ডেথ ওয়ান রেডিও স্টেশন – ছোটগল্প

Bengali Short Story Horror Story

0
1112
Photo : Youtube

(১)

শীতের পড়ন্ত বিকেলে, গার্স্টিন প্লেস লাগোয়া ফুটপাথের ওপর দিয়ে বইয়ের ব্যাগ হাতে পথ চলতে চলতে শ্যামল নিজের দুর্ভাগ্যের কথাই চিন্তা করছিল। চাকরিটা শেষ পর্যন্ত রাখা গেল না, অথচ ওই কাজটা ছাড়া উপার্জনের দ্বিতীয় কোন রাস্তা তার সামনে এইমুহুর্তে একদমই নেই। শুধুমাত্র সে কারনেই এতদিন অগ্রবালের উত্তরোত্তর অন্যায় দুর্ব্যাবহার মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, সামান্য এই রোজগারের ভরসাতেই শ্যামল বিয়েতে মত দিয়েছিল। তিয়াসা যেন তার নিঃসঙ্গ ছন্নছাড়া জীবনে একঝলক বসন্তের বাতাস বয়ে নিয়ে এসেছিল, রঙ রুপ রসে পরিপুর্ন হয়ে শ্যামল যখন জীবনকে প্রাণভরে ধন্যবাদ জানাচ্ছে ঠিক তখনই দুঃসময়ের কালো মেঘ মাথার ওপর চেপে বসল।

আগের বড়সাহেব পাকড়াসী অবসর নিতেই দিল্লীর হেড অফিস থেকে রাজীব অগ্রবালকে কলকাতা ব্রাঞ্চ অফিসের দ্বায়িত্ত্ব দিয়ে পাঠানো হল। অগ্রবাল চূড়ান্ত দাম্ভিক প্রকৃতির বদমেজাজি লোক, দ্বায়িত্ত্বশীল কর্মী হয়েও শ্যামল অগ্রবালের কুনজরে পড়ে গেল। পরপর কয়েকজন কর্মী ছাটাই হল, তারপর এলো শ্যামলের পালা, ডাউন-সাইজিংয়ের অজুহাতে চাকরিটা গেল। ঘরে তিয়াসা তখন পাচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শ্যামল নিজের উদ্বেগের বোঝা স্ত্রীর মাথায় চাপাতে চায়নি, তাই রোজ নিয়ম করে ঠিক আগের মতোই সকাল নটার মধ্যে স্নান খাওয়া সেরে বেড়িয়ে পড়ে, কখনও কোন কাজের চেষ্টায়, কখনও বা শুধুই উদ্দেশ্যহীন ভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরনো। ইদানিং শ্যামলের একটা কাজ জুটেছে, বইয়ের সেলস্‌ম্যানের, অনামী লেখকের সস্তার উপন্যাস, ইংরেজী গ্রামার, ভুতের গল্প ইত্যাদি নিয়ে ঘুরে বেরনো, যা বিক্রি হবে তার কুড়ি শতাংশ কমিশন।

আজকের দিনটাই অপয়া! সারাদিন ঘুরে একটা বইও বিক্রি হয়নি, উপরি জুটেছে কিছু বাজে লোকের বলা অন্যায্য কথা। বইয়ের ঝুলিটা ইডেনের কাঠের বেঞ্চির ওপর ফেলে শ্যামল ক্লান্ত শরিরটাকে এলিয়ে দিল। সুযোগ পেয়ে যেন দুশ্চিন্তা গুলো সব দল বেধে ভীড় করতে শুরু করল। সঞ্চয় যা আছে তাতে মেরেকেটে আরও দুটো মাস হয়ত চলে যাবে, তারপর? শ্যামলের হঠাৎ ভীষণ কান্না পেয়ে গেল, ঝোড়ো হাওয়ার মতো বিক্ষিপ্ত কয়েকটা চিন্তা তাকে প্রায় অস্থির করে তুলল। এভাবে অপদার্থের মতো বেঁচে থেকে কারো কোন কাজেই লাগবার সম্ভবনাই যখন নেই, তাহলে মৃত্যু ঢের ভালো। শ্যামল একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল। আত্মহত্যাই করবে সে! দূর থেকে চক্ররেলের শব্দ ভেসে আসছে। শ্যামলের প্রচন্ড ঝোঁক হল চলন্ত ট্রেনের সামনে গিয়ে ঝাপিয়ে পরে। হঠাৎ তিয়াসার মুখটা মনে পরতে হুঁশ এলো। না এইভাবে নয়, অন্তত শেষবারের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে চিরবিদায় নিয়ে আসতে হবে। তারপর নাহয়!

