মৃত্যু যন্ত্র -ছোট গল্প

0
1820
Photo :albiladpress

(১)

জীবন মালাকারের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল নেহাত আকস্মিক ভাবেই। টাইমস্‌ অফ ইন্ডিয়ার মাঝের পাতায় ছাপা জীবনবাবুর লেখা প্রবন্ধটি আমার যে শুধু নিছক ভালো লেগেছিল তাই নয় সত্য কথা বলতে সেটি আমার মধ্যে অতিপ্রাকৃত বিষয়ে কৌতূহলেরও সঞ্চার করেছিল। রচনাটি পরলোকগত আত্মা বা অতীন্দ্রিয় বিষয় সমূহের ওপর ভিত্তি করে লেখা। যেমন দুর্দান্ত লেখনী তেমনি সাবলীল ভাষায় ভদ্রলোক নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে গেছেন। তার বক্তব্য অনুসারে দেহাতিত মৃত আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বৈজ্ঞানিকেরা এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে আদৌ রাজি নন, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিজ্ঞানের এতবড় একটা ক্ষেত্র চূড়ান্ত অবহেলিত হয়েই পরে রয়েছে। পরলোক শাস্ত্রের চর্চাকারীদের সাধারন মানুষ এখনও সেই তান্ত্রিক, ওঝা অথবা নিম্নশ্রেণীর প্রবঞ্চক ব্যাতিত অন্য কিছু বিবেচনা করে না। দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা গেছে এরকম একটা প্রায়ন্ধকার অথচ চিত্তাকর্ষক বিষয়ে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করলেও যথাযোগ্য মর্যাদা দেবার মতো মানসিকতা আজও আমাদের সমাজের হয় নি। ভদ্রলোক নিজের বক্তব্যের সমর্থনে এবারে দেশ বিদেশের এমন কিছু অলৌকিক ঘটনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন যেগুলি নিঃসন্দেহে ইন্টারেস্টিং। প্রবন্ধটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক পরপর দুবার পরে লেখককে একটা চার লাইনের অভিনন্দনবার্তা টাইপ করে নিচে দেওয়া ই-মেলে পাঠিয়ে দিলাম।

আমার পরিচয়টা অবশ্য এতক্ষণ দেওয়া হয় নি। আমার নাম অরুন মিত্র। একটা বহুজাতিক সংস্থায় উচ্চ পদে কর্মরত। বয়স প্রায় তেত্রিশ, বিয়ে করিনি, ফার্ন রোডের এক কামরার ফ্ল্যাটে একাই থাকি। পড়াশোনার সূত্রে কিছুদিন বিদেশে থাকতে হয়েছিল সেই থেকে নিজের সব কাজ নিজেরই করার অভ্যাস ধরে গেছে তাই এই বাড়িতে কোন কাজের লোক নেই। সবাই বলে আমি নাকি খুব একটা মিশুকে নই তাই পেশাগত জগতের বাইরে বিশেষ বন্ধুবান্ধবও তৈরি হয় নি। আমার একমাত্র বন্ধু, স্কুলের সহপাঠী বিকাশ যে এখন কালিম্পঙে একটা চা বাগানে ম্যানেজারি করছে সুতরাং কলকাতা শহরে আড্ডা মারার মতো লোক তেমন কেউ নেই, তাতে অবশ্য অসুবিধে কিছু হয় না। দিনের সিংহভাগ অফিসের কাজে দিয়ে বাকি সময়টা টিভিতে পুরানো দিনের সিনেমা দেখে বা দেশী বিদেশী উপন্যাস পরে সময় ভালোই কেটে যায়। আর আছে ছুটি ছাটা পেলেই এদিক সেদিক ঢুঁ মেরে বেড়াবার অভ্যাস, সঙ্গী অবশ্য কাউকে পাইনা আর সেক্ষেত্রে আগেই বলেছি আমার কোন আক্ষেপ নেই।

এরপর কয়েকটা দিন কাজের চাপে জীবনবাবুর কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। সেদিন ই-মেল খুলতে হঠাৎ জীবনবাবুর বার্তা দেখতে পেলাম। ভদ্রলোক ধন্যবাদ জানিয়ে উত্তর দিয়েছেন। এরপর থেকেই জীবনবাবুর সঙ্গে বৈদ্যুতিন পত্রালাপ শুরু হয়ে গেল। যদিও ভুত প্রেত নিয়ে এযাবৎ মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করিনি কিন্তু জীবনবাবুর এই বিষয়ে তীব্র আগ্রহটা যেন ধীরে ধীরে আমার মধ্যেও সংক্রামিত হয়ে পরছিল। একদিন জীবনবাবু লিখলেন খবরের কাগজে আর্টিকেল লেখার শখ তার ঘুচে গেছে। আমাদের দেশের বেশীরভাগ মানুষজন ইংরেজী পড়তে শিখলেও এখনও নাকি তাদের একপ্রকার অশিক্ষিতই বলা চলে। প্রবন্ধটি ছাপার অক্ষরে বের হবার পরে জীবনবাবু অনেক গুলি চিঠি পেয়েছিলেন যার মধ্যে কেউ কেউ তাকে জানিয়েছে তাদের বাড়ির ছাঁদে নাকি রাত দুপুরে ভারী পায়ের কোন অশরীরীর পায়চারী করার পুরানো অভ্যাস, যদি জীবনবাবু দয়া করে ভুতটিকে কব্জা করে বিদায় করতে পারেন তাহলে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে পত্রপ্রেরক কার্পণ্য করবেন না আবার অন্য একজন লিখছেন ওনার সন্দেহ হচ্ছে তার বাড়িওয়ালা একটা পেত্নী বা জীন গোছের কিছু একটা পাঠিয়ে তাকে সপরিবারে উচ্ছেদ করার চেষ্টায় রয়েছে, জীবনবাবু যেন পত্রপাঠ অপদেবতাটিকে তাড়াবার ব্যাবস্থা করেন এক্ষেত্রেও অবশ্য মোটা পারিশ্রমিকের হাতছানি রয়েছে। তবে যেটাকে সবথেকে মজাদার বলেই আমার মনে হয়েছে আর জীবনবাবুর কাছে চূড়ান্ত বিরক্তিকর! হাওড়া জেলা থেকে এক কর্মপ্রার্থী লিখছেন তিনি কিছুদিন পরেই চাকরির পরিক্ষায় বসতে চলেছেন বাড়িতে উপার্জনশীল কেউ নেই, বৃদ্ধ পিতা অসুস্থ্য, জীবনবাবু যদি করুনাবশত তার কোন একটি পোষা ভুতের মাধ্যমে প্রশ্নগুলি আগাম জেনে পত্রপ্রেরককে পাঠিয়ে দ্যান তাহলে বাকি জীবন পত্রপ্রেরক যে সবিশেষ কৃতজ্ঞ থাকবে সেটা বলাই বাহুল্য।

