মধুচন্দ্রিমাতে দার্জিলিংয়ের কাছে এই স্বল্প পরিচিত গ্রামটাতে আসার প্ল্যানটা সুমিতেরই। ওদের দুজনের  মানে ওর আর ঐশীর বিয়ে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে। ঐশী একটু মুখচোরা,সুমিত প্রগলভ। যেদিন প্রথমবার দেখা করেছিল সুমিত সেদিনই অনেককিছু বলে দিয়েছিল ঐশীকে। ওর সততা ঐশীর মন ছুঁয়ে যায়। ঐশীর কিছুটা সময় লেগেছে। সুমিতও খানিকটা ঐশীর স্বভাব বুঝে ওকে সময় দিয়েছে। বিয়ের আগে তিনবার দেখা করেছে ওরা। যদিও শেষদিকে ফোনে প্রায় রোজই কথা হতো। তখনই প্রস্তাবটা দেয় সুমিত ওকে। ঐশীকে অস্বস্তিতে না ফেলার জন্য মধুচন্দ্রিমা শব্দটা ব্যবহার করেনি সুমিত ।শুধু বলেছিল ঘুরতে যাবে। সুমিতের এই ব্যাপারগুলো ঐশীর খুব ভাল লেগেছে। এই ছোট ছোট বোঝাপড়াগুলো আসলে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের ভিত। 
তারপর যথাক্রমে বিয়ে,বৌভাত, তারপর থেকে বেশ কিছু আত্মীয়র বাড়ি নিমন্ত্রণ ,অষ্টমঙ্গলা ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যে ঐশী একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ওর ইচ্ছে ছিল আরেকটু সহজ হয়ে তারপর শারীরিকভাবে সুমিতের কাছে যেতে। সুমিত সেটা বুঝেছে। স্বামীর অধিকার প্রয়োগের চেষ্টা কখনোই করেনি।সেইজন্য শ্রদ্ধায় ভরে গেছে ঐশীর মন। ঐশী ঠিক করেছে মধুচন্দ্রিমার প্রথমদিনে অনেক গল্প করবে আর সুমিতের অপেক্ষার সম্মান রেখে নিজেও এগিয়ে আসবে  সহজ হতে।  এইকথাগুলো ভাবতেই ঐশীর কানটা লাল হয়ে গেছিল। ঠোঁট টা অজান্তেই কেঁপে উঠছিল৷সুমিতের আগে জীবনে কখনো কোনো পুরুষ আসেনি ঐশীর ৷
কিন্তু ও যদি জানতো কী অপেক্ষা করে আছে ওর জীবনে!!
 বাগডোগড়া পৌঁছে কফি আর স্যান্ডউইচ দিয়ে প্রাতরাশ সেরে আর একফ্লাস্ক কফি আর হালকা কিছু স্ন্যাকস নিয়ে ওরা রওনা দিলো গন্তব্যে। সুমিতের ব্যাবস্থাতে কোনো ছেদ নেই। এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ি তৈরি ছিল আগে থেকেই। ড্রাইভার স্থানীয় লোক, নাম গোপাল সিং। আদিবাড়ি নেপালে কিন্তু তিন পুরুষ ধরে শিলিগুড়িতে।  তিরিশ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন।  পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষটার কথাবার্তায় স্নেহ আর আন্তরিকতার ছোঁয়া। ঐশীকে শুরু থেকেই মা বলে ডাকছেন। একটু অবাঙালী টান থাকলেও বাংলাটা বেশ ভাল বলে । গল্প করতে করতে গাড়ি চলছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে এঁকে বেঁকে । এক অজানা আনন্দে,খুশিতে শিহরণে মন ভরে যাচ্ছে ঐশীর মন। সুমিত তো এমনিতেই হইহই করতে ভালবাসে। এই এখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তোলে, এই একগোছা তাজা ফুলের মত স্কুলফেরত পাহাড়ি বাচ্চাদের সাথে গিয়ে সেল্ফি তুলে তাদের প্রত্যেককে চকলেট দিয়ে সবার থেকে একটা করে হামি নিয়ে ফিরে আসে। সুমিতের ছেলেমানুষি ঐশীর খুব ভাল লাগছে। ওরও ইচ্ছে করছে ছেলেমানুষি করতে কিন্তু ওর স্বভাব ওকে আটকাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে বাবামায়ের শাসনে শুধু পড়াশোনা আর বাবামায়ের সাথে ঘুরতে যাওয়া। ঐশীর কখনোই কোনো বন্ধু ছিলনা সেই অর্থে।