“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী”


মা ” — এই ডাকটিই বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সহজবাচ্য , স্নিগ্ধতম ডাক। সময়ের সাথে ক্রমবর্ধমান নবজাতকের মুখ থেকে উচ্চারিত প্রথম শব্দটিই হল ‘মা’। জন্ম থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে নিরাপদ, শান্তিদায়ক, ভালোবাসার আশ্রয় হল মায়ের কোল। এটি আসলে কোনো শব্দ নয় ,কোনো ডাক নয় , এটি হলো এমনই কিছু যার যোগ সরাসরি আমাদের হৃদয়ের সাথে। সৃষ্টি – স্রষ্টা -পালক ; এই সমস্ত শব্দের নিবিড়তম গূঢ় অর্থই হল মা। তাইতো এই শব্দটির কর্ণপাতে মানুষের সমস্ত আবেগ প্রস্ফুটিত হয় ।

মানুষ তথা মানবসভ্যতার স্রষ্টাই হলেন মা। দীর্ঘ দশ মাস মায়ের গর্ভে পালিত হয়ে ,শৈশবে মায়ের বুকের অমৃত পান করেই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা পায় সকলে। বড় বিত্তবান থেকে সামান্য মজুর : কেউই এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন। সমগ্র জীবকুলের এটাই হলো চিরন্তন নিয়ম । মা হলেন এই সমগ্র জীবকুলের স্রষ্টা । নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাইয়ে দেওয়া , খালি পেটে থেকেও হাসি মুখে সন্তানকে বলা, ” হ্যাঁ বাবা/মা তুই খেয়ে নে ,আমার পেট ভরা আছে “, সন্তানকে খুশি করতে ,সন্তানের মঙ্গল কামনায় নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে দেওয়া — এসব বিশেষণের ঊর্ধ্বে আরো অনেক অনেক মহান যিনি, তিনিই হলেন মা ।তাই মানুষের কর্ম, মানুষের জ্ঞান, মানুষের প্রতিষ্ঠা – এসবেরই ঊর্ধ্বে সবার আগে স্মরণীয় এবং অবশ্যপালনীয় হয়ে থাকে যা ,তাই হল ‘মাতৃ দিবস’। মাতৃ দিবস বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পালনীয় এবং ছুটির দিন । সমগ্র বিশ্বজুড়ে একসাথে পালিত হয় এই দিন । তবে কোথাও কোথাও আলাদা আলাদা সময়েও পালিত হয় এই বিশেষ দিন। ভারতেও প্রত্যেক বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মাতৃ দিবস রূপে পালন করা হয়।সময়ের সাথে সাথে এর পালনের বিভিন্ন ধারা এবং বৈশিষ্ট্য কিন্তু বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়।

মাতৃ দিবস পালনের প্রথম সূচনা স্থান বলা যেতে পারে প্রাচীন গ্রিক এবং রোমান সভ্যতাকে। প্রাচীন গ্রিক এবং রোমে মাতৃসমাজ কে সম্মান জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে দেবী ‘রেআ’ ( Rhea ) এবং ‘ সাইবেল ‘ ( Cybele ) এর পুজো করা হতো। অর্থাৎ এই দেবীদ্বয়কে মাতৃ প্রতীকরূপে ধরে সমগ্র মাতৃ সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো। ধীরে ধীরে এই ধারার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বর্তমানে পালিত মাতৃ দিবসের অর্থাৎ নির্দিষ্টভাবে প্রত্যেক মায়ের জন্য উৎসর্গীকৃত এই দিনের প্রকৃত পূর্বসূরী হল খ্রিস্টানদের একটি বিশেষ উৎসব যা পরিচিত ছিল ‘মাদারিং সানডে’ ( Mothering Sunday ) নামে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের একটা বড় অংশজুড়ে চতুর্থ রবিবার করে এই বিশেষ দিনটি পালিত হতো। সময়ের সাথে সাথে এই দিনটির গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং সন্তানেরা নিজের মাকে ফুল সহ বিভিন্ন উপহার দিতে শুরু করে।

পরবর্তী সময়ে এই দিনটির গুরুত্ব আরও বাড়তেই থাকে এবং বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগেও এই দিনটি পালনের প্রতি বিশেষ জোর দেওয়া হতে থাকে। পূর্বের এই ধরনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন জুলিয়েট কালহন ব্লেকলি ( Juliet Calhoun Blakely) নামে এক বিশেষ উদ্যোক্তা 1870 এর দশকে মিশিগানের এলবিওনে ( Albion ) মাতৃ দিবস পালনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মেরি টাউলেস সাসীন ( Mary Towles Sasseen ) এবং ফ্রাঙ্ক হেরিং ( Frank Hering ) যৌথভাবে মাতৃ দিবস পালনে বিশেষ ভাবে কাজ করেন। পরবর্তীকালে অনেকে হেরিংকে ‘ মাতৃ দিবসের জনক ‘ বলেও অভিহিত করেন।