ইডেন গার্ডেনস্‌ থেকে দুবার বাস পালটে কসবা রথতলা আসতে শ্যামলের একঘন্টার মতো লেগে গেল। পাড়ায় ঢোকার মুখে অভিলাষ সুইটস্‌ থেকে গোলাপ সন্দেশ আর হরিদার দোকানের চিকেন কাটলেট কিনতে গিয়ে পকেটে পড়ে থাকা সামান্য টাকাটাও শেষ হয়ে গেল। যাকগে! শ্যামলের অন্তত আজকের সন্ধ্যেয় খালি হাতে বাড়ি ফিরতে মন চাইছে না।

(২)

দ্রুত বাড়ির সামনে যেতে গিয়ে শ্যামল বাধা পেল। মেলা মানুষের ভিড়ে গলিটা তখন থিকথিক করছে। শ্যামল শুনে অবাক হল তার বাড়িওয়ালা দুর্লভ মল্লিক আজ দুপুরে মারা গেছেন, অথচ আজ সকালেই তার দুর্লভবাবুর সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়েছে, এমনকি ভদ্রলোক তাকে একটি পুরানো রেডিও উপহার স্বরুপ দিয়েছেন, সেই লোকটা আর নেই! এতো দুঃখেও শ্যামলের হাসি পেল, আজ বাড়িওয়ালা গেলেন আর কাল তার ভাড়াটের পালা। ওদিকে মৃতদেহ সৎকারের জন্য শববাহী গাড়ীতে তোলা হয়েছে, শ্যামল একমুহুর্ত দাড়িয়ে গেল, লোকটাকে একবার শেষ দেখা দেখে নেওয়া যাক। পাড়া আর বেপাড়ার গোটা তিন ক্লাবের শখানেক ছেলে তখন মহা শোরগোল তুলে গাড়ির সঙ্গে পা মিলিয়েছে, শ্যামল গাড়ীর কাচের আবরণের খুব কাছে গিয়ে ভিতরে চাইল। তুলোর পুলটিস দিয়ে দুর্লভ মল্লিকের নাকের ফুটো বন্ধ করে গালের পাশে চন্দনের বড় বড় ফোঁটা অপটু হাতে লেপে দেওয়া হয়েছে। অভ্যাস বশতঃ শ্যামল কপালে হাত ঠেকাতে যাচ্ছিল আর ঠিক তখনই মৃতদেহের ঠোটের কোনে রহস্যময় হাঁসি খেলে গেল। শ্যামলের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেল। একি অঘটন! সামান্য পরে হুঁশ ফিরতে দেখল, শবযাত্রা গলির মুখে অনেকটা এগিয়ে গেছে। শ্যামলের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, সব কিছুই তবে তার অস্থির মনের কষ্টকল্পনা!

শ্যামল চাইছিল আজকের সন্ধ্যেটা তিয়াসার সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে কিন্তু বিনা নোটিশে অক্কা পেয়ে দুর্লভবাবু সব ভেস্তে দিয়েছেন, পাড়ার মহিলারা জটলা করে দুর্লভ প্রশস্তিতে মেতেছে আর তিয়াসাও ওদের দলে গিয়ে ভিড়েছে, শ্যামল বারকয়েক স্ত্রীকে ডাক দিয়েছিল কিন্তু তিয়াসা তাতে জল ঢেলে দিয়েছে –আজ এখানে একজন বয়স্ক মানুষ মারা গিয়েছেন আর আমরা দরজা বন্ধ করে গল্প করব! ছিঃ লোকে কি বলবে? শ্যামল আর কি করে, বসে বসে সেও দুর্লভ মল্লিকের কথাই ভাবছিল।

দুর্লভবাবুর বয়স আশির কোঠায় হলেও শরির ছিল যথেষ্ট শক্তসমর্থ, বয়সের বিপরীতে পাল্লা দিয়ে দাঁতগুলো যেমন মজবুত, মাথার চূলগুলোও ছিল তেমন অদ্ভুত রকমের কালো। ভদ্রলোকের অগাধ সম্পত্তি। এই পাড়া আর আশেপাশের এলাকা মিলিয়ে তার পাঁচ পাচটা বাড়ি, যদিও সেগুলোর মালিকানা দাবী করার মতো লোক বোধহয় আর কেউ নেই। মল্লিক বাড়ির ছেলে বুড়ো বাচ্চা সবাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় এক এক করে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। শেষে বেচেছিল একমাত্র নাতি, দুর্লভবাবু তাকে দেশ থেকে অনেক দূরে বিলেতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু একদিন সেই নাতিরও মৃত্যু সংবাদ এসে হাজির হল। সে নাকি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। বেওয়ারিশ দুর্লভবাবু এতদিন এলাকার ক্লাবগুলোকে অকাতরে টাকা বিলিয়ে এসেছেন, তাই তার মৃত্যুতে সবথেকে দুঃখী বোধহয় তারাই।