,শুধু পরিচিত ছিল। ঐশী শুধু পড়েছে আর স্বপ্ন দেখছে।আজ যেন ওর মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা বাচ্চাটা তার সমস্ত উচ্ছাস নিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। পেটের মধ্যে সোডা বোতলের মত গুড়গুড় করছে অনেক  ইচ্ছে। যেকোনো সময় যেন উছলে পড়বে। এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওরা সাথে আনা কফি খাচ্ছিল।হঠাৎ সুমিত পাহাড়ের গা থেকে একটা নাম না জানা হলুদ ফুল এনে ওর চুলে গুঁজে দিতেই কী যেন হয়ে গেল। হঠাৎ সুমিতের গলা জড়িয়ে একটা চুমু খেয়েই ঐশী একদৌড়ে গাড়িতে উঠে পড়লো। সুমিতের কিছুক্ষণ সময় লাগলো ব্যাপারটা হজম করতে। তারপর ওর চোখেমুখে একটা আনন্দ খেলে গেলো। রাস্তার ধারে একটা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো 
– আই লাভ ইউ ঐশী।
কথাগুলো যেন সমস্ত অববাহিকায় ছড়িয়ে গেলো  সাথে সাথে। ঐশীর শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ । ওদের কান্ড দেখে গোপালের মুখে হাসি৷ঐশীর যেন আজ সবকিছু একটু বেশীই ভালো লাগছে ৷
 জায়গাটা খুব সুন্দর। মিম চা বাগান থেকে একটু দূরে একদম নিরালায় এই হোমস্টেটা। “সুমিতের আয়োজনের সত্যি কোনো তুলনা নেই”  মনে মনে আবার ভাবে ঐশী  ।
পুরো হোমস্টেটাতে চারটে ঘর। বড়ো বড়ো কাঠের ঘর, কাঠের মেঝে, দেওয়ালে ঝোলানো কিছু জন্তু জানোয়ারের ট্রফি, ঘরগুলোর সামনে পিছনে বারান্দা আর সামনে একটা বিরাট উঠোন। উঠোনে বসলে মিম চা বাগানটা পুরো দেখা যায়। পাহাড়ের গায়ে থাক থাক করে উঠে গেছে চা বাগান। অন্যদিকে পাহারগুলোর ফাঁকে মেঘের ওঠানামা। উঠোনের এক প্রান্তে হোমস্টের মালিক আবেশ থাপার দোতলা ঘর। আবেশ দাজু তার স্ত্রী ভূমিকা আর ছোট প্রজাপতির মত চনমনে মেয়ে আস্রার সাথে থাকেন উপরের তলায়। নীচের তলায় রান্নাঘর আর খাওয়ার জায়গা।  পুরো জায়গাটা ঝকঝকে পরিষ্কার। রান্না ভূমিকা ভাবী নিজেই করেন। অন্যান্য কাজ করার জন্য দুটো লোক আছে। তারা ওই খাওয়ার ঘরে রাতে শোয়। এখন হোম স্টেতে ওরা ছাড়া আর কোনো গেস্ট নেই।
উঠোনে বসে আকাশ দেখছিল ঐশী। সামনে ছোট চায়ের শিকড়ের টেবিলে বোন চায়নার কেটলিতে চা দিয়ে গেছে।  সুমিত ঘরে ফ্রেশ হচ্ছে। এক অদ্ভুত আনন্দ জড়িয়ে ধরছে ঐশীকে। মনে হচ্ছে সুমিতকে জড়িয়ে এখানে বসে থাকতে পারে জন্ম জন্মান্তর। হঠাৎ একটা মিষ্টি ছোঁয়ায় সম্বিত ফিরলো। আস্রা এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে। ছোট কিন্তু খুব উজ্জ্বল চোখ। আস্রাকে কোলে টেনে নিল ঐশী। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে দু চার কথা বলে ওদের কুকুর ভুটিয়ার সাথে খেলতে দৌড় দিল আস্রা। ঠিক যেন ফুলের বনে একটা প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে।
– ঠিক এরকম একটা মিষ্টি প্রজাপতি আমারও চাই কিন্তু – অসভ্য। কখন এলে তুমি?
