যাতক বাড়িতে ফিরিয়া শুনিল, অবন আসিয়াছিল। যাতকের মাতা তাহার সুন্দরী দিম্মা। দিম্মাকে ধরিয়া হাপুস নয়নে কাঁদিয়াছে। নালিশ করিয়া গিয়াছে। যাতক তাহাদের জন‍্য কিছুই করে নাই। সে বলিয়াছে ,- স্কুলেও প‍্যারাডাইস্ নাই। বাড়িতেও প‍্যারাডাইস্ নাই। তাহারা কোথায় খেলিবে।

         যাতক এই কথা শুনিয়া বড়ই কষ্ট পাইল। অবন তাহার বড় আদরের ধন। উহার এক জোড়া চোখ দেখিলে বড় ঈশ্বরের কথা মনে পড়িয়া যায়। যাতক মনে মনে স্থির করিল সে প‍্যারাডাইস্ বানাইবে।

           যাতক মাতার নিকট গেল। পাশে বসিয়া অবনের কথা ভাবিতে লাগিল। মাতাকে কহিল,- অবন দুঃখ পাইয়াছে। তাহার মনে খুব খেদ জন্মাইয়াছে। তাহার এই কষ্ট লাঘব করিব কি ভাবে।

          মাতা সন্তানের হাত ধরিয়া বলিলেন,- তোমার পিতা মৃত্যুর কিয়দকাল পূর্বে আমাকে একটি থলি দিয়া বলিয়াছিলেন,- ইহাতে বিষেশ ধরনের ফুল আর ফলের চারা রহিল। জাতকের প্রয়োজনে লাগিবে, উহাকে ইহা দিয়া দিও।

                 থলি খুলিয়া যাতক অবাক হইল। দশ রকমের চারা সর্বমোট পঞ্চান্নটি। বৃহত্তর চারার সংখ্যা দশ। সর্বনিম্ন একটি চারা। এই ভাবে ২,৩,৪ সংখ্যায় একই প্রকার চারা বাড়িয়া দশে শেষ হইয়াছে। যাতক বাগানটি দেখিতে আসিল। বাগানটি দেখিতে অর্ধচন্দ্রের মতো। যাতক ভাবিল এইরূপ বাগানের কোন সত‍্য কাহিনী লুকাইয়া রহিয়াছে। উহা কিভাবে উন্মেষ করিবে তাহা ভাবিয়া কূল পাইতেছে না‌। 

            যাতক পুনরায় মাতার নিকট আসিয়া বলিল,- মাতা, আপনি স্মরন করিয়া দেখুন, – পিতা আর কিছু বলিয়া যান নাই।

             মাতা মাথা নাড়িয়া বলিলেন, – বলিয়াছিলেন, কোন একদিন ধরনীতে স্বর্গ নামিয়া আসিবে। একথা শুনিয়া যাতকের চোখ স্থির হইয়া গেল। থলিটি হাতে লইয়া যাতক বাগানে পৌঁছিল।

             আকাশের দিকে তাকাইয়া দেখিল সূর্যদেবের কুসুম আলোতে অর্ধচন্দ্র প্রকাশ পাইয়াছে। চারা বিজের থলিটি বুকের ভিতর চাপিয়া ধরিল।পদ্মআঁখি হইতে অশ্রু গড়াইয়া পরিল। মাটি সিক্ত হইয়া ধারন করিবার শক্তি পাইল। যাতক বুঝিল চারা রোপন করিবার ইহাই উপযুক্ত সময়। কাল বিলম্ব করিল না। প্রথম সারিতে দশটি , দ্বিতীয় সারিতে নয়টি এই ভাবে শেষ সারিতে একটি চারা পুতিয়া দেখিল বাগানে কোন উন্মুক্ত জমি নাই।

              নীলাকাশ আভরণ পরিয়া যাতকের সম্মুখে উপস্থিত হইল। একটি অতি উজ্জ্বল রুপোলী আলোক চন্দ্রমা সমস্ত আকাশকে ভাসাইয়া অর্ধ বৃত্তাকারে প্রতিভাস হইতেছে। সুনীল আকাশের মাধুর্য সদ‍্যযাত শিশুর মুখের মতোই উজ্জ্বল, সুন্দর ও উচ্ছসিত। কয়েক লক্ষাধিক হীরের দ‍্যুতিময় তারাদের পরিবার স্নিগ্ধ রূপসী চাঁদকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। দীর্ঘশ্বাস লইয়া যাতক ধ্যানে নিমগ্ন হইল।      পদ্মআঁখি নিমীলিত। পদ্মের সৌরভে পরিমণ্ডল সুভাসিত হইয়া উঠিল। তাহার মাতা অতিকষ্টে বাগানে আসিয়া বুঝিল যাতক বাহ‍্যজ্ঞান অতীত হইয়াছে। বৃদ্ধ মাতা দু হাত তুলিয়া পুত্রকে আশীর্বাদ করিয়া নিজ কক্ষে ফিরিয়া গেল। 

