<< পর্ব 2
সেদিনটা সারাদিন তিনটে ফ্যামিলি, তাদের পাড়া–প্রতিবেশী আর বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতেই কেটে গেল। সারাদিনের জিজ্ঞাসাবাদে তেমন কোন কার্যকরী তথ্যই পাওয়া গেলনা। যে মার্ডারগুলো হয়েছে সেগুলো একদমই র্যান্ডমলি সিলেক্টেড, তাদের মধ্যে এখনো পর্যন্ত কোন লিঙ্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদ সেরে সন্ধ্যেবেলা অফিস ফেরার পথে অভিমন্যুর ফোন এল, একইরকমভাবে আরেকটা খুন হয়েছে গতকাল রাতে। এবারের ভিক্টিম একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী বিনয় বোস। ওদের সদ্য তৈরি করা লিস্টের মধ্যে বিনয় বোসও ছিলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁর সেকশনের এক লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ককে (LDC) কোন অন্যায় কাজ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। সেই ক্লার্ক অন্যায় কাজ করতে না চাইলে তাকে আরও বাজেভাবে ফাঁসানোর হুমকি দেন। চাপে পড়ে সুইসাইড করে নেয় সেই ক্লার্ক। এবারের খুনে একটা সুবিধা, ভিক্টিমের ফ্ল্যাটের বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। খুনের সময় বের করতে পারলে তার আগে কে কে ফ্ল্যাটে ঢুকেছে তা স্পষ্ট দেখা যাবে। অভিমন্যু আর কিংশুক ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেট করে বডি নিয়ে এল অফিসে। রাতে পোস্টমর্টেম হবে আর তাতেই জানা যাবে খুনের সময়। সেদিন রাতটা অফিসেই কাটল দুজনের। অভিমন্যু সাথে থাকায় কিংশুক কিছুটা হলেও আশ্বস্ত। দুজনেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকল পোস্টমর্টেম কমপ্লিট হওয়া পর্যন্ত।
সকালে জানতে পারা গেল খুনের সময়, রাত্রি ১২:৪০ নাগাদ হয়েছে খুনটা। সন্ধ্যে থেকে শুরু করে খুনের সময় পর্যন্ত সিসিটিভি রেকর্ড চালানো হল স্ক্রিনে। কিংশুক লক্ষ্য করছে অভিমন্যুর মুখে চিন্তার লেশমাত্র নেই, বরং সেও উত্তেজিত। রাত্রি ১২:০৫ নাগাদ সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা গেল অভিমন্যুকে, অর্ধচেতন অবস্থায় ফ্ল্যাটে ঢুকছে। অভিমন্যু তো যারপরনাই অবাক।
“এটা কীকরে হতে পারে! আমি তো কাল রাতে আমার ফ্ল্যাটেই ছিলাম, রাতে ঘুম আসছিলনা বলে শুয়েই ছিলাম সারারাত। ভোরের দিকে ঘুমিয়েছি। তারপর তো সকালে তুই এলি কিংশুক।“ কিংশুকও তখন চার্জ করতে থাকে অভিমন্যুকে
“কাল সকালে তোর দারোয়ানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। ওখানে সিসিটিভি ফুটেজে তোকে দেখেছি আমি প্রতি খুনের রাতে খুনের সময়ের একঘণ্টা আগে ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে। কোথায় যাস তুই অত রাতে?” পুলিশ পাঠিয়ে প্রতি খুনের রাতের সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে আসা হল অভিমন্যুর ফ্ল্যাটের। গোটা টিম সামনে দাঁড়িয়ে দেখল প্রত্যেকটা ফুটেজ। সবগুলোতেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে অভিমন্যুকে খুনের একঘণ্টা আগে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতে। অভিমন্যু মানতে নারাজ, কোনোকিছুই না জানার ভান করছে সে। তার দাবি, সে প্রত্যেক রাতেই বাড়িতে ছিল। কিন্তু এতবড়ো প্রমাণ তো অগ্রাহ্য করা যায়না। অভিমন্যুকে রাখা হল CID Interrogation Room এ। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোন পোক্ত প্রমাণ নেই অভিমন্যুর বিরুদ্ধে যার থেকে বলা যায় অভিমন্যুই করেছে খুনগুলো।
