লক্ষ্মী ঘর ছেড়েছে বছর পাঁচেক। এই পাঁচ বছর ও দেবীপুর মাড়ায় নি। মেলায় যাত্রাপার্টির রঘুর সাথে পালিয়ে এসেছিল সিনেমা করবে বলে। তখন ওর চন্দ্রকলার মত যৌবন।রোজই এক ধাক করে বাড়ছে। ডালিমের মত গায়ের রঙ। মায়ের মত পেয়েছে। দুগ্গার এখন আর সেই রঙ নেই। সারা বাড়ি গোবর নিকিয়ে, পুকুর-ঘাটে বাসন মেজে, পাঁচ বাড়ি জোন খেটে চামড়া এখন তামাটে। আধপেটা নুন আর পান্তায় কত আর জৌলুস দেবে।  ছোট মেয়ে সরস্বতী মানে ‘সরু’ এখন মিড্-ডে মিল স্কুলে যায় পেটভরা খাওয়ার লোভে। ছেলে কার্তিক একটা পাশ দিয়েছে। বাপটা অজানা জ্বরে মরে যাওয়ার পর বাপের রিক্সাটা চালাতে বাবুর সম্মানে লাগে। বাপটা মরে যাওয়ার সময়  দিয়ে গেছে বলতে, এই ভাঙা টালির ঘরখানা, আর পেটে আট মাসের গনশা। তবু লক্ষীর কলা গাছের মত বাড় দেখলে দুগ্গার ভয় হয়। এখন গ্ৰাম, আর সেই আগের মত নেই।  রাস্তা হয়েছে, পথবাতি লাগিয়েছে, শেয়াল শকুন কম দেখা যায়, কিন্তু ভয় এখন মানুষের। মা হয়ে খালি পেটে আর কত শাসন করা যায়। তবু একদিন বলে বসে,

“সন্ধেবেলা বাড়ির বাইরে আর যাসনি লক্ষ্মী, দিনকাল ভালো নয়।”

লক্ষ্মী ঝেঁঝিয়ে ওঠে, “ঊঁ.… , খেতে দেবার মুরদ নেই, আবার ‘মা’ গিরি। না খেয়ে মরার থেকে,  শেয়াল-শকুনের হাতে মরা ভালো।”

বরুণদা কলেজে পড়ে। বর্ধমানে। সাতটা দশের লোকালে ফিরবে। ঝালমুড়ি খাওয়াবে আর চাঁদের আলোয় রুপোলী স্বপ্ন দেখাবে। স্টেশনের রেলিং-এর ফাঁক ফাঁক ছায়া প্লাটফর্মে। শুধু আলোয় পা ফেলে ফেলে হাঁটে লক্ষ্মী। বরুণ হাসে। বলে, “অন্ধকার দাগগুলো তুই টপকে যাচ্ছিস কেন?”

লক্ষ্মী বরুণের হাতটা গায়ে চেপে ধরে বলে, “আমার শুধু আলো ভালো লাগে, কোজাগরী’ র মত।” 

বরুণের অস্বস্তি হয়। কারণ ও লক্ষ্মীকে ভালোবাসে। লক্ষ্মীও সেটা বোঝে। তাই হাতটা গায়ের সাথে চেপে ধরলেও কিছু হারাবার ভয় পায় না, বরং বয়স বেশ মজাই দেয়। বরুণ ঘর বাঁধতে শুধু একটু সময় চায়, যেটা লক্ষ্মীর হাতে খুব কম। বরুণদের পাকা বাড়ি। ওর বাবা শহরে চাকরি করে। জমিজমা আছে। আর আছে একটা শান-বাঁধানো পুকুর। লক্ষ্মী ঐ পুকুরে চান করতে যায়। ছুটির দিন জল থেকে উঠৈ ভিজে কাপড়ে বরুণকে ছাদে দেখতে পেলে লক্ষ্মীর লজ্জা লাগে। তবে লজ্জাটা ভয়ের নয়, গরমকালে কাঁচা আম, নুন দিয়ে খাওয়ার মত বেশ মজার। তবে রাতের বেলা শোবার পর মাঝেমধ্যে মাউথ-অরগ্যানের সুর ভেসে আসে লক্ষ্মীর কানে, বরুণ বাজায়, তখন একটু ভয় লাগে লক্ষ্মীর। ক্লাস ফোরের বিদ্যে নিয়ে বেশি স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। নিজেকে খুব ছোট নদী মনে হয়, মিশতে ইচ্ছে করলেও সমুদ্র দেখলে ভয় লাগে।