              সমাধিস্থ যাতক শরীরে অগ্নি, বায়ু ও জল উৎপন্ন করিয়া দক্ষিণ হস্তের মুষ্টি আবদ্ধ করিয়া প্রথম সারির দশটি চারাকে মাতৃ জঠর হইতে উৎসারিত করিল। দেখিতে দেখিতে উর্বী ছেদ করিয়া চারা গাছগুলি ক্রমশঃ বৃক্ষে রূপান্তরিত হইল। 

                       যাতকের তথাপি চক্ষুদ্বয় উন্মীলন  হয় নাই। কর্ণকুহরে ভ্রমরের গুঞ্জন ভাসিয়া আসিতেছে। ক্ষণিকে ক্ষণিকে নাসারন্ধ্র দিয়া চৈতন্যে নানাবিধ পুষ্পের গন্ধ মাতিয়া উঠিতেছে। মিষ্টি ফলের গন্ধে পাখীর কলরবে চারিদিক মুখর হইয়া উঠিতেছে। যাতকের শরীরে ভোরের শুভ্র শীতল বাতাস লাগিতেছে। যাতকের ধ্যান ভাঙ্গিল। সম্মুখে তাকাইয়া দেখিল তাহার পদ্মআঁখি হইতে আনন্দ অশ্রু বহিতেছে।

  • অবন, অবন ভোর হইয়াছে দ্বার খোল।

                   অবন বাহিরে আসিয়া দেখিল আপদ মস্তক চন্দন কাপড় জড়াইয়া এক উজ্জ্বল পুরুষ দাঁড়াইয়া আছেন‌। তাহার চক্ষুদ্বয় অর্ধ নিমীলিত।

ওষ্ঠে স্বর্গীয় হাসি। অবন পূর্বে কখনো যাতককে দেখে নাই। তাহার বাম হস্তে লাল চন্দন কাঠের সুদৃশ্য দন্ড। অবন আসিয়া প্রসারিত দক্ষিণ হস্ত শক্ত করিয়া ধরিল।

                   অবন নিজ চোখকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না। ইহা কোন বাগান নহে। ইহার কোন প্রান্তভাগ চোখে পরিল না। অর্ধ চন্দ্রাকারে পৃথিবীটাই রামধনু রঙে সেজে উঠেছে। ফুল এতো সুন্দরতা পাইল কোথা হইতে। আরো আশ্চর্য হওয়া বাকি ছিল অবনের। বাগানের প্রতিটি অংশ হইতে অসংখ্য তাহার বয়েসী ছেলে, মেয়ের দল আনন্দে ছুটিয়া আসিতেছে। তাহাদের পরনে রামধনু রঙের পোষাক। সবাই হাসিতেছে, খেলিতেছে। প্রজাপতির মতো রঙিন হইয়া ফুলে ফুলে ঘুরিতেছে, ফল পাড়িয়া খাইতেছে। অবন দু চোখ ভরিয়া দেখিল। সকল বন্ধুদের সাথে খেলিল। কত গল্প করিল। মন স্বর্গীয় আনন্দে ভরিয়া উঠিল।

                   যাতক তখনও দাঁড়াইয়াছিলেন। অবন ফিরিয়া আসিয়া যাতকের হাত ধরিয়া কহিল,- ইহাকে কি প‍্যারাডাইস্ বলে।

কলমে দেবানন্দ দে, ব্রক্ষ্মপুর, কলিকাতা

জন্ম ১৯৫৪। কবি ও লেখক হিসাবে পরিচিত সত্তোর দশকে। ১৯৮৭-২০১৯ সাল পর্যন্ত‍্য বিরতি। জীবনের যুদ্ধে অবশেষে কৃতকার্য হলাম। অনেক শোক সামলে আবার লেখায় ফিরলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here