কিছুক্ষন পর ডক্টর সিকদারের ফোন আসে অভিমন্যুর ফোনে। ইন্টারোগেশন রুমে পাঠানোর আগে অভিমন্যুর কাছ থেকে ফোন, ওয়ালেট সহ সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিংশুক ফোনটা রিসিভ করল। “আজও ভুলে গেছেন? সেশনে আসবেন না?” ডাক্তারের গলা। কিংশুক ডাক্তারকে বলল সব ঘটনা। সব শুনে ডাক্তার বলেন “আমি মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। ওনাকে নিয়ে আসুন আমার চেম্বারে, একটা ট্রিটমেন্ট করব।“
দুজন কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে কিংশুক অভিমন্যুকে নিয়ে পৌঁছায় ডাক্তারের চেম্বারে। কনস্টেবলদের রুমের বাইরে রেখে কিংশুক অভিমন্যুকে নিয়ে রুমের ভেতরে গেল।
টেস্টের নাম Polisomnography অন্য কথায় Sleep Study। মানুষের কোন Sleeping Disorder থাকলে এই টেস্টের মাধ্যমে তার ডায়াগনোসিস করা হয়। Polisomnography র সাহায্যে প্রধানত Brain Waves রেকর্ড করা হয়। এছাড়াও রক্তে Oxygen Level, Heart Rate, Breathing Rate এমনকি চোখ এবং পায়ের মুভমেন্টও পর্যবেক্ষণ করা হয়। আগেই বলা হয়েছে অভিমন্যুর ইনসোমনিয়া আছে আর তার চিকিৎসাও করেন ডক্টর সিকদার। তো এই টেস্ট অভিমন্যুর ক্ষেত্রে কার্যকরী হবে বলে ধারণা ডাক্তারের।
প্রথমে হিপনোটাইজ করে অভিমন্যুকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হল। তারপর মেশিন লাগিয়ে স্ক্রিনে ব্রেন ওয়েভস দেখা গেল, নরম্যালই আছে তখনও।
“DID কেন থাকবে ওর?” অবাক হয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে কিংশুক।
“হ্যাঁ থাকতেই পারে। মানুষের কোন খারাপ স্মৃতির কারণে ট্রমা, ইনসোমনিয়া এসব থাকলে তার সাবকন্সাস মাইন্ডে ঐ পুরনো স্মৃতি ঘোরাফেরা করে। ঘুমানোর সময় মানুষ পুরোপুরি সাবকন্সাস মাইন্ডে থাকে। সেইসময় কোন ট্রিগারিং এলিমেন্ট পেলেই ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে, কিন্তু অন্য পারসোনালিটি নিয়ে। আর সেই পারসোনালিটি তে সে যা কিছু করে তার কোন মেমরি কন্সাস মাইন্ডে স্টোর হয়না। স্বাভাবিকভাবেই সে যখন তার নিজস্ব পারসোনালিটিতে ফিরে আসে তখন কিছুই মনে থাকেনা। অভিমন্যুর ক্ষেত্রে DID থাকার সব উপকরণই আছে। আপনি তো জানেনই ওর হিস্ট্রি। একই দিনে স্ত্রী মণিকা আর মেয়ের সুইসাইড মেনে নিতে পারেনি অভিমন্যু। খুব বাজে প্রভাব ফেলেছে ওটা ওর মস্তিস্কে আর তার থেকেই এইসব ট্রমা, ইনসোমনিয়ার উৎপত্তি। আর তার থেকে Dissociative Identity Disorder হলে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।“
কিংশুক সঙ্গে সঙ্গে বলে “আর সব সিসিটিভি ফুটেজে অভিমন্যুকে অর্ধচেতন অবস্থায় দেখা গেছে। অভিমন্যুও বারবার বলছে ও কিছু করেনি, ওর কিছু মনে নেই, তাছাড়া অভিমন্যুর মত একজন দায়িত্ববান সিনিয়র CID অফিসার সজ্ঞানে এতগুলো খুন করেছে সেটাও আমি ঠিক হজম করতে পারছিনা, আমি তো ওকে পারসোনালিও চিনি।“
