রাতে ভালো ঘুম হয়নি। এই মন কেমনের বসন্তে খুব মন খারাপ হয় আমার। সারারাত এপাশ-ওপাশ করতে থাকি বিছানায়। খুব একা লাগে। বাইরে যখন কোকিল ডাকে, পাশের লেবু গাছ থেকে যখন ফুলের গন্ধগুলো অনুমতি ছাড়াই ঘরে ঢোকে। বড় রাগ হয় আমার। মনে হয় এখুনি গিয়ে ওই কোকিলটাকে পাড়া ছাড়া করতে আর লেবু গাছটাকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে। কিন্তু সব ইচ্ছেদের আবার আস্কারা দিতে নেই, বড় পেয়ে বসে তারা। হাবি হয়ে যায় মনের উপর। তখন মনে কেবল তাদের রাজত্ব চলে। জন্মায় পাওয়ার ইচ্ছে, না পাওয়ার বেদনা। মনে হয় পৃথিবী আমায় কিছুই দেয়নি, কেড়েছে কেবল। এই পৃথিবী আমার যোগ্য নয়, নয়ত পৃথিবীর যোগ্য আমি নই।

সকালে স্নান সেরে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আজ আমার একাদশতম ইন্টারভিউ। মাঝপথে পড়াটা ছাড়তে হয়েছিল আমায়। কোন কারণ ছাড়াই। বাবা মা আগাগোড়াই আমাকে কোন ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করত না। তাই পড়াশোনা কেন ছাড়লাম সেই প্রশ্নটার উত্তরও আমাকে দিতে হয়নি। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই বাবা একদিন বলল “ এবার একটা কাজ দেখ। যা হোক একটা কিছু কর। কতদিন আর বসে বসে খাবি?” 

বাবার এহেন কথায় কিছুটা চমকে গেছিলাম। বাবা’তো আগে কোনদিন আমার সাথে এইভাবে কথা বলেনি। তাহলে হঠাৎ করে কি এমন হল যে বাবা এইভাবে খাওয়ার খোঁটা দিল। ভাবলাম বাবার মাথাটা সত্যি বোধহয় খুব গরম ছিল সেদিন, তাই ওইভাবে বলে দিয়েছে। এইতো সবে কলেজ ছাড়লাম। টিউশনি করে নিজের খরচটা চালিয়ে নিই। বাবার কাছে হাত পাততে হয়না। কথাটা গায়ে মাখলাম না। কিন্তু কিছু কথা না চাইতেও শুনতে হয়। সময় আর পরিস্থিতি সবাইকেই পরিবর্তন করে। যতই হোক মানুষ পরিবর্তনশীল জীব।

কিছুদিন পর আমার ভুলটা ভাঙল। সেদিন বাইরে বন্ধুদের সাথে একটু ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবা মায়ের তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। কারণটা আমি। বাবা মায়ের উপর চেঁচিয়ে আমাকে ঘরে বসিয়ে কুঁড়ে করে দেওয়ার খেতাব দিচ্ছে। আর মা মুখ বুজে শুনছে। আমি ঘরে ঢুকতে আমাকেও বলে দিল, এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজ জোগাড় করতে পারলে ভাল, নাহলে এই বাড়িতে আমার আর কোন জায়গা নেই। এত বড় ছেলেকে বসিয়ে খাওয়াতে তিনি নারাজ। চুপ করে শুনলাম। অভিমান আর রাগগুলো শরীরের প্রতিটা শিরায় সরসর করে বইতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে, হাত মুঠো করে শুনলাম সব অপমান। তারপর থেকে অনেক ইন্টারভিউ দিলাম। কিন্তু হয় আমাকে তাদের পছন্দ হলনা, নয়ত তাদের আমার পছন্দ হলনা। দশটা ইন্টারভিউ দিয়েও যখন ব্যর্থ হয়ে ঘরে বসে রইলাম। বাবা আর সহ্য করতে পারল না। আমাকে ডেকে বলল, আর একটাই সুযোগ। এবার ব্যর্থ হলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে হবে আমায়। চেনা মানুষগুলো কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছিল আমার কাছে। ধীরে ধীরে সবাই আমার থেকে নয়ত আমি সবার থেকে দূরে চলে যাচ্ছিলাম। 