সুমিতের কথায় লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেলেও সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে।
– এইতো এলাম। দেখলাম তুমি মায়ের চোখে তাকিয়ে আছো ওর দিকে। ওর সৌন্দর্য্যটা এই পরিবেশের থেকে পাওয়া। আমরাও এখানে চেষ্টা করলে হয়তো ওর মতই হবে।- মারবো কিন্তু। 
কপট রাগ দেখায় ঐশী।
–উঁহু সে মারো ধরো যাই করো, তারজন্যও কিন্তু কাছে আসতে হবে ৷তখন আর ছাড়বো না 
ঐশী লজ্জায় লাল হয়ে যায় ৷
সেইদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ঐশীর জীবনে এক নতুন সন্ধিক্ষণ আসে। প্রথমবার আগুনের আদরে গলে পড়া মোমের মত পরতে পরতে জমতে থাকে সুমিতের ভালবাসা। এই শীতেও সুমিতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঐশীর সাধ করে পরা সিঁদুরের টিপটা ঘাঁটা। 
– আমাদের মেয়ে হলে তার নাম দেবো আস্রা। 
বলেই কম্বলের তলায় মুখ লোকায় ঐশী। আনন্দে সুমিত আবার মিশে যায় অববাহিকায়।
রাত তখন গভীর। হঠাৎ একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় ঐশীর। গেটের ছিটকিনিটার আওয়াজ। এত রাতে কে? ঘড়িতে রাত তখন তিনটে। সুমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে বড়ো মায়া হলো। শিশুর মত ঘুমাচ্ছে। হাড় কাঁপানো শীতেও বিছানা থেকে নেমে আস্তে আস্তে কাঁচের জানলার পর্দাটা ফাঁক করলো। না কেউ কোথাও নেই বাইরে। চিন্তিত মুখে এসে শুয়ে পড়লো আবার।
 পরদিন সকালে একটা গন্ডগোলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে ওদের।বাইরে খুব চিৎকার হচ্ছে। ভালো করে গরম কাপড় জড়িয়ে বাইরে এসে ওরা দেখলো গেটের বাইরে একটা জটলা। অনেক লোক জড়ো হয়ে আছে। পায়ে পায়ে কাছে যেতেই
– ওহ মাঃ 
বলে সুমিতের বুকে মুখ গুজে দিলো ঐশী। একটা লোকের ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে আছে গেটের সামনে। মুখটা প্রায় থেঁতলে গেছে। আর বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে ঘরে ফিরে এলো দুজনে। ঐশী রীতিমত কাঁপছে। সুমিতের কপালে চিন্তার ভাঁজ। 
কিছুক্ষণ পর রাঁধুনী ছেলেটা এসে ডেকে নিয়ে গেল ওদের। স্থানীয় থানার সাব ইন্সপেক্টর অনিল গিরি এসেছেন। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। বাংলাটা বেশ ভালই বলেন।