এবারে পৌষমাসে দারুণ মেলা বসেছে। কলকাতা থেকে যাত্রাদল এসেছে। যাত্রাদলের একটা ছেলে আড় চোখে লক্ষ্মীর দিকে হাসে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। রঙ মাখা গোলাপী গাল। চোখে স্বপ্ন নেই। একদিন কথা বলল লক্ষ্মীর সাথে। কথায় বরুণের মত ভবিষ্যত নেই, কিন্তু একটা সুখের হাতছানি আছে। দুপুরবেলা; মেলার পাশে ধানমাঠ। রোদে চিকচিক করছে সোনালী ধান। যেটার খুব অভাব লক্ষ্মীর ঘরে। কথায় কথায় জানল ছেলেটার নাম রঘু। রঘুবীর সামন্ত। ধানের একটা শিষ তুলে নিয়ে দাঁতে কাটতে কাটতে হাঁটছে লক্ষ্মী। রঘু জিগেস করে, “তুমি এই গ্ৰামেই থাকো? কী করো?”

— “কিছুনা, ঘুরে বেড়াই।”

— “অভিনয় করবে? যাত্রা,সিনেমা?”

— “আমায় লোকে নেবে কেন?”

— “সে তো আমি আছি, ঠিক ঢুকিয়ে দেব।”

— “ধ্যাৎ, আমি পারব?”

— “কেন….? আমি শিখিয়ে নেব।”

— “বাড়ি থেকে ছাড়বে?”

— “সিনেমায় কে কবে আবার বাড়িতে বলে নেমেছে? পালিয়ে গিয়েই নামতে হয়। দু-হাতে পয়সা লুটবে, সাজ-পোশাক নায়িকা’র মত হয়ে যাবে, তারপর যখন গ্ৰামে ফিরবে, সবাই ভিড় করবে একবার দেখার জন্য।”

চাঁদের স্বপ্ন গড়িয়ে পড়তে দেখেছে এর আগে বরুণের সাথে। কিন্তু আজকের নীল আকাশে কত আলো, গাছের পাতায়, সবুজ মাঠে, লক্ষ্মীর কচি মনে থৈ থৈ করছে আলো, চারিদিকে ‘জীবন’ ‘বাঁচা’ খেলছে আর হাসছে। ডাকছে লক্ষ্মীকে। বরুণের জ্যোৎস্নার নরম আলো, অরগ্যানের মিঠে সুর, জীবনের সুখের দিনের ধীর লয়, কবিতায় বলা সেইসব মন্থর প্রতিশ্রুতি, ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মীর মনে। ভাত নেই কাপড় নেই, মাথায় ভাঙা চাল, কথা আছে সুর নেই, গতি আছে ছন্দ নেই, প্রাণ আছে, বাঁচা নেই। এত ‘নেই’র মধ্যে রঘুর কথাগুলো খড়কুটোর মত লাগল, আবার ভয়ও লাগল। তবুও কোনও পিছুটান নেই। সম্বল বলতে, দুটো কাপড়, তিনটে সালোয়ার, আর কানের দুটো মাকড়ি। পুঁটলি বেঁধে নতুন বছরের গভীর রাতে চারিদিকে বাজির শব্দ আর তারাদের মিটিমিটি আলো সাথে নিয়ে চেপে বসল রঘুর বাইকে। 

