ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সারা ভারত বর্ষ ব্যাপী ছোট ছোট শহর গ্রাম,জনপদ হোলি খেলার রঙে মাতোয়ারা। এই হোলি উৎসব ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় রঙিন আমেজ বহন কারী,সম্প্রীতি ও মেলবন্ধনের বার্তা বাহক।নানান উৎসবের ভিড়ে হোলির আকর্ষণ ,রং,আবির নিয়ে উন্মাদনার পারদ উৎসব শুরুর আগে থেকেই চড়তে থাকে সারা দেশ ,রাজ্য,শহর,গলি মহল্লা জুড়ে টান টান উত্তেজনায়,আনন্দের পরশে। দিন যত যাচ্ছে,হরেক রকম আইটেম, পিচকারীর অভিনবত্ব,পরচুলা,মুখোশের রকম ফের আর কত রকমের যে আবিরে সেজে উঠছে দোকান গুলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।কৌতুহলি কচি কাঁচা ও ক্রেতাদের ভিড়ে ঠাসা এ প্রাণের উৎসব যেন,প্রহর গোনার অপেক্ষায় থাকে।
এক মুঠো আবির ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করে তারপর গুরুজনদের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বন্ধু-বান্ধব পরিবার-পরিজন যেভাবে আবিরের রঙিন আমেজে মেতে ওঠে এই মিলন উৎসবের সান্নিধ্যে তা এককথায় অপরূপতা। মহান দেশ ভারতের মাধুর্যতা,ঐক্য বহনকারী এই দোল বা হোলি উৎসব ,অল্পবিস্তর আবির,রং মাখানো দিয়ে আনন্দের বার্তাবহন করতে পারলেও ,ইদানিং কোথাও যেন একটা ভয় নোংরামি ,অশ্লীলতার প্রলেপে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে এই রঙ খেলা।সারা দেশ জুড়ে এই উৎসব ঘিরে উশৃংখলা আগেও ছিল, বিশেষ কিছু কমিউনিটির সদস্যরা, ভীষণই রংদার হোলি খেলতে অভ্যস্ত হলেও সেটার একটা ঘেরাটোপ ছিল,কিন্তু এই রং খেলার আড়ালে যেন খুল্লম খুল্লা একটা নোংরামি,প্রকাশ্য যৌনতা দিনকে দিন মাত্রা ছাড়াচ্ছে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দোল বা হোলি খেলার নানা পৌরানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।বিষ্ণু ভক্ত প্রহ্লাদ বিষ্ণুকে তার পিতার থেকে উচ্চে স্থান দেওয়ায় হিরণ্যকশিপুর নির্দেশে তার বোন হোলিকা, প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করেন। বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অক্ষত থাকলেও অগ্নি দগ্ধ হয়ে হোলিকার মৃত্যু হয়। অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কাহিনী দোলের আগের দিনের হোলিকা দহন নামে পরিচিত ।অপরটি হলো রাধা কৃষ্ণের লীলাখেলা,প্রেম ভালোবাসা দেহ তত্ত্বের ব্যাখ্যায় হোলি খেলার সূত্রপাত।কথিত আছে একবার সখীদের সাথে খেলায় মগ্ন রাধিকার বস্ত্র হঠাৎ অঙ্গ থেকে খসে পড়ায়,রাধার বিরম্বনার শেষ নেই। রাধার লজ্জা নিবারণে হঠাৎ কৃষ্ণের আবির্ভাবে সখিদের সঙ্গে রং খেলা শুরু ও রাধার উন্মুক্ত দেহ রং মাখিয়ে ঢাকার প্রয়াস থেকে নাকি এসেছে হোলি খেলা।
অপর লোক গাথা থেকে জানা যায়,রাধার অপরূপ গায়ের রঙে, ঈর্ষান্বিত শ্রীকৃষ্ণ নাকি ভূতের মত রাধাকে রঙ মাখিয়ে উল্টে যখন দেখেন রাধার রূপ আরো অপূর্ব হয়ে উঠেছে,সেই থেকে ব্রজধামে প্রতিবছর হোলি উৎসব চলে আসছে।কেউ বলেন, দেহতত্ত্ব প্রেমে পাগলিনী রাধা নিজেকে উজাড় করে সর্বস্ব কৃষ্ণকে উৎসর্গ করলে উনি রতিক্রিয়ায় কামকলার প্রয়োগে রাধিকার শরীরে সরাসরি এঁকে দেন ভালবাসার চিহ্ন ।রাধিকাকে,সে লজ্জা থেকে মুক্ত করতে শ্রীকৃষ্ণ রাধার অঙ্গ, রঙ দিয়ে ভরিয়ে তোলেন।