– আপনাদের নাম?- আমি সুমিত মুখার্জ্জী আর ও আমার স্ত্রী ঐশী।- আপনি কী করেন?- আমার একটা এনফোর্সমেন্ট কাম ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে।- ডিটেকটিভ এজেন্সি?- হ্যাঁ, ওই মূলতঃ ব্যাংকের যারা টাকা না দিয়ে পালায় তাদের নতুন ঠিকানা খোঁজা আর কোর্টের অর্ডার এক্সিকিউট করা আমাদের কাজ। তা ছাড়া মাঝে মাঝে ওই কিছু লোকজন আসেন,বউ প্রেম করছে কিনা,বর  প্রেম করছে কিনা এইসব খুঁজতে বলে। ওই আর কি।- তার মানে ফেলুদার মত ডিটেকটিভ নয়।- কি হে বলেন? বাই দা ওয়ে ,আপনি ফেলুদা পড়েছেন?- আরে মশাই আমি জলপাইগুড়ির ছেলে, প্রেসিডেন্সির ছাত্র। শুধু সারনেমটাই গিরি,আসলে আমি পুরোপুরি বাঙালি।- বাঃ। ভাল লাগলো।- আচ্ছা কাল আপনারা কিছু আওয়াজ পাননি?- কই না তো।- আমি পেয়েছি।
ঐশীর কথা শুনে দুজনেই ওর দিকে তাকালো। ঐশী কাল রাতের ঘটনাটুকু ওনাদের বলতেই সুমিত বললো
– কই আমায় বলো নি তো- তুমি তখন ঘুমাচ্ছিলে আর আমি তো কিছু দেখতে পাইনি। তাই মাথা ঘামাই নি।- আপনি ঠিক কীরকম আওয়াজ পেয়েছিলেন?- ওই বাইরের দরজার ছিটকিনিটা  খুললে বা খোলার চেষ্টা করলো যেরকম আওয়াজ হয় সেটা।- স্ট্রেঞ্জ। যাই হোক আপনারা এসে একটা বিপদের মধ্যে জড়িয়েছেন। বুঝতেই পারছেন। এখন দু তিনদিন এখানে থাকতে হবে আপনাদের। – সে তো তিনদিনের প্রোগ্রাম নিয়েই এসেছি আমরা। কিন্তু তার বেশী হলে তো মুশকিল।- দেখা যাক।- ওহ। আর একটা কথা ইন্সপেক্টর, আমাদের  আশপাশে ঘোরার কথা ছিল। মানে সেগুলো কি..- হ্যাঁ হ্যাঁ। শুধু আমায় না জানিয়ে স্টেশন লিভ করবেন না।- ওকে। থ্যাংক ইউ। সকালের এইসব ঝামেলাতে সেদিন বেরোতে ভয়ানক দেরী হয়ে গেলো। গাড়ি ছুটলো দুধিয়ার উদ্দেশ্যে। রাস্তায়  এক ছোট দোকানে গরম গরম  থুকপা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে দুধিয়া পৌঁছতে প্রায় দুপুর। চারদিকের মনোরম মন ভাল করা দৃশ্যের মধ্যেও সুমিতের মনে সকালের ঘটনার চিন্তা। । ওখান থেকে বেরিয়ে তামাং মনেস্ট্রি। এই এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। এখানে এসে যেন সব চিন্তা, সব কষ্ট , সব হিংসা ,দ্বেষ কোথায় হারিয়ে যায়। একটা অন্যরকম শান্তি আর বিষণ্ণতা নিয়ে ওরা ফিরে এলো ওদের হোম স্টে তে। পুরো এলাকাতে একটা শ্মশানের শান্তি বিরাজ করছে। আবেশ দাজু বসে আছেন বাইরে,ভুটিয়া একপাশে শুয়ে আছে। সুমিতরা আসতেই দাজু উঠে দাঁড়ালেন-
– কি সোব হয়ে গেলো সাব আজ সোকালে  । হামাদের ইখানে ইসোব আগে কোখনো হয়নি। ট্যুরিস্ট এর পর না আসলে আমাদের কী হোবে বলুন তো সাব।- সব ঠিক হয়ে যাবে দাজু।
সন্ধ্যের পর আর এখানে কিছু করার নেই। এমনিতেই এই সব পাহাড়ি গ্রামে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা আটটা তেই রাত্রি নেমে আসে। তার উপর আজ সকালে ওরকম একটা ঘটনা। ঘরের মধ্যে বসে গল্প করছে দুজনে। এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কও খুব দুর্বল। এটা ওটা কথার মাঝে হঠাৎ এক চিৎকারে  রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে গেলো। ওরা দুজনেই এক দৌড়ে বাইরে এসে দেখলো আবেশ দাজু আর ভুটিয়া হোটেলের পিছনের দিকে দৌড়োচ্ছে। সুমিতও ওদের সাথে দৌড়ালো।ভাবিও মেয়েকে নিয়ে নীচে নেমে এসেছে দেখে ঐশী ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