আজ সকালে হঠাৎ এহেন দুর্লভবাবুর জরুরি তলবে শ্যামল ঘাবড়ে গেছিল। তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে তাই বোধহয় কড়কানি দেবে ভেবে শ্যামল তটস্থ হয়ে হাজির হয়েছিল, যদিও দুর্লভ সেসবের ধারকাছ মাড়ালেন না। শ্যামলকে দেখে একটা চৌকো কার্ডবোর্ডের বাক্স হাতে তুলে দিয়ে বললেন –তুমি তো টিভি দ্যাখো, আজ থেকে নাহয় সাথে একটু রেডিও শুনবে, মাঝরাতে ডেথ ওয়ান রেডিও চ্যানেলে যে অনুষ্ঠান হয় সেটা মন দিয়ে শুনো, কেমন! শ্যামল ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল –কিন্তু এটা আমায় দিচ্ছেন কেন? দুর্লভ ভাঙ্গা স্বরে বললেন –কারন ও তাই চাইছে, তাছাড়া আমার দিন তো শেষ হয়ে গেল, কিন্তু খেলা তো চলতেই থাকবে, শুধু গুটিগুলো পালটে যাবে। তুমি এখন এটা নিয়ে যাও। শ্যামল একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গেছিল দুর্লভ মল্লিকের মাথাটা বিগড়েছে তবে পাছে ভদ্রলোক আবার বাড়ি ভাড়া চেয়ে না বসেন তাই প্যাকেট হাতে মানে মানে সরে পড়েছিল।

বিছানায় শুয়ে শ্যামল ছটফট করছিল। বেয়ারা চিন্তাগুলো সব আবার তার শান্তিভঙ্গ করতে শুরু করেছে। তিয়াসার এমন অবস্থায় এভাবে পালিয়ে যাওয়াটা কি পুরুষ মানুষোচিত কাজ হচ্ছে? তবে কি শ্যামল কাপুরুষ? মনে মনে শ্যামল পুরো পৃথিবীর বাপান্ত করে ছাড়ল, এমন অবস্থায় পড়লে স্বয়ং ভগবানও গলা ছেড়ে কাঁদতে বসত। শ্যামল নিজের মনকে প্রবোধ দিল, সে মরে গেলে উলটে তিয়াসার ভালো বই খারাপ কিছু হবে না। তিয়াসার বাবা-মা অভাবী হলেও নিশ্চয়ই মেয়ের পাশে এসে দাঁড়াবেন, তাছাড়া সরকার থেকেও দুঃস্থ বিধবাদের একটা ভাতার ব্যাবস্থা আছে সেটা শ্যামল শুনেছে। শ্যামল একবার ঘুমন্ত তিয়াসার মুখের দিকে চাইল, কি দুর্বল আর রুগ্নই না লাগছে ওকে, অথচ বিয়ের আগে কি সুন্দর চেহারাটাই না ছিল, অভাবের তাড়না সব রঙ রুপ শুষে নিয়েছে। শ্যামল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।

ঘড়ির কাটা বারোটার ঘর ছুয়েছে, শ্যামল ঘুমিয়ে পড়ার ব্যার্থ চেষ্টায় বিছানার ওপর এপাশ ওপাশ করে চলেছে। হঠাৎ কানের কাছে সুরেলা নারীকন্ঠ ভেসে এলো। দুর্লভ মল্লিকের রেডিওটা বাক্স সমেত শ্যামল ড্রয়ারের ওপর ফেলে রেখেছিল, আওয়াজটা আসছে ওখান থেকেই। শ্যামল বিস্মিত হল। রেডিওটা নিজে থেকে কি করে বাজছে? সে তো ওটা চালু করে নি! পাশে তিয়াসা অকাতরে ঘুমাচ্ছে। শ্যামল রেডিও হাতে দ্রুত বারান্দায় চলে এলো। রেডিও থেকে তখন লাস্যময়ী নারীকণ্ঠের ঠাট্টা তামাশার চটুল শব্দ ভেসে আসতে শুরু করেছে, একটু পরে খবর শুরু হল। গুরুগম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ আজকের বিশেষ সংবাদ পরিবেশন করতে শুরু করল, শ্যামল কান খাড়া করে শুনতে লাগল। খবর গুলো সবই কোন না কোন মৃত্যু বা দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, ভুটানে ভূমিকম্পে ত্রিশজনের মৃত্যু হয়েছে ফিলিপিন্সের ম্যানিলায় একটা বহুতলে আগুন লেগে শখানেক লোকের মৃত্যুসংবাদও এইমাত্র পাওয়া গেল। খবর শেষ হল, আবার সেই নারী কণ্ঠ ঘোষণা করল আগামীকাল শনিবার অতএব জাদুকরনি মায়া তার বিশেষ অনুষ্ঠানে যথারীতি হাজির থাকবেন, শ্রোতা চাইলে নিজের সমস্যার সমাধান ওনার কাছে থেকে লাইভ জেনে নিতে পারেন। রেডিও স্তব্ধ হল। শ্যামল অবাক হয়ে দেখল রেডিও পূর্ববৎ অচল হয়ে গেছে। শ্যামলের ভেবে হাঁসি পেল আজ বৃহস্পতিবার হলে কালকের দিনটা শুক্রবার হওয়ার কথা অথচ এইসব নিম্নশ্রেণীর চ্যানেল দিন আর বারটা অবধি ঠিকঠাক খেয়াল রাখতে পারে না।

