‘নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, বরং কেউ নারী হয়ে ওঠে।’ —–সিমন দ্য বেভোয়ার।               

   সিমন দ্য বেভোয়ার পুরো নাম সিমন লুসি এর্নেস্তিন মারি বেরত্রঁ দ্য বোভোয়ার  (ফরাসি: Simone Lucie Ernestine Marie Bertrand de Beauvoir; )  জন্ম ৯ই জানুয়ারি  ১৯০৮, আর মৃত্যু ১৪ এপ্রিল ১৯৮৬।  তিনি সিমন দ্য বোভোয়ার নামে বেশি পরিচিত। তিনি একজন ফরাসি লেখিকা, বুদ্ধিজীবী, অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, রাজনৈতিক-কর্মী, নারীবাদী ও সমাজতত্ত্ববিদ। বর্তমানে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার অধিবিদ্যামূলক উপন্যাস শী কেইম টু স্টেই এবং দ্য ম্যান্ডারিন্স, এবং ১৯৪৯ সালে লেখা তার প্রবন্ধগ্রন্থ ল্য দোজিয়েম সেক্স-এর জন্য। শেষোক্ত গ্রন্থটিতে নারীর উপর নিপীড়নের বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং এটিকে নারীবাদের একটি অন্যতম ভিত্তিগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সিমন সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন। ফরাসি দার্শনিক জঁ-পল সার্ত্র এবং মার্কিন লেখক নেলসন এ্যালগ্রেনের সঙ্গে তার প্রেম ও যৌনসম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। তাঁর লেখা দর্শন, রাজনীতি ও সামাজিক বিষয়াবলির উপর রচনা, গ্রন্থ ও উপন্যাস এবং জীবনী ও আত্মজীবনী সাহিত্যের রত্ন।  শেষোক্ত গ্রন্থটিতে নারীর ওপর নিপীড়নের বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং এটিকে নারীবাদের একটি অন্যতম ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

১৯০৮ এর ০৯ জানুয়ারী জন্ম নেন এই মহিয়সী নারী প্যারিসে। বাবা জর্জে বেরত্রাঁ দ্য বোভোয়ার ছিলেন আইনজীবী যিনি একসময় অভিনেতা হতে চাইতেন, মা ফ্রাঁসোয়া ব্রাসেয়ো গৃহিণী যিনি ছিলেন একজন টাকাওয়ালা ব্যাংকারের সন্তান, এবং এই মহিলা খুবই ধার্মিক ছিলেন । সিমোনের আরেকটি বোন ছিলো যার নাম হেলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায় তাদের। এ সময় সিমোনের মা সে সহ হেলেনকে ধর্মবাদী বিদ্যালয়ে পাঠাতে চেয়েছিলেন। সিমোন ছোটবেলায় ব্যাপক ধর্মবাদী ছিলেন, তিনি অবশ্য ১৪ বছর বয়সে ধর্মের উপর বিশ্বাস হারান এবং সারা জীবন নাস্তিক থাকেন। তাঁর জন্ম সালটা নিঃসন্দেহে নারীবাদী হওয়ার জন্য ছিল খুবই যুক্তিসঙ্গত। ধর্মীয় উন্মাদনায় নারীরা যখন কোণঠাসা, ঠিক তখন শিল্পবিপ্লবের নামে নারীদের পণ্যের কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিতে একদল পুঁজিবাদীর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। সে কারণেই পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থার সেই মুহূর্তে বোভোয়ারের মতো একজন নারীবাদীর জন্ম খুব অস্বাভাবিক ছিল না। বাবা জর্জ দ্য বোভোয়ার উকিল ও সখের অভিনেতা।মা ফ্রাসোঁয়া ব্রাসেয়ো  একজন ধর্মীয় গোড়া ক্যাথলিক। মা বাবা চিন্তায়, মননে  ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই বোভোয়ারের নানা গুস্তাভ ব্রাসেয়ো এক অর্থনৈতিক মহাসংকটের মধ্যে পড়েন। তিনি ছিলেন মিওস ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। ব্যাংকটি ঋণখেলাপি হওয়ায় সিমোনের পারিবারিক জীবনে এক অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে।

