।
ভেতরের মন্দিরে বুদ্ধের সোনালী মূর্তি।এছাড়াও বাইরে পাথরের বুদ্ধের মূর্তি চোখে পড়লো , যেখানে ছোট জলের গ্লাস এ জল দেওয়া। সাজানো রয়েছে অনেকে ধরণের লাল-সাদা লণ্ঠন।আরো কারুকার্যময় ল্যাম্প ও। আরো একটা দেখার বিষয় , দিক নির্দেশ। মন্দিরের কোন দিক দিয়ে ঢুকতে হবে আর কোন দিক দিয়ে বাহির তার নির্দেশ দেওয়া ছিল। পাশে বাঁশের বন। ছোট ছোট আরো দু একটা মন্দির ঘর। দেখলাম দুটো কাউন্টার আর তাতে বসে থাকা দুজন মহিলা। একদম চুপচাপ। নিজের কাজে ব্যস্ত।
বুদ্ধ মূর্তি |
লন্ঠন |
পাথরের বুদ্ধ মূর্তি |
ছোট ছোট জাপানীস পুতুলের মতো কিছু চোখ এড়ালোনা ,যার নিশ্চয় কোনো তাৎপর্য থাকবে ,যা আমার জানা নেই।
একটা জিনিস খেয়াল করলাম, বাস থামতেই , বাস, যাত্রীদের দিকে মানে বাসস্টপ এর দিকে(বাম দিক ) একটু নিচু হয়ে গেলো , যাতে যাত্রীরা সহজে উঠতে পারে আর ছাড়ার সময় আগের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হাহা। এরকম ও হয়।!! হয় হয়তো। আমার প্রথম বিদেশ দেখা তো। এরকম ব্যবস্থা দেখিনি বাপু।
ট্রেনের মতো এক্ষেত্রেও পেছনের দরজা দিয়ে ওঠা আর সামনের দরজা দিয়ে নামা। প্রতিটি স্টপে ,ডিসপ্লে (diplay ) সহ ঘোষণা হতে থাকলো পরবর্তী স্টপের নাম সহকারে এবং যে যে স্টপ কোনো বিশেষ টুরিস্ট স্পট , সেটাও আলাদা করে ঘোষণা হয় ।
বাসের ভেতর |
বাসে প্রতিটা সিট্ এর পাশে একটা সুইচ , তার নিচে ইংলিশ আর জাপানীস এ লেখা “বাটন টিপে ড্রাইভারকে জানাতে যে আপনি পরবর্তী স্টপেজে এ নামতে চান” ।তাই হয়তো এখানে বাস এ কন্ডাকটর নেই, আমাদের দেশের মতো। কেউ টিকেট চাইও না আর কোনো যাত্রী চেঁচিয়ে বলেও না, দাদা আমি পরের স্টপ এ নামবো। হিহি।
প্রাপ্তবয়স্কের টিকিট মূল্য ২৩০ আর ৬ বছরের উর্ধে ১২০।আমরা ৬ বছরের উর্দ্ধে ,কথাটি না পরেই সেদিন আসা যাওয়ার দুদিকেরই মেয়ের টিকিট কেটেছিলাম। খেয়াল হয়নি। তুমি যদি প্রথম স্টপে নামো তাও তোমার ভাড়া যা , শেষ স্টপে নামলেও একই। কি মজার ব্যাপার না?
Sanjo |
আমাদের স্টপ Sanjo ।স্টপ আসতেই এগিয়ে গিয়ে বক্সে coin ফেলে নেমে পড়লাম। ওহ। এই প্রথম জাপানে এসে ভালো লাগলো। আমি একটু কোলাহল প্রিয় মানুষ। মানে ভিড় পছন্দ করি ,জায়গাটা আমার জন্য একদম মানানসই। রাস্তা পার হতে একটা tunnel এর মতো কিছু। অপূর্ব সে দৃশ্য। হু হু করে হাওয়া বইছে।হাড় কাপানো একদম।তাতে কি। উৎসাহের একটুও ঘাটতি হলো না। ঝা চকচকে জায়গা। আলো আর আলো। লোক থিক থিক করছে। তেমনি গাড়ির লাইন । কিন্তু কোথাও কেউ থেমে নেই , নেই কোনো ট্রাফিক লাইন , না কোনো শোরগোল আওয়াজ। সব যেন নিয়মানুযায়ী চলছে- চলবে টাইপ।
Sanjo |
আজ এই পর্যন্ত।
[…] << জাপান পর্ব ৪ ১২য় মার্চ থেকে ১৮ই মার্চ ,২০১৮ […]
[…] << আগের পৃষ্ঠা :জাপান পর্ব ২ পরবর্তী পৃষ্ঠা :জাপান পর্ব ৪>> […]