সকালে ঘুম থেকে উঠে শ্যামল টের পেল আত্মহত্যার বাড়াবাড়ি রকম ঝোঁকটা উধাও হয়েছে আর যৎসামান্য হলেও বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা যেন ফের চাগিয়ে উঠেছে। তিয়াসা চা করেছে, পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে কাগজে চোখ বুলিয়ে শ্যামলের মনে বিরক্তির ভাব জাগল। নাঃ ভুটানে ভূমিকম্প অথবা ম্যানিলায় আগুন লাগার কোন খবরই নেই। যতসব উটকো চ্যানেলের ধাপ্পাবাজী!

সারাদিন বইয়ের ব্যাগ হাতে ঘুরে শ্যামল যারপরনাই ক্লান্ত বোধ করছে, আজকেও বিক্রির যা বহর শ্যামলের মনে হল এর থেকে ফুটপাথে চায়ের দোকান বসালে বোধহয় বেশী কাজে দেবে। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের কাছে বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের দোকানের সামনে কিছু লোকের জটলা। টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখাচ্ছে, দুদণ্ড জিরিয়ে নেবার জন্য শ্যামল হাতের ব্যাগটা পাশে রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। টিভির স্ক্রীনে হলুদ স্লাইড বাদিক থেকে ডানদিকে ঘুরে চলেছে তাতে আজকের বিশেষ বিশেষ সংবাদ। একটা খবরে শ্যামলের চোখ আটকে গেল, ভুটানে আজ সকালে ভূমিকম্পে এখনও পর্যন্ত দশজনের মৃত্যু হয়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও অনেক মানুষ চাপা পড়েছে, উদ্ধারকার্য চলছে। পরের স্লাইড দেখে শ্যামলের মাথা বোঁ করে ঘুরে যাবার উপক্রম হল। ম্যানিলার প্রাইড টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড! ব্যাস্ত সময়ে অফিস টাওয়ারের মধ্যে অনেক লোক আটকে পড়েছে, দমকলের লোকেরা আগুন নেভাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এখন অব্দি হতাহতের কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি। শ্যামলের বুকের ভিতরে দারুণ ধুকপুকানি শুরু হল, আজ এইমুহুর্তে যা সব ঘটছে একদিন আগের খবরে তা জানায় কি করে! ঘড়িত চারটে বাজে ডালহৌসী থেকে কসবা যেতে অন্তত চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় তো লাগবেই। হাতের ব্যাগ নিয়ে শ্যামল ছুটল, মহাজনের কাছে এটার গতি করে এখুনি একবার বাড়ি যাওয়া বিশেষ প্রয়োজন।

(৩)

সন্ধ্যে থেকে শ্যামল টিভির সামনে বসে রয়েছে। স্বামীর থমথমে মুখ দেখে তিয়াসা বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। টিভির চ্যানেল পাল্টে পাল্টে শ্যামল শুধু নির্দিষ্ট দুটো খবরেই চোখ রাখতে চাইছে। ভুটানে ইতিমধ্যে বাইশজনের দেহ উদ্ধার করা হয়েছে ওদিকে ফিলিপিন্সের অট্টালিকাটায় আগুন নেভার পর বিষাক্ত কালো ধোয়া যেন দানবের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে গোটা আকাশটাকেই গিলে ফেলতে চাইছে। এখনো অবধি অনেককে উদ্ধার করা গেলেও অন্তত কুড়িজনের মৃত্যু হয়েছে জানা গেল, দমকলের কর্মীরা নিথর দেহ গুলো স্ট্রেচারে করে বের করে আনছে। নটা নাগাদ তিয়াসা খেতে ডাকল। শ্যামল টিভি ছেড়ে উঠবে না, তিয়াসা বিরক্তিতে গজগজ করতে শুরু করল। করুক! শ্যামল ওর সবকটা ইন্দ্রিয়কে লাগিয়ে দিয়েছে টিভির পর্দায়, অন্য কোন শব্দ তার কান শুনতে নারাজ, অন্য দৃশ্য চোখ দেখেও দেখবে না।

