অঙ্কন : অহিজিৎ সরকার
    “চক্রবত্ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ”……
সবার জীবনের চাকা হয়তো পরিবর্তন হয় না। কারোর জীবনের চাকাটি দুখের বন্দরে পৌঁছেই আটকে যায় চিরকালের মতো। আর চলতে চায় না। নানারকম দ্বন্দ,ঝড়, ঝাপট, বিপদ কাটিয়েও তারা কিছুতেই তাদের ভাগ‍্যচক্রটিকে নিয়ে সুখের বন্দরে পৌঁছতে পারে না। এরকমই চিরকাল দুখের বন্দরে দাঁড়িয়ে থেকে দুখের সাথে লড়াই চালিয়ে গেছে শান্তি ঠাকুমা।
      আমাদের পাড়ায় ছোট্ট একফালি দখলি জমিতে ওপরে টালি আর চারপাশে বেড়া দেওয়া একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে সংসার পেতেছিলো শান্তি ঠাকুমা। একপাশে আমাদের গুহ রায় পরিবারের বাড়ি আর একপাশে ভট্টাচার্য্য পরিবারের বাড়ির মাঝখানে গাছপালায় ঘেরা ছোট্টো কুঁড়ে ঘরটি আজো ছবির মতো আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। আর মনে পড়ে সেই চির অভাগী ছোট্টোখাট্টো চেহারার রোগা পাতলা ফর্সা গড়নের শান্তি ঠাকুমাকে। অসুস্হ হাপানি রোগে আক্রান্ত স্বামী, দুই মেয়ে (আহ্লাদী ও ভুলন) আর একমাত্র ছেলে সুজিতকে নিয়ে ছিলো তাঁর সংসার। আমরা যখন খুব ছোট্টো ছিলাম তখন খেলতে গিয়ে শুনতে পেতাম ওর স্বামীর হাপানির টানের সাথে কাশির আওয়াজ। আর দেখতাম মানুষটি সংসার চালানোর জন‍্য মাথা গোঁজ করে বসে ঔ অবস্হাতেও বিড়ি বেঁধে চলেছে একনাগাড়ে। লোকের বাড়ি কাজ করে কোনোরকমে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াটুকু শেখাতে পেরেছিলো ঠাকুমা। শান্তি ঠাকুমার বাড়ির উল্টোদিকে ছিলো বর্মণ রায় পরিবার। ওদের সাথে আত্মীয়ের নয় কিন্তু এক আত্মার সম্পর্ক ছিলো শান্তি ঠাকুমাদের। আমরা পাড়ার সব ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা ঠাকুমা বলে ডাকলেও বর্মণ বাড়ির ছেলেমেয়েরা ওনাকে আম্মাবউ বলে ডাকতো। আমার ঠাকুমা, বর্মণ বাড়ির ঠাকুমা আর শান্তি ঠাকুমার সম্পর্ক ছিলো প্রাণের বন্ধুর। লক্ষ্মী পূজোয় একসাথে বসে নাড়ু বানানো, বিজয়া দশমীতে মাকে বরণ করতে যাওয়া, গ্রীষ্মকালের আমের আচার, শীতকালে  মূলোর অম্বল বানানো (মূলো, নারকেল আর চালতা দিয়ে টক) আর দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর  উঠোনে রোদে একসাথে বসে চুল শোকাতে শোকাতে সংসারের টুকিটাকি আলোচনার বাদ পড়েনি কখনো। এইভাবেই সবার সাথে একসাথে মিলেমিশে থেকে সবার সাহায‍্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন সামান‍্য আয়োজনে কিন্তু অনেক যত্নে।
      হঠাৎ একদিন ভোরবেলা শান্তি ঠাকুমার ডাক ছেড়ে কান্নার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো আমাদের সকলের। জানা গেল চলে গেলেন তাঁর স্বামী। একমাত্র ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে বিড়ি বেঁধে, নানারকম কাজ করে কোনোরকমে দিন চলে যাচ্ছিল। এতো অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো তাঁর জীবনে। বেশ কয়েকদিন ছেলে সুজিতকে নিয়ে বর্মণ বাড়ির সাহায‍্যে তাঁদের দিন কাটাতে হচ্ছিল। মেয়েদের শ্বশুড় বাড়ির অবস্হাও “নুন আনতে পান্তা ফুরানো”র মতো। তাই মা ভাইয়ের দায়িত্ব নেওয়ার মতো ক্ষমতা তাঁদের ছিলো না। আমাদের পাড়ার এই দু তিনটি বাড়ির ওপর নির্ভর করেই তাঁদের মা ও ছেলের দিন কাটছিলো। সুজিত কাকু ছিলো খুবই  শান্ত, ভদ্র ও নিরীহ। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কখনোই তাঁকে মাথা তুলে হাঁটতে দেখিনি। ছোটোবেলা থেকে দেখে আসা এতো দুঃখ, দারিদ্রতা  অন‍্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা তাকে যেন ভেতরে ভেতরে অনেকটা বড়ো করে দিয়েছিলো। তাই কিছুদিনের মধ‍্যে সে কাজ জুটিয়ে নিলো বারাকপুরের শান্তিবাজারের এক জুতোর দোকানে। সুজিত কাকু তার মাকে খুবই ভালোবাসতো। মার কষ্ট তাকেও খুব কষ্ট দিতো। তাই জুতোর দোকানে কাজ পাওয়ার পর ভেবেছিলো মাকে আর কষ্ট পেতে দেবে না। আর কোথাও কাজ করতে দেবে না। মা আর ছেলে মিলে খুব ভালো থাকবে। কিন্তু জীবন খাতার প্রতি পাতার হিসেব গুলোতো অন‍্যরকম ভাবে কষা থাকে, যা আমরা মেলাতে পারি না।
