নিউটন আর পুলি

কলমে সোহেল রেজা

0
165

“কি কচ্চ টুমি?”

প্রশ্নটা পড়ার টেবিলের ডান পাশ থেকে ভেসে এলো। কথা বলার সুর ও ভঙ্গি থেকে বোঝা যায় কথাটা এসেছে একটা বাচ্চা ছেলের গলা থেকে, আর সে ঈষৎ তোতলা। জানলার ঠিক পাশেই টেবিলটা। বিকেল পড়ে এসেছে, এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো একটু আগে, ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ বাতাসে ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছে। সারি সারি দুথাক বই রাখা টেবিলের উপর। কোনোটা মলার্ট দেওয়া, কোনওটা বা খালি। একটা পেনস্টান্ড আর একটা টেবিল ল্যাম্পও রাখা আছে, তবে শেষের জিনিসটা বহুদিন ব্যাবহার হয়নি; একপুরু ধুলো তার উপর, বাল্বটাও কেটে গেছে কিনা কে জানে। একটা বিস্কুটের কৌটোও আছে একপাশে, তবে সেটার মুখ বোধয় আলগা কারণ একসারি লাল পিঁপড়ে ভেতরে রাখা গুড়বাদামকে ছেঁকে ধরেছে। আর পাঁচটা সাধারণ পড়ার টেবিলে যা যা থাকে, সেসবই আছে, এই যেমন ছড়ানো ছেটানো পেন-পেনসিল, কটা ছেঁড়া খাতার পাতা, এক তাড়া জেরক্স করা নোট, জেমস ক্লিপ, জলের বোতল, এইসব। তবে যে জিনিসটা একেবারেই বেমানান ক্লাস সেভেনের একটা ছেলের পড়ার টেবিলে, সেরকম একটা জিনিসও আছে। সেটা হল একটা বাঁদর- না না আসল নয়, একটা খেলনা পুতুল, ওই যেমন বাচ্চাদের টেডি বিয়ার হয়, সেরকম। পুতুলটা দু’থাক বইয়ের মাঝে হেলান দিয়ে রাখা।

“উই…কি কচ্চ টুমি?”

আবার এলো প্রশ্নটা। পুলি ঘাড় ঘোরালো না, কারণ সে জানে যেদিক থেকে প্রশ্নটা আসছে সেদিকে কেউ নেই। অঙ্ক কষতে কষতে আনমনেই সে জবাব দিলো-

“অঙ্ক কষছি। তুমি পারো অঙ্ক কষতে?”

“হুম পারি তো! এক এককে এক, দুই দুগুণে চার, পাঁচ দুগুণে সাত…”

পুলি হেসে ফেললো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

“কে শেখাল তোমাকে?”

পুতুলটা বলে উঠলো “ছোতোমামা”

আগের শনিবারের কথা।

“খুকু দেখবি আয় তাড়াতাড়ি” ছোটমামার চিৎকারে পুলিও বেরিয়ে এলো ঘর থেকে; আর বেরিয়ে এসেই চমকে গিয়ে থ! সন্ধ্যে নেমে গেছে সেই কখন, একটু আগে আজান দিলো, কাজেই অন্তত সাতটা তো বাজেই; অথচ আকাশ দেখে সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই। উজ্জ্বল গোলাপি আলোয় ভরে আছে আকাশটা; আর তার বুক চিরে জ্বলন্ত একটা গোলা এমাথা থেকে ওমাথা চলে যাচ্ছে। তারাখসা! ঝপ করে চোখ বুজে পুলি বিড়বিড় করে কি যেন আওড়াল; তারাখসা দেখে কিছু চাইলে সেটা নাকি সত্যিই পাওয়া যায়, এমনটা শুনেছে সে।

“এই জিনিস আগেও একবার দেখেছিলাম আমরা, অনেক বছর আগে, তখন বাবা বেঁচে ছিল। মনে আছে তোর বুলু?” প্রায় ফিসফিস করে মা বলল।

আকাশের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই মুণ্ডুটা দুবার উপর-নিচ করলো ছোটমামা।

কিন্তু চোখ বুজে কি চাইলো পুলি?

