উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার সম্পত্তির মালিকানা আইনানুযায়ী তার পুত্র কন্যারাই পেয়ে থাকেন। কিন্তু নোবেলের উত্তরাধিকার? -সত্যি কথাটা শুনলেই কেমন যেন চমকে উঠতে হয়। ঠিক তাই। বাবার নোবেল প্রাপ্তি এবং পরবর্তীতে সন্তানের নোবেল প্রাপ্তির ঘটনা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। এমন অন্তত সাতটি উদাহরণ তৈরি হয়েছে নোবেলের প্রায় ১২০ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে।

পৃথিবীর বুকে নোবেলের থেকে বড়ো পুরস্কার আর একটিও নেই। কাজেই এই পুরস্কার পাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। ঐ বছর থেকে আজ পর্যন্ত সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল এবং অনন্য সাধারণ গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক তুলনারহিত কর্মকাণ্ডের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রথমে মোট পাঁচটি বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হতো। বিষয়গুলো হলো: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, সাহিত্য এবং শান্তি। পরবর্তীতে অর্থনীতিতেও নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। নোবেল পুরস্কারকে এ সকল ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পূর্বেই বলেছি পিতা ও সন্তান যৌথভাবে বা আলাদা আলাদা ভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এমন অন্তত সাতটি উদাহরণ রয়েছে। এর মধ্যে আবার চারটি যৌথভাবে বা আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য। বাকি তিন জোড়া পৃথক ক্ষেত্রে। একজন বাবা তার সন্তানের মন, শিক্ষা এবং কল্পনাশক্তির উপর যে কি উচ্চ প্রভাব ফেলতে পারেন, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এগুলি।
এবার একে একে সেই কয়েকজন গর্বিত পিতার গর্বিত সন্তানের আলোচনায় আসবো।

সর্বপ্রথম ১৯০৩ সালে ফরাসী পদার্থবিদ ‘পিয়ের ক্যুরি ‘ তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণার ফলস্বরূপ পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালে তাঁর সুযোগ্যা কন্যা ‘আইরিন ক্যুরি’ কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এখানে উল্লেখ্য নোবেলের ইতিহাসে বিপ্লব সৃষ্টিকারী ক্যুরি পরিবার সবমিলিয়ে মোট পাঁচটি নোবেলের মালিক। এরমধ্যে পিয়ের ক্যুরির স্ত্রী সর্বশ্রেষ্ঠ মহিলা বিজ্ঞানী মাদাম ক্যুরি পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন মিলিয়ে দুটি এবং আইরিন ক্যুরির স্বামী ফ্রেডরিক ক্যুরি স্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে রসায়নে নোবেল পেয়েছিলেন।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী ‘জোসেফ জন থমসন ‘ পরমাণুর ভিতরে ইলেকট্রনের অস্তিত্ব আবিস্কার করে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ‘ জর্জ প্যাগেট থমসন’ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পদার্থের কেলাসে ইলেকট্রনিক অপবর্তনের ধারণা দিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

এরপর ১৯১৫ সালে ঘটে এক অভিনব ঘটনা। পিতা ও পুত্র যৌথভাবে গবেষণা ও যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। ইংল্যান্ডের গবেষক ‘স্যার উইলিয়াম হেনরি ব্রাগ ‘এবং ওনার পুত্র
‘উইলিয়াম লরেন্স ব্রাগ’ এক্স রশ্মি সহযোগে কেলাসের গঠন পর্যালোচনা করে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। প্রসঙ্গত ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে’ স্যার উইলহেম রন্টজেন’ এক্স রশ্মি আবিষ্কার করে সর্বপ্রথম পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
এরপর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে পরমাণুর গঠনের সঠিক ধারণা দিয়ে ড্যানিশ পদার্থ বিজ্ঞানী ‘নিলস্ বোর’ পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পান। আবার ওনার পুত্র’ অ্যাগে বোর’ ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কণাগুলোর নিজস্ব ও সংঘবদ্ধ গতির বিষয়ে ধারণা দিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
১৯২৫ সালে ‘ম্যানে সিগবান্ ‘ এবং ১৯৮১ সালে ওনার পুত্র ‘কাই সিগবান্’ পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। দুজনের গবেষণার বিষয় ছিল এক্সরে স্পেক্ট্রোস্কোপি ও ইলেকট্রন স্পেক্ট্রোস্কোপি।
এছাড়াও ১৯২৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ‘হ্যান্স ভন অয়লার’ সুগার ও উৎসেচকের উৎসেচন প্রনালীর উপরে গবেষণা করে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। পরবর্তীতে ওনার পুত্র ‘উলফ্ ভন অয়লার’ নিউরোট্রান্সমিটার বিষয়ে আলোকপাত করে ১৯৬৯ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
সর্বশেষে যে পিতা ও সন্তান আলাদা আলাদা ভাবে ভিন্ন বিষয়ে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, ওনারা হলেন ‘ আর্থার কর্নবাগ’ এবং ওনার পুত্র ‘রজার কর্নবাগ’ ।
১৯৫৯ সালে আর্থার কর্নবাগ ‘ জিনগত তথ্যের আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে ডিএনএ ‘ এর ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পান। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে ওনার পুত্র রজার কর্নবাগ ‘বাহক আর এন এ’ এর বিষয়ে গবেষণা করে রসায়নে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।

এই সাতজন গর্বিত পিতার গর্বিত পুত্র ছাড়াও ভবিষ্যতে আরও অনেক সমরূপ উদাহরণ তৈরি হবে। প্রতি ক্ষেত্রেই পিতার সান্নিধ্য এবং নিজস্ব কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে পুত্রও সমান ভাবে উজ্জ্বল। এ ব্যাপারে সুইডিশ নোবেল লরিয়েট ‘বাই সিগবান্’এর একটি কথা উল্লেখযোগ্য। যিনি নোবেল লরিয়েট ‘ম্যানে সিগবান্’এর পুত্র। ‘বাই সিগবান্’ বলেছিলেন-

“It’s a decided advantage if you start discussing physics every day at breakfast. “
সত্যি এ এক আশ্চর্য কৃতিত্ব। বাবা ও সন্তানের নোবেল পুরস্কার অর্জন, এক আশ্চর্য উত্তরাধিকার।।

কলমে সৌমেন চক্রবর্তী, হাওড়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here