      একদিন রাতে বাড়ি ফিরলো না সুজিত কাকু। সারারাত চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না শান্তি ঠাকুমা। পরেরদিন ভোর হতেই বর্মণ বাড়ির এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ছুটলো সেই দোকানের মালিকের বাড়িতে। খোঁজ করে জানা গেল, একসপ্তাহ হয়ে গেছে সুজিত কাকু ঐ দোকানের কাজ ছেড়ে দিয়ে শিয়ালদহে কোনো একটা জুতোর দোকানে কাজে ঢুকেছে। দুদিন ধরে অনেক খোঁজাখুজির পর দোকানের খোঁজ পাওয়া গেল। জানা গেল তিনদিন আগে সে মাইনার কিছু টাকা অগ্রিম নিয়ে আর মার জন‍্য পছন্দ করে একজোড়া জুতো নিয়ে রাত দশটা নাগাদ দোকান থেকে বেরিয়েছে। আসলে এতোটাই অভাব ছিলো যে শান্তিঠাকুমার পায়ে পড়ার জুতোটা কেনারও কোনো সামর্থ ছিলো না  একটা হাওয়াই  চটি অবশ‍্য পায়ে গলাতো, যেটার সামনেটা ছিলো সেফটিপিন দিয়ে আটকানো আর পেছনটা ক্ষয়ে গিয়েছিলো। অনেকদিনই সেফটিপিনের খোঁচায় আর পায়ের গোড়ালিতে কিছু ঢুকে খুবই  কষ্ট পেতে দেখতো মাকে। তাই মাকে না জানিয়েই কলকাতায় জুতোর দোকানের কাজটা নিয়েছিলো। তিনদিন পর মর্গ থেকে উদ্ধার হয়েছিলো সুজিত কাকুর দেহটা।  কাজ থেকে  লাস্ট ট্রেনে করে ফেরার সময় দমদম আর বেলঘড়িয়ার মাঝে একটা লাইট পোস্টে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিলো। থানা থেকে জানানো হয়েছিলো মৃত‍্যুর পরেও মায়ের চটি জোড়া বুকের মধ‍্যে জাপটে ধরা ছিলো। সেই চটি জোড়া আর অগ্রিম টাকাটা শান্তিঠাকুমার হাতে তুলে দেওয়া হলেও কোনোদিন তা পরে দেখেনি।  মাথার খুলি খুলে গিয়ে ডান চোখটা বেরিয়ে এসেছিলো সুজিত কাকুর। তখন খুব ছোটো থাকা সত্বেও মায়ের কথার অবাধ‍্য হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম  দেখতে, সুজিত কাকুকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর। সেদিনের সেই দৃশ‍্য আর শান্তি ঠাকুমার “ওরে সুজিতরে মাকে ছেড়ে কোথায় গেলিরে বাপ” বলে বুকফাটা কান্নার আওয়াজ আজ ও মাঝে মাঝেই আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। মায়ের প্রতি এতো ভালোবাসা ছিলো বলেই হয়তো নিয়তি তাকে এতো নিষ্ঠুর ভাবে মায়ের থেকে কেড়ে নিয়েছিলো। তাই হয়তো বলে “নিয়তি”।
       তারপর সব যেন কেমন হয়ে গেল। সব কিছু নষ্ট হয়ে গেল। বেশ কয়েকবছর শান্তি ঠাকুমার মাথার ঠিক ছিলো না। ছোটো পাড় আলা সাদা মলিন একটা শাড়ি পড়ে, ডান হাতে একটা থলে ঝুলিয়ে, ঐ ছেড়া চটি ঘষে ঘষেই কোনোরকমে কাজে যেতো। মেয়েরা মায়ের ঐ একচিলতে জমিটুকুও বিক্রি করে দিলো সামান‍্য কিছু টাকার লোভে। প্রোমোটার তার ঐ ছোট্টো কুঁড়েঘরটি ভাঙ্গার আগেই সকাল বেলা কাজে যাওয়ার সময় ছেলের পথ ধরেই (ট্রেনে কাটা পড়েছিলো) ছেলের কাছে চলে গিয়েছিলো শান্তি ঠাকুমা।
      বহুবছর কেটে গিয়েছে। শান্তি ঠাকুমার ছোট্টো এক ফালি জমিটার ওপরে গড়ে তোলা হয়েছে একটা বিলাসবহুল ফ্ল‍্যাটের গ‍্যারাজ ঘর।  যার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আজ ও আমি দেখতে পাই একটা বেড়া দেওয়া টালির ঘরে টিমটিম করে জ্বলছে কুপির আলো আর শুনতে পাই এক অভাগিনীর বুকচাপা কান্নার আওয়াজ।

কলমে ববিতা সরকার(গুহ রায়), বেলঘড়িয়া, কলকাতা

পড়তে, পড়াতে, মনের কথা সহজ ভাষায় লিখতে, গান গাইতে ভালোবাসি…



LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here