যাই চাক সে, এক্কেবারে সেরকম একটা জিনিস না পেলেও তার মতো বা তার চেয়েও ভালো একটা বিকল্প যে সে পেয়ে গেছে, সেটা বুঝল পরেরদিনই। চিলেকোঠার ঘরে পুরনো লাটাইটা খুঁজতে গিয়ে ঘরের এক কোণের মরচে পড়া ভাঙা লোহার ট্রাঙ্কটায় দেখতে পায় জিনিসটা। গায়ে গাঢ় বেগুনী রঙের লোম, ধুলো পড়ে যেটা এখন কালচে বাদামী দেখাচ্ছে, লম্বা একটা লেজ, হাত আর পায়ে দুজোড়া বাদামী গ্লাভস, শরীরের তুলনায় বেমানান রকম বড়ো কান; আর ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্টু হাসি, যেন সবসময়েই কিছু একটা বদমায়েশি ফন্দি আঁটছে মনে মনে। একটা খেলনা পুতুল। ভালো করে ঝাড়পোঁচ করতে গায়ের রং খুললো। জিনিসটা এখনও অক্ষতই আছে, সেলাই কেটে পেটের তুলো বেরিয়ে পড়েনি; কিন্তু অনেক ভেবেও ছোটবেলার এরকম কোনও খেলনা পুতুলের কথা মনে পড়লো না তার। যদিও সেটাতে আশ্চর্যের কিছু নেই; আগেই বলেছি গাছ থেকে পড়ে মাথায় চোট পাওয়ার ফলে ছোটবেলার স্মৃতি বেমালুম মুছে গেছে তার মন থেকে। পুতুলটা নিয়ে এলো পুলি সাথে করে।

আর সেদিনই লাগলো চমকটা!

“টুমি নৌকা বানাটে পালো?” হটাত প্রশ্নটা চমকে দিয়েছিলো পুলিকে। বিছানায় বসে সে একমনে সুডোকু খেলছিল, প্রশ্নটা শুনে এদিক ওদিক তাকাল, দরজা ভেজানো, জানলা বন্ধ; ঘরে তো সে একাই। তাও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে খাটের তলাটা দেখে নিল একবার। কানে কি ভুল শুনল তাহলে? দুবার মাথা ঝাঁকিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো ভ্যাবাচ্যাকা উটপাখির মতো।

“এই দেখো আমান নৌকা” ঠিক আগের মতোই কে একটা বলে উঠলো। যদিও নৌকা কোথাও দেখতে পেলনা পুলি কিন্তু সে বুঝতে পারলো, আর বুঝতে পেরে গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেলো, কথাটা এসেছে তার টেবিলের উপর রাখা জিনিসটার থেকে! কি বলবে, কি করবে ভেবে পেলো না পুলি। আমতা আমতা করে কোনও এক অদৃশ্য নৌকাকে প্রশংসা করার উদ্দেশ্যেই সে বলল- ব…বাহ, বেশ হয়েছে তো।

“আমি পাখি, ব্যান আর উলোজাহাজও বানাতে পালি”

এবার নিশ্চিত, কোনও ভুল নেই; কথাগুলো ওই পুতুলের মুখ দিয়েই আসছে!

হটাত একটা ঘর-সাজানো পুতুল দিব্বি একটা বছর তিনেকের বাচ্চার মতো কথা বলছে- এটা আবিষ্কার করার পর আর পাঁচজন হয়তো ভয়ে আঁতকে উঠত, ভিরমি যেতো চেয়ার উল্টে, কিন্তু পুলির ব্যাপারটা আলাদা। এরপর থেকে রোজই কথাবার্তা হয় ওদের। অবিশ্যি আলাপ আলোচনার বিষয় খুবই মামুলী, এই যেমন কোন বিস্কুটটা দুধে ডুবিয়ে খেতে বেশী ভালো- পারলেজি না মেরি; কিংবা শক্তিমান দিদার আচারের বয়ামের ঢাকনা কষে আটকে দিলে সেটা আর কখনও খোলা যাবে কিনা; অথবা কমলালেবুর দানা খেয়ে ফেললে সত্যিই পেটে গিয়ে গাছ গজাবে কিনা, এইরকম। তিন বছরের একটা বাচ্চার সাথে অবিশ্যি এর থেকে বেশী ভারী কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করাও চলেনা। কতো ভূতের সিনেমায় পুলি দেখেছে মাঝেমাঝে কিরকম বদমাশি শুরু করে এরকম পুতুলগুলো, সারাদিন দিব্বি শান্তশিষ্ট হয়ে বসে থাকে সবার সামনে, কিন্তু রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেই ওদের মধ্যে প্রাণ আসে। অথচ এই পুতুলটাকে কোলে নিয়ে গল্প করতে করতে সেসব কথা একটা বারের জন্যেও কখনও মনে আসেনি পুলির। দিব্বি মজাই লাগে তার ওর সাথে গল্প করতে। পুতুলটাকে হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে পুলি দেখলো মা দিদা আর ছোটমামা আড্ডা দিচ্ছে জমিয়ে।

