খিদের জাত

By: Rajkumar Mahato

0
17
খিদের
খিদের
Put your rating for this post for encouraging the author

খিদের জাত

  এই গ্রামের রাস্তায় সন্ধ্যের পর থেকে আর মানুষ দেখা যায়না। যে যার ঘরের দাওয়ায় হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকে। মহিলারা মাথায় ঘোমটা দিয়ে কাঁচা উনুনে কাঠ-পাতা জ্বালিয়ে ভাত চাপায়। হাঁড়ির গরম জলের মধ্যে ফুটতে থাকে খিদে। এদিকে বঁটিতে ততক্ষণে কলমি শাক, নয়ত নটে শাক অথবা কুমড়ো কাটা হচ্ছে। লম্ফের আলোয় ভালো দেখা যায়না বটে! তাই, শাকের বদলে বন্য পাতাও পেটে চলে যায় মাঝে-সাঝে। আসলে ওই যে কথায় বলে, না দেখে বিষ খেলেও মাঝে মাঝে কোন ক্ষতি হয়না।

  তবে বিনোদ পুঁটিকে কড়াভাবে জানিয়ে দিয়েছে, যেদিন সে শাক রান্না করবে, সেদিন যেন আলো থাকতে থাকতে বেছে নেয়। শাকের বদলে তার পেটে যেন বনবাদাড় না যায়! বিনোদ মায়ের কাছে ছোটবেলায় শুনেছিল। রাতে নাকি শাক খেতে নেই। বড় হওয়ার সাথে সাথে তার সেই ভাবনা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে। আর এই গ্রামে আসার পর সে বুঝেছে আসলে খিদের কোন সময় হয়না। শহুরে মানুষের প্রচুর খাদ্য মজুত থাকে। তাই, অনেক রকম নিয়ম পালন করেন তাঁরা। কিন্তু এই গ্রামে সকাল-সন্ধ্যে মানুষের একটাই ভরসা, মাঠে-ঘাটের নয়ত পুকুরের নানারকমের শাক।  

  পুঁটি বিনোদের রান্না করে, ঘর মোছে, জামাকাপড় কেচে দেয়। তবে বিনোদ অনেকবার চেষ্টা করেও পুঁটিকে নিজের বাড়িতে খাওয়াতে পারেনি। পুঁটি বলে, “না বাবু আপনাদের বাসনে আমরা খেলি আপনাদের পাপ লাগবে। আপনারা খেয়ে যা ফেলে দিবেন। সেটাই কলা পাতায় তুলে খেলি আমাদের প্রসাদ। আপনারা ব্রাম্ভন। আপনাদের পাতে খেতি পারি? মা-গো, বাবা বড় কর্তা আমায় ক্ষেমা দিক।” বিনোদ তাই পুঁটিকে আর খেতে বলেনা। বাড়তি খাবার কলা পাতায় করে নিয়ে চলে যায় সে।    

  বিনোদ, পুরো নাম বিনোদ বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমান যুগের একজন নামকরা লেখক। একবার সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। বয়স চল্লিশের কোটায়। মাথা ভরা কাঁচা পাকা চুল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। আর মনে হাজার শব্দের বাস। কিলবিল করতে থাকা শব্দেরা তার মাথা কামড়ায় ভীষণ। সেইদিন থেকে, যেইদিন থেকে সে তার মূল পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে লেখালেখি।

  বিনোদ এখানে এসেছে তিন সপ্তাহ হল। প্রায় অনেকদিন লেখালেখির জন্য একটু নিরিবিলি জায়গার খোঁজে ছিল সে। যেহেতু লেখালেখিটাই তার মূল পেশা। তাই কলকাতার কংক্রিটের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থেকে আর লিখতে পারছিল না। প্লট মনে এলেও শব্দেরা বিদ্রোহ করে বসেছিল। তারা আর নিজেদের চারদেওয়ালের আড়ালে রাখতে চাইছিল না। তারা মুক্ত হতে চাইছিল, ভীষণভাবে চাইছিল।  