বোভোয়ার বেড়ে উঠতে থাকেন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেই। চোখের সামনেই দেখতে পান মা ব্রাসোয়ার অমানষিক দুঃখ-দুর্দশার এক করুণ চিত্র। সিমোন ছেলেবেলাতেই সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করবেন না। জন্ম দেবেন না সন্তানের। যে সমাজ লিঙ্গের বৈষম্যেকে লালন-পালন করে সে সমাজে আর যাই হোক বিয়ের মতো সামাজিক বন্ধন মানায় না।সিমোন দ্য বোভোয়ারের ছোট বোন হ্যালেন দ্য বোভোয়ার  বিখ্যাত  অঙ্কন শিল্পী হয়ে খ্যাতি লাভ করেন।সিমনের বাবার দুই কন্যা সন্তানের চেয়ে অনেক শখ ছিল একটা পুত্র সন্তানের। এ নিয়ে তিনি মাঝে মধ্যেই অনেক আক্ষেপ করতেন। ছেলেবেলা থেকেই সিমোন প্রচণ্ড মেধাবী হওয়ায় বাবা জর্জ সবসময় বলতেন, একজন পুরুষের মতোই তোমার মেধা আছে । ১৫ বছর বয়সে সিমোন সিদ্ধান্ত নেন তিনি একজন বিখ্যাত লেখক হবেন। পিতা জর্জের জীবনে নাটক আর শিল্প-সাহিত্যের প্রতি যে অক্ষমতাটুকু ছিল তার ষোলআনাই ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন কন্যা বোভোয়ার।সিমোন ভর্তি হন ফ্রান্সের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সোরবোর্নে। সেখানে পরিচয় হয় বিখ্যাত লেখক, দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রের সঙ্গে। ১৯২৯ সালে সিমোনের যখন ২১ বছর বয়স তখন তিনি দর্শনে এগ্রিগেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পেয়ে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য, সেই পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন জ্যাঁ পল সার্ত্র। পরীক্ষায় এই প্রথম আর দ্বিতীয় হওয়া নিয়েও কিছু কানাঘুঁষা সেই সময় বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বোভোয়ারের জীবনীকার দেয়ার্দে বেয়ার্স মনে করেন, পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন সত্যিকার অর্থে খোদ সিমোনই।কিন্তু সার্ত্র ছিলেন পুরুষ আবার পরীক্ষাটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় উদ্যোগের ফসল। তাই অনেকটা মানবিক অজুহাত দিয়েই জুরি বোর্ড সার্ত্রকে প্রথম স্থানটি দিয়ে দেন। কিন্তু প্রথম আর দ্বিতীয় যেই হোন না কেন সার্ত্রের সঙ্গে সিমোনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের, প্রেমের আবার কখনো কখনো গুরু-শিষ্যের।এক ব্যতিক্রমী সম্পর্কে, যারা কখনো পরস্পরকে ছেড়ে যান নি, কিন্তু অন্য কারো সাথে না জড়ানোর, শুদ্ধ একনিষ্ঠ দেহ ও মনের সতীত্বের বাধ্যবাধকতায়ও থাকেন নি। সার্ত্রের সাথে দেখা হওয়ার পর বোভোয়ারের জীবন বদলে যায় চিরকালের মতো, এ-সাক্ষাৎ বিশশতকের এক শ্রেষ্ঠ ঘটনা, হয়তো বদলে গিয়েছিলো সার্ত্রের জীবনও, কেননা দ্য বোভোয়ার অস্তিত্ববাদী দর্শনের ‘অপর’ বা আদার’ হয়ে থাকার মতো নারী ছিলেন না।
সার্ত্রের সঙ্গে শুধু বন্ধুত্ব নয়, তার দার্শনিক চিন্তার বিচার বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণ সমালোচক হয়ে ওঠেন সিমোন দ্য বোভোয়ার। প্রাক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকে পুঁজিকরে আর সার্ত্রের সঙ্গে ওলগা কোসাকিউয়িজ এবং ওয়ান্ডা কোসাকিউয়িজের প্রেমের দুর্বোধ্য জটিল সম্পর্কের মালা গেঁথে সিমোন লিখে ফেলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ’সি কেম টু স্টে’ । সেটা ছিল ১৯৪৩ সাল। এই উপন্যাস প্রকাশ হওয়ার পরপরই উন্মেচিত হয় সিমোন এবং সার্ত্রের অপেক্ষাকৃত জটিল সম্পর্কের কথা।১৯৪৫ সালে সিমনের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘লা সেং ডেস অট্রিস’ প্রকাশিত হয়। রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবেও এটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮২ সালে ক্লাউদে চারবলের পরিচালনায় এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র হেলেন। এই উপন্যাসটির পটভূমি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসন্ন অনাগত ভাবিষ্যতের কথা। উপন্যাসের নায়ক জন ব্লোমার্ট।