কিছুক্ষণ পর সুমিত, দাজু আর ভুটিয়া ফিরে এলে জানা গেলো যে ওরা কিছুই দেখতে পায়নি। 
রাতে এইসব হয়ে ঘুমাতে একটু দেরী হয়ে গেছিল। ঘটনাটার রেশ যাচ্ছিলই না ওদের মন থেকে। দাজুও খুব চিন্তিত। সুমিত বুদ্ধি করে অনিল বাবুকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাতে উনি সকালে আসার আশ্বাস দিলেন।
পরদিন সকালে অনিল বাবু  সাথে একটা খারাপ খবর নিয়ে এলেন। আরেকটা লাশ পাওয়া গেছে কাল জঙ্গলের মধ্যে। পুরো শরীর পোস্ট মর্টেমের মত করে কেটে সেলাই করা । কার লাশ এখনো সনাক্ত হয়নি। সুমিত আর অনিলবাবু বারান্দায় বসে চা খেতো খেতে কথা বলছিলেন –
– কী বুঝছেন মিস্টার ডিটেকটিভ?- কিছুই না। আমার তো এসব ফিল্ডে একদম আইডিয়া নেই। যদিও ছোটবেলায় সবার মত আমিও ফেলুদা হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছি কিন্তু আমার দৌড় ওই ব্যাংকের ডিফলটার খোঁজা অবধি। – আমার অবাক লাগছে জানেন। আমি এখানে পোস্টেড আছি তিন বছর। শান্ত জায়গা। চা বাগানের লেবার সমস্যা আর ওই মদ খেয়ে একটু মারামারি ছাড়া সেরকম কোনো ক্রাইম নেই। হঠাৎ পরপর দুদিন দুটো মার্ডার। ঠিক লাগছে না। একটা কাজ করুন। আপনারা কলকাতা ফিরে যান। – কী বলছেন?- ঠিকই বলছি। এই রিস্কের মধ্যে থাকতে হবে না।- ,মিস্টার গিরি,আমি যদি এই কেসটা আমার মত করে তদন্ত করতে চাই আপনার আপত্তি আছে?- কেন এসব ঝুট ঝামেলায় জড়াচ্ছেন? সবে বিয়ে করেছেন। তারপর নিজেই বললেন এসবে আপনার আইডিয়া নেই। চলে যান।- মন চাইছে না। আমার সিকস্থ সেন্স বলছে আমি কিছু একটা পাবো। আমি ঐশীকে কলকাতা পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি থেকে যাচ্ছি।
ওদের আলোচনার মাঝে কখন ঐশী এসে দাঁড়িয়েছে ওরা খেয়ালও করেনি। 
– তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? মিস্টার গিরি তো ঠিকই বলেছেন। চলো আমরা চলে যাই। এসব তোমার কাজ নয়।- না ঐশী। তোমায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি যাও। আমি আসছি কদিন পরে।- তাহলে আমিও কোথাও যাবো না। একসাথে এসেছি,একসাথেই ফিরবো।- কেন পাগলামি করছেন সুমিতবাবু। বৌদি ঠিক বলেছেন।
হাজার অনুরোধ উপরোধেও কোনো ফল হলো না। সুমিত নাছোড়বান্দা। ঐশীও জেদ করে থেকে গেলো। মিস্টার গিরি বললেন
– যা ভাল বোঝেন করুন। কিন্তু আপনি তদন্ত করবেন নিজের ক্যাপাসিটিতে। সরকারি সাহায্য বা এক্সট্রা প্রোটেকশন আমি দিতে পারবো না কিন্তু।
রাতে সুমিতের বুকের মধ্যে শুয়ে ঐশী বললো?