  আসলে তার খুব কাছের এক বন্ধু সজলের পৈতৃক ভিটে এই বাড়ি। বীরভূম জেলার বাবর গ্রাম। বক্রেশ্বর নদীর তীরের ছোট্ট এই গ্রামটা এই কয়েকদিনেই বিনোদের মনের অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে। সজল প্রথম দুইদিন এখানে ছিল তার সাথে। তিনদিনের দিন সব ব্যবস্থা করে দিয়ে পুনরায় কলকাতা ফিরে গিয়েছে। আবার আসবে পরের সপ্তাহে। এই ছোট্ট নদী, এই আম গাছ, পুকুরে ভেসে থাকা কলমি শাক, টালির চালে ঝুলে থাকা লাউ কুমড়ো, পুকুর পাড়ে চরে বেরানো হাঁসেদের দল আর রাতে ডাকতে থাকা শিয়ালের হুক্কা-হুয়া বিনোদকে একেবারে নিজের করে নিয়েছে। তার ফেলে আসা একটুকরো শৈশব ফিরে পেয়েছে সে এই গ্রামে।

  দিনটা শনিবার। বিকেলের দিকে হালকা হাওয়া বইছে আর সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছিল। বিনোদ মাটির ঘরটার নিকানো বারান্দায় বসে একটু লেখার চেষ্টা করছিল। কোন এক অজানা অচেনা গ্রামে হারিয়ে যাওয়া এক রাজপুত্রের গল্প। রুপকথার পাতা থেকে উঠে আসা সেই রাজপুত্র আজ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে। এখানে সব বাড়িতে ইলেক্ট্রিক নেই। পুরো গ্রাম মিলিয়ে তিনটে বাড়িতে ইলেক্ট্রিক। যার মধ্যে সজলদের বাড়িটা একটা। তাও প্রতি এক ঘন্টায় মিনিট কুড়ির মত নিয়ম করে লোডশেডিং হয়।

  হঠাৎ সেই বৃষ্টির মাঝে একটুকরো রোদের মত একটি একরত্তি ছেলে উঠোনে এসে দাঁড়াল। পরনে একটা আধময়লা ধুতি। গায়ে কিছু নেই। চুলগুলো ভিজে সপসপে। রোগা, কালো গড়নের ছেলেটির হাতে একটি লাঠি আর দুটো বাটি। বাটি দুটো পরস্পর পরস্পরকে আঘাত করিয়ে একটা আজব শব্দ তুলছে ছেলেটা। আর বিনোদের দিকে তাকিয়ে আছে।

  বিনোদ লেখা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল, “কে তুমি? কি চাই?”

  ছেলেটি উঠোন থেকে বারান্দার আরও একটু কাছে এগিয়ে এল। ওকে বারান্দায় উঠে আসতে বলল বিনোদ। মাটির সিঁড়িতে বসে পরল ছেলেটা। উৎসুক নয়নে বিনোদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি লাকি শহর থেকে এয়েচ, বাবু?”

  ছেলেটার গলার স্বরটা ভারি মিষ্টি। বিনোদ বলল, “তোমাকে কে বলল?”

  সে একই ভাবে বিনোদের দিকে তাকিয়ে বলল, “মা বলল তো, শহর থেকে বাবু এয়েচে। তাকে খেলা দেখিয়ে আয়।”

  বিনোদ খানিক অবাক হল। খেলা? এই একরত্তি আবার কি খেলা দেখাবে? প্রশ্ন করল, “খেলা? কি খেলা?”

  ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে বাটি বাজাতে বাজাতে বলল, “হাপু খেলা গো বাবু, হাপু খেলা।”

  হাপু খেলার নাম শুনেছে বিনোদ। এই খেলা বীরভূম, বাঁকুড়ার এক প্রতিবাদী সুর। নিজেদের উচ্ছেদের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক সবল প্রচেষ্টা। তবে সেই খেলা যে এইভাবে বিনোদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াবে সেটা ভাবেনি সে!

  বিনোদ হেসে বলল, “তুই দেখাবি খেলা? আর হাপু গান গাইবি?”

“হ্যাঁ, আমার বাপের সাথে যেতুম খেলা দেখাতি। সব শিখে ফেলিচি।”

“তোর নাম কি?”

ছেলেটি বেশ গর্বের সাথে বলল, “নাড়ু।”

হেসে ফেলল বিনোদ। বলল, “ধুস পাগল, নাড়ু আবার কারোর নাম হয় নাকি? ওটা ডাকনাম। ভালো নাম কি?”

ছেলেটি মাথা চুলকে বলল, “নাড়ুগোপাল মাল।”

বিনোদ বলল, “হ্যাঁ এই হল নাম। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে এটাই বলবি। কেমন?”

