জীবনে অর্থের ভূমিকা নিয়ে আজ আমি দ্বিধা বিভক্ত। কখনো মনে হয় জীবনের কাছে অর্থ পরাজিত আবার কখনো মনে হয় অর্থের কাছে জীবন পরাজিত। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন- অর্থ ছাড়া, খালিপেটে কী আনন্দ করা যায়? রং ছড়ানো যায়? আমি বলবো- হয়ত যায়, হয়ত যায় না।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো বলা যায়। ভাগ্যের জোড়েই হোক কিংবা মেধারজোড়েই, মোটামুটি সব পাবলিক পরীক্ষায় বরাবর বৃত্তি পেয়ে এসেছি। বৃত্তি পাওয়ার সুবাদে প্রত্যেক বছরের শেষে আমার কাছে কিছু টাকা পয়সা থাকতো। সেই টাকা দিয়ে খুব বেশি হলে দুই-একটা খেলার সরঞ্জাম কিংবা দুই-একটা গাছ কেনা হতো। বেশিরভাগ সময়েই পুরো টাকাটা থেকে যেতো।
গত বছর লকডাউনের সময় বাবার এক ফুফাতো বোন হঠাৎ বাসায় এসে হাজির। চারদিকে করোনার ভয়, এই সময়ে অতিথি আসায় বাসার সবাই কিছুটা শঙ্কিত, বিরক্ত। চক্ষুলজ্জায় কেউ কিছু বলতেও পারছে না, এ যেন শাখের করাতের মতো হলো। আমরা যতটা না লজ্জিত ছিলাম তার চেয়ে সহস্রগুন লজ্জিত ছিলো বাবার সেই ফুফাতো বোন। তার লজ্জা প্রকাশ পেলো তার চলাফেরার মধ্যে, পুরোটা সময় সে নিজেকে গুটিয়ে রাখলো।
রাতে বাবা বাসায় ফিরলে আমরা সবাই খাবার টেবিলে খেতে বসেছি, সাথে আমার সেই অতিথি ফুপুও আছেন। ফুপু কোন ভ্যানতারা না করে খাবার টেবিলেই সরাসরি বলে ফেললেন – ভাইজান, আপনার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি।
বাবা খুব শান্তস্বরে বললেন- তোমাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করার সামর্থ্য আমার কতটুকু আছে তা তুমি ভালো করেই জানো। আব্বাসের কী চাকরি নেই, চাকরি চলে গেছে?

  • জ্বি ভাইজান, উনার চাকরি নেই গত দুইমাস থেকে, মাঝখানে আবার স্ট্রোক ও করছেন।
  • এখন কী করতে চাও?
  • ভাইজান, আমার উনারে দুইটা রিক্সা কেনার ব্যবস্থা করে দেন, তাতেই কোনমতে চালিয়ে নিবো।
  • রিক্সা চালাবে! সেই বয়স কিংবা শরীরের সামর্থ্য আব্বাসের কী আছে?
    -ভাইজান প্যাডেল রিক্সা না, ব্যাটারি রিক্সা।
    -ও আচ্ছা, তাই বলো। আমি ভাবছি প্যাডেল রিক্সা।তা দুইটা রিক্সা দিয়ে কী করবে? চালাবে মোটে একটা, আর সত্য বলতে দুই রিক্সার টাকা এই মুহূর্তে আমার কাছে নাই।
    আমি কী মনে করে, কারো সাথে কিছু পরামর্শ না করেই হঠাৎ বলে ফেললাম, বাবা আমার কাছে মনে হয় একটা রিক্সার টাকা হবে। আপনার অনুমতি পেলে আমি টাকাটা দিতে পারি।
    বাবা মনে মনে প্রচন্ড আনন্দিত বোধ করলেন, সেটা তার চোখের চাহনি বলে দিলো। পরক্ষণেই আনন্দটাকে চাপা রেখে বললেন-তোমার টাকা দিবা সমস্যা নাই। কিন্তু এই টাকা ফেরত পাবার আশা ক্ষীণ। তুমি কী তার জন্য প্রস্তুত?
    বাবার এই কথাটি ফুপুকে প্রচন্ড আঘাত করলো। আমি নিজেও লজ্জিত বোধ করলাম। আমি কিছু বলে উঠার আগেই ফুফু বললেন – ভাইজান, আপনার কথা সত্য। যেহেতু ভাতিজা টাকা দিচ্ছে, আমি মাসে-মাসে ভাতিজার পকেট খরচের জন্য কিছু টাকা দিবো।
    বাবা বলেন- তা কী করে হয়! এমনিতেই তোমার এখন টানাটানি অবস্থা। এর মধ্যে আবার টাকা পাঠানো, এটা আমি কিছুতেই পছন্দ করবো না।
    ফুপু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন – ভাইজান, এটা আমার অনুরোধ।

সত্যি বলতে কী, সেই ফুপু চলতি এই মাস ছাড়া প্রতিমাসেই পাঁচ হাজার করে টাকা বিকাশে পাঠাচ্ছিলেন। মাসে পাঁচ হাজার টাকা পকেট খরচ আমার কোন মাসেই লাগত না। মোটামুটি তেলে-ঝোলে দিনগুলি কাটছিলো। হঠাৎ করে সেদিন টিভিতে দেখি ব্যটারিচালিত রিক্সা সরকার চলতে দিবে না। খবরটা শুনার পর সারারাত মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করছিলো, আমার এতগুলো টাকা জলে যাবে। সারারাত একটা প্রচ্ছন্ন চিন্তায় থাকার পর, সকাল হতেই ফুপুরে ফোন দিলাম।
ফোনে বললাম- ফুপু রিক্সার খবরটা কী শুনছেন?
ফুপু নিরুত্তাপের মতো বললেন- হ্যা, শুনছি। তোমার ফুপা রাতেই চার্জ দেওয়ার সময় খবরটা শুনছে।
ফুপুর নিরুত্তাপ আচরণের কারনে আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললাম, ফুপারে কয়েকদিন রিক্সা নিয়ে বের হইতে নিষেধ কইরেন। পরিস্থিতি কোন দিকে যায় আগে দেখতে বলেন।
ফুপু শুধু বললেন-বলবো।