“হ্যাঁরে কি ওটা?” জিজ্ঞেস করলো মা, দৃষ্টি পুলির হাতের দিকে।

“পুতুল, উপরে ছাদের ঘরে পেলাম।” এক গাল হেসে পুলি বললো। মা দেখতে চাইলে পুলি বাড়িয়ে দিলো সেটা। পুতুলের বাকশক্তির কথা চেপে যাওয়াই ভালো, লোকে হয়তো তাকেই পাগল ভাববে, কিংবা দিদা গুণিন ডেকে ঝাড়ফুঁক করাবে; আর ছোটমামার পাল্লায় পড়লে তো কথাই নেই- পুতুলটাকে কাটাছেঁড়া করে দফারফা করে দেবে। মাঝখান দিয়ে পুতুলটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে পুলির।

হঠাৎ ছোটমামা বলে উঠলো – “আরে এটা সেই পুতুলটা না যেটা সেই জাপানী ম্যাজিশিয়ানটা দিয়েছিলো? খুকু তোর মনে পড়ছে?”

ভূরু কুচকে পুতুলটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে মা বললো – “হুম সেটাই তো মনে হচ্ছে।“

ব্যাপার কি? পুলির চোখেমুখে প্রশ্ন।

ব্যাপার যেটা জানা গেলো, সেটা যেমনই আশ্চর্যের তেমনই মজার। পুলি তখন এইটুকু। সেদিন পুলির তিন বছরের জন্মদিন। কলকাতায় গেছে ম্যাজিক দেখতে। জাপানী ম্যাজিশিয়ান হামাকার শো, বড়মামার বন্ধু ইনি। খেলার শেষে জাদুকরমশাই পুলিকে কোলে নিয়ে তার ম্যাজিক হ্যাট থেকে এই পুতুলটা বের করে উপহার দেন; আর সাথে এও বলে দেন- ঠিক দুদিন পর সন্ধ্যাবেলা একটা গোলাপি আলো দেখতে পাবে আকাশে, আর সেটা দেখা মাত্র পুতুলটার কপালে দুবার টোকা মেরে বলবে ‘মেজামেরু’, তখন থেকেই ও তোমার সবসময়ের সঙ্গী হয়ে যাবে। আশ্চর্য ব্যাপার, হোলও ঠিক তাই। সত্যিই দুদিন পর আকাশে গোলাপি একটা উল্কার মতো জিনিস দেখা গেলো। তা সে যাদুকর মশায়ের ভবিষ্যৎবাণীর জোরেই হোক কি নেহাতই কাকতালীয় ভাবেই, ওই পুতুলটা পাওয়ার পর থেকে সত্যিই বাকি সব খেলনবাটির কথা বেমালুম ভুলে গেলো পুলি। সারাদিন ওর সাথেই খেলা করতো, গল্প করতো, খেতে বসতো, ঘুমাতে যেতো। শুধু তাই নয়, কি কি গল্প হোলো ওর সাথে সারাদিনে, সেটাও পুলি মাকে শোনাত রাতে শুয়ে শুয়ে। ওই বয়সের বাচ্ছাদের এরকম হয়; ছোটমামা নাকি একটা নিবভাঙা কলমের সাথে গল্প করতো ছোটবেলায়।

দিদা মায়ের হাত থেকে পুতুলটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। তারপর বলল-

“হ্যাঁ, এই পুতুলটা তোর খুব পেয়ারের ছিলো। কি আবার একটা নামও দিয়েছিলি ওর। দাঁড়া দাঁড়া…ন দিয়ে শুরু। নটু…নটু…” বলে দিদা মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলো।