রাত প্রায় পৌনে বারোটা। ভুটানে রেসকিউ অপারেশান শেষ হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ত্রিশ, আহত চতুর্গুন। ম্যানিলার বহুতলটাকেও বিপদমুক্ত করা গেছে তবে একশোটা জীবনের বিনিময়ে। অর্ধদগ্ধ আর আহত অসংখ্য। শ্যামল দারুন বিস্ময় আর অজানা আতঙ্কে গুম হয়ে বসে রয়েছে। সামনে রেডিওটা যথারীতি মুক বধির হয়ে রয়েছে, চেষ্টা করেও ওটাকে চালু করা যায় নি। যদিও শ্যামলের মন বলছে ঘড়ির কাটা বারোটার ঘর ছুলে এই রেডিও ঠিক কথা বলতে শুরু করবে এবং সেটা হবে নিজে থেকেই। শ্যামল আড় চোখে ঘরের ভিতরে চেয়ে দেখল তিয়াসা যথারীতি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভালোই হয়েছে শ্যামল চায় না এসব জিনিস ওর মাথায় ঢুকুক।

মধ্যরাত্রি! রেডিও থেকে সুরেলা নারীকণ্ঠের লাস্যময়ী অভ্যর্থনা ভেসে এলো ‘ডেথ ওয়ান রেডিও ষ্টেশনে আপনাকে স্বাগত’ এরপর শুরু হল আজকের খবর, শ্যামল লক্ষ্য করল তারিখ যা উল্লেখ করা হল সেটা আগামীকালের! আজকের খবরের শিরোনাম আজারবাইজানে প্লেন ক্র্যাশ করে পঁচিশজন যাত্রীর মৃত্যু। দক্ষিণেশ্বরে ট্রাকের ধাক্কায় এক সাইকেল আরোহী পিষ্ট। আরও কিছু মৃত্যুর খবর দিয়ে সংবাদ শেষ হল। সুরেলা নারীকণ্ঠ ঘোষণা করল এবার শুরু হচ্ছে জাদুকরনি মায়ার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘মায়ার ফাঁদে’ একমুহূর্তের স্তব্ধতা তারপর রেডিওর মধ্যে থেকে রুক্ষ শীতল নারীকণ্ঠ ভেসে এলো ‘আমি জাদুকরনি মায়া, চির অতৃপ্ত মানবমনের অবদমিত বাসনা চরিতার্থ করেই আমার তৃপ্তি, ধনসম্পত্তি অর্থ ক্ষমতা সুন্দরী নারী সব কিছুই এখান থেকে পাওয়া যাবে যার সাহস আছে চেয়ে নিক’ শ্যামলের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে, কোনরকম শব্দ না করে সে চুপ করে বসে রইল। রেডিও আবার বলে উঠল –অবদমিত লোভ, অতৃপ্ত বাসনা চরিতার্থ করার জন্যই এই যন্ত্র তোমাকে দেওয়া হয়েছে, ওহে শ্যামল সেন, বলো তোমার কি চাইবার আছে? শ্যামল শুকিয়ে যাওয়া গলা থেকে অতিকষ্টে শব্দ বের করল – আমার চাকরিটা যদি আবার ফেরত পেতাম! রেডিও থেকে রহস্যময়ী কণ্ঠস্বর পৈশাচিক অট্টহাসি করে উঠল –শুধু চাকরি কেন, চাইলে রাজার ঐশ্বর্যও মিলতে পারে, তবে যতটা নেবে কড়ায়-গন্ডায় ততটাই মূল্য কিন্তু চুকিয়ে দিতে হবে, রাজি তো বলো? শ্যামলের শরির জুড়ে আতঙ্কের স্রোত বয়ে চলেছে, উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইল। নারীকন্ঠ আবার বলল –যদি চাও তাহলে অনন্ত বিত্ত, ক্ষমতার অধিকারি হতে পারো অথবা হতে পারো সেরা ধনিদের একজন! কি বল! চাই তোমার এসব? শ্যামল ঢোঁক গিলে বলল –শুধু আমার চাকরিটা যদি ফিরত পেতাম, আর কিছুই চাই না। নারীকন্ঠ সামান্য বিরতির পরে বলল –একজনের সৌভাগ্য উদয় হবে অন্যের দুর্ভাগ্য আর বিনাশে, চরম মুল্যের দ্বারাই হবে কার্যসিদ্ধি, রাজিব অগ্রবালের আকস্মিক মৃত্যু আর কর্মক্ষেত্রে তুমি তার জায়গায় বহাল! শ্যামলের বুকের ভিতরটা যেন হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে, ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল -অগ্রবালের যা খুশি হোক কিন্তু ওর চেয়ারে আমি বসব সেটা কি করে সম্ভব? চেড়া হাঁসির শব্দ ভেসে এলো -মুল্য চুকাতে হবে, জীবনের বদলে জীবন!

