শ্রীমতির গল্প (সেই মেয়েটা )

1
1847
Photo http://lilymaemartin.com/

অফিস এর কাজ গুলো যেনো চারটের পর থেকে বেশি বেশি ভিড় জমায় টেবিলে ! যত্ত আর্জেন্ট রিপোর্ট  বানানো,মেল করা কি শেষ ঘন্টায়  আসতে হয় ! তার ওপর আচ্ছে দিনের শুভ সংকেত নিয়ে লুপ লাইনের ট্রেন লেট তো নিত্য সঙ্গী আমাদের,গা সওয়া একটা ব্যাপার ! যথারীতি গণ দেবতা এক্সপ্রেস গড়াতে গড়াতে ঘড়ির কাঁটা ৮:১৭ হয়ে গেলো আজ বর্ধমানে পৌঁছাতে । চরম বিরক্তি মনে খেয়ালই করিনি ,বাড়ি থেকে অর্ধাঙ্গিনী তিন তিনবার ফোন করেছিল! নেমে হন্তদন্ত হয়ে ফোন করতেই আড়ষ্ট গলায় খবর পেলাম ভালো রকম জ্বর বেঁধেছে !
বাড়ি পৌঁছতে অষ্টম বর্ষীয়া কন্যার শুকনো মুখে বার্তা “মা জ্বরের ঘোরে ,ভীষন গা গরম স্কুল থেকে ফিরতেই “।ওর অসহায়তা ,থার্মোমিটার নিয়ে জ্বর মাপা আমায় স্পর্শ করলো ,ইশ কত্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছে পুঁচকে মেয়ে আমার ! হাত পা একটু ধুয়ে পাশে বসতেই চমকে উঠলাম ,বাপরে এত্ত জ্বর ,বিছানাটা তো পুড়ে যাচ্ছে যেনো ! দেখলাম কি যেনো বিড় বিড় করছে আর মেয়েকে জড়িয়ে ধরছে ।
ক্যালপল ৬৫০, দেবার আগে দু টুকরো রুটি,  সবজি মা কে খাইয়ে দেবার ,মেয়ের  প্রয়াস করার ফাঁকে ,একটু স্যুপ বানাতে রান্না ঘর গিয়ে  আওয়াজে বুঝলাম জ্বরের ঘোর কাটিয়ে  উঠে বসেছে শ্রীমতি ।

ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে ডক্টর এর খোঁজ নিয়ে এসে  চা নিয়ে পাশে বসতেই ওষুধের প্রভাবে উঠে বসে যে কথাটা গল্প আকারে ওর মুখ থেকে  সংক্ষেপে শুনলাম বুঝতে বাকি রইল না ,ঠান্ডা লাগা ছাড়াও এক মানসিক অস্থিরতা ওকে যথেষ্ট নাড়া দিয়ে গেছে আজ মনে !

প্রতিদিনের মতো আজো বাড়ির সামনের বাস স্টপ থেকে নির্দিষ্ট বাসে উঠে পড়ে শ্রীমতি । এই শীতের সকাল,সংসারের  সাত ঝামেলা সেরে সময়ে রোজ স্কুলের বাস ধরতে ,নিজের দিকে ভালো করে তাকানোর ফুরসত টুকুও আজকাল কেড়ে নিচ্ছে যেন ।

বাসে উঠতেই সামনের একটা খালি সিট দেখে বসতেই আজ নজর কেড়ে নিলো পাশে বসা এক ঝাঁকড়া কালো চুলের এক মেয়ে ।কতোই আর বয়স হবে ,ওই বড়জোর আমাদের মেয়ের থেকে একটু বেশি ,নয় কি দশ ।গোল মায়াবী মুখ খানা ,কিন্তু মুহূর্তেই বুঝতে অসুবিধা হয় না ,যেনো ভেতরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ! ওরে বাবা চোখ গুলো যে জলে টস টস আর লাল করে ফেলেছে ! স্বাভাবিক ভাবে শ্রীমতি প্রশ্ন করে ওঠে ,”কি রে ,কাঁদছিস কেনো ,কে আছে সঙ্গে “? পেছন থেকে এক যুবক খুব ধীরে জানালো ,”দুদিন আগে মেয়েটার মা মারা গেছে “! কথাটা ছেলেটার মুখ থেকে শোনা মাত্র বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে এক লহমায় শ্রীমতীর ,”আহারে,এই টুকু বয়সে মা কে হারিয়ে ! মা ছাড়া এই বয়স থেকে কেই বা ওর খেয়াল রাখবে ! এই সব ভাবনার মাঝে বাচ্ছাটিকে ওর বাবার কথা ,বাড়িতে কে আছে আর জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আবার মোক্ষম ধাক্কা খায় । বাচ্ছাটি জানায় ,বাবা আগেই ওদের ছেড়ে চলে গেছে ,মা খুব অসুস্থ ছিলো ,আর বাড়িতে ওর একটা দাদা আছে ! হে ভগবান ,মা বাবা ছাড়া এমন অভিভাবকহীন ওর পুঁচকে জীবন যে  অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে !

