উপেক্ষিত ও বিস্মৃত বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস
পরাধীন ভারত মায়ের শৃংঙ্খল মুক্ত করার লক্ষে কত যে বীর শহিদ অত্মত্যাগ করেছ তাঁর শেষ নেই। এই বীরেদের মৃত্য ভারতীয় দের এক জাতি হিসাবে গড়ে তুলতে পেরেছে। এই শহিদের মহান কীর্তি অমৃত সমান। কিন্তু সময়ের সাথে তাদের অনেকের স্মৃতি হয়ে পড়েছে ম্লান, আবছা হয়েছে আত্মবলিদান। এমনই এক উপেক্ষিত ও বিস্মৃত নায়ক হলেন শহিদ বসন্ত বিশ্বাস। তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় এর এক জলন্ত অগ্নিশিখা।এই তরুন বিপ্লবী দিল্লী সহ সমগ্র উত্তর ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের কাঁপিয়ে তুললেও ইতিহাস রচয়িতাদের কলমে তেমন স্থান দখল করতে নি। তাই প্রণত চিত্তে এই অমর শহিদ কে স্মরণ করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।
১৮৯৫ সালের ৬ ই ফেব্রুয়ারী নদিয়া জেলার পোড়াগাছা গ্রামের বনেদী মাহিষ্য পরিবারে এই মহান আত্মার জন্ম হয়।নীল বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক দিগম্বর বিশ্বাস ছিলেন তাঁর সেজদাদু।তাই বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে তেজ, সাহস, দেশানুরাগ লক্ষ্য করা গিয়েছিল ।.১৯০৬ সালে তিনি ও তাঁর তুত ভাই মন্মথ মুড়াগাছা স্কুলে ভর্তি হন।সেখানে প্রধান শিক্ষক ক্ষিরোদাপ্রসাদ বাবুর কাছে স্বাধীনতার মন্ত্রে দিক্ষিত হন দুই ভাই।১৯০৮ সালে শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যুতে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে।দলে দলে কিশোররা বিপ্লবী দলে নাম লেখাতে থাকে। ক্ষিরোদাপ্রসাদ বাবু দেশের প্রতি তাঁদের প্রগাঢ় প্রেমের পরিচয় পেয়ে যুগান্তর দলে যোগদান করানোর উদ্দেশ্যে কলকাতা নিয়ে আসেন।বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপধ্যায় মহাশয়ের সান্নিধ্য লাভ করেন। দিনের বেলা শ্রমজীবি সমবায়ে কাজ করতেন আর রাতে চলত নানা বিপ্লবী প্রচার।পরে বিপ্লবী মতিলাল রায় এর সহকারী হিসাবে কাজ করার জন্য চন্দননগর এর বাড়িতে আসেন। এই বাড়ি ছিল বিপ্লবীদের পীটস্থান।
মতিলাল বাবুর চন্দননগরের বাড়িতে প্রখ্যাত বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর আনাগোনা ছিল।তিনি সারা উত্তর ভারতের নানা স্থানে নানা বেশে নানা বিপ্লবী দল গুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বেড়াতেন।এখানেই বসন্ত বিশ্বাসের সাথে রাসবিহারী বসুর প্রথম দেখা হয়। প্রথম দেখাতেই বসন্তকে বেশ উপযুক্ত মনে করেছিলেন, তাই ১৯১১ সালে দেরাদুনে বিশেষ কাজের উদ্দেশ্যে তাকে নিয়ে আসেন। ‘বিশুদাস’ ছদ্মনামে কাজের লোক হিসাবে থাকতে শুরু করেন। রাতে চলে বোমা ছোড়ার ট্রেনিং। নিখুঁত নিশানার জন্য তিনি হয়ে ওঠেন রাসবিহারী বাবুর প্রিয়পাত্র।এরপর লাহোরে্র পপুলার ফির্মেসীতে ছদ্মনামে কাজ করেন। সেখানে বিপ্লবী বলরাজের নির্দেশে চলতে থাকে বিপ্লবী কার্যকলাপ। উত্তর ভারতের বড় বড় বিপ্লবী সংগঠন গুলিকে নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন রাসবিহারী বসু। তাতে জায়গা পেলেন কিশোর বসন্ত।