কলকাতার রাস্তা গুলো তখন একটু বিরতি পেয়েছে। কোলাহলটা একটু কম। মোবাইলে দেখলাম রাত এগারোটা পাঁচ। মানে কলকাতার ষাট শতাংশ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট তখন বন্ধ। এই সময়টা বাস পাওয়াও মুস্কিল। সারাদিন না খেয়ে-দেয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে কাটিয়েছি। ভেবেছিলাম বাড়ি যাবনা। কিন্তু রাস্তায় থাকার অভ্যাস আর উপায় দুটোই নেই। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থেকে ভাগ্যক্রমে একটা বাস পেলাম। ইন্টারভিউ ভালোই দিয়েছি। তবে এরা যদি না ডাকে। কোথায় থাকব? কি করব? কার কাছে আশ্রয় খুঁজব? কেউ যদি থাকতেও দেয়। কতদিন? এইসব ভাবতে ভাবতে বাসে উঠলাম। ব্যাগে কাগজ পত্রের সাথে একটা খুব দরকারী জিনিস নিয়েছি আজ। খুব দরকার আমার এই সময় সেই জিনিসটার। ফাঁকা বাস। দুজন আলাদা আলাদা সিটে বসে ছিল সামনের দিকে। আমি আগাগোড়াই পিছনের সিটটাতে বসি। ভালোলাগে। আমার এখন একা থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে। কিছুই আর ভালো লাগেনা। খেতে, ঘুমাতে, পড়তে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে কিছুই না। একা থাকি, জানালা দিয়ে সচল শহরটাকে দেখি, গাড়ি গুলোর একে অপরকে পিছনে ফেলে যাওয়ার লড়াই গুলো দেখি। মানুষ দেখি, রাস্তার কুকুর দেখি, হালকা হাওয়ায় দুলতে থাকা গাছের সবুজ পাতা আর লাল ফুল দেখি। একভাবে জানলার গ্রিলে মাথা লাগিয়ে কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। আমি একা, একাই থাকি। মাঝে মাঝে ভাবি এ জীবন রেখে লাভ কি। কিছুই তো করতে পারলাম না। বৃথা গেল জীবনটা। পুরুষ মানুষ হয়ে একটা চাকরি পর্যন্ত জোগাড় করতে পারলাম না এখনও। এর থেকে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে? এরকম নানা চিন্তা এসে ভিড় করে এই তেইশ বছরের মাথাটায়। ভারী হয়ে যায় তখন শরীর। মনে হয় মাথাটা যেন এবার ফেটে যাবে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হয়। নিজের মাথার চুলগুলো নিজেই মুঠো করে ধরে উপর দিকে টানতে থাকি, ছিঁড়তে থাকি। ব্যাথা কমেনা। পেইন কিলার খাই। একটা না কমলে আবার একটা। না, কমে না কিছুতেই। 

দুটো স্টপেজ পরে আমার পাশে কেউ একজন এসে বসল। আমার কানে হেডফোন। হেডফোনে তখন “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন” গানটা চলছে। ছেলেটি পাশে বসেই বলল ” দাদা একটু সরে বসবেন?” কানে হেডফোন থাকার সত্বেও আওয়াজটা শুনলাম। সরে গেলাম সেদিকে না তাকিয়েই, আর মনে মনে ভাবলাম বাসের এত সিট খালি ওকে আমার পাশেই এসে বসতে হল। ওর শরীরের কিছুটা অংশ আমাকে স্পর্শ করে ছিল। আমি একবার বাসের সামনে তাকিয়ে দেখলাম। তখনো সেই দু-জন ছাড়া আর কোন প্যাসেঞ্জার নেই বাসে।ভাবলাম সেই সিট থেকে উঠে চলে আসব, অন্য সিটে বসব। এরম চিন্তা ভাবনা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটির দিকে তাকালাম। আমার বুকটা কেঁপে উঠল। কে এ? এত চেনা চেনা লাগছে কেন? কোথাও যেন দেখেছি আমি ছেলেটিকে। ছেলেটি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল ” বসো বসো। আমি জানি তুমি এখন নামবে না। আমি সরে বসছি।'” ছেলেটি সরে গেল। বসে পড়লাম পুনরায়। মাথায় জোড় দিলাম, কোথায় দেখেছি ছেলেটাকে? কেন এত চেনা লাগছে? স্মৃতিতে জোর দিলাম। মাথাটা আবার যেন ব্যাথা করে উঠল। 

ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমিও হাসলাম। সব চিন্তার উর্ধ্বে তখন আমার মনে পড়ল সেই বিশেষ জিনিসটার কথা। ব্যাগের চেইন খুলে হাত দিয়ে দেখলাম সে নিজের জায়গায় আছে। বাস চলেছে বাসের মত। হাজরা মোড়ের ইন্দিরা রাজীবের মুর্তি পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। পিছনে পড়ে থাকছে কত মানুষ। সবার গন্তব্য আলাদা আলাদা। সবার লক্ষ্য আলাদা। এগিয়ে যাওয়া শহর আর তার এগিয়ে যাওয়া মানুষ। কেউ পিছিয়ে থাকতে চায়না। মাড়িয়ে চলে একে অপরকে। কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। কেবল সামনের দিকে এগিয়ে চলে। 

কন্ডাক্টার দাদা এসে ভাড়া নিয়ে গেল আর নিজের দুঃখ শুনিয়ে গেল। বাসে এই সময় একদম প্যাসেঞ্জার হয়না। মালিক রাগ করে। টিকিটের হিসাব দিলেও বলে তারা নাকি চুরি করে নেয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। পাশে তাকালাম। ছেলেটা হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে। উফফ, কেন আজ আমার এরকম হচ্ছে? কেন বুকের ভেতর কিছু একটা এভাবে ছটফট করছে? কোথায় দেখেছি ছেলেটাকে? কেন এত চেনা লাগছে? ও যেভাবে আমাকে দেখে হাসছে তাতে করে বোঝা যাছে ও আমায় চিনতে পেরেছে আর এটাও বুঝতে পেরেছে আমি ওকে চেনার চেষ্টায় আছি। তাই পাশে বসে মজা নিচ্ছে। 

জানলার দিকে মুখটা করলাম। আলিপুর জেল পেরিয়ে গেল বাসটা। তখন আমার কানে হেডফোন নেই। গান শুনতে আর ভালো লাগছিল না। ছেলেটা আমাকে জিজ্ঞেস করল ” এত চিন্তা কিসের তোমার?” আঁতকে উঠলাম। এই গলার স্বর আমার বহুদিনের পরিচিত। এই স্বরে কত গল্প কত কবিতা শুনেছি আমি। কে ও? কেন নিজের পরিচয় দিচ্ছেনা? আমি মনে করতে পারছি না, পারছি না আমি মনে করতে। মুখটা ওর দিকে করে বললাম ” তোমাকে আমার চেনা চেনা লাগছে! তুমি আমাকে চেনো?” ছেলেটা হাসল আর মৃদু স্বরে কিছু একটা বলল। শুনতে পেলাম না। আমি আবার তাকে বললাম ” আসলে তোমাকে কেন জানিনা খুব চেনা চেনা লাগছে!” 

ছেলেটা বলল ” ওসব ভেবে লাভ নেই। কে কাকে কখন দর্শন করলাম। সেটা ভেবে লাভ আছে? “

মুখটা ঘুরিয়ে জানলার দিকে করলাম। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে। কাজটা কি বাড়ি গিয়ে করব? নাকি বাসেই? নাকি বাস থেকে নেমে বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে হাঁটাপথে যে মাঠটা পড়বে, সেখানে? বাড়িতে করলে মা নিজের চোখে দেখলে কষ্ট পাবে। উফফ, চিন্তায় আমার মাথাটা ফেটে যাচ্ছে।

বাসটা আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে। কন্ডাক্টার জায়গার নাম বলে বলে প্যাসেঞ্জার তোলার চেষ্টা করছে। যদিও রাস্তায় বেশি প্যাসেঞ্জার নেই। ট্রাফিকটা হাত দেখিয়ে ইশারা করে গাড়ি গুলো পাশ করাচ্ছে। এদিকে যাও, ওদিকে যাও। সবাই যে যার কাজে ব্যাস্ত। শুধুমাত্র আমি ছাড়া। জীবনে আমার যেন কিছুই করার নেই। লক্ষ্যহীন গতিহীন একটা অকেজো মানুষ হয়ে পরে আছি। পৃথিবীর বোঝা। 

ছেলেটা আবার আমায় জিজ্ঞেস করল ” কেন এত ভাবছ?সব ঠিক হয়ে যাবে।”

অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। সে কি করে জানল আমি কি ভাবছি? কোন তান্ত্রিক নাকি? কপাল পড়তে পারে? মনের কথা চোখেই দেখে ফেলে নাকি? চোখটা নামিয়ে নিলাম। এখন তার পরিচয় মনে করার থেকে বেশি জরুরি হয়ে গেল এটা জানা যে, সে কি করে আমার মনের কথাগুলো জানতে পারছে। এও সম্ভব?