“নিউটন!” প্রায় লাফিয়ে উঠে ছোটমামা বলল।

“হ্যাঁ, নিউটন! ঠিক! একবার এই নিউটনকে নিয়ে হল এক কাণ্ড। সেবার আমার বড়ভাশুর, মানে তোর দাদুর বড় ভাই ঘুরতে এসেছে কিছুদিনের জন্যে। তোর বড়মামা তাল পুকুরে জাল ফেলে মস্ত দুটো কাতলা ধরে আনল, এক-একটা প্রায় আধমন তো হবেই। তো সেই মাছ নিয়ে কলতলায় কুটতে যাবো আর দেখি আঙুলের আংটি থেকে পাথরটা কোথায় পড়ে গেছে। হিরের আংটি, বেশ কিছুদিন থেকেই পাথরটা আলগা হয়ে এসেছিলো, তখনই খুলে রাখা উচিৎ ছিলো। কিন্তু এবার কি হবে? ওইটুকু পাথর, তা সে যতই চকমকে হোক, কোথায় খুঁজব এবার? তন্নতন্ন করে রান্নাঘর, বাশনমাজা কল, উঠোন সব খুঁজলাম; কিন্তু পেলাম না। শেষে পুকুরের বাঁধানো সানঘাটে গিয়ে খুঁজতে লাগলাম, একটু আগে শাক বাছতে এসেছিলাম এখানে, হটাত একটা প্যাঁকপ্যাঁক আওয়াজ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি তুই কখন গুড়গুড় করে এসে পুকুরের বাঁধানো ঘাটে দাঁড়িয়েছিস। তুই সারাদিন বাড়িময় করতি বলে ওই প্যাঁকপ্যাঁক করা জুতোটা খুকু পরিয়ে রাখতো তোকে, যাতে বোঝা যায় কোথায় কখন যাচ্ছিস। তো তুই সিঁড়ির উপর থেকেই বললি, কি খুঁচ্ছ দিদা? আমি বললাম। তাতে তুই নিউটনকে দেখিয়ে ঘাড় নেড়ে নেড়ে বললি, এরও দিদার আংটির হীরে একবার হারিয়ে গেছিলো, শেষে কোথা থেকে পেয়েছিল জানো? একটা কাতলা মাছের পেট থেকে। আমি তো হেসেই খুন। তোকে কোলে নিয়ে বারান্দায় দিয়ে এলুম। তুই দাদুর কাছে রোজ সন্ধ্যে বেলা রাক্ষস-খোক্কসের গল্প শুনতি, ভাবলাম সেরকমই কিছু বলছিস হয়তো, ওই মাছের পেটে রাক্ষসের প্রাণ গোছের ব্যাপার। কিন্তু পরে দেখা গেলো সত্যিই ব্যাপারটা তাই। মাছ কাটতে গিয়ে দেখি একটা পাথরের মত জিনিস টপ করে মেঝেতে পড়লো একটার পেট থেকে, ভালো করে ধুয়ে দেখি, ওমা এতো সেই আংটির পাথরটা। কোনও ভাবে পাথরটা আলগা হয়ে মাছের ঝুড়িতে পড়েছিল আর মাছটাও গপ করে খেয়ে ফেলেছে সেটা, আর সেখান থেকে সোজা তার পেটে।”

তিনজনেই হোহো করে হেসে উঠলো, হাসলো না এক পুলি। হাসি তার পাচ্ছেনা, কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম, গলা তার শুকনো। তবে সেটার কারণ শুধু এটাই নয় যে সে নিজে এই কদিন আগে ঠিক এই গল্পটাই পুতুলটাকে শুনিয়েছিল, আরও একটা খটকা রয়ে যাচ্ছে এখানে, আর সেটা ওই ‘নিউটন’ কথাটায়।

নিউটন? ভোলা-ভূতো-হাবা গোছের না হয়ে এরকম একটা আজগুবি নাম কেন হবে পুতুলের? সেটার একটা সম্ভাব্য উত্তর পুলির জানা আছে, আর সেখানেই গোলমালটা; কিন্তু সেটা এতোই অবাস্তব যে তার যুক্তিনিষ্ঠ মন সেটাকে সহজে মেনে নিতেও পারছে না।

ছাদের ঘর থেকে আনার পর পুতুলটা একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল- তোমান নাম কি?