ততক্ষণে বাস এগিয়ে চলেছে শহরের ভিড় ঠেলে ,গ্রাম্য পথের রেখা দেখতে পাওয়া, সবুজ জমির বুক চিরে কালো পিচ রাস্তা ধরে ।মনের মধ্যে নিজের মেয়েটা একা কি করছে স্কুলে এতক্ষণ ,টিফিন খেলো কিনা এই সব প্রশ্নের ভিড়ে মেয়েটার মাথায় এলো চুলে একটু স্নেহের পরশ দিতে ইচ্ছে করে খুব ।সম্বিত ফিরতেই নিজেকে একটু ঠিক করে নিয়ে শ্রীমতি ওকে প্রশ্ন করে ,”কি রে কাজ কর্ম কিছু করতে পারিস ,একটু নিজের খেয়াল রাখিস কেমন “। মুখ তুলে লাল টকটকে চোখে শুকিয়ে যাওয়া  জলের সাক্ষী রেখে একটু যেনো সাবলীল হয়ে উঠলো বাচ্ছাটা ,অস্ফুট স্বরে জানালো ,কোনদিন তো তেমন ভাবে বাড়ির কাজ করার প্রয়োজন হয়নি ,বলে আবার যেনো ফুঁপিয়ে উঠলো । ওকে সামান্য স্বান্তনা দিতেই ,যা ভীষণই আজ নগণ্য মেয়েটার কাছে , কন্ডাক্টর হাঁক ছাড়লেন ,’ও ম্যাডাম আসুন আসুন ,আপনার স্টপেজ এসে গেছে !’
বাস থেকে নেমে কেমন যেনো একটা বিশ্রী অনুভূতি ,শরীর টা ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করে হটাত ,কেমন যেনো হাত ,পা গুলোতে ভার ভার ,আড়ষ্ট ভাব । আজ স্কুলে স্বরস্বতী পুজোর খিচুড়ি ভোগ খাওয়ার দিন ,এক বিন্দু মুখে তুলতে পারলো না শ্রীমতি । বারবার সেই ঝাঁকড়া চুলের মায়াবি মুখ খানা ভেসে আসছে মনে ,চোখের কোল ভিজিয়ে দিয়ে ফ্লাশব্যাকে নিজের মেয়ে তাথৈ কে  ভীষণ ভাবে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে !
সেও কেমন একাকী সেই দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে  স্নান ,খাওয়া ,নিজের কাজ টুকু করে সারাদুপুর না ঘুমিয়ে খেলে বেড়ায় ।একদম বাড়ি লাগোয়া  ব্যস্ত যানযট দ্রুতগতির রাস্তায় যদি বেরিয়ে পরে দরজায় কারুর কড়া নাড়া শুনে ! যদি হটাত্  আমারও কিছু হয়ে যায় ! এই সব ভাবনার ভিড় বাড়তে বাড়তে  স্কুলে দুপুর থেকেই গা গরম হয়ে শরীর খারাপ হয়ে যায় আর বাড়ি ফেরার পর ধুম জ্বর আসে । এমন ধুম জ্বর শেষ কবে এসেছে মনে পরেনা শ্রীমতির ! জ্বরের ঘোরে মাকড়সার জালের মতো কেমন যেনো ভাবনার জাল তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে ,যেখান থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে তাঁকে ,দমবন্ধ হয়ে  ছটফট করে ওঠে ঘুমের মধ্যেই ।

রাতে ডক্টর দেখিয়ে এসে আমি সারা রাত  উপলব্দি করি বাচ্ছা মেয়েটির মানসিক টানাপোড়েন !ওই ঝাঁকড়া চুলের ফুলের মতো মেয়েটিকে অনুভবে আমিও দেখতে পাই ,উঠে বসি ,জল খাই । আবার পাশে শুয়ে উপলব্ধি করি সেই বাসের ঘটনাটা ,যা কিনা শ্রীমতিকে সারারাত ছটফট আর এপাশ ওপাশ করে ছেড়েছে এক অদ্ভুত বোবা কান্নায় !

              ✒—রাণা চ্যাটার্জী

Writer Rana Chatterjee

পরিচিতি: ছোটবেলা থেকেই কবিতা,ছড়া, সৃজনশীলতার ওপর আত্মিক টান বর্ধমান শহর নিবাসী রাণা চ্যাটার্জীর।প্রতিভা,সারল্যের মেলবন্ধন ও অনুভূতিপ্রবণতায় অবিরাম সৃষ্টি করে চলেছেন কবিতা,ছোটগল্প,বাচ্ছাদের জন্য ছড়া, নিবন্ধ,কার্টুন। নক্ষত্রানি সম্মান,কবির “মেঘ বালিকা তোমায়”,”ছন্দ ছড়ায় জীবন” কাব্যগ্রন্থ ও নিয়মিত পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশ রাণা চ্যাটার্জী’র আগামী উজ্জ্বল করুক।

SOURCERana Chatterjee
Previous articleসাম্য
Next articleহিন্দি_হ্যায়_হাম
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here