নাড়ু মাথা নাড়ল। তারপর উৎসুক হয়ে বলল, “দেখবে?”

বিনোদ বাইরের দিকে দেখল। বৃষ্টিটা থেমে গিয়েছে। হেসে বলল, “দেখা।”

লাঠি হাতে নিয়ে উঠোনে নেমেই গাইতে শুরু করল নাড়ু –

“হাপু রে হাপু, হাপু গেল মাঠে” তারপর নাড়ু থেমে গেল। বিনোদ বলল, “কি হল? থেমে গেলি যে!”

মাথা চুলকে নাড়ু বলল, “ভুলে মেরেচি বাবু।” হাসল বিনোদ। মিনিট দুই দুজনেই চুপ। তারপর যেইনা বিনোদ কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক সেই সময়েই নাড়ু আবার শুরু করল –

“হাটে গেলাম মাঠে গেলাম কিনে আনলাম আদা,

আদা খেয়ে হাঁদার বাবা হাগে গাদা গাদা।”

এই লাইনটা গেয়েই নাড়ু নিজের পিঠে সেই লাঠি দিয়ে আঘাত করতে করতে অদ্ভুত সুরে “হা-পু হাপ-পু হা-পু” বলে গাইতে লাগল। বিনোদের এতক্ষন ভালই লাগছিল ব্যাপারটা, সে মজা পাচ্ছিল বেশ। আসলে নাড়ুর এই গান বিনোদকে অনেক কিছু ভাবতে বাধ্য করছিল। বাংলার ঐতিহ্য কায়েম রাখার এই লড়াই এখনও এইসব এলাকার লোকেরা মনে রেখেছে। হাপু এখন নিজের অস্ত্বিত্ব বাঁচানোর লড়াই লড়ে চলেছে। কেই বা শোনে এখন এসব? এসব করে কাদের সংসার চলে? দু-বেলা দু-মুঠো ভাত জোগাতে পারেনা হয়ত এইসব ঐতিহ্য বহনকারী মানুষগুলো! এইসব ভাবছিল বিনোদের লেখক মন কিন্তু ওই একরত্তিটার পিঠে ওইভাবে লাঠি মারা দেখে বুকটা কেঁপে উঠল তার। চেয়ার ছেড়ে উঠে সোজা উঠানে নেমে এল সে। চিৎকার করে বলল, “থাম নাড়ু, থাম।”

  নাড়ু থেমে গেল। ওর চোখভর্তি জল। বিনোদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভালো লাগেনি বাবু?”

  বুকটা যেন শুন্য হয়ে গেল বিনোদের। এক লহমায় শহরে ফেলে আসা নিজের ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল তার। তিন সপ্তাহ তাকে ছেড়ে এই গ্রামে আছে সে। নিজের জন্য, পেশার তাগিদে। হঠাৎ এই ছেলেটার নিজের পেশার তাগিদে নিজেকে কষ্ট দেওয়াটা তার ভিতরটাকে নাড়িয়ে দিল। খিদে মানুষকে আর ঠিক কি কি করতে বাধ্য করে? সেটা অজানা নেই বিনোদের। তবে এই নরম শিশু চামড়াটার উপর এই লাঠির আঘাত আজ তাকে এক লহমায় বিধস্ত করে তুলেছে।

  বিনোদ নিজেকে সামলে বলল, “ইসস, দেখি পিঠটা। তোদের কি আর অন্যভাবে খেলাটা দেখানো যায়না?”

  নাড়ুর চোখে জমে থাকা জল তার কালো চামড়ার গাল্ বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেল। বিনোদ বুঝল, এই মুহুর্তে নাড়ু শারীরিক কষ্টের থেকেও মানসিক কষ্টটা বেশি পেয়েছে। সে হয়ত ভেবেছে তার হাপু খেলা পছন্দ হয়নি এই শহুরে লোকটার।

  নাড়ুর পিঠের দিকে তাকাল বিনোদ। চমকে উঠল। অজস্র দাগ সেখানে। খিদের দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে আছে। মোটা মোটা কালশিটে দাগ বিনোদকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। তার ঘরে প্রতিদিন যে ভাতগুলো নষ্ট হয়। যেগুলো ডাস্টবিনের পেটে যায়। এইসব গ্রামে সেইসব ভাতের জন্য কত নাড়ু দিনের পর দিন তাদের পিঠে কালশিটে দাগ তৈরি করে।

  চোখ ফেটে জল এল বিনোদের । নাড়ুর পিঠের দাগ ছুঁয়ে দেখার সাহস তার নেই। জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে, ওষুধ লাগাস না?”