অভিকর্ষ বলের চ্যাপ্টারটার পাতা ওলটাতে ওলটাতে দুষ্টু হেসে পুলি উত্তর দিয়েছিলো- নিউটন।

মায়ের হাত থেকে পুতুলটা নিয়ে টলমল পায়ে পুলি পা বাড়াল পড়ার ঘরের দিকে। মাথাটা তার বনবন করে ঘুরছে, সব ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। সে যখন দরজার কাছে, তখন শুনল মা বলছে-

“নিউটনের আরেকটা কীর্তির কথা তোমরা ভুলে গেলে? সেবার সেই পুরন্দরের মেলার ব্যাপারটা…”

গল্পের বাকিটা শোনার দরকার ছিলোনা পুলির কারণ সে জানে পরের ঘটনাগুলো। গল্পটা এরকম-

রঘুদের ধানক্ষেতের পরে পুরোনো পঞ্চায়েত বাড়ি লাগোয়া যে খোলা মাঠটা আছে, সেখানে এককালে নাকি একটা মেলা বসতো। লোকে বলতো পুরন্দরের মেলা। এরকম বিদঘুটে নাম কেন মেলার, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে মাঠের এক্কেবারে মদ্দিখানে পেল্লায় সব নাগরদোলা ভর্তি জায়গাটায় যেতে হবে যেখানে বড়বড় ব্যানারে লেখা থাকতো ‘পুরান্দার কি খেল’। আর শুধু নাগরদোলা নয়, বিশাল বিশাল দোল খাওয়া ময়ূর, একটা বিশাল গোল টেবিলের উপর সাঁইসাঁই করে ছুটতে থাকা বাটি, যার মধ্যে লোক বসতে পারে; কিংবা প্রায় দুতলা উঁচু আর একটা পুকুরের মতো বড় একটা কাঠের খাঁচা, আর তার মধ্যে হুশহুশ করে পাঁচ-ছটা বাইক ধাক্কা বাঁচিয়ে চরে বেড়াচ্ছে- এইসব আশ্চর্য খেলা দেখতে পাওয়া যেতো ওই মাঝখানের গোল মাঠটায় গেলে; আর সেটাই ছিল মেলার মূল আকর্ষণ। লোকে তাই নাম দিয়েছিলো ‘পুরন্দরের মেলা’। শীতকালে বসতো মেলা। সন্ধ্যে হলেই ঝিকমিক আলো দেখা যেতো ছাদ থেকে, শোনা যেতো হৈহট্টগোল, বাচ্চাদের চেঁচামেচি, যাত্রার মাইক।

মা খুব ভালোবাসতেন নাগরদোলা চড়তে। যত উপরে উঠবে নাগরদোলা মায়ের ফুর্তি ততো বাড়বে। পুরন্দরের মেলা বসলে অন্তত তিনটে সন্ধ্যে ওই নাগরদোলা চড়া চাইই চাই তার। তো এরকমই এক সন্ধ্যেয় পুলিকে নিয়ে মেলায় যাবেন বলে সবে জামাকাপড় বের করছিলেন মা, পুলি বসলো বেঁকে। কিছুতেই যাবেনা সে মেলায়। বাচ্চারা কোথায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে মেলায় যাবে বলে, জেদ করে, আছাড় খায় উঠোনে, সেখানে পুলি কিছুতেই রাজি নয় যেতে। কারণ কি? জিজ্ঞেস করতে জানা গেলো নিউটন নাকি বলেছে ওদের বাড়ির কাছেও মেলা বসতো এরকম, তারপর একবার নাকি নাগরদোলার কলকব্জা বিগড়ে গিয়ে সেটা ভেঙে পড়ে মাঠের মধ্যে, অনেকে জখম হয় তাতে। কিছুতেই বোঝানো গেলনা পুলিকে, শেষে ভ্যা করে কাঁদতেই বসে গেলো তবুও যেতে রাজি হল না। ওদিকে বাড়িতে আর লোকও কেউ নেই, দিদা-মামারা গেছে মাসির বাড়ি, পরেরদিন ফিরবে, কাজেই কার কাছে আর রেখে যাবে তাকে; তাই মাও আর গেলনা।

আশ্চর্যভাবে সেদিনই ঘটলো ঘটনাটা, খবরটা বাড়ি বয়ে দিয়ে গেলো হারুনের মা। শর্ট সার্কিট হয়ে সত্যিই একটা বিশাল নাগরদোলা মাঝপথেই ভেঙে পড়েছে, সাতজন লোক চাপা পড়ে ওখানেই মারা গেছে, আহত হয়েছে আরও অনেকে, মেলা বন্ধ হয়ে গেছে।