এর পরবর্তীকালে মাতৃ দিবস কে জাতীয় ছুটি হিসেবে স্বীকৃত করানোর পেছনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বটি ছিলেন অ্যানা জারভিস ( Anna Jarvis )। তার এই বিশেষ কাজের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে জড়িত ছিল যে বিষয়টি সেটি হল 1905 সালে তার মা আন রীভস্ জারভিস (Ann Reeves Jarvis) -এর মৃত্যু। এই ঘটনার পরেই তিনি মায়েদের নিজের সন্তানের প্রতি আত্মত্যাগ , অকৃত্রিম অশেষ ভালোবাসা -এজন্য মায়েদের উদ্দেশ্যে মাতৃ দিবস পালনের প্রতি বিশেষভাবে দায়িত্বশীল হয়ে পরেন। জন (John Wanamaker ) নামে একজন বিক্রেতার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে 1908 সালের মে মাসে মেথদিস্ট গির্জায় ( Methodist church, Grafton, West Virginia) মাতৃ দিবস পালন করেন। সেদিনের চূড়ান্ত সাফল্যই তাকে অনুপ্রাণিত করে এই মাতৃ দিবস কে জাতীয় স্তরে স্বীকৃতি পাইয়ে দেওয়ার। মাতৃত্ব কে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ দিনকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃত করার উদ্দেশ্য নিয়ে এরপর তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ,সংবাদপত্র – তে নিয়মিত লেখা প্রকাশ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের কাছে আবেদন প্রভৃতি করতে শুরু করেন। এই দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ( Woodrow Wilson ) যখন 1914 সালে সরকারিভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার কে মাতৃ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে স্বাক্ষর করলেন তখন এই মহীয়সী নারীর উদ্দেশ্য সফল হল। আর তখন থেকেই প্রত্যেক বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটি মাতৃ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেল যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালেন্ডারে।

সারা জীবনের অনেক ব্যস্ততার মধ্যে এই একটি বিশেষ দিনে নিজের মাকে আলাদা ভাবে আরো বেশি করে সময় দেওয়ার সুযোগ আমাদের তাই ছাড়া উচিত নয় ।তবে মাতৃ দিবস নিয়েও কিন্তু এই লজ্জাজনকঘটনা রয়েছে। মাতৃ দিবস কে যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে একটা নতুন প্রথা চলে আসল- মাতৃ দিবসে মাকে বিভিন্ন কার্ড ,ফুল ,ক্যান্ডি প্রভৃতি উপহার দেওয়ার। তখন কিছু কিছু ব্যক্তির চোখে এই দিনটি প্রকাশ পেল ব্যবসায়িক দিন রূপে। কিন্তু অ্যানা জারভিস এর প্রতিবাদ করে মাকে দিতে বললেন বুক ভরা ভালোবাসা আর একটু সময়।

মাতৃ দিবস পালনের প্রথা ও রীতি বিভিন্ন ।উদাহরণস্বরূপ বলা যায় থাইল্যান্ডে প্রত্যেক বছর মাতৃ দিবস পালিত হয় আগস্ট মাসে ,সেখানকার রানীর জন্মদিনে। এরকমই বলা যেতে পারে ইথিওপিয়া ,যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতির কথা ।

বর্তমান সমাজ প্রেক্ষিতে মাতৃদিবস একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। নিজের ব্যস্ততার মধ্যে মানুষ যেন ভুলে গেছে নিজের পরিবারকে একটু সময় দেওয়ার কথা। ব্যস্ততার দুর্ভেদ্য পাঁচিল যেন গড়ে উঠছে মা এবং সন্তানের মাঝে। সন্তানের দ্বারা মায়ের অত্যাচারিত হওয়ার মতো নির্মম ঘটনাও উঠে আসে চোখের সামনে । দেখা যায় ভবিষ্যতের সৃষ্টির রচয়িতা কন্যাদের প্রতি অনীহা। আবার রয়েছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’। প্রসঙ্গত মনে পড়ে নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটি। সময়ের ব্যস্ততায় মানুষ যখন ভুলতে চলেছে নিজের স্রষ্টাকে একটু সময় দেওয়ার কথা তখন সরকারিভাবে মাতৃ দিবস দিনটিকে ছুটি ঘোষণা করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মায়েরা একটি দিনের জন্য হলেও নিজের বুকে ফিরে পায় তার সন্তানকে। তাই মাতৃ দিবসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কোনদিন সম্ভব নয়।
কবিও বলে গেছেন ,

” বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে “।
( – সঞ্জিব চট্টোপাধ্যায় )


মায়ের কোলে শিশু – পৃথিবীর এই সুন্দরতম এবং পবিত্রতম চিত্রটি কে পুনরায় চিত্রিত করতে তাই মাতৃদিবস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। শিশুর কাছে সর্বদা সবচেয়ে নিরাপদ ,শান্তিপূর্ণ আরামের আরামের স্থান হল তার মায়ের কোল। তাই মাতৃ দিবসের যে মহান উদ্যোগ তা অবশ্যই সফল হবে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে কানে বারবার বেজে ওঠে সেই গান —
                         

“মাগো তুমি সর্বজনীন
                          আছো হৃদয় জুড়ে “।…….

কলমে মোহম্মদ সাইদ ইকবাল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here