হোলি খেলার সূত্রপাত বিষয়ে নানা মত প্রচলিত থাকলেও একটা বিষয় পরিষ্কার যে ফাগুনের মিষ্টি সুবাসে মাতোয়ারা মন-প্রেম কখনো মনে,কখনো শরীরে মিষ্টি সুবাস এনে দেয়।কৃষ্ণের অনুরাগে রং খেলার সাথে প্রেম ভালোবাসা,শরীরী দেহ তত্ত্ব জড়িত থাকার উন্মাদনা সেই আদি কাল থেকে আজও চলে আসছে । কোথাও যেন রং খেলার মধ্যে নারীর শরীরী আকর্ষণ,প্রেমিকাকে রং দেওয়া,ক্ষনিকের স্পর্শ এক অদ্ভুত শিহরণ মাখা হয়ে কখনো জোড় করে কাউকে রং দিয়ে বিব্রত করার মধ্য দিয়ে,না পাওয়ার গ্লানি থেকে দেখ কেমন লাগে এই প্রতিশোধ স্পৃহা হোলির মিলন উৎসবকে কিছুটা হলেও কালিমা লিপ্ত করছে। উৎসবের মধ্যে যখন বেহায়াপনা,নোংরামি ঢুকে যায় তখন তার মধ্যে এসে যায় ভীতি,আড়ষ্টতা,যা উৎসবের মহান উদ্দেশ্যর অবশ্যই পরিপন্থী।
উশৃঙ্খল সৃষ্টি করার মানুষ জন আগেও ছিল এখনও আছে কখনো তারা থাকে সভ্য সমাজের চাপে অবদমিত হয়ে থাকে কিন্তু কখনো সুযোগ পেলেই উশৃংখলতার নমুনা খুল্লামখুল্লা পেশ করে নিজেদের জাহির করার প্রবণতায়।তারা অপেক্ষায় থাকে কখন টুক করে বাঁদরামির নজির স্থাপন করেই কেটে পড়বে।ইদানিং যত বেশি স্বাধীনতা,ইন্টার নেটের রমরমা,প্রকাশ্যে যৌনতার রগে রগে ভিডিও মাকড়শার জালের মতো ছড়াচ্ছে,বখাটেদের বেলেল্লাপনা,কাণ্ডকারখানা তত বেশি মাত্রা ছাড়াচ্ছে,এ এক রুচিহীন দূষণ, সুস্থ সমাজ,সংসার কে ,মানুষে মানুষে সম্পর্ক কে বিষিয়ে দিচ্ছে।
হোলির রং মাখানো কেন্দ্র করে আড়ালে প্রকাশ্যে কত রকমের যে অশ্লীলতার কান্ড জোরপূর্বক ঘটানো হয় তা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। ভালো মানুষের ভিড়ে বরাবরই ঔদ্ধত্বপূর্ন, কাউকে তোয়াক্কা না করা বা নোংরা মনের অনেকে, নারীদের প্রতি ছুঁক ছুঁক করা মানুষ গুলো লুকিয়ে থাকলেও হোলির রঙ মাখানোর আড়ালে সুযোগ পেলেই নখ দাঁত বের করে হিংস্রতার সুযোগ নেয়। সারা বছর যার কাছে ঘেষতে পারেনি কিংবা কোন ভাবে প্রেমে ধাক্কা খেয়ে অপমানিত হওয়ার বদলা মনে পুষে, দগ দগে ঘা হওয়া অতীতকে সঙ্গে নিয়ে,কেউ কেউ এই হোলি খেলার সুযোগকে কাজে লাগায়। কেউ কেউ অতি উৎসাহী ঝপ করে কোপ মারার মতো অপেক্ষায়, একাকী অসুরক্ষিত মহিলা পেলেই বিব্রত করার ঘৃণ্যতাকে প্রশয় দেয়। হোলির দিন একটু বেলা করে চোখ কান খোলা রেখে গলি মহল্লাতে বেরুলেই সহজেই নজরে পড়বে এই সব লালসার চোখ নিয়ে শকুন বাহিনীর রংবাজি, বাইক রেসিং যদিও এসব আর নতুন নয় একটা প্রকাশ্যে কিছু ঘটাতেইই পারি এ দাপট ,জনজীবন কে,সুস্থ সংস্কৃতিকে অস্থির করে তুলছে।
পারিবারিক অনুষ্ঠান গুলিতে রং মাখানো কে কেন্দ্র করে পর্দার আড়ালে অনেক সময় অশ্লীলতাকে আড়াল করা হলেও আচার আচরণে ,তার ওপর ফেসবুক আপডেটে তা আর অপ্রকাশিত থাকে না।যেটা থাকে তা হলো দাবিয়ে রাখা,মুখ না খোলার পুরুষ তান্ত্রিক হুমকি ।ব্যস্ততার যান্ত্রিক জীবনে সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব অতি আধুনিকতার খুব চেনা এক বৈশিষ্ট্য ,যত সম্পর্কের মধ্যে বাড়ছে টানাপোড়েনে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব ,তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাব আর এসবের মধ্যেই হোলিতে রং খেলা,”টাচ মি টাচ মি” বুড়ি ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা।এমনিতেই নামেই নারী পুরুষ সমতার এই আধুনিক সমাজে নারীদের প্রতি বেলেল্লাপনা,বেহায়াপনা ,কটূক্তি প্রদর্শন কড়া আইন থাকা সত্ত্বেও যথেচ্ছ ভাবে অব্যাহত ।তারওপর যে হোলি খেলার উৎসেই আছে শ্রীকৃষ্ণ-রাধিকার প্রেম লীলা সেখানে এই উৎসবের মেজাজে একটু বেশিই যেন যুব সমাজ অতি আধুনিকতার পাঠ পড়ে বেসামাল হয়ে পড়ে।তবু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কাছে সুন্দর ভারসাম্য রক্ষাকারী সমাজের স্বার্থে বখাটে পনা,অতি মাতলামি রুখে দেবার আহবান জানাই।বেঁচে থাকুক সম্প্রীতি রক্ষায় রঙ খেলার মাধুর্য্য,বেঁচে থাকুক দেশের সুস্থ সংস্কৃতি।
লেখক পরিচিতি : রাণা চ্যাটার্জী, বিবেকানন্দ কলেজ মোড়, পোস্ট-শ্রীপল্লি, বর্ধমান পূর্ব