বরাতের জোরই বল কি নিয়তির লিখন, সে যাত্রা ধনেপ্রাণে বেঁচে গেছিলো মা-ছেলে। মায়ের মুখেই এই গল্পটা অনেকবার শুনেছে পুলি, আর সেটাই পরশু দুপুরে ছাদে বসে পুতুলটাকেও শুনিয়েছিল।

দরজা ভেজিয়ে দিয়ে কোনওমতে চেয়ারে এসে বসলো পুলি। হাত-পা ঠাণ্ডা বরফের মতো তার, নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ, বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা ধিন ধিন করে নাচছে। পুতুলটাকে টেবিলে রেখে ঠায় একভাবে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। বেগুনী লোমওয়ালা খেলনা বানরটা আর পাঁচটা সাধারণ খেলনার মতোই নির্বাক, নিষ্প্রাণ। কবে কোথায় একটা সিনেমায় দেখেছে এরকম একটা ঘটনা- একটা লোক, যে কিনা একটা গোয়েন্দা, রোজ স্বপ্নে একটা বুড়ো লোককে দেখতে পায়; বুড়ো লোকটা তাকে বলে দেয় কে অপরাধী, কোথায় পাবে তার প্রমাণ। তারপর সিনেমার শেষে দেখা গেলো স্বপ্নে দেখা ওই বুড়ো লোকটা ও নিজেই; পৃথক সময়কালের একই দুটো মানুষের মধ্যে একটা যোগস্থাপন ঘটেছে স্বপ্নের মাধ্যমে। সিনেমায় যেটা ঘটেছিল স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে, পুলির বেলা সেটাই কি ঘটছে এই বেগুনী লোমওয়ালা পুতুলটার ভেতর দিয়ে? আর তাই যদি হয়, ঈষৎ তোতলা তিন বছরের ওই বাচ্চার গলার অধিকারী কি সে…

আর ভাবতে পারলো না পুলি, মাথাটা ভো ভো করছে তার। সেই জাপানী যাদুকর বোধয় সবই জানতেন!

মনের সন্দেহটা সত্যি কিনা সেটা পরীক্ষা করার একটা সহজ উপায় অবশ্য আছে, আর সেটা এতদিন কেনো মাথায় আসেনি সেটাই আশ্চর্যের। যে সহজ প্রশ্নটা পুতুলটাকে অনেকদিন আগেই করা উচিৎ ছিলো পুলির কিন্তু করা হয়নি কারণ সেটা করার পেছনে কোনও যুক্তি খুঁজে পায়নি সে এতদিন, আজ সেটাই করলো। দুবার গলা ঝেড়ে প্রায় ফিসফিস করেই পুলি জিজ্ঞেস করলো-

“কি নাম তোমার?”

এক মুহুর্ত সব চুপ, জানলা দিয়ে সন্ধ্যের ফুরফুরে হাওয়া ঘর ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। বাইরে এখনও মা-দিদারা আড্ডা দিচ্ছে, তাদের হোহো হাসির শব্দ বন্ধ দরজার পেছনেও শুনতে পাচ্ছে পুলি। এমন সময়ে ভেসে এলো কথাটা। একটা বাচ্চা ছেলের গলা, কিঞ্চিৎ সর্দি বসা।

“আমান নাম পুলি…পুলিন বিশ্বাস”

পুলির খুব শখ ছিল তারও একটা ভাই থাকবে- এই যেমন বড়মামা-ছোটমামা, কিংবা ওদের ক্লাসের পল্টু আর বোল্টু। মাঝেসাঝেই বেশ করে কানে মোচড় দেবে, ‘তোকে ড্রেন থেকে কুড়িয়ে আনা’ বলে খ্যাপাবে, বিকেলবেলা হুজ্জুতি করে লুডো কি ক্যারামে হারিয়ে দেবে, আবার স্কুল ফেরত লজেঞ্জ কিনে আনবে কিংবা একইরকম জামা-জুতো পরে ঘুরতে যাবে- এরকম কতো শখ ছিল পুলির ভাইকে নিয়ে। তারাখসা দেখে চোখ বুজে পুলি তাই বিড়বিড় করে বলেছিল- “আহা একটা যদি ভাই থাকতো আমার!”

কে জানতো তার মনোবাঞ্ছা এইভাবে পূর্ণ হবে! 

কলমে সোহেল রেজা

Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here