শ্যামল উৎকণ্ঠিত স্বরে জিগ্যেস করল -কার জীবন? -যে এখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি তার। তোমার স্ত্রীর গর্ভস্থ সন্তান! কি করবে লেনদেন? শ্যামল শিউড়ে উঠল এমন কিছু সে কল্পনাও করতে পারেনি। কয়েক মুহুর্তের নৈশব্দ তারপর রেডিও থেকে স্বর ভেসে এলো -চুপ করে রইলে কেন হে, একসপ্তাহে সাকুল্যে তিনটে বই বিক্রি হয়েছে। এরপর এই কাজটাও যাবে, তোমার সন্তানের মৃত্যু অনিবার্য, তবে সেটা অনাহারে! এবারে বল তুমি কি চাও? শ্যামল ইতিমধ্যে মনোস্থির করে ফেলেছে, কাঁপা স্বরে বলল -আমি রাজি। অকস্মাৎ রেডিও থেকে পুরুষ কণ্ঠের চাপা আর্তনাদ ভেসে আসতে লাগল যেন কেউ কারও শ্বাসনালী টিপে ধরেছে আর ফাঁদে পরা মানুষটি মুক্ত হবার জন্য শুরু করেছে মরণপণ ছটফটানি। মরিয়া প্রচেষ্টা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ল। ঘড়ঘড়ে একটা শব্দ! কেউ যেন তার শেষ নিঃশ্বাস ফেলল। শ্যামল শীতের রাতেও কূলকুল করে ঘামছে। কণ্ঠস্বরটা সে চিনতে পেরেছে, ওটা আর কারো নয় তার একসময়ের দুর্বিনীত মনিব রাজীব অগ্রবালের। মুহুর্তখানেকের জন্য সব নিস্তব্ধ। হঠাৎ ফের খবর শুরু হয়ে গেল, আবার সেই গুরুগম্ভির পুরুষকণ্ঠ ঘোষণা করল ‘এইমাত্র খবর পাওয়া গেছে বাইপাসের ওপর চলন্ত গাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একজন চালকের মৃত্যু ঘটেছে তার নাম রাজীব অগ্রবাল তিনি অরবিট ফাইন্যান্স নামক একটি বেসরকারি সংস্থায় উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন’।

(৪)

অরবিট ফাইন্যান্সের নতুন বড়কর্তা শ্যামল সেনের চমকপ্রদ উত্থানে অনেকেরই চোখ কপালে ঠেকেছে।বছর দুয়েক আগে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অগ্রবালের মৃত্যুর পর তার কুকর্ম গুলো একে একে সামনে আসতে শুরু করল। অগ্রবাল শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের মুলধন এবং সুনাম নিয়েই যে ছিনিমিনি খেলেছে এমন নয়, বেশ কিছু যোগ্য কর্মিকেও খেয়াল খুশিমতো বরখাস্ত করেছে। কোম্পানির কর্তাব্যাক্তিরা নড়েচড়ে বসলেন, ছাটাই হয়ে যাওয়া বেশ কয়েকজনকে ফের কাজে বহাল করা হল এর মধ্যে শ্যামল সেনের বড়াতে শিকে ছিঁড়ল। তাকে চাকরি ফেরত দেওয়ার সাথে সাথে প্রোমোশনও পাইয়ে দেওয়া হল। সে এখন থেকে বসবে অগ্রবালের ফেলে যাওয়া চেয়ারে।

