পশ্চিম দিগন্তটা এখন লালে লাল। শারদীয়া মেঘের উপর অস্তগামী সূর্যের রক্তিম রাগে আকাশে যেন রঙের ছড়াছড়ি।
    পশ্চিমে যখন রঙের খেলা চলছে তখন তার ঠিক বিপরীতে মুখ ক’রে গুরুতর আলোচনায় মগ্ন সমীর ও তার অনীলদা। দু’দিন পরেই সমীরের পি.এস.ইউ. সেলের ইন্টারভিউ। এর আগে চার-পাঁচটি এরকম পরীক্ষায় বসেছিল সে। প্রায় প্রতিটাতেই রিটেন ক্লিয়ার ক’রে ইন্টারভিউয়ে আটকে গেছে। ছাত্র হিসাবে কোনোকালেই খারাপ ছিলনা সমীর। কিন্তু চাকরির পরীক্ষা যে স্কুল-কলেজের পরীক্ষার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং এখানে ইন্টারভিউয়ে যে এতোটা বেগ পেতে হয় রিটেনের পরে – এই ধারণাটা তার তেইশ বছরের জীবনে ছিল না ।তাই জলপাইগুড়ি ইন্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ক্যাম্পাসিং-এ পাওয়া সফ্টওয়ারে না ঢোকার সিদ্ধান্তে তাকে যে এত কাঠখড় পোড়াতে হবে তা সে ভাবেনি।

    অনীলদা সমীরের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ো। সে থাকে প্রায় ছ’কিলোমিটার দূরের গ্রামে। বাবারা ছিলেন বাল্যবন্ধু। সেই সূত্রে সমীরের বাড়িতে অনেকবার এসেছে সে। তারপর দু’জনে বড়ো হলো । অনীলদা শিবপুর থেকে যে বছর ইন্জিনিয়ারিং পাশ করলো সে বছরই মাধ্যমিক দিল সমীর। সায়েন্স নিয়ে প’ড়ে ইন্জিনিয়ারিং করার প্রেরণা অনীলদার থেকেই পায় সে । অনীলদার ছিল ইলেকট্রিকাল আর সমীরের ইলেকট্রনিক্স। ক্রমশ সম্পর্কটা বয়সের পার্থক্যের বাধা পেরিয়ে বন্ধুত্বের পর্যায়ে আসে। 
    অনীলদা কলেজ থেকে বেরিয়েই সেলে ‘ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি’ পরীক্ষা দিয়ে পেয়ে যায়।
    তার আগে থেকেই অবশ্য সমীরের প্রায় ‘আইডল’ হয়ে উঠেছিল সে। হওয়ার মতো গুণও ছিল তার। পড়াশোনা ছাড়াও অনেকরকম তাসের ম্যাজিক জানতো সে। তার উপর অন্যের কন্ঠস্বর নকল করা, ফুটবল, সাঁতার, দাবা, আবৃত্তি এরকম অনেক বিষয় সে ভালোভাবে আয়ত্ত করেছিল। কতকটা অনীলদাকে দেখেই সমীর মনে মনে ঠিক করেছিল সফ্টওয়ারে না গিয়ে পি.এস.ইউ. তেই চেষ্টা করবে।

    অনীলদা বছরের মধ্যে অন্তত চারবার গ্রামে আসে। আসলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভর সমীরের সাথে দেখা করে। উৎসাহ দেয় তাকে।

   যে বিকালের কথা বলা হচ্ছে তখন তাদের মধ্যে আগামী পরশুর সেলের ইন্টারভিউ নিয়ে কথা চলছিল। অনীলদার কোম্পানীর ইন্টারভিউ ব’লে কথা! সমীর তাই যেন একটু বেশী উত্তেজিত ও চিন্তিত।

     “অনীলদা, এটা নিয়ে পাঁচ নম্বর”।   
    
     “তাতে কি? এখনো তো একবার ক’রেও সমস্ত পি.এস.ইউ. গুলো দেওয়া হয়নি”।
   
    ”আইডিল বসে আছি। এই নিয়ে জিজ্ঞাসা তো করছেই ইন্টারভিউয়ে” ।                          
   
   “আরে সবে তো কয়েকমাস হয়েছে। এখনো ওসব ভাবার মতো সময় হয়নি । এগুলো ভেবে কোনো নেগেটিভ থটস্ মুখের উপরে আনবি না। ইন্টারভিউয়ে এগুলো ম্যাটার করে”।                    
    “কিন্তু শুধু চাকরির পরীক্ষা দেওয়া ছাড়াও আরেকটা কিছু তো করতে হবে।”                
    “তা তুই তো গেটের জন্য অ্যাপ্লাই করছিসই। এম.টেকে অ্যাডমিশনের পরও তুই এই পরীক্ষাগুলো দিতে থাকবি। তখন আর ইন্টারভিউয়ে কেউ জিজ্ঞাসাও করবে না কেন তুই ‘আইডিল’ ছিলি। তবে ওতো কিছু ভাবতে হবে না। তোর ঠিক এটাতেই হয়ে যাবে।”