১৯৫৪ সালে সিমন প্রকাশ করেন আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘লেস মেন্ডারিন’ বা দি ম্যান্ডারিন। উপন্যাসটিতে সিমন তার নিজের এবং সার্ত্রের অনেক ঘটনাই তুলে এনেছিলেন অনেকটা রূপক আর ব্যাঙ্গাত্মকভাবে। উপন্যাসটি এনে দেয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। উপন্যাসটি প্রিক্স গনকোর্ট পুরস্কারে ভূষিত হয়। তার আগে ১৯৪৯ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় তার সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় বই ‘দি সেকেন্ড সেক্স’। বইটিতে তিনি লিঙ্গ বৈষম্যের ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিগুলো ব্যাখ্যা করেন।
১৯৫৮ সালে সিমন চার খণ্ডে তার আত্মজীবনী শেষ করেন- মেমোয়ার্স অব এ ডিউটিফুল ডটার, দি প্রাইম টাইম, ফোর্স অব সারকামস্টেন্স এবং অল সেইড অল ডান। ১৯৭৯ সালে প্রগতিশীল নারীদের জীবন অবলম্বনে লিখেন ছোটগল্প ‘দ্য থিংস অব দি স্পিরিট কাম ফার্স্ট’। নারী অধিকার বিষয়ক তাঁর আরেক ছোটগল্পের সিরিজ ‘দি ওমেন ডেস্ট্রয়েড’ বেশ সাড়া জাগায়। এমবিগিউটি’। অনেকে বলেন এটি সার্ত্রের বিখ্যাত ‘বিং এন্ড নাথিংনেস’ দ্বারা অনুপ্রাণিত। এ প্রসঙ্গে সিমন বলেন, তিনি সার্ত্রের চিন্তা এবং দর্শন দ্বারা কখনোই প্রভাবিত ছিলেন না। তিনি নিজেকে একজন দার্শনিকের চেয়ে বরং সাহিত্যিক হিসেবেই দেখতে বেশি ভালোবাসতেন।

১৯৮১ সালে সার্ত্রের জীবনের শেষ বছর গুলোর স্মৃতি নিয়ে প্রকাশ করেন ‘এ ফেয়ারওয়েল টু সার্ত্র’। বইটির মুখবন্ধে সিমোন লেখেন, “সার্ত্রের ওপর এটিই আমার একমাত্র বই যেখানে রচনাগুলো প্রকাশিত হওয়ার আগেই সার্ত্র পড়তে পারলেন না। ” এখানে উল্লেখ্য, সিমোন এবং সার্ত্র সবসময়ই পরস্পর  নিজেদের লেখা পড়তেন এবং সমালোচনাও করতেন। সার্ত্রের মৃত্যুর পরপরই সিমোন এবং আরলেটে এলকেইম নামের এক আলজেরিয়ান নারী বিভিন্নরকম তিক্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। আরলেট ছিলেন সার্ত্রেরজীবনের শেষ দিকে সিমোন প্রচণ্ড ভাবে  মাদকাসক্ত হয়ে পরেন। সার্ত্রের মতো তিনিও একসময় ড্রাগ নিতে শুরু করেন। ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল নারীবাদী এই নারী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পর সিমোন দ্য বোভোয়ারকে কবর দেওয়া হয় প্যারিসের সিমেটর ডু মোন্টপ্যারানেসে তাঁর আজীবন বন্ধু জ্যাঁ পল সার্ত্রের সমাধির ঠিক পাশেই। সমাপ্ত হয় এক নারীবাদীর জীবনের সমস্ত কথা। কিন্তু তিনি শুধু একজন নারীবাদী
লেখক হিসেবেই নয়, সিমোন বেঁচে রইলেন  এক তুখোড় বুদ্বিজীবী, দার্শনিক এবং সাহিত্যিক হিসেবে গোটা পৃথিবীর মানুষের হৃদয় জুড়ে। 

মনোজিৎকুমার দাস,  মাগুরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here