সময়ের একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। প্রতিটা মানুষের জন্য তার রুপ ভিন্ন। দুসময় যেন স্থির অচঞ্চল, তার গতি শ্লথ আর চাল বিলম্বিত! আর সুসময়? সে যেন ছোটে হাওয়ার বেগে, ঝড়ের গতিতে। অন্তত শ্যামলের তো আজকাল তাই মনে হচ্ছে। গত দুবছরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে শ্যামল বুঝিয়ে দিয়েছে তার পদোন্নতির সিদ্ধান্ত কোন মতেই ভুল ছিল না। ম্যানেজমেন্ট শ্যামলের ওপর যারপরনাই সন্তুষ্ট, সম্প্রতি তাকে নতুন দ্বায়িত্ত্বভার দেওয়া হয়েছে, সমগ্র ইস্টার্ন রিজনের জোনাল ম্যানেজার করে। পরিবর্তন এসেছে ব্যাক্তিগত জীবনেও, শ্যামল আর তিয়াসা নতুন সংসার পেতেছে নিউ আলিপুরে দশতলার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। আজকের শ্যামল সাফল্যের নেশায় টগবগ করে ফুটছে। শুধু একটা বিষয়েই মাঝে মাঝে তার মানসিক স্থিরতা নষ্ট হবার উপক্রম হয়, রেডিও জাতীয় কোন যন্ত্র দেখলেই আতংকের হিমেল স্রোত শিরদাঁড়া দিয়ে নামতে থাকে, ভয়ে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। হাজার চেষ্টা করেও দুবছর আগের স্মৃতি মুছে ফেলা সম্ভব হয় নি। তিয়াসা প্রায় মরতে বসেছিল। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মিস-ক্যারেজ হবার পরে যখন রক্তাক্ত অবস্থায় হাঁসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল তখন ডাক্তারেরাও আশ্বাস দিতে পারেনি। দুদিন পরে যখন জ্ঞ্যান এল, শ্যামল হাঁপ ছেড়ে বেচেছিল। এরপর দুটো বছর কেটে গিয়েছে, তিয়াসা আজও ফ্ল্যাটের একটা ঘর পুতুল আর খেলনা দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে, প্রতিনিয়ত একটাই স্বপ্ন দেখে তার কোল ভরে একটা নিষ্পাপ শিশু খেলা করবে, আধো আধো স্বরে মা বলে ডাকবে। যদিও ডাক্তার বলে দিয়েছেন, তিয়াসার গর্ভ এইমুহুর্তে সন্তান ধারণে অক্ষম। এখন দৈবই ভরসা! শ্যামলের বিমর্ষ ভাব দেখে আবার তিয়াসাই সান্তনা যোগায় ‘তুমি এতো ভেঙে পরো না দেখবে একদিন ঠিক আমাদের ঘর কচি পায়ের শব্দে ভরে যাবে’। শ্যামল এসব কথার কোন উত্তর দ্যায় না শুধু ভাবে একবার সায়ক্রায়াটিস্টের কাছে যাবে। আজকাল ঘুমের মাঝেও যেন রেডিওর শব্দ শুনে ধরমরিয়ে বিছানার ওপর উঠে বসে। আগের রেডিওটা ভেঙে ফেলতে খুব ইচ্ছে করেছিল কিন্তু সাহসে কুলায় নি তাই ওটাকে রথতলার সেই পুরনো বাড়িতেই ফেলে এসেছে।

অফিসের কাজে শ্যামলকে সপ্তাহখানেকের জন্যে ভুবনেশ্বরে যেতে হয়েছিল। হাওড়ায় নেমে প্রিপেড বুথ থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে নিউআলিপুরের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। বেল টিপতেই তিয়াসা দরজা খুলে দিল। আজ তিয়াসা কি সুন্দর সেজেছে আর ফ্ল্যাট-টাকেও ফুল দিয়ে নিজের মতোই সাজিয়েছে। শ্যামল বিস্ময় মাখানো দৃষ্টে চেয়ে থাকে! তিয়াসা হাঁসি হাঁসি মুখে বলল ‘আজ ডাক্তার সোমের চেম্বারে গেছিলাম, উনি আমাদের কংগ্র্যাচুলেট করেছেন’ শ্যামল অবুঝের মতো চেয়ে থাকে। তিয়াসা দুহাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে কিছু বলল।

(৫)

পুরীর সমুদ্রতটে শ্যামল আগেও একবার এসেছিল কিন্তু তখন জায়গাটাকে এতো আকর্ষণীয় মনে হয়নি এবারে যেমন হচ্ছে। তিয়াসা এখন সাত মাসের গর্ভবতী, ওর জন্যই এখানে আসা, প্রাকৃতিক পরিবেশে মেজাজ ভালো থাকবে যেটা এসময়ে বিশেষ প্রয়োজন। শ্যামল স্ত্রীর পরিচর্যায় কোনরকম খামতি রাখতে চায় না। মাস ছয়েক আগে যখন শ্যামল জানতে পারল তিয়াসা আবার মা হতে চলেছে, হাঁপ ছেড়ে বাচল, মনের কোনে জমে থাকা গ্লানি আর অপরাধবোধ তরল হয়ে যেতে সময় নিল না। চরম দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লড়তে গিয়ে একবার তাকে আপোষ করতে হয়েছিল সে আর কাকেই না করতে হয়। প্রতিটা সফল মানুষের সাফল্যের পিছনে কিছু না কিছু রহস্য থাকেই তা নিয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়া অর্থহীন। শ্যামল নিজেকে এভাবেই বুঝিয়েছে আর তাতে বিলক্ষণ কাজ হয়েছে। শ্যামল শান্তিতেই আছে। রিসর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে শ্যামল সমুদ্রের বুকে ঢেউয়ের ওঠানামা দেখছিল। তিয়াসা এসে আব্দার জুড়ল -কাজ মিটলেই চলে আসবে লক্ষ্মীটি একদম দেরি করবে না। দেরী শ্যামলও করতে চায় না। তিয়াসাকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে সেটাই জানিয়ে দিল। কিছু ব্যাক্তিগত মুহুর্ত কাটিয়ে শ্যামল স্যুটকেস হাতে জীপে গিয়ে বসল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিয়াসা হাত নাড়তে লাগল। তিয়াসাকে এখানে রেখে শ্যামল আপাতত কলকাতায় যাবে অফিসের কাজে, অবশ্য সপ্তাহখানেক পরেই ফিরত আসবে, এই কদিন তিয়াসার সাথে ওর মা থাকবে তিনিই দেখাশোনা করবেন। জীপ স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেল।