আর একদিন জীবনবাবুর মেলে অদ্ভুত উত্তেজনার আভাষ! যেন বিশাল কোন যুদ্ধ জয় করে ফেলেছেন। লিখেছেন নিজেকে আজ সত্যিকারের একজন বিজ্ঞান সাধক মনে হচ্ছে যে জীবন মৃত্যুর মাঝখানের সব থেকে জটিল প্রশ্নের উত্তর পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে যেতে সক্ষম। তার এই খোঁজ নাকি জীবনচক্র নিয়ে মানুষের চিন্তা ভাবনার আমুল পরিবর্তন ঘটিয়ে ছাড়বে।

একমাস পরেই জীবনের পরের চিঠিতে তীব্র হতাশার প্রকাশ। নিজের কাজের ডিটেলস্‌ অনেক গুলো কপি করে বিদেশের বাছাই করা বিজ্ঞানীদের আর সায়েন্স জার্নালে পাঠিয়েছিলেন, কোন একজনও উত্তর দ্যায়নি। অনেক চেষ্টার পরে ভদ্রলোক সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন, কিন্তু তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে এই পত্রিকায় শুধু বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রবন্ধ ছাপা হয়ে থাকে, পাগলের প্রলাপে কান দেওয়ার মতো সময় তাদের নেই।

এরপর অনেকদিন কোনোরকম যোগাযোগ নেই হঠাৎ একদিন কম্পুটারের পর্দায় জীবনবাবুর সাদর আমন্ত্রণ ভেসে উঠল। তিনি একবার তার ধুপগুড়ির বাড়ি থেকে আমাকে ঘুরে যেতে অনুরোধ করেছেন। উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক পরিবেশে অবশ্য ছুটি কাটাতে খারাপ লাগার কথা নয়, কিন্তু প্রায় অপরিচিত কারো আতিথ্য নিতে সংকোচ বোধ হচ্ছিল তবে ভদ্রলোকের সনির্বন্ধ অনুরোধ ঠেলতে না পেরে ঠিক করলাম সামনেই পুজোর ছুটিতে একটা সপ্তাহ কালিম্পঙে আমার বাল্যবন্ধু বিকাশের বাংলোয় কাটিয়ে আসব যাবার পথে একটা রাত্রি নাহয় জীবনবাবুর বাড়িতে কাটালেই হবে। ই-মেল করে জানিয়ে দিলাম কয়েকদিনের জন্য সম্ভব না হলেও একটি রাত্রির জন্য তার আতিথ্য গ্রহন করতে আমার বিশেষ অসুবিধে নেই।

বৃষ্টিস্নাত সপ্তমীর দিন সকালে দার্জিলিং মেলে চেপে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে নামলাম। স্টেশন চত্বরে চায়ের দোকান থেকে ধোয়া ওঠা গরম চায়ের সঙ্গে ক্রীমক্রেকার বিস্কুট দিয়ে জলযোগ সেরে একটা ভাড়া গাড়িতে চড়ে ধুপগুরির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ধুপগুড়ি এখান থেকে ঘন্টা তিনেকের পথ। নেপালি ড্রাইভার মহাদেবের ছবির সামনে ধুপকাঠি নাচিয়ে, মন্ত্রটন্ত্র পরে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে দিল। কিছুটা পথ পেরিয়ে গাড়ি গিয়ে পড়ল ন্যাশনাল হাইওয়ে ২৭ এর রাস্তায়। অনেকদিন পরে কলকাতার দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে বের হয়ে প্রাণটা যেন হাঁপ ছেড়ে বাচল। হাইওয়ের দুপাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মনে বেশ ফুরফুরে একটা ভাব আসছিল, ছন্দপতন ঘটল প্রবল এক ঝাঁকুনিতে। বিকট শব্দ তুলে অ্যাম্বাসাডর গাড়িটা রাস্তার একপাশে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে নেপালি ভাষায় তোড়ে গালমন্দ শুরু করল। গাড়ি থেকে নেমে যা দেখলাম তাতে চক্ষু স্থির হবার উপক্রম। সামনের টায়ারটা ফেটে একেবারে ফর্দাফাই হয়ে গেছে। বিপদের উপর বিপদ! ড্রাইভার জানাল বিশেষ কারনে গাড়িতে আজ অতিরিক্ত টায়ার রাখা হয়ে ওঠে নি, এই ব্যাপারে সে গঙ্গা মায়ের দিব্যি কাটতেও রাজি যে আজ অবধি এমন ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেনি, তাই সে তৈয়ার ছিল না, তবে ভবিষ্যতে এমন কিছু আর ঘটবে না। ভবিষ্যতের কথা পরে! এখন আমার কি হবে? ড্রাইভার জানাল এই রাস্তা দিয়ে হরদম বাস চলছে তারই একটাতে আমাকে তুলে দেবে।

প্রায় ঘন্টখানেক পর বাসের দেখা মিলল। রঙচটা লজঝরে একটা বাস, বনফুলের ভাষায় ‘তিলধারণের স্থান হয়ত রয়েছে, কিন্তু মনুষ্য ধারণের সত্যই স্থানাভাব’।

কোনক্রমে তাতেই সওয়ার হওয়া গেল। এরপর ঘন্টা দেড়েক নিদারুন যাতনা ভোগ করতে করতে ধুপগুরি এসে পৌঁছলাম। বৃষ্টির বেগ শান্ত হয়ে এলেও স্ট্যান্ডে যানবাহনের বেশ অভাব দেখা গেল অবশেষে ডবল ভাড়া কবুল করে একটা রিক্সায় চেপে জীবনবাবুর বাসস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। জীবনবাবুর বাড়ি শহরের প্রান্ত সীমায় জায়গাটা অবশ্য রিক্সা চালকের চেনা। মিনিট চল্লিশ কাঁচা পাকা ঘিঞ্জি রাস্তার বাক পেরিয়ে অবশেষে রিক্সা এসে দাঁড়াল জীবন মালাকারের বাসভবন ‘রেণু ভিলার’ সামনে। কাছে পিঠে কাউকে দেখতে না পেয়ে, অগত্যা মরচে ধরা লোহার গেট ঠেলে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। সাবেক আমলের দোতলা বাড়িটির সর্বাঙ্গে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট, দেওয়ালের জায়গায় জায়গায় পলেস্তরা খসা ইটগুলোতে শ্যাওলার ছোপ পড়েছে। বাড়ির সামনে একফালি জমি যেখানে কোনকালে হয়ত শখের বাগান ছিল, কিন্তু আজ শুধুই বুনো আগাছার ঝোপ। কাঠের দরজার পাশে ইলেকট্রিক বেলের সূইচ্‌ ভেঙে ঝুলছে যেটায় আর হাত ছোঁয়াবার দরকার আছে মনে হল না। দরজার কড়ায় হাত রাখতেই অকস্মাৎ বিশ্রী শব্দ তুলে সেটাকে কেউ ভেতর থেকে খুলে ফেলল, সামনে দাড়িয়ে মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুলের একজন প্রৌঢ় ব্যাক্তি, ভদ্রলোকের চেহারায় তেমন বিশেষত্ব কিছু না থাকলেও দুচোখের অসম্ভব ধারাল দৃষ্টি দেখে লোকটিকে সাধারণ পর্যায়ে ফেলা যায় না।

