লোনাভেলা খুব বিখ্যাত মুম্বাইবাসী দের কাছে। বৃষ্টির দিনে খালি খালি মন কেমন করে লোনাভেলা-খান্ডালা যাওয়ার জন্য। এমনি এক বৃষ্টির দিনে আমিও রওনা দিয়েছিলাম স্বামী আর পুত্র-কন্যা নিয়ে লোনাভেলার উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল।Karla cave নামে একটি দর্শনীয় জায়গা আছে সেখানে। সুন্দর পাথরের ভাস্কর্য সেখানে,না গেলে বোঝানো খুব মুশকিল সেই জায়গার সৌন্দর্য। যা মন থেকে উপভোগ করার জিনিস, হঠাৎ দেখলে মনে হবে কি আর এমন কিন্তু যখন চারিদিকে বিশাল বড় বড় পাথরের মূর্তি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তখন মনে হলো এ কি করে সম্ভব! এই cave এ যাওয়ার সময় অনেক সিঁড়ি চড়তে হয়, ওঠার সময় মনে হচ্ছিল পারবো তো!কিন্তু পারলাম হয়তো চারিপাশের দোকান দেখতে দেখতে সময় টা পেরিয়ে গেলো।বেশ কিছু বড় দোকানের সাথে কিছু কিছু দোকান ছিল বাদামের। খোলা শুদ্ধ বাদাম , আর সেগুলো নিয়ে বসেছিল বেশ কিছু বয়স্ক মহিলারা। পথে ঘাটে আগে অনেক বয়স্ক মহিলা দেখেছি,কিন্তু এমন ভাবে আগে কখনো বিষয়টাকে উপলব্ধি করিনি। খুব বৃষ্টি ছিল তখন তার মধ্যে মাথায় কোনো রকমে একটা করে ছোট্ট ছাউনি দিয়ে তারা পথচলতি মানুষ কে বাদাম কেনার জন্য বলছে। যারা পড়ছেন তারা ভাববেন তাতে কি ,এরকম তো কত লোকেই করে এটাই তাদের রোজগার। কিন্তু না, বিষয় টা আমার কাছে এতোটাও সহজ ছিল না। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় খুব বৃষ্টি এসে যাওয়ায় একটি দোকানে আমরা কিছুক্ষন দাড়াই, তার ঠিক উল্টো দিকে ঐরকম একটা বাদামের দোকান।খুব বৃষ্টি থেকে বাদমগুলো বাঁচাবার কোনো উপায় ছিল না তার, সে নিজে ছোট্ট একটি বেতের ছাতার নীচে কোনোরকমে বসে ছিল আর বাদাম গুলো তার আঁচল এ ঢেকে রেখেছিল। ওই বৃষ্টিতে তার আঁচল , বাদাম দুটোই ভিজে একাকার। আমি কিছুক্ষন দাড়াই বৃষ্টি কমার পর কি হবে সেটা দেখার জন্য। বৃষ্টির পর ওই মহিলা তার ভেজা কাপড় নিংড়ে গায়ে জড়িয়ে বাদাম গুলো আবার সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলো। ভীষণ ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছিল তখন।কিন্তু মহিলা বোধহয় তার রোজের অভ্যাস বশত এসব বাধা অনেক আগেই অতিক্রম করেছিলেন। আমার এত ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলেন এক ভদ্রলোক, বেশ সুন্দর পোশাক তার পরণে।সে এসে “আই ” বলে প্রণাম করলো ওই মহিলা কে, আর তার ঝুড়ি থেকে বাদাম তুলে খেতে খেতে গল্প করতে লাগলো। আমার মনে মনে খুব রাগ হলো, ইসস কি বাজে লোক রে বাবা, দাম দেবে না নিশ্চই। যাই হোক , আমি ভেবে কি করবো ,তাই আমি আবার সিঁড়ি চড়তে শুরু করলাম।আর তখনই সেই অবিস্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী হলাম। শুনতে পেলাম আশেপাশের বাকি মহিলারাও ওই ব্যক্তির সাথে জোরে জোরে হেসে মারাঠি ভাষায় কিছু বলছে।আমি আবারো একটু দাঁড়ালাম আর অপেক্ষা করলাম। আমার পরিবারের বাকিরা তখন সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা এগিয়ে গেছে। আমার কৌতূহল মেটাবার জন্য আমি আমার সামনের এক মহিলা কে জিজ্ঞেস করলাম ওই ব্যক্তি কে? উত্তরে আমি অবাক, উনি ওই মহিলার ছেলে এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত।ছেলে মা কে বহুবার বারণ করেছে এখন র বাদাম না বেচতে,কিন্তু ওর আই এখনো বাদাম নিয়ে বসে তার পুরোনো বন্ধুদের সাথে,পুরোনো একই সেই জায়গায় অনেক নতুন ঘটনার সাক্ষী হতে। তাদের বাদাম হয়তো রোজ বিক্রি হয় না কিন্তু মনটা বিক্রি হয় ওই cave ঘুরতে আসা ছোট শিশুদের কাছে।এ এক অদ্ভুত অনুভূতি আমার কাছে। এবার দেখছি ওই ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন র সবার থেকে বাদাম নিচ্ছেন,বলতে পারি কিনছেন। এটাই হয়তো তার মা কে দেওয়া তার রোজের প্রনামি। আমার মনে হলো ওপরে cave এর দেবী দর্শনের আগেই আমি যে মাতৃত্বের দর্শন করলাম তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। তবু চেষ্টা করলাম, মা সবসময় পূজনীয় কিন্তু এমন করে সন্তান মানুষ করতে পারে যে মা সে অনুসরণীয়।আজকের যুগে সবাই তো নিজের ভালো বুঝি, কিন্তু পরের হাসি পরের দুঃখের জন্য যে মা সন্তান কে যোগ্য করে তোলে তাকে আমার অনেক কোটি প্রণাম। সত্যি এখনো সমাজ শেষ হয়ে যায়নি হয়তো। ঘটনাটি পরে তোমাদের হয়তো খুব সাধারণ মনে হবে কিন্তু আমার কাছে বাস্তবের এক অনন্য অভিজ্ঞতা।।
নীলাঞ্জনা সরকার এর কলম থেকে —
“ছোটবেলা থেকে কবিতার আর গল্পের প্রতি আকৃষ্ট আমি। তবে কবিতা লেখার শুরু , নিজের প্রতি ভালোবাসা থেকে। মনে হয় কিছু শব্দ যা মনের মধ্যে খেলা করে তাকে একটু কলমের ছোঁয়া দি। জানিনা কতটা কবি হতে পেরেছি, তবে এতটুকু বিশ্বাস রাখি নিজের মনের আয়না হয়ে উঠতে শিখছি।“
এই লেখিকার আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন অপেক্ষার-উৎসব রোজনামচা আমি-বিপ্লব ক্ষত মানসী-কিনবে-গো মনোস্কামনা সংগ্রাম আমি-নারী
খুব সুন্দর, এমন মাকে আমি ও প্রনাম জানালাম 🙏