এমন সময় চেম্বারের ফোনটা বেজে উঠল। দৌড়ে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করল ডাক্তার। পাছে ফোনের আওয়াজে অভিমন্যুর ঘুম ভেঙে যায়, আর এইসময় ঘুম ভাঙলে অন্য পারসোনালিটিতে চলে যেতে পারে। ফোনটা কেটে গেছে রিসিভ করার আগেই। ডায়ালটা রেখে দিয়ে ফিরে আসতেই আবার বেজে উঠল ফোনটা, আবার রিসিভ করতে গিয়ে দেখে কেটে গেছে। পরপর তিনবার হল এরকম, সবাই অবাক। কিন্তু ভালো কথা, অভিমন্যুর ঘুম ভাঙেনি। একমিনিট পর আবার বেজে উঠল ফোনটা। এবার রিসিভ করে কথা শুনতে পাওয়া গেল, কাটেনি। “হ্যাঁ, কি? এখন নয় পরে।“ বলে ফোনটা রেখে দেয় ডাক্তার।
এদিকে অভিমন্যু জেগে গেছে আর যেমন ভাবা হয়েছিল, অন্য পারসোনালিটিতে চলেও গেছে। কনস্টেবল দুজনকে ডেকে পাঠানো হল। অভিমন্যু বেড থেকে উঠে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছে, হাত–পা ছুঁড়ছে। চারজন মিলে ওকে ধরে রেখেছে বেডের ওপর। কিংশুক স্ক্রিনে Brain Wave এর Anomaly লক্ষ্য করল। ডাক্তার অভিমন্যুকে জিজ্ঞেস করেন “তুমি কে? রাত্রে বেরিয়ে যাও কেন?” অভিমন্যু উত্তর দেয় “আমি Adrasteia। রাত্রে বেরোই ওদের মারতে। ওরা বাঁচতে পারেনা, ওদের শাস্তি পেতেই হবে।“
ডাক্তার কিংশুককে বলেন “পাশের রুমে ড্রয়ারে ফাইলের নিচে স্ট্রং সিডেটিভ আছে, ওটা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন।“ সিডেটিভ নিয়ে এসে কিংশুক দেখে অবস্থা আরও বেগতিক। অভিমন্যু পাগলের মতো হাত পা ছাড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর চিৎকার করে বারবার বলছে “আমাকে ওদের মারতেই হবে, আমি Adrasteia, ওরা বাঁচতে পারেনা। আমাকে এখনি যেতে হবে, স্বপনকে আজ মরতেই হবে।“ কিংশুকের মনে পড়ে স্বপনের নাম ঐ ৯ জনের লিস্টে ছিল। ডাক্তারকে সিরিঞ্জ দিল কিংশুক। ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়ল অভিমন্যু।
অভিমন্যু ঘুমানোর পর এরপর কি করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা হয় কিংশুক আর ডাক্তারের মধ্যে। এখনও পর্যন্ত খুন করতে হাতেনাতে ধরা যায়নি অভিমন্যুকে। শুধুমাত্র Circumstantial Evidence এর ওপর ভিত্তি করে কাউকে খুনি বলা যায়না। হাতেনাতে ধরতে গেলে অভিমন্যুকে খুন করতে যেতে দিতে হবে, কিন্তু ওকে একা ছেড়ে দেওয়াও উচিত হবে না। বলা যায়না কখন অন্য পারসোনালিটিতে এসে আরেকটা খুন করে বসে। তাই পেছনে থাকবে বাকি টিম। ক্রাইমের মুহূর্তে হাতেনাতে ধরতে হবে অভিমন্যুকে। প্ল্যানটা আজ রাতেই কার্যকরী হবে।
কিছুক্ষন পর ঘুম ভেঙে ওঠে অভিমন্যু, এবার নর্মাল পারসোনালিটিতে। ওকে বলা হল একটু আগে কি কি ঘটেছে সব। অভিমন্যুর কিছুই মনে নেই, ও বলে যাচ্ছে আমি কিছু করিনি। যাইহোক পরিকল্পনামতো সন্ধ্যাবেলা অভিমন্যুকে নিয়ে যাওয়া হয় ওর নিজের ফ্ল্যাটে। অভিমন্যু আর ডাক্তারকে ভেতরে পাঠিয়ে বাকি টিমের সাথে বাইরে অপেক্ষা করে কিংশুক।
যুগ্মকলমে ঋতশ্রী সূত্রধর ও রিজু মোদক (পশ্চিমবঙ্গ)
[…] << পর্ব ১ পর্ব ৩ >> […]
[…] << পর্ব ৩ […]