ভদ্রলোক ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বললেন -আপনি নিশ্চয়ই অরুনবাবু আমি জীবন মালাকার।

-নমস্কার

-আসুন ভেতরে আসুন। গৃহকর্তার আহ্বানে বাড়ির ভিতর পা রেখেই হোঁচট খেলাম, দিনের বেলাতেও ঘরের মধ্যে তীব্র অন্ধকার। জানলা ঢাকা কালো রঙের মোটা মোটা পর্দাগুলো সুর্যের আলোকে পুরোপুরি আটকে দিয়েছে। জীবনবাবু হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপতেই ঘরে কম আলোর হলুদ বাল্ব জ্বলে একটা ভুতুরে পরিবেশের সৃষ্টি হল।

জীবনবাবুর বাড়ির বাইরে যেমন ভেতরেও সেই একই রকম ছন্নছাড়া ভাব স্পষ্ট। এইটে বোধহয় বসবার ঘর, একপাশে কয়েকটা হাতল ভাঙা কাঠের চেয়ার ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে। ঘরের মাঝামাঝি বেখাপ্পা ভাবে একটা সোফা পাতা রয়েছে যেটা দেখিয়ে ভদ্রলোক ইঙ্গিত করলেন -আপনি ওইটেয় বসুন আরাম করে। ট্রেতে জলের গ্লাস হাতে একজন বেঁটেখাটো ব্যাক্তি হাজির হলেন যার উচ্চতা আর ঠোটের উপর বাটারফ্লাই গোঁফ বিখ্যাত একজন কৌতুক অভিনেতার কথা মনে করিয়ে দ্যায়।

জীবনবাবু বললেন -আলাপ করিয়ে দিই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাক্তার পিনাকী সেন। ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখ করে বললেন -নমস্কার জীবন আপনার কথা বলেছে তা পথে কোন কষ্ট হয় নি তো? কষ্ট অবশ্য হয়েছে কিন্তু সেসব বলে আর কাজ নেই। হাসিমুখে জানালাম আরামেই এসেছি। জীবনবাবু গলা খাকড়ে বললেন -তা কয়েকটা দিন থাকবেন তো? এখানকার জল হাওয়া কিন্তু খারাপ নয়, তাছাড়া কাছাকাছির মধ্যে পাহার-জঙ্গল সবই পেয়ে যাচ্ছেন। আমি একটু অবাকই হলাম কারন আমার সময়াভাবের বিষয়টা আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। কাল সকালেই বিদায় নেবার ইচ্ছের কথা শুনে জীবনবাবু সহসা গম্ভির হয়ে পরলেন। ডাক্তার সেন একগাল হেসে বললেন -যাওয়ার কথা পরে, আগে তো মিঃ মিত্র কিছু জলযোগ করুন, পথশ্রমে নিশ্চয়ই ক্লান্ত। দেখলাম অতিথি সৎকারটাও ডাক্তার সেনের হাতেই ঘটল। ট্রেতে করে চায়ের কাপ আর প্লেটভর্তি খাবার হাজির করলেন, লুচি আলুর-দম সেইসঙ্গে খানকয়েক ল্যাংচা গোছের মিষ্টি। লুচি কয়টা বোধহয় আগেই ভেজে রাখা ছিল কারন সেগুলো ততোক্ষণে মিইয়ে নরম হয়ে গেছে। জীবনবাবু বললেন -অরুনবাবুর এখানে একটু অসুবিধে হবে, আসলে আমি সব কিছু একা গুছিয়ে উঠতে পারি না তাও পিনাকী রোজই এসে টুকটাক সাহায্য করে যায় নাহলে যে কি হত। পরিস্থিতি কল্পনা করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হল, একজন ডাক্তার নিজের প্র্যাকটিস ফেলে জীবনবাবুকে বাড়ির কাজে সাহায্য করেন!

-এখানে কাজের লোক পাওয়ার বোধহয় একটু অসুবিধে?

-একটা নেপালি চাকর রেখেছিলাম তা ছোকরা কয়েকমাস বেশ ভালই কাজকর্ম করল, তারপর এদের যা স্বভাব শেষে টাকাপয়সা হাতঘড়ি মায় বাসনপত্র অবধি নিয়ে ভেগেছে। জীবনবাবু হঠাৎ ব্যাস্ত হয়ে বললেন -আপনার স্নানের জন্য বাথরুমে গরম জল রাখা আছে, সেরে আসুন, তারপরে লাঞ্চের সময় হয়ে যাবে। স্বল্প পরিচিত লোকের বাড়ি এসেই স্নানাহারের জন্য দৌড়নোটা শিষ্টাচার হবে কি না ভাবছিলাম কিন্তু জীবনবাবু বিষম তাড়া লাগাতে আর কিছু বিশেষ চিন্তা করার সুযোগ পেলাম না।

এবাড়ির সর্বাঙ্গে গৃহকর্তার আর্থিক অসাচ্ছল্যের ছাপ স্পষ্ট, স্নানের ঘরটিও তার ব্যাতিক্রম নয়। সাদা বাথটবে ময়লার পুরু প্রলেপ পরে কালছে সবুজ হয়ে পড়েছে, শাওয়ারের ট্যাপটা দেখলাম ভেঙে দু-টুকরো হয়ে এক কোনে গড়াচ্ছে।

তবে আমার জন্য দুটো প্লাস্টিকের বালতিতে উষ্ণ গরম জল রাখা ছিল। ভালো করে স্নান করতেই ক্লান্তি অনেকটা দূর হল। সঙ্গে আনা পাজামা পাঞ্জাবী পরে বসবার ঘরে চলে এলাম। ডাক্তার সেন দেখলাম বিদায় নিয়েছেন। জীবনবাবু টেবিলের উপর প্লেট সাজিয়ে রাখছিলেন আমাকে দেখে হাসলেন, বললেন -তাহলে লাঞ্চ করে নেওয়া যাক কি বলেন।

-এই তো খেলাম, লাঞ্চ পরে হলেও অসুবিধে নেই।

-আসলে আমার একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবার অভ্যাস তো, ঠিক আছে তাহলে নাহয় পরেই হবে।

-আপত্তির কিছু নেই এখনও খেতে পারি। ভদ্রলোক প্লেটে খাবার সাজিয়ে দিলেন। ভাত, মুসুরির ডাল, আলুভাজা আর রুই মাছের ঝোল। জীবনবাবু একাই সব ব্যাবস্থা করেছেন, আমার কেমন সংকোচ হতে লাগল। মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললাম -আমি বোধহয় আপনার একটু অসুবিধেই ঘটিয়ে ফেললাম। জীবনবাবু কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন -আপনিও তো মশাই একা থাকেন।