ছেলেটা আবার বলল ” কিছু জিনিস সময়ের উপর ছেড়ে দিতে হয়। এত চাপ নিয়ে, দুশ্চিন্তা করে বাঁচা যায়না। এগুলো অকাল মৃত্যুর পথ প্রশস্ত করে।”

নিজেকে আর চেপে রাখতে পারলাম না। চোখ ফেটে জল এল। সময় যেন থমকে গেল। বাসটাও কি আর চলছে না? আশে-পাশে কেউ নেই। আমি আর ওই ছেলেটা। কি নাম ওর? ওকে বলব নিজের মনের কথা? আমি কি পরিস্থিতির মধ্যে আছি বলব ওকে? যদি ও না শোনে। যদি আবার আমার কাউকে নিজের মনের কথা বলার অভ্যাস হয়ে যায় আর তারপরে আমি তাকে না পাই? 

ছেলেটা আমার পাশে আরও কিছুটা সরে এল। মুখটা আমার দিকে তুলে বলল ” আমাকে মনের কথা বলে ঠকবে না তুমি।” হাতটা আমার হাতের উপর রেখে খুব শান্ত একটা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলল ” যাদের তুমি নিজের ভেবে মনের কথা বলেছ। আসলে তারা দু-দিন পর আর সে কথা শোনায় আগ্রহী হবেনা। আর তুমি তখন আরো ডিপ্রেশড হয়ে যাবে। কারণ তখন তোমার তাদেরকে বলার অভ্যাস হয়ে যাবে। মানুষ অভ্যাসের দাস।” 

ভীষণ একটা সত্যি কথা বলেছে ছেলেটা। আসলেই ঠিকই তো একদিন দুদিন দুটো মনের কথা বলে আমরা যাদের কাছের মানুষ,পাশের মানুষ ভাবি। তারা আসলে সেই মরুভূমির মরীচিকার মত। দূর থেকে দেখে মনে হয় আছে, আসলে তারা নেই, কোথাও নেই। 

ছেলেটাকে কেমন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনের কথাগুলো মুখ ফুটে বের হতে চাইছে। তীব্র বেগে সুনামির মত আমার না বলা কথাগুলো আছড়ে পরতে চাইছে সেই ছেলেটার কানে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম ” জীবনে কিছু করতে পারলাম না। আর নিজেদের অপমান নিতে পারছি না। তাই অবসাদে……”

আমার কথা শেষ হলনা। ছেলেটা আমার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলল ” তাই ব্যাগে ওই অবসাদের ওষুধ নিয়েছ বুঝি?” আরও অবাক হলাম। আমার ব্যাগে কি আছে। ছেলেটি জানল কি করে। ভাবলাম এত কিছু যখন জানে। তখন আমার ভিতরে থাকা কথাগুলোও হয়ত জানে। মুখটা ফিরিয়ে নিলাম। ছেলেটা আবার বলল ” ঠিকই ধরেছ। আমি সব জানি তোমার মনে কি চলছে? তোমার সবটা জানি আমি মন।”  চমকে উঠলাম। দরদর করে ঘামছি। মন? এই নামটা তো সেই কোন ছোটবেলায় ঠাম্মি আমায় ডাকত। সকাল থেকে দুপুর, আবার দুপুর থেকে রাত। ঠাম্মি মন মন করে পাগল থাকত। আমার নাম যে মৃন্ময় সেটা বাড়ির সবাই প্রায় ভুলে গেছিল। ছেলেটি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম ” ঠাম্মির সাথে আমি খুব ভালো থাকতাম। ঠাম্মি আমার মনের কথা না বলাতেই বুঝে যেত। কেন যে ঠাম্মিটা এভাবে চলে গেল? তারপর থেকে আমায় আর মন  নামে কেউ ডাকে না। ওই নামটা শুনলেই আমি কেমন যেন হয়ে যাই। হারিয়ে যাই। নিজেকে খুঁজে পাইনা।” 

ছেলেটি বলল ” সব মানুষ সর্বদা এই পৃথিবীতে থাকেনা। সবাইকে যেতে হয়। কাউকে আঁকড়ে ধরে পরে থাকতে নেই মন।”

ভেঙে পড়লাম আমি। দু চোখ দিয়ে অনবরত জল পরতে লাগল। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম ” আমার বাবা পর্যন্ত কেমন যেন পালটে গেছে জান। এখন আমার সাথে আর সেভাবে কথা বলেনা। আর মা, আমি প্রতিদিন তার কোলে মাথা রেখে শুতাম।কিন্তু এখন সেই কোলটাও আর আমার জন্য নেই।”

ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। রাগ হল। সেও আমার কথায় হাসছে ! মুখটা নীচের দিকে করে বললাম ” হাসলে কেন? তুমিও মজা নিচ্ছ তো?”