বিকালের দিকে বাসার ছাদে গিয়েছি। অনেকদিন আগে ছাদের ট্যাঙ্কিতে মাছ ছেড়েছিলাম, সেগুলো দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভাগ্য খারাপে ট্যাঙ্কিতে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। টর্চ আনার জন্য ঘরে যাবো, এমনসময় বাবা ফোন দিলেন। ফোনে বললেন – তুমি কই আছো?
আমি বললাম – বাসার ছাদে আছি।
বাবা আড়ষ্ট গলায় বললেন- যতদ্রুত সম্ভব তুমি গাবতলীর উদ্দেশ্যে রওনা দাও। আর হ্যাঁ, আমিন বাজার ব্রিজের পূর্ব পাড়ে থাকবা। আমি অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে আসছি।
আমি বললাম – বাবা, কোন সমস্যা? বাবা ধমকের সুরে বললেন- যা বলছি করো, এতো কথা বলো কানো?
আমি প্রচন্ড চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাবাতো কোনদিনও এভাবে কিছু বলে না, তবে বাবার কী হয়েছে? বাবা কী কোন বিপদে, এইসব ঘোরের মধ্যেই ‘ইতিহাস’ বাসে আমিন বাজার ব্রিজে এসে নামলাম। আমি বাস থেকে নামার ঠিক মিনিট পরেই একটি কালো রঙের গাড়ি থেকে বাবা ডাক দিয়ে বললেন- সানি গাড়িতে উঠে আসো। আমি গাড়িতে উঠতে-উঠতে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিলাম। ঠিক সময়েই এসে পৌঁছেছি, না হলে আবার ঝাড়ি খেতে হতো।
গাড়িতে উঠার পরে বাবা নিজে থেকেই বললেন- সানি কোন প্রশ্ন করবা না। কোন প্রশ্ন শোনার মতো অবস্থায় আমি নাই। আমি মনে মনে ভাবলাম – এ কোন বিপদ, বাবার আবার কী হলো? বাবা এমন আচরণ করছেন কেনো? একবার ড্রাইভার এর সাথে চোখাচোখি হতেই সেও চোখের ভাষায় জানিয়ে দিলো, ‘আমিও কিছু জানি না’।

খেয়াল করলাম, ড্রাইভারকে বাবা কোন নির্দেশনা দিচ্ছেন না। অথচ, ড্রাইভার নিজেই আমিন বাজার ব্রিজ থেকে ডানে মোড় নিয়ে ঘিঞ্জি রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আশ্চর্য, বাবা কী এখানে আগেও এসেছে! কই আমি তো কোনদিন জানতে পারলাম না। তবে কী আমরা বাবার সম্পর্কে কিছুই জানি না! চিন্তার ঘোর ভাঙলো বাবার গলার স্বরে- সানি নেমে এসো।

যে বাড়ির সামনে গাড়ি থামলো, সেখানো ছোটখাটো একটা জটলা। আবার, কান্নার স্বরও শুনতে পাচ্ছি। বাড়ির যতো ভিতরে ঢুকছি কান্নার স্বর ততো স্পষ্ট হচ্ছে। কান্নার স্বরটাও কেমন যেনো নাকি সুরে গান করার মতো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে এই বাড়ির কেউ একজন মারা গেছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছুক্ষনের মধ্যেই সত্য প্রমাণিত হলো, আর সবচেয়ে বড় সত্যটি হচ্ছে – মৃত ব্যক্তিটি আমার ফুপুর স্বামী।

ফুপুর মুখ থেকে যতটা শুনেছি তার সবটুকু বুঝতে পারি নি। কান্না, বিলাপের মিশেলে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তার সারমর্ম হলো- আমার ফোন পাবার পর ফুপু ফুপাকে রিক্সা নিয়ে বের হতে নিষেধ করেছিলেন। ফুপা একরকম জোর করেই রিক্সা নিয়ে বের হয়েছিলেন। কারণ, এই মাসে আমার পকেট খরচের টাকাটা এখনো দেওয়া হয়নি। গাবতলীতে বাস চলাচল বন্ধ, রিক্সার চাহিদা ব্যাপক। রিক্সা নিয়ে বের হওয়ার পর ফুপার দুপুর পর্যন্ত কোন খোঁজ-খবর ছিলো না। দুপুরের দিকে পুলিশ ফুপুকে ফোন দেয়। ফোন দিয়ে থানায় যেতে বলে। ফুপু থানায় গেলে জানতে পারে, দুপুরের দিকে পুলিশের আমিন বাজার চেকপোস্টে ফুপার রিক্সাটি আটকানো হয়। ফুপাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই পুলিশ রিক্সাটি ভাঙার নির্দেশ দিয়ে দেয়। এই ঘটনা সহ্য করতে না পেরে, কোন দিকে না তাকিয়েই ফুপা সোজা ব্রিজে উঠে যান এবং উঠেই ব্রিজ থেকে লাফ দেন। ঘটনার আকস্মিকতায় কোন পথচারীও তাকে আটকানোর সুযোগ পায়নি। পরবর্তীতে পুলিশ রিক্সার পেছনে লেখা নাম্বারে ফোন দিয়ে ফুপুকে থানায় যেতে বলে।

কলমে সাব্বির আহম্মেদ, বাংলাদেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here