<< পর্ব ১

কিংশুক ভাবতে বসল, কি এমন পাপ করতে পারে কেউ যার কোনো পুলিশ রেকর্ড থাকেনা, অথচ সেই পাপের গম্ভীরতা এতটাই বেশি যে তার শাস্তি হিসেবে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। কী এমন পাপ হতে পারে যা আইনের চোখে অপরাধ নয় অথচ তার জন্য শাস্তি পাওয়া উচিত। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ উত্তর খুঁজে পেল কিংশুক, সুইসাইড। কেউ সুইসাইড করলে তার মৃত্যুর জন্য কাউকে দোষী বিচার করে কোনো আইনি দণ্ড দেওয়া হয়না, কিন্তু প্রত্যেকটা সুইসাইডের পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে আর কিছু ক্ষেত্রে সেই কারণ হয়ে থাকেন কোনো ব্যক্তি। অর্থাৎ নিজে হাতে খুন না করলেও সেই ব্যক্তির কারণে চাপে পড়ে অন্য কেউ সুইসাইড করলে যদি কোনো প্রত্যক্ষ বা পোক্ত প্রমাণ না থাকে তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই সুইসাইডের কারণ হিসেবে তাকে কোনো সাজা দেওয়া হয়না অথচ সেই হয়ে ওঠে মৃত্যুর প্রধান কারণ। একজন নেমেসিসের জন্য এটাকে পাপ হিসেবে গণ্য করা যথেষ্ট যুক্তিসংগত।

                              এইসব ভেবেই সেদিন সন্ধ্যাবেলা কিংশুক পুরোনো পেপার নিয়ে বসল সুইসাইড কেস খুঁজতে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেল এমন কিছু কেস যা তার ধারণার সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।

                              এক মহিলা, স্বামী রিক্সাচালক আর সে নিজে পরিচারিকা, অতিকষ্টে দিন চলে তাদের। একদিন রিক্সা চালাতে গিয়ে স্বামী ভয়াবহ এক্সিডেন্টে কোমায় চলে যায়। স্বামীর চিকিৎসার জন্য স্ত্রী হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় টাকা জোগাড় করতে। ব্যাঙ্কে লোন চেয়েও পায়নি। চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে না পেরে দুই বাচ্চা সমেত নিজেও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে মহিলা। মহিলাকে লোন না দেওয়া ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আর কেউ নয়, আশুতোষ রায়। নিজেকে নেমেসিস মনে করা খুনি কি তবে এটাকেই আশুতোষবাবুর পাপ হিসেবে গণ্য করে তার শাস্তি দিয়েছে! তাহলে তো বাকি দুজনেরও কোনো না কোনো ঘটনা থাকবে। পেপার ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরও খবর খুঁজে পেল কিংশুক। সেগুলোও সুইসাইড কেস।

                            স্কুল টিচার বিকাশবাবু এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী পকেটে ফোন নিয়ে পরীক্ষা দিতে বসার অপরাধে তার পেপার ক্যান্সেল করে দেন। পরীক্ষার্থীর দাবি ছিল, পকেট থেকে ফোন বের করতে ভুলে গেছে সে, পরীক্ষা চলাকালীন ফোন ব্যবহার করেনি। মানতে নারাজ বিকাশবাবু কোনো কথা না শুনে তৎক্ষণাৎ তার পেপার ক্যান্সেল করে দেন। পরীক্ষার্থী সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়ে চারতলার বারান্দা থেকে নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। পরে যদিও তার ফোনে কোন ছবি বা মেসেজ খুঁজে পাওয়া যায়নি যা সে টুকলি হিসাবে ব্যবহার করতে পারত।

                       বাকী থাকল শুভ্রতনুবাবুর ঘটনা। তাঁর অফিসের একজন কর্মচারীকে খুব সামান্য এক ভুলের কারণে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেন তিনি। আর সেইসময়ই সেই কর্মচারীর টাকার ভীষণ প্রয়োজন ছিল, বাবা মা অসুস্থ আর বোনের বিয়ের জন্য পণের জোগাড়, সব দায়িত্ব ছিল তার মাথায়। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তার কথায় কর্ণপাত করেননি শুভ্রতনুবাবু। সেদিনই রাতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে সেই কর্মচারী।

