কালিপদ – অনুগল্প

0
800
Photo :Pinterest

গুরুমশাই তার নামের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে বলতেন, “কি রে কালি /কোথায় গেলি?” বলেই হো হো করে হাসতেন। এ কথায় কালিপদ বিব্রত হয়ে বলতো, “এই যে গুরুমশাই আমি তো একেনেই আছি।” গুরুমশাই আরো জোরে হেসে উঠে বলতেন, “না রে তুই এখন অনেক দুরে । তা যা বাপু ঘুরেই আয়, আজ আর পড়া এগোবে না। মন তোর যাত্রা করেছে।” কালিপদর জীবনটা এইভাবেই চলছিল, তবে খুঁড়িয়ে চলছিল। মা তাঁকে জন্ম দিতে গিয়ে মরল আর বাবা মরল ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে সাপের কামড়ে। বাবার কিছু জমি ছিল তা কাকামশাই তাঁকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিজের করে নিল, এমন কি বাবার একচালা ঘরটা পর্যন্ত। তা ভালই হয়েছে। কালিপদ আবার বিষয় সম্পত্তি কিছু বোঝে নাকি? তার চেয়ে এই ভালো। অকৃতদার গুরুমশাই কালিকে স্নেহভরে নিজের কাছে রেখে দিলেন। গুরুমশাই মাঝে মাঝে উপনিষদের শ্লোক বলতেন । ” উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত-” “ওরে কালি এবার জেগে ওঠ বাপ, পাওনা যা আছে বুঝে নে”। ধুর! এতো শক্ত কথা কি মাথায় ঢোকে! তবে হ্যাঁ শুনে শুনে ‘শোলকটা’ মুখস্থ হয়ে গেছিল। কিন্তু তার যে কি পাওনা তা আর বোঝা হলো না। ইস্কুলের গণ্ডী পেরোবার আগেই গুরুমশাই ‘স্বগ্গে’ গেলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য নিজের ছোট কুঁড়ে ঘরখানা কালির নামে লেখাপড়া করে গেছিলেন। কিন্তু গুরুমশাই ছাড়া কি আর এখানে মন টেকে? তাছাড়া খাবে কি? ঘরে শিকল তুলে এক গ্রামতুত দাদার সঙ্গে কালি চলে এল কলকাতায় কাজের সন্ধানে। ব্যবস্থাও হলো একটা। বেশ বড় একটা ফ্ল্যাটবাড়ি পাহারা দেবার কাজ। একটা থাকার ঘরও দিয়েছে। সেই থেকেই কালির ‘কলকেতা’ বাস। এমন করে কালি কবে দশ বছর কাটিয়ে দিল নিজেও বোঝেনি। সেই গ্রাম , সেই মাঠ -ঘাট , একচালা ঘর কিছুই আর মনে পড়ে না সেভাবে, কেবল গুরুমশায়ের কথাগুলো কানে বাজে। “কিরে কালি/ কোথায় গেলি?” “এই তো গুরুমশাই আমি একেনে মানে কলকেতায়”। যখন পাহারা থাকে না গুরুমশায়ের সঙ্গে মনে মনে অনেক কথা বলে কালি। কিন্তু তার যে কি পাওনা ছিল সেটা আজও জানা হয় নি। চলছিল বেশ। কিন্তু দুখিনী পিসি সব এলোমেলো করে দিল। দুখিনী পিসি ৫০৬ নম্বর ফ্ল্যাটে কাজ করে । হঠাৎ করে বাপ মা মরা নাতনিকে নিয়ে হাজির। “বাবা কালি তিনকুলে আমার আর কেউ নেই। বয়স্থা মেয়েকে কোথায় রাখি? মেয়েটা কে উদ্ধার কর বাবা”। কালি পড়ল মহা মুশকিলে -কে কাকে উদ্ধার করে! লতিকাকে দেখে বড় মায়া হল, যেন লক্ষী ঠাকুর। রাজি হয়ে গেলো কালি। শুভদিনে কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে ওদের বিয়ে হোল। মায়ের চরণে প্রণাম করে মনে মনে গুরুমশাইকে স্মরণ করল কালি। “এ সোমসারখানা কি আমার পাওনা ছিল গুরুমশাই?” সন্ধে নেমেছে। কালি লতিকাকে ঘরে নিয়ে এলো। দু একজন যারা ছিল সবাই মিষ্টি মুখ করে চলে গেছে এমনকি দুখিনী পিসিও। ঘরে ঢুকে ঠাকুরের সমুখে একটা প্রদীপ জ্বালাল কালি। লতিকা মুখ নিচু করে বসে আছে। লাল শাড়ি, মাথায় সিঁদুর। ভারি সুন্দর লাগছে। “এইটুকু ঘরে এমন লক্ষী পিতিমে!” খুব লজ্জা করছিল কালির। একটা ভালো কাজ নেবে এবার। ৫০৬ নম্বর ফ্ল্যাটের বৌদিমণি থালায় করে খাবার সাজিয়ে নিয়ে এল, “কাল থেকে