-সেটা অবশ্য ঠিক। যে বিশেষ কৌতূহল আমাকে এতদূর টেনে এনেছে সে বিষয়ে এবার কথা না বলে আর পারলাম না।

-আপনার গবেষণার কদ্দুর? জীবনবাবু যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিলেন তার তীক্ষ্ণ চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল বললেন -অনেকটাই সাকসেসফুল তবে এই মুহূর্তে উপাদানের অভাবে কাজ মাঝে মধ্যেই ব্যাহত হচ্ছে। অরুনবাবু আপনি শিক্ষিত মানুষ আমার ডাকে সাড়া দিয়ে এতদূর এসেছেন আশাকরি আমাকে সাহায্য করতে আপনার আপত্তি হবে না। জীবনবাবু আমার কাছে ঠিক কি ধরনের সাহায্যের আশা রাখছেন বুঝতে না পারলেও ভদ্রতাবশতঃ মাথা হেলিয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করলাম। জীবনবাবু স্মৃতিচারণ শুরু করলেন। আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগের কথা তখন তিনি বহরমপুর কলেজে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক, হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালাবার সময় একটা ট্রাকের সঙ্গে সরাসরি ধাক্কায় তার গাড়িটা ভেঙে গুড়িয়ে যায়। স্ত্রী এবং দুই সন্তানের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটলেও জীবনবাবু কোনোক্রমে রক্ষা পেয়ে গেলেন, এরপর প্রায় গোটা একটা বছর হাঁসপাতালে থেকে ভাঙা হাড়গোড় জোরা লাগিয়ে যখন বাড়ি ফিরলেন ততদিনে বেচে থাকাটাই যেন নিরর্থক হয়ে পড়েছে। সবার আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে দায়িত্ব মুক্ত হলেন। এইসময় জীবনবাবু একদিন এইবাড়িরই একটা ঘরে তার মৃতা স্ত্রীর অশরীরী মুর্তি দেখতে পেলেন। উগ্র এক কৌতূহল ততদিনে দুর্দান্ত নেশার মতো তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। মৃত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টায় কিছুদিন একটি প্রেতচক্রের সাথে ভিড়েছিলেন কিন্তু তাদের বুজরুকি ধরতে পেরে সরে আসতেও দেরি করেন নি। জীবনবাবু এরপর গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রেততত্ত্বের অধ্যায়ন শুরু করলেন। মিডিয়মের মাধ্যমে প্ল্যানচেট বা অন্য কোন উপায়ে আত্মাকে আহবান জানিয়ে সাময়িক ভাবে তাদের উপস্থিতি অনুভব করার একটা পক্রিয়া অবশ্য আছে, কিন্তু জীবনবাবু তাতে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিস্কার করার চেষ্টা শুরু করলেন যার মাধ্যমে মৃত আত্মা দীর্ঘসময়ের জন্য পৃথিবীর বুকে জীবিত মানুষের চোখের সামনে নিজের অস্তিত্ব প্রকট করতে পারে। বিগত তেরো চোদ্দ বছরে এই গবেষণার ভার বইতে গিয়ে জীবনবাবুর তিনটে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত অর্থও প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, এসবে অবশ্য ভদ্রলোকের আপসোস নেই কিন্তু সভ্যসমাজ তার গবেষণার ন্যূনতম স্বীকৃতিটাও দিতে চাইছে না এটা তার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। জীবনবাবুকে তার কাজ আমেরিকার প্যারাসাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনে পাঠাবার পরামর্শ দিতে তিনি সজোরে মাথা নেড়ে আপত্তি জানালেন তার একটাই বক্তব্য তিনি নিজেকে বৈজ্ঞানিক বিবেচনা করে থাকেন প্যারাসাইকলোজিস্ট নয়। আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটল মৃদু কড়াঘাতের শব্দে। জীবনবাবু বিরক্ত হয়ে দরজার দিকে চাইলেন।

-আপনি খান, আমি দেখি কে এলো। ভদ্রলোক দরজা খুলতে উঠে গেলেন।

দরজার বাইরে পুলিসের পোশাক পরা মেদবহুল চেহারার একজন ব্যাক্তি দাড়িয়ে। জীবনবাবু দেখলাম ভদ্রলোককে চেনেন কেননা তিনি বলে উঠলেন -আরে সুখময় বাবু যে! কি ব্যাপার? আগুন্তুক হাসার চেষ্টা করলেন -একটু আসতে হল।

-কি দরকারে?

-ভিতরে আসতে পারি কি?

জীবনবাবু যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বললেন -আসুন। ভদ্রলোক এসে টেবিলের ধারে একটা চেয়ার দখল করে বসে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন -ইনি কে? এনাকে তো চিনলাম না! উত্তরটা জীবনবাবুই দিলেন -চেনার কথা নয়, ইনি কলকাতায় থাকেন আমার অতিথি। ভদ্রলোক নমস্কার করে বললেন -আমি সুখময় দাস লোকাল থানার ওসি।

-নমস্কার আমার নাম অরুন মিত্র। জীবনবাবু গম্ভির স্বরে বললেন -তা সুখময়বাবু হঠাৎ কি মনে করে?

-একটা ব্যাপারে আসতে হল, কিছুদিন আগে একজন প্রতিবন্ধী লোক, নাম জগত সাপুই এই পাড়ায় এসেছিল, উদ্দেশ্য ভিক্ষে করা, কিন্তু তারপর থেকেই তার কোন খোজ পাওয়া যাচ্ছে না। জীবনবাবু ঠান্ডা গলায় বললেন -তা এই ব্যাপারে আমার কি করার থাকতে পারে। সুখময়বাবু স্থির দৃষ্টে চেয়ে বললেন -পাড়ার একজন ছেলে ভিখিরিটিকে আপনার দরজায় ভিক্ষে চাইতে দেখেছে। জীবনবাবু কর্কশ কণ্ঠে বললেন -দিনে অনেক ভিখিরিই এসে ভিক্ষে চায় কাউকে দিই কাউকে দিই না, হয়ত এ লোকটাও এসেছিল। সুখময়বাবু তীক্ষ্ণকণ্ঠে জিগ্যেস করলেন -তা এর ক্ষেত্রে কি ঘটেছিল।

-মনে পরছে না সরি! সুখময় চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন -বেশ উঠি তাহলে তবে দরকার পরলে আবার আসব। জীবনবাবু জিগ্যেস করলেন -আমার চাকরটার কোন খোজ পেলেন?

