রাত গভীর। তাপসী চুপটি করে দাওয়ায় বসে। তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। লাউয়ের মাচার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কাস্তে ফলার মতো চাঁদ। রাতে তারই মুক্তোভাঙা আলো এসে পড়েছে উঠোনে। একেবারে নীল বেনারসীর মতন তারা ছাপা আকাশ। তাপসী চেয়ে আছে তারাদের দিকে। তাপসী তারাদের চেনে না। চিনবে কী করে? যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, বাবার হাত ধরে এক বাড়ির কাজের মেয়ে হয়েছিল। বয়স বাড়ল। তাপসী পরিচিত হল ঠিকা কাজের দিদিতে। সকাল এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে কাজ করে। ভোরে ঝি লোকালে কলকাতা আসে। সব ডেলি প্যসেঞ্জার প্রায় একই ট্রেনে ও একই কামরায় যাতায়াত করে। হৈ হৈ করতে ওরা আসত। দত্তপুকুরে উঠতো বিপিন। ট্রেনে উঠে চুপটি করে বসে থাকত। কেমন উদাস হয়ে বসে থাকত। কেমন যেন ভাবুক ভাবুক চেহারা। কারো সাথে খুব একটা কথা বলত না। তাপসীর ওকে কেমন যেন ভালো লাগত। মাঝে কয়েকদিন বিপিনকে না দেখে বিস্মিত হয়েছিল। প্রায় সপ্তাহ খানিক পরে বিপিন আসে। সেদিন পাশে বসেছিল তাপসী। দুজনে কথা বলে। তাপসী জানতে পারে বিপিন ট্যাক্সি ড্রাইভার। শরীর খারাপের জন্য কাজে যেতে পারেনি। সেদিন যাচ্ছে। কিন্তু চিন্তিত, যদি মালিক ছাঁটাই করে দেয়! এভাবেই দুজনের আলাপ শুরু। দুজনের সম্পর্ক নিবিড় হয়। দুজনে ঘর বাঁধে দত্তপুকুরের এই ঘরে। বিপিনের মা-বাবা বহুদিন গত। দুজনে মিলে গুছিয়ে নিয়েছিল সংসার। কতদিন দুজনে এই উঠোনে বসে গল্প করত। বিপিন তারা দেখতে ভালো বাসত। চিনিতো অনেক তারা। তাপসীকে তারা চেনাবার চেষ্টা করত। ভুলো মনা তাপসী সব ভুলে যেত। সব ভুলে গেলেও ধ্রুবতারাটা চিনেছিল। বিপিন বলত, “আকাশে সারা বছর সব তারা তাদের অবস্থান পাল্টায়। শুধু ধ্রুবতারা একই জায়গায় থাকে।”

     বিস্মিত তাপসী বলে, “কেন গো?”

     “তা তো জানি না। বোধহয় সবাইকে সঠিক দিশা দেখানোর জন্য ধ্রুবতারা রাতের আকাশে এক জায়গায় থাকে।”

     কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, “আমি যখনই জীবনের দিশা পাইনা চুপ করে ধ্রুবতারার দিকে তাকিয়ে সঠিক পথের হদিশ খুঁজি। মনে রাখিস সততা ও বিশ্বস্ততার প্রতীক ধ্রুবতারা। যখন মনের কথা কাউকে বলতে পারবিনা তখন ধ্রুবতারার দিকে তাকিয়ে সব বলবি। মন হালকা হবে।”

     চার বছরের তাদের গোছান সংসার এক দূর্ঘটনায় তছনছ হয়ে গিয়েছিল। তাপসীর পেটে তখন ন’মাসের তাদের ভালোবাসার চিহ্ন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তাপসীর হাত জড়িয়ে ধরে বিপিন বলেছিল, “আমাদের সন্তানকে মনের মতন মানুষ করিস।”

     তাপসী ফিরে গিয়েছিল পুরানো পেশায়। আবার ঠিকা কাজের  দিদি। মানুষ করছে তাদের সন্তান ধ্রুবকে। কোনদিন বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। ধ্রুব এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। বাবার মতনই শান্তশিষ্ট। মায়ের দুঃখ বোঝে। পড়াশুনায় বেশ মনোযোগী। আর পাঁচটা ছেলের মতন কোন বায়না করে না। যা পায় তাতেই সন্তুষ্ট ও খুশি থাকে।