– খুব দরকার সুমিত?- খুব। কারণটা পরে জানাবো।কিন্তু খুব দরকার।  তোমার কিন্তু চলে যাওয়া উচিৎ ছিল।- তোমায় ছেড়ে কখনোই না।
তারপর আরো সাত দিনে পাহাড়ের বিভিন্ন প্রান্তে আরো সাতটা লাশ পাওয়া গেল। সব একই রকমের কাটা। পুলিশ অনেক খুঁজেও কোনো ক্লু পাচ্ছে না।
হঠাৎ মিস্টার গিরির ফোনে একটা ফোন-
– হ্যালো,আমি সুমিত বলছি।- বলুন মিস্টার ডিটেকটিভ।- সাহায্য চাইছি না, কিন্তু কিছু ইনফরমেশন কি পাওয়া যাবে?- এই কেসটা সলভ করার জন্য আমি সব করতে রাজী সুমিতবাবু। থানায় আসুন।
এক ঘন্টা পরে থানায় সুমিত আর মিস্টার গিরি।
– অর্গান পাচারের কেস? – প্রথমে তো তাই ভেবেছিলাম সুমিত বাবু। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কোনো বডিপার্টস মিসিং নেই।- কী বলছেন? সেটা সম্ভব?- সেটাই তো আরো গন্ডগোল করে দিচ্ছে।আরো একটা গন্ডগোল আছে- আবার কী?- সবকটা বডিতে ব্রেন মরছে আগে,হার্ট মরছে পরে।- মানে?- মানে ব্রেনগুলোর ডেথ টাইম হার্টের ডেথটাইমের অন্ততঃ ছ ঘন্টা আগে।- ইম্পসিবল।- সেটাই তো ক্যাচ।আর কোনো বডিতে কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই।- কিন্তু যেভাবে বডিগুলো কেটে আবার সেলাই করা হচ্ছে কোনো ডাক্তার ছাড়া সম্ভব নয়।- একজ্যাক্টলি সুমিতবাবু। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই তল্লাটে এত ভাল সার্জেন নেই। দার্জিলিং সদর হাসপাতালের মর্গের ডাক্তারও তাই বলছে যে এ একদম নিপুণ হাতের কাজ।- খুব অবাক করা বিষয়। যেকটা পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এসেছে আমি কপি নিয়ে যেতে পারি? একটু স্টাডি করতাম।- ঠিক আছে নিয়ে যান। কিন্তু ওনলি বিটুইন ইউ এন্ড মি। – একদম।
এই সাতদিনে ঐশী চিন্তায় চিন্তায় অনেকটা শুকিয়ে গেছে। মুখে সেই আনন্দটা নেই। সুমিত সারাদিন কিসব পড়ে। আজ আবার থানা গিয়েছিল,কিসব কাগজ নিয়ে এসেছে। পড়েই যাচ্ছে। 
– জানো ঐশী, এই নেটওয়ার্কের প্রব্লেমের জন্য আমি একদিন আত্মহত্যা করবো। এত রিসার্চ এত খারাপ নেটে করা যায়?


◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆


 জঙ্গলের মধ্যে একটা হাঁটাপথে চলেছে সুমিত। এদিকটা কোনো লোকবসতি নেই। পথটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কম লোক আসে খুব। কিন্তু ও যেটা ভাবছে সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে…


◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆


– মিস্টার গিরি- বলছি।- আমি ঐশী বলছি,সুমিতের স্ত্রী। ও কাল থেকে  ফেরেনি।- হোয়াট?- হ্যাঁ। একবার আসবেন প্লিজ?- আসছি ।
মিনিট পনেরোর মধ্যে মিস্টার গিরি এসে পৌঁছল হোম স্টেতে। 
ঐশীর সাথে কথা বলে যা জানা গেলো তা হলো গতকাল বিকেলে সুমিত কারো সাথে ফোনে অনেক্ষন কথা বলে। খুব উত্তেজিত ছিল। তারপর হোম স্টের পিছনদিকের জঙ্গলটাতে যায়। আর ফেরে নি। সন্ধ্যেবেলা দাজু আর বাকি দুজন স্টাফ অনেক্ষন খোঁজাখুঁজি করে ফিরে এসেছে। কাউকে পায়নি। 
মিস্টার গিরি আর চারজন কনস্টেবল চললো সেই পথে।

◆◆◆◆◆◆◆◆◆


– খুব টিকটিকি সাজার শখ হয়েছে? যে কাজটা করছিলেন সেটাই তো ভাল ছিল। অন্যের বউয়ের প্রেমিক খোঁজা ছেড়ে ফেলুদা হওয়ার চেষ্টা না করলেই চলছিল না? – আমি কিন্তু আপনাকে চলে যেতে বলেছিলাম সুমিত বাবু।ম্যাডামও বলেছিলাম। কিন্তু শুনলেনই না। এবার বুঝুন।
একটা আধো অন্ধকার ঘরে একটা চেয়ারের সাথে বাঁধা আছে সুমিত। সামনে মিস্টার গিরি আর একজন ডাক্তার। 
– ডক্টর মিত্র, এর ব্রেনটা এবার..
মিস্টার গিরির কথায় হা হা করে হেসে উঠলো দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে বাইরে গুলির আওয়াজ। মিস্টার গিরি আর ডক্টর মিত্র ছুটে যেতেই দরজা দিয়ে ঢুকলো কয়েকজন  ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ান। হাতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।
– হ্যান্ডস আপ।
মিস্টার গিরি আর ডক্টর মিত্রকে ঘিরে ফেললো তারা। 
– আর ইউ ওকে ?- ইয়েস আই এম। থ্যাংকস ক্যাপ্টেন বিক্রম।- আপনি দুর্দান্ত কাজ করেছেন । কিন্তু রিস্কটা একটু বেশী নিয়ে ফেলেছেন। 
সুমিতকে উদ্ধার করে হোম স্টেতে নিয়ে আসতেই ঐশীর পাথরের মত শরীরটা সুমিতের বুকের উপর কান্নায় ভেঙে পড়লো। 
– ধুর পাগলী। কাঁদে না। এই তো এসে গেছি। আর কোথাও যাবো না।

◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆

পরেরদিন খবরের কাগজে বেরোল নেপাল থেকে চোরা পথে মৃতদেহের মধ্যে দিয়ে ড্রাগস এবং সোনা চোরা চালানকারী এক দলকে মিম বস্তির কাছে এক জঙ্গলের মধ্যে তৈরি করা বাঙ্কার থেকে গ্রেপ্তার করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এই দলের সাথে স্থানীয় থানার এক সাব ইন্সপেক্টরও যুক্ত ছিল বলে জানা গেছে  ।