                      তিনটে আত্মহত্যার খবরই পেপারে বেরিয়েছিল আর তাতে ভিক্টিমদের নামও ছিল। বেশ ভালোমতোই চর্চিত হয়েছিল ঘটনাগুলো সেইসময়। আলাদা আলাদা বছরে ঘটেছে এইসব ঘটনা। অর্থাৎ ভিক্টিম তিনজনের প্রত্যেকের কারণেই কেউ না কেউ সুইসাইড করেছে অথচ তাদের কোনোরকম সাজা হয়নি। খুনির মতে তারা প্রত্যেকেই শাস্তির যোগ্য আর তাদের প্রাপ্য শাস্তি দিতেই খুনগুলো করেছে এই নেমেসিস। আর মারা যাওয়ার মুহূর্তে তাদের জীবনের সবথেকে বড়ো ট্রমাটিক ঘটনাগুলো ভেসে উঠেছে যেগুলোর কারণে হয়তো তারা অনুতপ্তও ছিল। এইসব পাপের চিন্তা করতে করতে পাপের ভারে দাঁড়িপাল্লা গেছে ভেঙে অর্থাৎ ব্রেন ব্লাস্ট করেছে। আর এইসব করানোর জন্যই এত ব্যবস্থা করেছে খুনি।

                      রোমহর্ষক এত কিছু আবিষ্কার করে ফেলে কিংশুক আর ধৈর্য রাখতে পারলনা, কল করল অভিমন্যুকে। অভিমন্যুর ফোন সুইচড অফ। কিছুক্ষণ পর আবার করল, এবারেও তাই। চিন্তায় পড়ে গেল কিংশুক। বারবার ফোন করতে থাকল কিন্তু সারারাত একই জিনিস। চিন্তায় কিংশুকের অবস্থা খারাপ। পরদিন সক্কাল সক্কাল অভিমন্যুর ফ্ল্যাটে উপস্থিত কিংশুক। বেশ কয়েকবার ডোরবেল বাজানোর পর দরজা খুলল। ঘুমন্ত চোখে সামনে দাঁড়িয়ে অভিমন্যু। হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচল কিংশুক।

                      ফোনটা সুইচড অফ কেন? কতবার ফোন করেছি জানিস? আমার তো প্রাণ বেরিয়েই যাচ্ছিল।বলতে বলতে ভেতরে ঢুকল কিংশুক।

ওহ ফোনটায় বোধহয় চার্জ নেই, তাই সুইচড অফ হয়ে গেছে। আচ্ছা বোস, আমি চা করে আনিবলে চা বানাতে গেল অভিমন্যু। চা খেতে খেতে কিংশুক তার সদ্য আবিষ্কার করা তথ্যগুলো বলল অভিমন্যুকে।

কাল রাতেই তোকে ফোন করে বলতাম সবটা।

কাল রাতেও ঘুম হয়নি জানিস। ভোরবেলা কখন যে ঘুমিয়েছি জানিনা। তোর ডোরবেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙল। কয়েকদিন থেকে ইনসোমনিয়াটা বেড়েছে।কিছুটা হতাশাগ্রস্ত স্বরে অভিমন্যু বলে।

কিংশুক জিজ্ঞেস করেকেন ডাক্তারের ওষুধে কাজ করছেনা?“

ডক্টর সিকদার বলেছেন সময় লাগবে, তবে আগে যেরকম পুরনো সিনগুলো দেখে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেত সেটা এখন আর হয়না। এইজন্য উনি প্রতিদিন সেশনে যেতে বলেন। ওখানে অন্তত আমি একটু শান্তিতে ঘুমাই।

কীভাবে ঘুম পাড়ান? ইঞ্জেকশন দিয়ে?“

না না, হিপনোটাইজ করে।বলে চায়ে শেষ চুমুক দেয় অভিমন্যু। যাইহোক চা টা খেয়ে রেডি হয়ে দুজনে নীচে নেমে এল অফিস যাওয়ার উদ্দেশ্যে। অভিমন্যুর মনে পড়ল একটা ফাইল আনতে ভুলে গেছে।তুই বাইকটা স্টার্ট কর, আমি ফাইলটা নিয়ে আসছি।বলে অভিমন্যু ওপরে চলে গেল ফাইল আনতে। নীচে দারোয়ানের সাথে দেখা কিংশুকের। দারোয়ান কিংশুককে দেখেই জিজ্ঞেস করে