অফিসের কাজ সারতে সারতে রাত প্রায় দশটা হয়ে গেল। বাড়ি ফিরেই শ্যামল শাওয়ারে বেশ খানিকটা গা ভিজিয়ে নিল। ডিনার বাইরে সেরেই এসেছে, অতএব ও ঝঞ্জাট নেই। মোবাইলের স্ক্রীনে পরিচিত নম্বর ভেসে উঠল। তিয়াসা ফোন করেছে। তিয়াসার সঙ্গে মিনিট দশেক গল্প করার পর ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এলো। ঘড়িতে সোয়া এগারোটা বাজে। শ্যামল আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই হঠাৎ কিসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আওয়াজটা আসছে বাথরুমের দিক থেকে, শ্যামল ঘুমচোখে সেদিকে এগিয়ে গেল। অবাক কান্ড! বাথরুমের সবকটা কল কে যেন একসঙ্গে খুলে দিয়েছে। বেসিন আর বাথটব উপছে মেঝে জলে ভেসে যাচ্ছে। দ্রুতহাতে সবকটা কল বন্ধ করে হতভম্ব শ্যামল বেডরুমে ফিরল। শোবার ঘর থেকে সুরেলা আর পরিচিত একটা কন্ঠস্বর কানে ধাক্কা মারতেই মাথার চুলগুলো এবারে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যাবার উপক্রম হল। চটুল নারীকন্ঠ ঘোষণা করছে ‘ডেথ ওয়ান রেডিও স্টেশন’। ড্রেসিং টেবিলের ওপর কে যেন স্বযত্নে বসিয়ে দিয়েছে তিন বছর আগে রথতলার ভাড়া বাড়িতে ফেলে আসা দুর্লভ মল্লিকের রেডিও সেটটাকে! শুরু হল জাদুকরনি মায়ার অনুষ্ঠান। শ্যামল জীবন্মৃতের মতো শুনছে। মায়ার উদ্দাক্ত আহ্বান শ্যামলের প্রতি ‘কি হে আর কিছু চাইবার নেই নাকি তোমার?’ শ্যামল ঘামছে কুলকুল করে, বুকের শিরাটা দপদপ করে ওঠানামা করছে। মায়া তীক্ষ্ণ স্বরে বলল ‘মনে করাবার জন্য এলাম তোমার স্ত্রীর গর্ভস্থ সন্তান কিন্তু আমাদের’ শ্যামল বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠল ‘সেকি! কেন! এবারে তো কিছু নিই নি আমি’ মায়ার ব্যাঙ্গাত্মক হাঁসি শোনা গেল ‘প্রতিদিনই নিয়ে চলেছ আর আমরাও প্রতিবারে নিয়ে যাব’ শ্যামল হাতজোড় করে মেঝেতে বসে পড়ল ‘দয়া করো এরপর তিয়াসা আর বাঁচবে না’ রেডিওর বুক চিড়ে হিংস্র স্বর ভেসে এলো ‘দয়া! তুমি করেছ কাউকে? এতো অকালমৃত্যু আগাম জানার সত্বেও একজনকে রক্ষা করার কথাও কি ভেবেছিলে। শুধু নিজের স্বার্থ চিন্তাই করেছ, বাসনা পুর্ন হয়েছে এবারে মূল্য চুকাতে হবে’। রেডিও স্তব্ধ হয়ে গেল। শ্যামল উন্মাদের মতো হাহাকার করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।

 

Writer Sanjoy Bhattacharya

লেখক : সঞ্জয় ভট্ট্যাচার্য, পদ্মপুকুর রোড , কলকাতা।

বিঃ দ্রঃ : এই লেখাটি #মন_ও_মৌসুমী আয়োজিত Quaterly Creative Writing Competition , June 2019 এর একটি এন্ট্রি ।লেখাটি “Just Missed” এন্ট্রির অধিকারি হয়েছে। #মন_ও_মৌসুমী র তরফ থেকে লেখক-কে পুরষ্কার হিসাবে একটি গল্পের বই এবং একটি মেডেল দেওয়া হচ্ছে। অভিনন্দন লেখককে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here