  নাড়ু হেসে বলল, “আগে মা তেঊড়ি পাতা ঘষে দিত। কিন্তু এখন আর লাগেনা। হাত দিয়ে দেখো কেমন কড়া পরে গেচে।” হাত দিয়ে দেখার সাহস নেই বিনোদের। এইটুকু বাচ্চার জীবিকা নির্বাহনের এই পথ কে দেখিয়েছে তাকে? ভেবে পায়না বিনোদ। হয়ত খিদেই তাকে এই পথে আসতে বাধ্য করেছে।

  বিনোদ কিছু বলছে না দেখে নাড়ু তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “ও বাবু পছন্দ হয়নি আমার হাপু গান?”

  সেই মুহুর্তে আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। নাড়ুর হাতটা ধরে ওকে বারান্দায় তুলে আনল বিনোদ। নাড়ু নিজে থেকেই গোবর দিয়ে নিকানো মাটির মেঝেটায় বসে পরল। বিনোদ চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে, তুই স্কুলে পড়িস না? তোর বাবা কি করে? এই বয়সে এসব কেন করিস?”

  নাড়ু মুখটা নিচের দিকে করে নিয়েছিল। তারপর যখন মুখটা তুলল। ওর চোখদুটো দেখে বিনোদের পা থেকে মাথার লোম পর্যন্ত কেঁপে উঠল। ওই নম্র ছেলেটার দুই চোখ ভর্তি আক্ষেপ, আবেগ। শিশু মনটার ভেতর না জানি কতশত ব্যথা চাপা! কিছুই বলল না নাড়ু।

  কিছুক্ষন ওইভাবে বসে থাকার পর বিনোদ আবার জিজ্ঞেস করল, “খাবি কিছু?”

  নাড়ু মুখটা তুলল। ওর চোখদুটো উজ্বল। খিদের তাড়নায় ঘুরে ঘুরে ফেরা ক্ষুদার্থ চোখদুটো খাবারের সন্ধান পেয়ে উজ্বল বর্ন ধারণ করেছে।

  ওর চোখটা দেখে বিনোদের মনটা ভরে গেল। হেসে বলল, “ওই যে ওখানে মুড়ি, চিঁড়ে, মুরকি, চানাচুর আছে। যা খাবি খেয়ে নে।” পরক্ষনেই বিনোদের মনে পড়ল আজ পুঁটি তার জন্য দুপুরে মাছ রান্না করেছিল। সেই মাছটা সে খায়নি। আর ভাতটাও অল্প খেয়েছে। সে ব্যস্ত হয়ে আবার বলল, “ওই হাঁড়িতে ভাতও আছে, পাশের বাটিতে মাছের ঝোল আছে। ওটা খেলেও খেতে পারিস। দেখ তোর যেটা ইচ্ছে!”

  নাড়ু যেন হাতের কাছে একটুকরো স্বর্গ পেয়ে গেল। কোনটা খাবে, কোনটা রাখবে ভেবে পেলনা! ওর ক্ষুদার্থ চোখ একবার চিঁড়ে মুরকির দিকে গেল, একবার গেল মাছ ভাতের দিকে, একবার গেল মুড়ি চানাচুরের দিকে।

  বিনোদ ওর চোখের ভাষাটা বুঝতে পারছিল। যদি ভগবান ওকে কোন বর দিয়ে দিত তাহলে নাড়ু হয়ত আজ এইসব খাবারগুলো একবারে খেয়ে ফুরিয়ে দিত। তার একমাস হয়ত আর খিদে পেতনা! সে মনের আনন্দে হাপু খেলা দেখাত, পিঠের দাগগুলো আরও গভীর হত মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য; দুটো ভাত জোগাড় করার জন্য।

  শেষ পর্যন্ত ভাত দিয়ে মাছের ঝোলটা খেতে শুরু করল নাড়ু। হাপুস-হুপুস করে খেতে লাগল। বিনোদ অনড় নয়নে ওর খাওয়া দেখতে থাকল। কত খিদে থাকলে মানুষ এইভাবে খায়! কতটা খিদে জমে থাকে এই গ্রামের নাড়ুদের পেটে। মোটা চালের ভাতও জোটেনা হয়ত ঠিকমত!