সুখময়বাবু যেতে উদ্যত হয়েছিলেন পিছন ফিরে দাঁড়ালেন, বললেন -ভালো কথা ওই ছেলেটির বাবা-মা থানায় এসে বিস্তর কান্নাকাটি করে গেছে ওদের বক্তব্য ছেলেটি চোর নয় তার এইভাবে নিখোঁজ হওয়ার পিছনে অন্য রহস্য আছে। জীবনবাবু বিকৃত স্বরে বললেন -টাকার ভাগ তো সবাই পেয়েছে, এখন চালাকি করছে, আপনি একটু চাপ দিলেই আসল সত্যটা বেরিয়ে পড়ত। সুখময়বাবু রুষ্ট স্বরে বললেন -আমার কাজ আমি জানি, তবে বলে দেওয়া কর্তব্য তাই বলছি একটু সাবধানে থাকবেন, আমার কিন্তু লোকগুলির গতিক সুবিধের মনে হয়নি। সুখময়বাবু চলে গেলেন। জীবনবাবু হঠাৎ অতিমাত্রায় গুম হয়ে গেলেন, যেন কথা বলার সব উৎসাহই হারিয়ে ফেলেছেন। খাওয়ার পরে বললেন -আপনি পাশের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন সব বন্দোবস্ত করাই আছে। বিকেলে কথা হবে। পাশের ঘরে গিয়ে দেখলাম একটা তক্তপোষের উপর বিছানা পাতা রয়েছে। জীবনবাবুর ব্যাবহারে মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল ঠিক করলাম বিকেলে চলে যাওয়াটাই ভালো হবে, রাতে থেকে আর কাজ নেই। বাড়ির অন্য ঘরগুলির মতো এই ঘরেও জানালা মোটা পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা সেটা খুলতে দেখতে পেলাম ঘরটা সম্ভবত বাড়ির পিছনের অংশে এই ঘর থেকে বাইরে কিছু দেখা সম্ভব নয় সামনে উচু পাচিল যাইহোক এবারে অন্তত কিছুটা আলো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে কিছুটা স্বস্তি দিল। কিছুক্ষণ ধরেই টের পাচ্ছিলাম মাথাটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে কেন জানি না অকস্মাৎ চোখের পাতা খুলে রাখাই যেন দায় হয়ে পড়ল সঙ্গে মাথাটাও যেন পাল্লা দিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের নুয়ে পরতে চাইছে এই অবস্থায় বেশিক্ষণ জেগে থাকা সম্ভব নয় সেটা ভালোমতোই বুঝতে পারছিলাম। নিশ্চয়ই খাবারে কিছু মেশানো ছিল! মোবাইলে বারবার বিকাশকে ধরার চেষ্টা করলেও সিগন্যালের অভাবে ব্যার্থ হলাম। জীবনবাবুর ঠিকানা আর নিচে হেল্প কথাটা টাইপ করে এস-এম-এস করে দিলাম, জানি না এটা আদৌ পৌছবে কিনা! কিন্তু আমি আর জেগে থাকতে পারছি না হঠাৎ চোখ দুটো কেমন যেন বুজে এলো, মনে হল আমি যেন চেতনা হারিয়ে থিকথিকে অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি।

(২)

কতক্ষণ অচেতন হয়ে পরেছিলাম সে বোধ ছিল না, তবে হুঁশ ফিরতে বুঝলাম ঘন অন্ধকারের মধ্যে শুয়ে রয়েছি। কানের কাছে মশার অসহ্য ভনভনানি শুনতে শুনতে শরীরের সর্বত্র তাদের বিষাক্ত দংশনও ভালোমতোই টের পাচ্ছিলাম। গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে এসেছে। উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে পরলাম। বালিসের তলায় মোবাইল ফোনটা রেখে ছিলাম, সেটা দেখলাম উধাও হয়েছে। এইভাবে ধুপগুড়ি আসাটা নিতান্তই ছেলেমানুষি হয়ে গেছে! জীবনবাবুর উদ্দেশ্য তিনিই জানেন! তবে আমার সামনে যে বিষম ফাঁড়া উপস্থিত সেটা বুঝতে জ্যোতিষ চর্চার প্রয়োজন নেই। মনে পরল তক্তপোষের পাশে কাঠের টুলটায় জলের পাত্র দেখেছিলাম, দুর্বল পায়ে সেটার দিকে এগোতেই ভারসাম্য হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পরলাম, কাঁচ ভাঙার শব্দ আর মুখের ওপর জলের ছিটে লাগতে, বুঝলাম জগটা ভেঙে ফেলেছি।

কাঁচ ভাঙার শব্দে ডাক্তার সেন এসে হাজির হলেন, বেঁটেখাটো নিরীহ চেহারার লোকটার মুখে এখন কেমন যেন একটা শয়তানি হাঁসি ঝুলছে, ভদ্রলোক যেন মজা পেয়েছেন এমন সুরে বললেন -এই যে মিত্রবাবু আপনার নার্ভ তো দারুন স্ট্রং দেখছি যে পরিমানে সিডেটিভ দিয়েছিলাম তাতে অন্তত আরও ঘণ্টাদুয়েক ঘুমানো উচিৎ ছিল। উত্তর দিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম জিভ ভিজে ন্যাতার মতো জড়িয়ে আসছে কোনরকমে বললাম -আপনাদের মতলবটা কি? ভদ্রলোক আমার কথার উত্তর না দিয়ে বললেন -দোতলায় চলুন জীবন অপেক্ষা করছে। আমার হেটে যাবার ক্ষমতা ছিল না ডাক্তার এগিয়ে এসে হাত ধরে উঠতে সাহায্য করলেন। ডাক্তারের টর্চের আভায় অন্ধকারের বুক চিড়ে নিস্তেজ আলোর একটা দুর্বল বৃত্তের সৃষ্টি হল, আমার কেমন যেন মনে হল এবাড়ির জমাট-বাঁধা আধার যেন বিদ্রূপ করে বলতে চাইছে এই আলোর বিন্দু আর আমাকে, গিলে ফেলা শুধুমাত্র সামান্য সময়ের ব্যাপার। সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় ডাক্তারকে ঘুষিতে কাবু করে ছুটে পালাবার মতলব ত্যাগ করলাম, অসম্ভব চিন্তা করে লাভ নেই। দুপা হাঁটতেই মাথা ঘুরছে, দৌড়ব কোন উপায়ে? ডাক্তার সেন আমার মনের কথা বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছেন, কেননা তিনি বেশ কৌতুকের স্বরে বললেন -পালাবার চিন্তা বৃথা মিঃ মিত্র, আরও ঘন্টা তিনেকের আগে আপনি কখনই নর্মাল হচ্ছেন না, আসুন। ডাক্তারের কাঁধে ভর দিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলার একটা ঘরে এসে উপস্থিত হলাম এই ঘরটায় অবশ্য টিমটিম করে ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছে। ঘর জুড়ে একটা অদ্ভুত জিনিস রয়েছে, যেটা দেখে যন্ত্র গোছেরই কিছু মনে হল।অনেকটা যেন আগেকার যুগের এক্সরে মেশিনের মতো। প্রায় আড়াই ফুট উচু পায়ার উপরে একটা ছয়ফুটের লম্বা কাঠের টেবিল পাতা, দুপাশে অসংখ্য পাইপ আর ইলেকট্রিক তার কিলবিল করে জড়ানো, টেবিলের শেষ প্রান্তে গোলাকৃতি খাঁজ কাটা, আর তার ওপর বলের মতো কাঁচের আচ্ছাদন। টেবিলের অন্য প্রান্তে তার আর পাইপগুলো একটা ইনভার্টার গোছের যন্ত্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া আছে যেখানে বিভিন্ন রঙের কয়েকটা ক্ষুদ্র ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে রয়েছে। বাক্সটা থেকে আবার কয়েকটা তার একটা প্যানেলের সাহায্যে কম্প্যুটারের সঙ্গে সংযুক্ত করা রয়েছে। জীবনবাবুকে দেখলাম র‍্যাচেট রেঞ্জ নিয়ে মেশিনের কলকব্জা ঘাটাঘাটি করছেন আমাকে দেখে বললেন -গুড ইভনিং অরুনবাবু।