আমার হাতটা আরও শক্ত করে ধরল সে। তারপর হাসি হাসি মুখে বলল ” আসলে আমরা যখন নিজে দুঃখী থাকি, তখন আমাদের মনে হয় পাশের প্রত্যেকটা মানুষ আমাদের দেখে মজা নিচ্ছে।তারা যেন আমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়। আমাদের চোখ কেবল আমাদের দৃষ্টি। আসল দর্শন তো মগজ করায়। আমরা সেখানে যা ভাবি সেটাই দেখি। তার বাইরে কিছু দেখার শক্তি আমাদের থাকেনা। ” চুপ করে রইলাম। ছেলেটার কথাগুলো শুনে মনটা কেন জানিনা হালকা হয়ে আসছিল। মাথার ভার ভাবটা কমে যাচ্ছিল। ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরলাম। ও মুখের সেই হাসি ভাব বজায় রেখেই বলল ” এই যেমন তুমি তোমার বাবা-মা কে আগে একরকম দেখেছ। এখন আরেক রকম দেখ। আসলে তাদের পরিবর্তনটা তোমার জন্য।” চমকে উঠলাম।  আমার জন্য তারা পরিবর্তন হয়ে গেল। কেন? আমি কি এমন করেছি? সবে জিজ্ঞেস করতে যাব ছেলেটা নিজেই বলল ” যে নিজে যতটা দুঃখী থাকে, ডিপ্রেশড থাকে। তার সাথে থাকা মানুষগুলো তার প্রভাবে ঠিক ততটাই ডিপ্রেশড হয়ে যায়। ওইযে বললাম আমাদের মগজ আমাদের যা দর্শন করায় আমরা তাই দেখি। চোখতো কেবল মাধ্যম।”

বাসের একেবারে শেষ স্টপেজে নামলাম আমি। আমার সাথে ছেলেটিও নেমে গেল। জিজ্ঞেস করলাম না। সে কোথায় যাবে? কেন আমার সাথেই সে নামল? আসলে সেই ইচ্ছেটা তখন আর ছিলনা। মনে হচ্ছিল ওর কথাগুলো শুনতে থাকি আর আমার কথাগুলো বলতে থাকি। 

বাস থেকে নেমে প্রায় পনেরো মিনিট হেঁটে গেলে তবে আমার বাড়ি। মাঝখানে একটা বেশ বড় খেলার মাঠ পড়ে। তার পাশে পিচ ঢালাই রাস্তা। আমি হাঁটছি, ছেলেটাও অনর্গল কথা বলতে বলতে আমার সাথে হাঁটছে। আমার দিকে তাকিয়েই সে রাস্তা চলছে। আমার পা ঠিক যেভাবে মাটিকে স্পর্শ করে উঠে আবার একটা স্টেপ নিচ্ছে। সেও ঠিক একই ভাবে চলছে। অবাক হওয়ার আর কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। কারণ, তার সাথে দেখা হওয়া থেকে এখনও পর্যন্ত অনেক কিছুই অস্বাভাবিক ঘটেছিল। যেমন, তার আমার নাম জানা, আমার সব মনের কথাগুলো মুহুর্তে রপ্ত করে নেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