আপনারা কি রাতেও কাজ করেন স্যার?“

কই না তো, কেন?“

স্যার তো মাঝেমধ্যেই রাতে বেরিয়ে যান দেখি। আমি ভাবতাম হয়তো আপনারা রাতে কাজ করেন। তবে স্যার কোনোকিছু না নিয়ে খালি হাতেই বেরিয়ে যান।

রাতে কেন বেরোয় অভিমন্যু?“ কিংশুকের মনে সন্দেহ জাগে। খুনগুলো তো সব রাতেই হয়। তবে কি——!!!“

মেন এক্সিটের ওপরে দুটো সিসিটিভি ক্যামেরা চোখে পড়ে কিংশুকের।

আচ্ছা সিসিটিভি ফুটেজ দেখাতে পারবে আমাকে?” দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে কিংশুক।

নিশ্চয়ই স্যার, আসুন।বলে কিংশুককে ফুটেজ দেখাতে নিয়ে যায় দারোয়ান। ফুটেজ দেখে তো কিংশুক যারপরনাই আশ্চর্য। যেদিন যেদিন খুনগুলো হয়েছে, সেই দিনগুলোতেই খুনের সময়ের ঠিক একঘণ্টা আগে অভিমন্যুকে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে, কেমন যেন অর্ধচেতন অবস্থায়। এমন সময় কিংশুকের ফোন এল। রিসিভ করতেই অভিমন্যুর গলাকি রে কোথায় গেলি? আমি তো বাইকের কাছে চলে এসেছি।

তোর পেছনেই তো গেছিলাম। আসছি দাঁড়া লিফটে আছি।বলে ফোনটা কেটে দেয় কিংশুক।

কিংশুকের মনে সন্দেহ গভীর হয়। এতবড়ো প্রমাণ তো এড়িয়ে যাওয়া যায়না। অভিমন্যুকে তখনই কিছু বলল না কিংশুক, ওর মাথায় তখন অন্য প্ল্যান। ভাবল অফিসে গিয়ে অভিমন্যুকে একটু ঘাঁটিয়ে দেখবে, কোনো ইনফরমেশন বের করতে পারে কিনা। এখন কিছু বুঝতে দিলে চলবেনা। হাতেনাতে ধরার ফন্দি আঁটে কিংশুক।

                          অফিস গিয়ে দুজনে ভালোভাবে আলোচনা করল কেসটা নিয়ে। যতরকমভাবে সম্ভব অভিমন্যুকে ঘাঁটিয়ে দেখে নিল, কিন্তু সন্দেহজনক কোনো তথ্যই বেরোলনা। দুজনে বসে গত ২০ বছরের সমস্ত পেপার ঘেঁটে খুঁজতে থাকল এরকম আর কত সুইসাইড কেস আছে যেগুলোর জন্য অন্য কেউ দায়ী কিন্তু সে কোন সাজাই পায়নি আর খুব সাধারণ জীবনযাপন করে। ২০ বছরের পেপার ঘেঁটে এরকম টা কেস খুঁজে পেল ওরা। তাদের একটা লিস্ট বানিয়ে তাদের মধ্যে কানেকশন খোঁজার চেস্টা করতে থাকল। লিস্টের মধ্যে তিনজন ভিক্টিমও আছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কোন লিঙ্ক নেই। ঘটনাগুলোর মধ্যে বছরের ব্যবধান। র‍্যান্ডমলি সিলেক্ট করা হয়েছে ভিক্টিমদের, কোন এক্স্যাক্ট প্যাটার্ন নেই। কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজির পর অভিমন্যু বলে ওঠে

নাঃ! এভাবে তো কিছু পাওয়া যাচ্ছেনা। তার থেকে বরং চল আমরা ভিক্টিমদের জন্য যারা সুইসাইড করেছিল তদের পরিবার বন্ধুবান্ধবদের সাথে কথা বলে আসি। হতে পারে তাদের মধ্যেই কেউ করছে খুনগুলো। তাছাড়া খুনির ভিক্টিম নির্বাচনের পদ্ধতিতেও আলোকপাত হতে পারে।

কিংশুকও সহমত অভিমন্যুর কথায়। দুজনে বেরিয়ে পড়ল।

 

যুগ্মকলমে ঋতশ্রী সূত্রধররিজু মোদক (পশ্চিমবঙ্গ)

 

<< পর্ব ১                                                                                                                    পর্ব ৩ >>


                        

2 COMMENTS

  1. বেশ সুন্দর চলছে। ভালো লাগলো । উপস্থাপনা খুব ভালো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here