-এসবের মানে কি? জীবনবাবু আমার কথায় কান না দিয়ে ডাক্তারকে বললেন -পিনাকি ওকে চেয়ারে বসাও। ডাক্তার আমার কাঁধে চাপ দিয়ে সামনে রাখা একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে হাতলের সঙ্গে যুক্ত চামড়ার স্ট্র্যাপে শক্ত করে হাত বেধে ফেললেন। জীবনবাবু তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। অতিকষ্টে গলার স্বর চড়িয়ে বললাম -অতিথির সঙ্গে কি এই ব্যাবহারই করে থাকেন? জীবনবাবু স্থির দৃষ্টে চেয়ে গাম্ভির্যপূর্ন স্বরে বললেন -মাপ করবেন অরুনবাবু আপনার অনুমতি না নিয়েই আপনাকে কাজে লাগাতে বাধ্য হচ্ছি, তবে আপনি শিক্ষিত মানুষ আশাকরি আমার সব কথা শুনে গবেষণার কাজে সহযোগিতা করতে দ্বিধা করবেন না। জীবনবাবু একমুহুর্ত চুপ করে ফের বললেন – দুপুরে আপনাকে আমার রিসার্চের ব্যাপারে ডিটেলসে্‌ বলছিলাম হঠাৎ দুম করে থানার মাথামোটা ওসি-টা হাজির হয়ে সব

ভেস্তে দিল, বাকিটা বলছি, মন দিয়ে শুনুন। দরকার আছে বলেই বলছি।

-চোখের সামনে পরিবারের আকস্মিক মৃত্যুতে ভীষণ ভেঙে পরেছিলাম। মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখে যে এতদিনের স্বযত্নে লালিত আত্মাভিমান ভেঙে খানখান হয়ে গেছিল সেটা স্বীকার করতে আজ আর কোন দ্বিধা নেই। মৃত্যুর সামনে আমরা শ্রেষ্ঠ প্রজাতি এই একবিংশ শতাব্দিতেও এতো অসহায় কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিলাম। মৃত্যুর পর প্রাণীর আর কিছুই কি অবশিষ্ট থাকে? উত্তর খোঁজার তাগিদে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মই দেহাতীত আত্মার কথা বলেছে। আমি চিরকালের নাস্তিক, ঈশ্বর, ধর্মাধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন কখনো বোধ করি নি আজও করি না, কিন্তু ধর্ম গ্রন্থগুলি পাঠ করে একটা বিষয় আমার কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছিল, প্রাচীন যুগের চিন্তানায়কেরা সুক্ষ শরিরের যথার্থতার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। ঠিক করলাম দেহ বিচ্ছিন আত্মার বিষয়টা তলিয়ে দেখব। প্রায় একমাস ধরে প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত আমার মৃতা পত্নি অপর্ণার চিন্তায় মনের শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই ঘটল না। অবশেষে যখন হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেবার অবস্থা তখন চেষ্টার ফল মিলল। একদিন ভোর রাতে হঠাৎই কোন কারন ছাড়া ঘুম ভেঙে যেতে দেখলাম অপর্নার ছায়া শরীর যেন ঘরের ভিতর ভেসে বেড়াচ্ছে। ডান হাতের বুড়ো আঙুলে লম্বা নখ্‌ রাখাটা আমার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। জোরালো চাপে সেটা মট করে হাতের তালুতে ভেঙে যেতে বুঝলাম স্বপ্ন দেখছি না সম্পুর্ন সচেতন অবস্থাতেই রয়েছি, এবং যা কিছু দেখেছি খোলা চোখেই। কিছু পরে অপর্ণার শরীর গলে হাওয়ায় মিশে গেল। বাকি রাতটা বিছানায় বসেই কাটল। আমি কেমিস্ট্রির অধ্যাপক এমন কোন বস্তুতে আস্থা রাখতে শিখি নি যাকে বিজ্ঞান স্বীকৃতি দ্যায় নি কিন্তু সম্পুর্ন সচেতন অবস্থায় নিজের চোখকে অবিশ্বাস করার পেছনেও কোন যুক্তি খুজে পাচ্ছিলাম না। এরপর কিছুদিন প্ল্যানচেট মিডিয়াম জাতীয় সব বিষয়ের চর্চা করে শুধু একরাশ বিরক্তি ছাড়া আর কিছুই জুটল না। অবশেষ সম্পুর্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আমি আত্মা নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করলাম যার ফলশ্রুতি এই মেশিন। জীবনবাবু পরম মমতায় তার যন্ত্রের গায়ে হাত বোলালেন।