রান্না কোরো কেমন”। রাত বাড়ছে। লতিকা খুব জড়োসড়ো। নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। কালি খাবারের থালা নিয়ে লতিকার কাছে বসল। খেতে খেতে গল্প করা যাবে। একি! লতিকা এমন করছে কেন? শারীরখানা কি খারাপ লাগছে? লতিকা দৌড়ে বাথরুমের দিকে গেলো। ঘর থেকে বমির আওয়াজ পেলো যেন! বাথরুমের দরজার সামনে উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছিল করছিল কালি। ওপরে একজন ডাক্তারবাবু আছে, ডেকে আনতে হবে । লতিককে ধরে ধরে বিছানায় বসালো কালি। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “তুমি শুয়ে থাকো আমি ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনি -এই যাব আর আসবো।” লতিকার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল, হঠাৎ করে কালিপদর পা জড়িয়ে ধরলা! “ওগো আমি জানি আমার কি হয়েছে! তুমি আমায় ক্ষমা কর , আমার যে আর কোনো উপায় ছিল না”। কালিপদ হতবাক, লতিকাকে ধরে বসালো, চোখ মুছিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে সস্নেহে বললো, “শান্ত হয়ে বসো দিকি। ঠিক আছে কাল সকালে সব শুনব, একন ঘুমিয়ে পড়”। লতিকা অঝোরে কেঁদে চলেছে, “দয়া কর আমায় , আমায় তাড়িয়ে দিও না!” কালির নিজেকে অসহায় লাগছিল। লতিকা এমন কথা কেন বলছে ? ছি ছি এমন কথা বলতে আছে? লতিকা দু হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকল, কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “আমি মা হতে চলেছি। গেরমের এক শয়তান বিয়ে করবে বলে আমায় আশা জাগিয়েছিল গো। আমি আশ্রয়ের লোভে পাপ করেছি। আমায় তুমি তাড়িয়ে দিয়ো না। দয়া কারো! দয়া কর!” কালি চুপ করে বসে রইলো অনেকক্ষণ। মাঝ রাত পেরিয়ে গেছে। ঠাকুরের সমুখের প্রদীপটা নিভে গেছে। লতিকাও কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। গুরুমশায়ের হাসি কানে এলো “কি রে কালি, কোথায় গেলি?” “আমি তো একেনে গুরুমশাই। মহা আতান্তরের মধ্যে! আপনি আমারে পথ দেখান”। গুরুমশায়ের উদ্দ্যেশ্যে হাতজোড় করে প্রণাম করলো কালি। “জেগে ওঠ বাপ ,পাওনাটা বুঝে নে”। দিনের আলো একটু একটু করে ফুটছিল। লতিকা উঠে বসেছে। ওর দুচোখে জিজ্ঞাসা। কালি ওর কাছে গেল। চোখে চোখ রেখে গুরুমশায়ের মতো করে বললো, “ওঠো লতু তোমার পাওনা বুঝে নাও। এতো তোমার সোমসার তোমাকেই তো গুইছে নিতে হবে না কি গো”। লতিকার দুচোখে তখন নির্ভরতার উপচে পড়া জল। সূর্যের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। লতু চা বসালো।
এখন কালি দিব্বি আছে তার ফুটফুটে মেয়ে আর লক্ষী ‘পিতিমের’ মত বৌ নিয়ে। শুধু ঠিকানাটা বদলে গাছে। ‘কলকেতার’ বাস তুলে আবার ‘গেরামে’ গুরুদেবের আস্তানায় এসে উঠেছে কালি। চাকরির জমানো টাকায় জমি কিনে চাষবাস করে বেশ আছে সে। এতদিনে পাওনাটা বুঝতে শিখেছে যে!!

শর্বরী চক্রবর্তী

লেখিকা : শর্বরী চক্রবর্তী 

লেখিকার কলম থেকে : অভিনয় আমার প্রথম প্রেম। মঞ্চ অভিনয়ের পাশাপাশি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের নাটকের শিল্পী।বাংলা নিয়ে পড়ার শখ থাকলেও ঘটনাচক্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর করেছি। ছোটবেলা থেকেই একটু আধটু লেখার চেষ্টা করতাম।বর্তমানে অবসরে লেখালিখি করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here