  ঠিক সেই সময়ে পুঁটি গজগজ করতে করতে এসে উঠল বারান্দায়। “মরা মুখো আকাশ। টিপটিপে বৃষ্টি লাজ্ঞেচে দেখো দিকিনি কেমন। মর ওলাউঠো, মর।”

পুটির কথায় বিনোদের হাসি পেল। হেসে বলল, “আকাশ আবার মরবে কি-রে?”

  পুঁটি তার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় নাড়ু তার নজর কাড়ল। পুঁটি নাড়ুকে ওইভাবে খেতে দেখে চিৎকার করতে করতে নাড়ুর দিকে এগিয়ে গেল। বলতে থাকল, “ওরে মরা রে। বাবুর জাতটা গেল। হ্যাঁরে ও ওলাউটো, তোকে বলেছিলুম খেলা দেখাতি। তুই এখানে এসে বাবুর বাসনে খেয়ে ফেললি? মরণ হয়না কেন আমার!”

  নাড়ু ততক্ষনে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। একরাশ উড়ন্ত আতঙ্ক এসে ঘিরে ধরেছে তাকে। খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। আর পুঁটি দৌড়ে গিয়ে তার চুলের মুঠি ধরে নাড়িয়ে দিয়েছে। নাড়ু কাঁদতে শুরু করেছে। মুখে লেগে থাকা ভাতগুলোতে চোখের জল এসে মিশছে।

  বিনোদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে, হচ্ছেটা কি? কেন পুঁটি এইভাবে নাড়ুকে এসে মারতে শুরু করেছে? সে দৌড়ে গিয়ে নাড়ুকে অন্য দিকে সরিয়ে দিল। পুটিকে রাগত স্বরে বলল, “ও আমার খাবার খেয়েছে, তাতে তোর কি? আর তুই এভাবে ওকে মারছিস কেন? ও কি চুরি করেছে?”

  পুঁটি হঠাৎ করেই বিনোদের পা-দুটো জড়িয়ে ধরল, আর কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, “আমারে ক্ষমা করে দিন বাবু। ছেলেটারে পাঠিয়েছিলুম খেলা দেখাতি। সে যে আপনার বাসন এঁটো করবে আমি বুঝতে পারি নি বাবু, আমারে ক্ষেমা দেন বাবু, ক্ষেমা দেন।”

  বিনোদ কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “নাড়ু তোর ছেলে?”

  পুঁটি মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ বাবু। আমার ছেলে ও। আপনার জাত খোয়া গেল। কি সব্বনাশটাই না হল!”

  বিনোদ মুচকি হাসল। তারপর নাড়ুকে বলল, “ভাতগুলো শেষ কর নাড়ু।”

  নাড়ু ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়েছিল, এগোল না। পুঁটির দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, “না বাবু, খিদে নেই।”

  পুঁটির দিকে তাকিয়ে বিনোদ বলল, “শোন পুঁটি। কাল থেকে আমি যতদিন এই বাড়িতে আছি। নাড়ু দুই-বেলা আমার এখানে ভাত খেয়ে যাবে। তুই রাঁধবি সেই ভাত।”

  পুঁটি পুনরায় বিনোদের পা-দুটো জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। বলল, “মাতব্বররা জানলে আমায় গাঁ ছাড়া করবে বাবু। তোমাকেও।”

  বিনোদ হেসে বলল, “কেউ কাউকে গাঁ ছাড়া করবে না পুঁটি। যেটা বলেছি সেটা করবি। দেখি কার কত ক্ষমতা!”

  পুঁটি বিনোদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার জাত চলে যাবে বাবু।”

  বিনোদ হো হো করে হেসে উঠল। তারপর নাড়ুকে ভাতের থালার পাশে কাঁধ ধরে বসিয়ে বলল, “খিদের কোন জাত হয়না পুঁটি। মনে রাখিস।”  

  নাড়ু খেতে বসল। পুঁটি বুঝল কিনা জানা নেই বিনোদের কথা। হয়ত তারা এখনও বিশ্বাস করে খিদেরও জাত হয়। নাড়ু দুচোখ ভর্তি জল নিয়ে মাছের কাঁটা ছাড়াতে লাগল।  

By: Rajkumar Mahato

Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here