– তিনটে প্রশ্ন ছিল।- বলে ফেলো।- প্রথম মৃতদেহটা কার ছিল। ওটাতো এই সোনা পাচার করা মৃতদেহ নয়।- না। ওটা সেনাবাহিনীর ইন্টিলিজেন্স অফিসার দীপক চৌহানের।আমার পুরনো বন্ধু। ও একটা সিক্রেট মিশনে ছিল। কিন্তু হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়।আমি ওর জন্যই ওখানে আমাদের হানিমুনের প্ল্যান করি। খুব সম্ভবতঃ ওকে ওরা ধরে ফেলে এবং অত্যাচার করে। ও পালিয়ে আসতে পেরেছিল। আমার কাছেই আসতে চাইছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। সম্ভবতঃ গিরিই ওকে..- দ্বিতীয় প্রশ্ন।- বলো। – তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর আমি ঐ রিপোর্ট গুলো পড়েছি। আমি নৃতত্ত্ববিদ্যার ছাত্রী। আমিও কিছুটা বুঝি।  ব্রেন আগে কিভাবে মরলো।- এই প্রশ্নটা করার জন্য তোমার একটা চুমু প্রাপ্য।- নাটক না করে উত্তর দাও।- একদম সিওর নই তবে নেপালে একটা ব্রেন ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের চেষ্টা চলছে বেআইনি ভাবে। প্রতিবেশী দেশ করাচ্ছে। টেরোরিস্ট বানানোর জন্য।- ব্রেন ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন?- হ্যাঁ মৃত ব্যক্তির ব্রেন জীবিত ব্যক্তির মধ্যে। যাতে ওদের নেতাদের ব্রেন থেকে যায় কারো না কারো মধ্যে।-ও মাই গড – সেটা এখনো বোধ হয় সাকসেসফুল নয়। আর তারপরেই সেই লোকগুলো মারা যাচ্ছে। আর তাদের দেড় বডির মধ্যে ড্রাগস আর সোনা পাচার হচ্ছে।- আর তোমার ব্যাপারটা কী?- কী আবার?- আর্মি ওখানে পৌঁছল কিভাবে? তোমার নামই বা সামনে এলো না কেন?
ঐশীর প্রশ্নের উত্তরে সুমিতের মুখে দুষ্টুমি হাসি।- বলবে?- আচ্ছা বলবো।কিন্তু কথা দাও কাউকে কখনো বলবে না।- প্রমিস।- আচ্ছা। মনে আছে আমি বলছিলাম এই নেটে রিসার্চ করা মুশকিল। আমি ঐ পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট গুলো নিয়ে রিসার্চ করছিলাম। সব নর্মাল ডেথ। অপারেশনের ক্ষেত্রে মৃত্যু হলে যেরকম হয়। প্রতিটা দেহের ব্লাড স্যাম্পলে সোনা অথবা ড্রাগসের ট্রেস। কিন্তু লাংসে বা লিভারে নেই। হার্ট ও যথেষ্ট স্ট্রং। তখনই সন্দেহটা হয়। ভাবতে ভাবতে এটা বেরোয়। আমি ক্যাপ্টেন বিক্রমকে পুরোটা জানাই আর জায়গাটা খুঁজতে বেরোই। কিন্তু গিরির উপর আমার সন্দেহ হয়নি। তাই ওকেও জানাই। শুধু ক্যাপ্টেন বিক্রমের কথাটা ভাগ্যিস ওকে বলিনি। গিরিকে আমি জঙ্গলে দেখা করতে বলি। ভাবি স্থানীয় লোক, খুঁজতে সুবিধা হবে। কিন্তু ও যে ওদের দলে বুঝতে পারিনি। ওর সাথে দেখা করে খোঁজা শুরু করতেই মাথায় পিছন থেকে রিভলবারের বাঁটের বাড়ি আর আমি ধরণীতলে। – কিন্তু তুমি তো খোঁজার আগেই এই অবস্থায় তাহলে আর্মি কিভাবে পৌঁছল?- আমার শার্টের বোতামে একটা ছোট্ট ট্রান্সমিটার লাগানো ছিল সেটা ট্রেস করে।- অসাধারণ। এবার দয়া করে বলে ফেলুন আপনি কে?- আমি সুমিত। আক্ষরিক অর্থে সবাই যা দেখে তাই। ব্যবসায়ী,ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাই। আদতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আন্ডার কভার ইন্টিলিজেন্স অফিসার। কোনোদিন যদি হঠাৎ করে না ফিরি বুঝবে আমিও দীপকের মত..- চুপ।
চারটে ঠোঁট একে অপরের সমস্ত কথা নীরবতায় পর্যবসিত করলো।

কলমে শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here