-এখনও আমার গবেষণা ষোলোআনা সফল হয়েছে এমন কথা বলা যাচ্ছে না তবে আর কয়েকটা দিন পরেই এটা যে যুগান্তকারী আবিস্কার রুপে গণ্য হবে সেটা জোরগলায় বলতে পারি। জীবনবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন -মেশিনটা ভালো করে দেখুন অরুনবাবু আপনি এখন যে হুইল চেয়ারে বসে রয়েছেন সেটা এই মেশিনের এক্সটার্নাল পার্ট এটাকে এই টেবিলের কোনের সঙ্গে ফিক্স করে দেওয়ার পরে আপনার মাথায় ওই কাঁচের গোলাকার আস্তরণটা এটে দেওয়া হবে ওই অংশটার নাম দিয়েছি ডেথ চেম্বার। কাঁচের বলটার সঙ্গে একটা সিলিকনের পাইপ জুড়ে দেওয়া আছে দেখতে পাচ্ছেন এক্ষেত্রে ব্রেন ডেথের পরেই প্রাণবায়ু স্থুল শরীর ছেড়ে সুক্ষ আকার ধারণ করে আন-নোন ফ্রিকুয়েন্সিতে লীন হয়ে যাবে যেটাকে আমরা পরলোক বলে থাকি। এই পরলোক সম্মন্দে আমাদের স্পষ্ট ধারনা নেই কারন মৃত ব্যাক্তি সে বিষয়ে খবর দিতে ফিরে আসে না কিন্তু যদি কোন উপায়ে এমন একটা স্ট্রং ম্যাগনেটিক ফীল্ড তৈরি করা যায় যেটা দেহত্যাগী আত্মাকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে ধরে রাখতে সক্ষম হবে যাতে সে মৃত্যু পরবর্তি অভিজ্ঞতা বয়ান করতে পারে, তাহলে হয়ত জগতের অনেক বড় একটা রহস্যের মিমাংসা হয়ে যেত। জীবনবাবু উত্তেজিত ভঙ্গীতে মেশিনের দিকে ইঙ্গিত করে ঘোষণা করলেন, -অরুনবাবু এই সেই মৃত্যু যন্ত্র, যার মাধ্যমে আত্মা বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের প্রশ্নের উত্তর দেবে! মানব ইতিহাসের যুগান্তকারী একটি আবিস্কার আপনার চোখের সামনে! জীবন মালাকারের মতলবটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে শরীর হিম হয়ে এলো এই লোক যে নিজের উদ্দেশ্য পুর্তির জন্য কোন অনুরোধ বা প্রার্থনায় কান দেবে না সেটা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। তাও মরিয়া হয়ে চিৎকার করলাম -আপনি পাগল, এর জন্যে আপনাকে জেলে যেতে হবে সেটা জানেন। জীবনবাবু হিংস্র ভাবে হাসলেন -প্রত্যেক জিনিয়াসকেই কোন না কোন সময় লোকে পাগল বলেছে, যাইহোক শেষ অংশটা শুনে নিন, প্রায় একবছর আগে প্রথম লাইভ এক্সপারিমেন্ট করি একটা খরগোস দিয়ে, কিন্তু তাতে কিছু লাভ হয় নি, তারপর আমার অ্যালসেসিয়ন কুকুর টমির উপর পরিক্ষাটা চালাই। প্রাণবায়ু সবে একটা নির্দিষ্ট আকৃতি নিচ্ছিল তক্ষুনি যান্ত্রিক গোলযোগে টমির বায়বীয় শরীর রেনু রেনু হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অনেক খেটে কাজের ফাক ফোঁকর গুলো সারিয়ে তুললাম। কিন্তু জন্তু জানোয়ার দিয়ে এক্সপারিমেন্ট করে কিছু লাভ হবার কথা নয়, তাই এবার আমার নেপালি চাকর ভোলাকে একদিন এই সিটে বসালাম, যেখানে এখন আপনি বসে রয়েছেন। এবারে আর সম্পুর্ন ব্যার্থ হলাম না অল্পসময়ের জন্য হলেও ভোলার সুক্ষশরীর ডেথ চেম্বারে দেখা গেল। বুঝতে পারছিলাম সাফল্যের অতি নিকটে এসে পরেছি। কয়েকদিন পরে ভাগ্যক্রমে একটা আধপাগলা ভিখিরি এসে হাজির হল। প্রচুর পরিমানে মদ্যপান করিয়ে লোকটিকে মৃত্যু যন্ত্রে বসালাম। বিষ ইঞ্জেক্ট করার সাথে সাথে লোকটি ছটফট করতে করতে মারা গেল। পুরো দুটো ঘন্টা লাগল সুক্ষ শরীরের সুনির্দিষ্ট রুপ ধারণ করতে। এযাবৎ কালের মধ্যে গবেষণার সব থেকে বড় সাফল্য সেই দিন পেলাম মৃত আত্মা সাংকেতিক ভাষায় আমার প্রশ্নের উত্তর দিল। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। মরবার কিছু আগে লোকটি মৌতাতে মজে ছিল অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এখনও সে যেন ঘোরের মধ্যেই রয়েছে। এত বড় পরিবর্তনের কোন অনুভূতিই তার হয় নি। পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডের পর সাক্সান ফেল করল আর আত্মা অনন্ত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। জীবনবাবু সামান্য বিরতি নিলেন তারপর বললেন -মেশিনটাতে একটা বাড়তি ভাল্ভ লাগিয়েছি এবারে সাক্সান অন্তত দুমিনিট ধরে রাখবেই, অরুনবাবু আপনি শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষ সম্পুর্ন সজ্ঞানে এবং ঠাণ্ডা মাথায় ডেথ চেম্বারে বসে রয়েছেন নিজের স্নায়ু-তন্ত্রী সজাগ রাখুন, আমার বিশ্বাস মৃত্যু পরবর্তী অভিজ্ঞতা আপনি সঠিক ভাবেই বয়ান করতে পারবেন। এতোটা বলে জীবনবাবু থামলেন।

কাল সকালের সুর্য দেখা যে আমার কপালে নেই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু এই রকম ইঁদুরের মতো ফাঁদে পরে মরতে হবে ভাবতেই মন যেন বিদ্রোহ করে বসল কিন্তু মুক্তির কোন সম্ভবনাই চোখে পড়ল না। একমাত্র অলৌকিক কোন উপায় ছাড়া আমার এই ঘর থেকে বেঁচে বের হওয়া অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছিল এবং প্রায় তখনি আমাকে চমকে দিয়ে সেই প্রাচীন ইংরেজি প্রবাদবাক্যটা ‘ওয়াট ম্যান প্রপোসেস গড ডিসপ্রপোসেস’ জীবনবাবুর ক্ষেত্রে সত্য প্রমানিত হতে দেখলাম। জীবন মালাকার নিজের বক্তব্য শেষ করে আবার তার সাধের মৃত্যু যন্ত্র নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরলেন। আর ডাক্তার ক্রূর দৃষ্টে আমাকে দেখতে দেখতে একটা সিরিঞ্জে কিছু তরল পদার্থ ভরে বসে রইলেন। ওই সিরিঞ্জের মারাত্মক বিষেই হয়ত একটু পরে ছটফট করতে করতে চাকর ভোলা আর ভিখিরি জগত সাপুইএর মতো আমাকেও মরতে হবে! অকস্মাৎ তীব্র কোলাহলের আওয়াজ কানে এলো সেই সঙ্গে সদর দরজার উপর বারংবার আঘাতের শব্দ। জীবনবাবু আর ডাক্তার একে অপরের দিকে অবাক দৃষ্টে চাইলেন। ডাক্তার বললেন -আমি দেখে আসছি। জীবনবাবু আপত্তিসূচক মাথা নাড়লেন -উহু! আরও কিছুক্ষণ দেখা যাক, যারা এসেছে তারা হয়ত সারা না পেয়ে, শেষেমেসে নিজে থেকেই চলে যাবে। কিন্তু দরজায় ধাক্কার শব্দ ক্রমশ বাড়তে লাগল, মনে হচ্ছিল যেন কেউ বা কারা দরজা ভেঙেই বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়বে। জীবনবাবু উঠে পরলেন -আমি দেখছি তুমি এখানে থাকো। জীবনবাবু চলে যেতেই আমি নিজেকে বাচাবার একটা শেষ চেষ্টা করলাম, ডাক্তারের দিকে চেয়ে বললাম -ডাক্তারবাবু মানুষ খুনের দায়ে জীবন মালাকারের সঙ্গে আপনার জেলে যাওয়াও নিশ্চিৎ, ডাক্তার হয়ে মানুষকে জীবন দেওয়ার বদলে আপনি একজন খুনিকে সাহায্য করছেন। ডাক্তার হিংস্র দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন -আর একটা কথা বললে এখুনি এই সিরিঞ্জ তোর গায়ে ফুটিয়ে দেব। বেটে খাটো চেহারার আপাত নিরীহ দেখতে এই মানুষটাকে সেই মুহূর্তে একটি নরপিশাচ ছাড়া অন্য কিছু মনে হচ্ছিল না। ডাক্তার স্বগতোক্তি করার মতো বললেন -দুবছর আগে আমার একমাত্র ছেলেটা কলকাতায় ট্রামে চাপা পরে মারা গেল ওকে ডাক্তারি পরতে পাঠিয়েছিলাম, জীবন বলেছে এক্সপারিমেন্ট সফল হলে আমার ছেলের আত্মার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দেবে। এদিকে গণ্ডগোলের শব্দ ক্রমশ বেড়েই চলছিল। কারা যেন বাড়ির সব জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। জীবনবাবুর কোনরকম সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তারের চোখে মুখে উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে উঠল। কিছুক্ষন ছটফট করার পর বিষের সিরিঞ্জ হাতে নিয়েই ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই ডাক্তারের আর অন্য একটা অপরিচিত কণ্ঠের আর্তনাদ প্রায় একাকার হয়ে কানে এলো আর সেইসঙ্গে ভারী কিছু পরে যাওয়ার শব্দ। হঠাৎ কোথা থেকে গলগল করে কালো ধোয়া ঢুকে ঘরের আবহাওয়াকে বিষিয়ে তুলল। বাড়তে থাকা কটু গন্ধ আর প্রচন্ড উত্তাপে শরীরে দারুন জ্বলুনি ধরে গেল দম আটকে হাঁসফাঁস করতে করতে মনে হল বাচার সব আশা শেষ। এরপর বোধহয় আমি জ্ঞ্যান হারিয়ে ফেলেছিলাম কেননা তারপরের ঘটনা আমার আর কিছু মনে নেই।