রাসবিহারী বসুর পরিকল্পনায় তৈরি হল বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার নিল নক্সা। তা বাস্তবায়িত করার গুরু দায়িত্ব পড়ে কিশোর বসন্তের কাঁধে। এক পাউন্ড এর বেশি ভারী বোমা নিয়ে ‘লীলাবতী’ ছদ্মনামে মেয়েদের ভীড়ে সেখানে মিশে যান।যদিও শেষ মুহুর্তে নিদিষ্ট স্থানের পরিবর্তে আগেই আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। মেয়েদের পোষাক ছেড়ে দিয়ে আবার রাজপথে হাজির হন তিনি ও অবোধবিহারী। ১৯১২ সালের ১৩ডিসেম্বর লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লীতে শোভাযাত্রার মাধ্যমে নতুন রাজধানীর উদ্ধোধনে যাবার সময়, নিখুঁত নিশানায় বোমা নিক্ষেপ করেন কিশোর বসন্ত। বোমার আঘাতে শোভাযাত্রা লন্ড ভন্ড হয়, লর্ড হার্ডিঞ্জ গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সঙ্গী অবোধবিহারী কে পালিয়ে যেতেও সক্ষম হন। অপরাধীকে ধরার জন্য ১ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষিত হয়।বিপ্লবী মহলে দুজনের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পরে। তাই এরপর অত্যাচারী গর্ডনকে হত্যার দায়িত্বও বসন্ত বিশ্বাস ও অবোধবিহারী এর ওপর পড়ে। যদিও অনেক চেষ্টায় গর্ডনের কাছাকাছি আসতে না পেরে তাঁর যাতায়াতের পথে একইরকম একটি বোমা রাখে আসেন, তাতে মারা পড়েন রামাপদ নামে এক চাপরাশি।এরপর ব্রটিশ গোয়েন্দা বাহিনী বোমা চালনার ঘটনায় বিশ্বাসঘাতক দীননাথ তলোয়ারকে গ্রেফতার করে, তাকে রাজসাক্ষী করে সমস্ত ঘটনা উদ্ধার করে। বাধ্য হয়ে রাসবিহারীবাবু ও বসন্ত স্বামী স্ত্রী ছদ্মবেশে চন্দননগরে আত্মগোপন করেন। এখানে থাকার সময় খবর পান পিতৃ বিয়োগের। গোপনে দেশের বাড়ি গেলে, কোন এক বিশ্বাসঘাতক পুলিসকে খবর দিয়ে দেয়। বসন্ত বিশ্বাস ব্রিটিশ পুলিসের হাতে গ্রেফতার হন।লাহোরে বিচারের নামে প্রহসন শুরু হয়। ‘দিল্লী লাহোর যড়যন্ত্র’ মামলায় গ্রেফতার হওয়া সকলেই দোষী সব্যস্ত হয়। কিশোর বসন্তকে অমানুষিক অত্যাচার করেও কোন কথা বের করতে পারেনি। ২ বছর বয়স বাড়িয়ে সাবালক বানিয়ে ফাঁসির সাজা হয়। ১৯১৫ সালের ১১ ই মে আম্বালা জেলে বসন্ত বিশ্বাস দেশ মায়ের জয়ধ্বনি দিতে দিতে ফাঁসির দড়ি গলায় বরণ করেন।তৎকালীন সরকার তাঁর দেহ পরিবারের হাতে তুলে দিতেও ভয় পায় য়শেতাঁর প্রিয় শিষ্যের মৃত্যুতে রাসবিহারী বসু মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন, চিরতরে দেশ পরিত্যাগ করে জাপানে চলে যান। সেখানে টোকিও শহরের একটি বাগানে বসন্তের স্মৃতিতে একটি ‘ওক’ গাছের ফলক প্রোথিত করেছিলেন।
যে রত্নটিকে রাসবিহারী বসু চিনতে পেরেছিলেন, সেই অক্ষয় অমর রত্ন অযত্নে অবহেলিত। রত্ন যেমন আলো পেলেই উজ্জল হয়ে ওঠে, ফুল যেমন পরিচর্যায় সুরভিত করে চারিদিক। তেমনি এই অমর বিপ্লবী শহিদকে কে আমাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিলে, অমর শহিদ বসন্ত বিশ্বাসের দ্যুতি ও সৌরভ ছড়িয়ে পড়বে স্বাধীন ভারতের প্রতিটি কোনে কোনে, অত্যাচারীর উদ্দেশ্যে রণিত হবে স্বাধীন কিশোরের শেষ কথা “You Please Get Out”।
By: Bhubajit Mandal
Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.