      অনীলদার অনুপ্রেরণা যোগানোর টেকনিকটা দারুণ। সে বলে- 
   “দেখ্। ইন্টারভিউয়ে যাবি একেবারে নির্ভয়ে। সেখানে তুই যাচ্ছিস কিছু পেতে । কিছু খোয়াতো নয়। তুই যদি কিছু বলতে নাও পারিস কেউ তোর মোবাইলটা বা ঘড়িটা নিয়ে নেবে না।’ আরো বলতো – “ইন্টারভিউয়ে যেটা সবচেয়ে বেশী ম্যাটার করে সেটা তুই কতোটা জানিস তা নয়। তুই কতোটা এক্সপ্রেস করতে পারিস সেটা। গ্রামের ছেলে ব’লে ভাববি না যে তোকে সিলেক্ট করবে না। তাই নিজের উপরে বিশ্বাস কখনো কমাবি না।”

অনীলদা ব’লে যেত আর সমীর তন্ময় হয়ে সেগুলো আত্মস্থ করার চেষ্টা করতো।

ইন্টারভিউ হয়ে গেল। জিডি আর ইন্টারভিউ দুটোই বেশ ভালো হয়েছে সমীরের এবারে। অনীলদাও খুব খুশী।    
“পরের বার যখন গ্রামে আসব কাকীমার কাছে বড়োসড়ো ট্রিট নেব।”                                    

“কতোদিন লাগে ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট বেরোতে, অনীলদা?”

“ঠিক নেই । আমাদের বারে তো ম্যাসিভ টাইম লেগেছিল। প্রায় চারমাস।  তবে তুই সময় নষ্ট করিস না । গেট এবং নেক্সট পি.এস.ইউ. এক্সাম গুলোর উপর কনসেনট্রেট করিস।”

                          ———————-                              
     আড়াই মাস পরের কথা। ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট বেরিয়েছে। সমীর সিলেক্টেড হয়েছে। সকালেই ইন্টারনেটে সিলেক্টেড ক্যানডিডেটদের নাম ডিসপ্লে করেছে। ঘরে বসেই ইন্টারনেটে দেখছে সমীর সেটা। নিজের চোখ দুটো একবার কচলে আর একবার দেখলো সমীর। না, ভুল হয়নি। এইতো , ইলেকট্রনিক্সের সিলেক্টেড ক্যানডিডেটগুলোর মোটামুটি মাঝামাঝিতে সমীর হালদারের নাম। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর সমীর প্রথমেই ফোন করলো অনীলদাকে। স্বভাবতই, অনীলদা খুব খুশী।           

     “তাহলে ট্রিটরা রেডি রাখছিস তো যখন আসবো।”

     “সে আর বলতে । কিন্তু আসছোটা কবে?”
       
     “এই শীতেই একবার আসতে হবে। বাবার অবস্থাও তো জানিস। আচ্ছা, এখন ছাড়তে হচ্ছে রে। মর্নিং সিফ্টে আছি আর একটা ব্রেকডাউনও আছে এখন। ফ্রি হলেই ফোন করছি তোকে।”

       সারাটা দিন একটা অদ্ভুত এবং অভূতপূর্ব অনুভূতির মধ্যে দিয়ে গেল। যে ক’জন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ ছিল এক এক ক’রে ফোন করলো সমীর। অভিনন্দনবর্ষণ করলো প্রচুর সবাই। বিকালের দিকে ভাবলো সাইকেলে ক’রে একবার ঘুরে আসে অনীলদার বাড়ি। কিন্তু সেদিন নিজের বাড়ি এবং প্রতিবেশীদের হাত থেকে পারলো না সে সময় বের করতে। রাতে আরেকবার অনীলদাকে ফোন করলো সমীর । কিন্তু ওদের গ্রামে রাতের দিকে নেটওয়ার্ক কেন এতো গন্ডগোল করে কে জানে? ফোনটা লাগলই না কয়েকবার চেষ্টা সত্ত্বেও।
                         ——————             
    
        খবরের কাগজ এখন ওদের গ্রামেও সকাল ১০টার মধ্যে চলে আসে । সমীর দেখলো তাতে ষষ্ঠ পাতায় খবর আছে —- মর্নিং সিফ্টে বোকারো স্টিল প্ল্যান্টে হট মেটাল সহ লেডেল উল্টে ৩ জনের মৃত্যু। একজন এক্সিকিউটিভও আছেন তাতে। নাম অনীল সরকার।

কলমে আশিক মুন্সী, দুর্গাপুর

কবিতা, ছোটগল্প, অণুগল্প লেখার বিষয় প্রধানত। অনেকগুলি লেখা বিভিন্ন অনলাইন ও অফলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে দুর্গাপুরের অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্টে আধিকারিকের পদে কর্মরত। লেখালেখির বাইরে দাবা খেলা, সাঁতার ও আবৃত্তি পছন্দের বিষয়।

3 COMMENTS

Leave a Reply to Ayan Bhattacharya Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here