ভুতের শখ আমার মিটে গেছে। বুক আর গলায় বিশ্রী পোড়া ঘা শুকিয়ে উঠতে এখনও বেশ কিছুটা সময় লাগবে। এ যাত্রায় শুধুমাত্র বিকাশের দ্বায়িত্ত্ববোধ আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে বেচে গেলাম নাহলে আমার ঝলসানো দেহটা এতদিনে কোন শ্মশানে চুল্লীতে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। গায়ের পোড়া ঘাগুলি হয়ত একসময় সেরে উঠবে কিন্তু মানসিকভাবে সম্পুর্ন রুপে সেরে উঠতে এখনও অনেক সময় লাগবে বলেই আমার ধারণা। বিকাশ আমার জীবন রক্ষা করেছে। যে মেসেজ-টা ওকে পাঠিয়েছিলাম সেটা দেখে ফোনে যোগাযোগ করতে না পারলেও, বিকাশের বুঝে নিতে দেরি হয় নি যে আমি কোন বিপদে পড়েছি। সেই রাত্রেই পাহাড়ি রাস্তায় দুরন্ত বেগে গাড়ি চালিয়ে ধুপগুড়ি এসে থানার ওসি সুখময়বাবুকে নিয়ে যতক্ষনে জীবনবাবুর ঠিকানায় হাজির হয়েছে ততক্ষণে পুরো বাড়িটাই জতুগৃহের মতো দাউদাউ করে জ্বলছে। নিজের প্রানের তোয়াক্কা না করে বিকাশ আগুনের মধ্যে ঝাপিয়ে দোতলার ঘর থেকে আমাকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করেছে। বিকাশের হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানাবার চেষ্টা করতেই ও বেশ জুত করে আহাম্মক গাড়ল জাতীয় সম্ভাষণে ভূষিত করে ছাড়ল খানিকটা গালিগালাজ প্রাপ্যই ছিল, ওসব গায়ে মাখলাম না। বাকি কথা কিছুটা সুখময়বাবুর কাছে শোনা আর কিছুটা নিজের কল্পনা মিশিয়ে একটা তত্ব খাড়া করেছি। সেই রাত্রে চাকর ভোলার বাপ কিছু লোকজন নিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে জীবন মালাকারের বাড়ি আক্রমণ করে, জীবনবাবুকে সামনে পেয়ে ভোলার বাবা মুঙ্গিলাল বিনা বাক্য ব্যায়ে তার বুকের মাঝে আড়াআড়ি ভাবে ছুরি বসিয়ে হত্যা করার পরে এবার ডাক্তার সেনের মুখোমুখি হয়ে পরে, তবে আবার আক্রমণ শানাতে ডাক্তারও তার হাতের সিরিঞ্জটা মুঙ্গিলালের গায়ে ফুটিয়ে খালি করে দিতে কসুর করেনি। পরিণামে দুজনেরই মৃত্যু ঘটেছে। দলের লোকেরা এরপর লুটপাঠ চালিয়ে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে যায়। পলাতকদের মধ্যে কয়েকজনকে পুলিশ ধরতে সক্ষম হয়েছে বাকিদের খোঁজ চলছে। পুলিশ নিশ্চয়ই অপরাধীদের ধরে জেলে পুরবে তবে সেটা আমার সমস্যা নয় তাই ও নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করলাম না।

পরিশিষ্ট

মধ্যরাত্রে ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে আকাশ পাতাল চিন্তা করছি। শরীর সারিয়ে নেওয়ার জন্য একমাসের ছুটি পাওয়া গেছে, অফিস যাওয়ার কোন তাড়া আজকাল আমার নেই। ডাক্তার এই সময়ে কোন রকমের চাপ নিতে নিষেধ করেছেন তবে ধুপগুড়ির সেই রাতটা বোধহয় বাকি জীবন ক্রমাগত মনের মাঝে খোঁচা দিয়ে যাবে।

আগুনে জীবনবাবুর মেশিন এবং গবেষণার কাগজপত্র পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে গেছে, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই তবে মৃত্যুর কিছুদিন আগে জীবনবাবু তার কাজের খুঁটিনাটি, বাছাই করা পন্ডিতদের পাঠিয়েছিলেন যার অধিকাংশেরই জায়গা হয়েছে বাজে কাগজের ঝুড়িতে কিন্তু হয়ত কোথাও একটা প্রতিলিপি এখনও অনাদরে পরে রয়েছে কোন প্রথিতযশা বৈজ্ঞানিকের টেবিলের কোন কোনায়, রাশি রাশি কাগজের মাঝে। হয়ত একদিন, আবার শুরু হয়ে যাবে মৃত্যুর মিছিল…

 

Writer Sanjoy Bhattacharya

লেখক : সঞ্জয় ভট্ট্যাচার্য, পদ্মপুকুর রোড , কলকাতা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here