মিনিট তিন পর মাঠের পাশে আসতেই আমার মনে পড়ল আমার ব্যাগে রাখা সেই বস্তুটির কথা। একবার তাকালাম ছেলেটার দিকে। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। ভাবলাম, ও তো এতক্ষনে জেনেই গেছে আমার মনের কথা। তাই কিছু না বলেই ব্যাগে হাতটা ঢোকালাম। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাকে অবাক না করেই ছেলেটি বলল ” বাঁচতে হবে যে। ব্যাগের ওই বস্তুটা আমার সামনে ফেলে দাও মন। তোমার অনেক কাজ বাকি। কত স্বপ্ন ছিল না তোমার! সেগুলোকে এভাবে ধুলোয় মেশাবে? পারবে নিজের লেখার খাতাটা পুড়তে দেখতে?পারবে বুড়ো বাপটাকে পাথর হয়ে বসে থাকতে দেখতে? সে যে তোমায় বড্ড ভালোবাসে মন। পারবে তোমার মা’কে ডাক ছেড়ে কাঁদতে দেখতে? হয়ত বারবার সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তার কিছুদিনের মধ্যে তোমার শোকে তিনিও হয়ত…..” থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। হাতটা ব্যাগের ভিতরে সেই বস্তুটাকে স্পর্শ করে আছে। চারপাশটা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল আমার। ওইতো বাবা পাথর হয়ে বসে আছে। পাশে ওইতো মা, ইসসস মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সবাই তার চোখে মুখে জল দিল। আবার উঠে কাঁদতে লাগল সে। সবাই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। একবার জ্ঞান আসছে, আবার কেঁদে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বুকটা বোধহয় বড্ড ব্যাথা করছে মায়ের। কেমন বুক চাপড়ে কাঁদছে মা। হঠাৎ থেমে গেল মায়ের কান্না। অজ্ঞান হয়ে গেল আবার। কিন্তু এবারে  চোখে মুখে জল দিতেও আর উঠছে না মা। কেন? কেন উঠছে না মা? বাবা জোড়ে কেঁদে বলে উঠল মাকেও নিয়ে গেলি মন। আমাকে একা করে। কেন মন? কেন?

আর কিছু ভাবার সময় আর সুযোগ কিছুই দিলাম না নিজেকে। ব্যাগ থেকে বিষের শিশিটা বের করে পাশের ড্রেনে ফেলে তাকালাম সেই ছেলেটার দিকে। হাসছে সে আমার দিকে তাকিয়ে। একবার মনে হল তাকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু পরক্ষনেই দেখলাম সে যেন কেমন একটা আবছা হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে এত ধোঁয়া কেন? কোথা থেকে এল এত ধোঁয়া? কেন মিলিয়ে যাছে সে আমার জীবন থেকে? জোড়ে চেঁচিয়ে বললাম ” যেওনা বন্ধু, আমাকে ছেড়ে যেওনা।” কিন্তু ক্রমাগত তার মুখাবয়ব আমার সামনে ধূসর হয়ে যাচ্ছে। একি, সে চলে যাচ্ছে আর আমি তার পরিচয়টাই জিজ্ঞেস করিনি এখনও। জোড়ে বললাম ” তুমি কে? আবার কবে আসবে?” 

ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টিতে।  তার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ। মুচকি হেসে উত্তর দিল ” আমি তোমার সুস্থ দর্শন। আমি মন। তোমার মধ্যেই আছি। চাইলেই দেখতে পাবে।” সেই আবছা ধোঁয়াতে নিজের মুখটা এতক্ষনে চিনতে পারলাম আমি।

মিলিয়ে গেল সে। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার। জ্ঞান ফিরে দেখি বাড়ির বিছানায় শুয়ে। পাশে মা, বাবা বসে। চোখটা তাকাতেই বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওঘরে চলে গেল। মা মুখের দিকে তাকিয়ে।  চোখে জল নিয়ে জিজ্ঞেস করল ” কি হয়েছিল বাবা? ওখানে পরে গেছিলিস কেন? কিছু দেখেছিলিস নাকি?”

মুচকি হেসে উত্তর  দিলাম ” হ্যাঁ মা, মনকে দেখেছিলাম। ওখানের দর্শনে আমি নিজেই ছিলাম মা। তোমাদের পুরানো মন।”

মা কি বুঝল জানা নেই। শুধু হাত জোড় করে উপরের দিকে তাকিয়ে বলল “ মা কালি বাঁচিয়েছে”। কিন্তু আমি জানি আমাকে কে বাঁচিয়েছে।

কলমে রাজকুমার মাহাতো, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পার্ক, কলকাতা

 অনলাইন ও অফলাইন বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখেন। প্রথম বই ইবুক রুপে প্রকাশির। নাম "তিনের গপ্পো।" তারপর নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার ২০২০ তে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে সকলের মন জয় করে নেওয়া। প্রথম মুদ্রিত বই "ফুলশয্যা।" 

1 COMMENT

  1. Asadharon….rudhhoswas e pore jaoar moto golpo….tobo protita golpoi abosyo darun…bises kore samajik golpo guli
    Ar golpota te kotto bar amr dak nam ta achhe😁😁😁
    Darun laglo dada👍

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here