     এখন তাপসী চার বাড়িতে কাজ করে। সব শেষের বাড়ি এক চাকুরে দম্পতির। শনি রবিবার ছাড়া ওঁদের সাথে দেখা হয় না। তাপসী যখন কাজে আসে তখন দুজনেই অফিসে। ঘরদোর পরিষ্কার করে, রাতের খাওয়ার ও পরের দিনের সকালের টিফিন করে রাখে। ওঁরা তাপসীকে খুব বিশ্বাস করে। করবে না কেন। বেশ অগোছাল দুজনেই। প্রায় টাকা গয়না বাইরে পড়ে থাকে। তাপসী সব গুছিয়ে রাখে। ঘরে ঢুকেই তাপসী দিদিমণিকে ফোন করে জেনে নেয় কি রান্না করতে হবে। আজ দিদিমণি বলে, “দিদি, ফ্রিজে ইলিশ কেটে পিস করে রাখা আছে। আজ কোন সবজি করোনা। মাছের দুটো পদ ও ভাত ব্যাস।”

     ফ্রিজ খুলে দেখে ফ্রিজে অনেক ইলিশমাছের পিস রয়েছে।  তাপসীর মনটা উদাস হয়ে যায়। মনে পড়ে আজ ধ্রুবর জন্মদিন। কাল রাতে মা বেটা শুয়ে গল্প করতে করতে তাপসী বলেছিল, “বাবু, কাল তো তোর জন্মদিন। কী খাবি বল। ফেরার পথে বাজার করে আনব।”

     “সে আমি কী বলব। তুমি যা খাওয়াবে তাতেই আমি খুশি।”

     “সে তো জানি। তোর কি কোন ইচ্ছে হয় না?”

     কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধ্রুব বলে, “অনেকদিন ইলিশ মাছ খাইনি। অনেক দাম। থাক।  তোমার হাতের পায়েসই ভালো। পায়েস করো।”

     মাছ ধুতে ধুতে তাপসীর চোখে জল এসে যায়। ভাবে গরীব মানুষের আবার ইচ্ছে! পরক্ষণেই ভাবে অনেক মাছের পিস। ওঁরা নিশ্চয়ই গুণে রাখেননি। দুটো পিস ধ্রুব জন্য নিলে ধরতে পারবেন না। তাছাড়া তাকে ওঁরা খুব বিশ্বাস করেন। তাঁরা তাপসী মাছের পিস সরিয়েছে চিন্তাও করবেন না।”

     রাতে ধ্রুব ইলিশমাছের পদ ও পায়েস তৃপ্তি করে খেয়েছে। ধ্রুবর খুশিতে তাপসীর মন ভরে যায়। মাকে জড়িয়ে শুয়েছিল ধ্রুব। ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তাপসীর চোখে ঘুম নেই। তাই বাইরের উঠোনের এসে বসেছে। তাকিয়ে আছে ধ্রুবতারার দিকে। ভাবছে সে কী পাপ করল!তার মন উথাল পাথাল হচ্ছে। উঠে দাঁড়ায় তাপসী। বাম হাতে ডান হাতের অনামিকায় বোলাতে বোলাতে ধ্রুবতারার দিকে তাকিয়ে বলে, “ বিপিন পারিনি আমি। শত অভাবে আমি যা কোনদিন করিনি, তাই করতে বাধ্য হয়েছি। পুত্র স্নেহের কাছে আজ আমাকে হার মানতে হয়েছে। তোমার ভালোবাসার স্পর্শ চিরদিনের মত আজ হারালাম। না গো, ওঁদের বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারিনি। ফুলশয্যার রাতে তুমি আমায় সোনার আংটি দিয়েছিলে। তুমি যাওয়ার পর ওটায় হাত বুলিয়ে তোমার স্পর্শ পেতাম। সেই আংটি বিক্রি করে ধ্রুব মুখে ইলিশ মাছ তুলে দিয়েছি। তুমি আমায় ক্ষমা করো বিপিন।”

     আংটি শূন্য অনামিকায় হাত বোলাতে বোলাতে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে তাপসী।        

কলমে দীপক কুমার মাইতি, বেলদা, পশ্চিম মেদিনীপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here