রঘু নিয়ে এসে তুলল কোলকাতায় একটা ছোট্ট ঘরে। মনে হয় তক্তোপোশ আগে ঢুকিয়ে তারপর দেওয়াল গাঁথা হয়েছে। খুব ঘিঞ্জি বাড়িগুলো। রাস্তা যে এত সরু অলিগলি হয়, লক্ষ্মী আগে দেখেনি। দিগন্তবিস্তৃত ফাঁকা মাঠ ছিল ওর জীবনে কিন্তু রাস্তার এত প্যাঁচ ও বোঝে না। ভোরবেলা দেখল, অনেক রঙ-বেরঙের মেয়ে। কত বিচিত্র তাদের সাজ। যাত্রাদলের মেয়েদের মত চড়া রঙ মাখা। রঘু দামী জামা-কাপড় আর খাবার নিয়ে এল।বলল, “লক্ষ্মী দলুই নাম চলবে না, শহরে এসব নাম চলে না, কেউ জিগেস করলে বলবে ‘নীপা’। এখন ভালো করে স্নান করে নাও, তারপর এই জামা পরে নেবে। কাল রাতে তো খাওয়া হয় নি, আগে খেয়ে নাও।”

বাধ্য ছাত্রীর মত ঘাড় নাড়ল লক্ষ্মী।

স্নান সেরে ঘরে ঢুকতেই জড়িয়ে ধরল রঘু। লক্ষ্মী অপ্রস্তুত। হাতের মধ্যে বরুণের ভালো লাগা নেই। শিকারি বেড়ালের নিঃশব্দ থাবার মত হাত। ভালো লাগছে না লক্ষ্মীর, তবু বয়স বাধা দিতে পারছে না, সারা শরীর তদন্ত করছে রঘু, লজ্জাবস্ত্র সরে যাচ্ছে, কুমারীত্বের পর্দা ছিঁড়ে নারী বেরিয়ে আসছে। থরথর করে কাঁপছে লক্ষ্মীর শরীর। বাধাহীন দেহ, সমর্পণ করছে রঘুর কাছে। জীবনের প্রথম সম্ভোগ। এলোমেলো ঘন চুলে ঢেকে যাচ্ছে দেবীপুরের হাওয়ায় নুয়ে পড়া মাঠ, বরুণদের পুকুর-ঘাট, জল চিরে হাঁস-চরা,বা অলস দুপুরে বকেদের মাছ ধরা। একটা উদ্দাম অনুভূতি হচ্ছে। পেটের অনেক খিদে সহ্য করেছে। কিন্তু শরীরে যে এত খিদে থাকে, সেটাই জানত না। সেই জানার মধ্যেই জন্ম হল ‘নীপা’র।

রঘু আলাপ করিয়ে দিল, রঘুর মাসির সাথে। তারপর কাজে বেরলো। ভয় করছে লক্ষ্মীর। রঘুকে বলল, “খুব ভয় করছে, আমি তো কাউকে চিনি না।”

রঘু মাথায় হাত দিয়ে বলল, “ভয়ের কী আছে, আমি যাব আর আসব। মাসি থাকলো তো, খুব ভালো।”

তারপর যা হবার তাই হল, রঘু আর কোনদিন এল না। হাতে হাতে প্রতি রাতে ঘুরতে লাগলো নীপা। দিনে সাজা, আর রাতে আরও বড় সাজা। আর্থিক আদর আর মনমরা শরীরের উদ্দাম আনন্দে পয়সা প্রচুর হল নীপার। প্রতি মাসে টাকা পাঠায় বাড়িতে।

কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস! জীবাণুর কবলে আজ জীবন। পৃথিবীর প্রতিটি মূমুর্ষূ পাকে আজ বিষকুম্ভ। শারীরিক দূরত্ব এখন সরকারি নিয়ম। মৃত্যু- ভয় গ্ৰাস করেছে লোলুপ ভোগীদের। তাই দেহপসারিনীরা আজ কর্মহীন। মন খারাপের মধ্যে নীপার মনে পড়ে দেবীপুরের কথা। এতদিন কাজের গতিতে সব ভুলে ছিল। তবু দ্বিধা হয় যেতে। টাকা গ্ৰহণ করে, কারণ তাতে স্পর্শদোষ নেই। বাড়ি ওকে আর হয়তো ফেরৎ নেবে না। তবু ওর বিশ্বাস, বরুণ একদিন আসবেই হয়তো ‘আমফানে’র  মত কোন নাম নিয়ে।

কলমে বাণীব্রত গোস্বামী, ইস্টমল রোড্, কোলকাতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here