ডে সিক্সটিনথ — বিকেল ৫:00
মিতা রিনিকে নিয়ে হসপিটালে অপেক্ষারত , ভিসিটিং এর সময় এখন শুরু হয়নি l গতকাল শেষ রাতে ঘুম তাই আজ উঠতে অনেকটাই দেরি হয়েছে , রিনিকেও আর স্কুল পাঠাতে পারেনি মিতা ,ওঠার পর থেকে যত ফোন এসেছে মিতা একটাও রিসিভ করেনি , রিনিকে বলেছে বলে দিতে মা ব্যস্ত আছে l গতরাতের অভিজ্ঞতায় মনটা তিক্ত হয়ে ছিল ..একটা চাপা অভিমান কিছু কাছের লোকের উপর হয়েছে l
যদিও মিতার মনের এখন যা অবস্থা খারাপ ভাল কোনোকিছুই আর বিশেষ দাগ কাটেনা l
বিকেলে ছোটোমাসি ফোনে জানায় যে ছোটমাসির মেয়ে টুম্পা আর জামাই অরুন হসপিটালে আসবে মাকে দেখতে l সুগতদা এখন অফিসের কাজে কলকাতার বাইরে তাই আজ দাদা আসতে পারছেনা l
মাকে সেই একরকমভাবেই একপাশ ফিরিয়ে শুইয়ে রেখেছে , RMO বললেন, যে ডাক্তার মাকে দেখছেন ওনার সাথে সকালে এসে কথা বলতে l
টুম্পাকে বহুদিন পরে দেখে মনটা যেন একটু ভাল লাগছে , জীবনে ছোট ছোট মান অভিমানের পালা চলতেই থাকে …কখনো সেসব জটিলতার আকার নেয় …আবার কোন আকস্মিক ঘটনা সব ধুয়ে মুছে নতুনভাবে সম্পর্কের বাঁধন শক্ত করে তোলে l
ডে সেভেনটিনথ — সকাল ১১:৩০
মিতা রিনিকে স্কুল পাঠিয়ে হসপিটালে এসেছে ডক্টরের সাথে কথা কথা বলবে বলে, গত দুদিন মায়ের শারীরিক অবস্থা একই রকম আছে .. ঘুমিয়েই আছে , ডক্টর জানতে চান মায়ের ব্রেইন ক্যান্সারের প্রাইমারি সোর্স ডিটেক্ট করতে মিতারা আগ্রহী কিনা , মিতা জানায় তারা একেবারেই আগ্রহী না , কারণ এই হসপিটালে এরোগের চিকিৎসা করার উপযুক্ত কোন পরিকাঠামো নেই …আর যেখানে ডক্টর বলেই দিয়েছেন এখন আর কিছু করার নেই সুতরাং এসব করার মানেও নেই l
আসলে ডক্টর যদি কোনোভাবে রুগীকে রেখে আর কিছু বিল বাড়িয়ে দিতে পারেন তাহলে হয়তো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সুনজরে থাকবেন ..একটি আধাসরকারি হসপিটালেও এক গল্প ..শুধু বিজনেস l
ডক্টর অগত্যা ডিসচার্জ সার্টিফিকেট করে দিলেন , এবারে হসপিটালের বিল খুব বেশি হয়নি l বড়মা যেদিন এসেছিল মাকে দেখতে সেদিন কিছু টাকা মিতার হাতে দিয়ে গিয়েছিল ,আজ মেডিক্লেমের থেকে বিলের যে এমাউন্ট এর আপ্রুভাল এসেছে বাকিটা মিতা বড়মার দেওয়া টাকা থেকেই দিয়ে বিল মেটালো l
এসব ফর্মালিটি মিটিয়ে মিতা উপরে আই সি ইউ তে আসে , নার্স বলে মায়ের জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু কড়া ওষুধ দেওয়া আছে তাই ঘুমোচ্ছে , এখন রাইস টিউব দিয়ে খাওয়াতে হবে লিকুইড খাবার , আর টয়লেট এর জন্য ক্যাথিটার লাগানো আছে ..মিতা সবকিছু বুঝে নিলো l মিতা আজ রিনিকে স্কুল থেকে এনে ওকে একটু খায়িয়ে সাথে নিয়ে এসেছে …দুজনেই অ্যাম্বুলেন্স করে মাকে নিয়ে বাড়ি ফেরে l
এবারে যেন সবকিছু আরো কঠিন হয়ে গেল , রাইস টিউব দিয়ে তিন চার ঘন্টা বাদে লিকুইড খাওয়াতে হবে , যে মানুষটা আর চোখ খুলছেনা তার পরিচর্যা করা সত্যি আরো কঠিন হয়ে পড়ল l
ডে এইটটিনথ — সকাল ৯:৩০
আজ আয়া মেয়েটিকে মিতা দেখিয়ে দেয় মাকে কিভাবে খাওয়াতে হবে, যদিও মিতা বাড়িতে থাকলে নিজেই খাওয়াবে কারণ অন্যের উপর ও ঠিক ভরসা পায়না যদি কিছু ভুল করে ফেলে l
মাকে আজ স্পঞ্জ করানোর সময় দেখা যায় মায়ের ব্যাক পোরশনে বেড সোর হয়েছে , আয়া মেয়েটি খুব রেগে .বলে ” দিদি এই কদিন হসপিটালে কোন যত্ন করেনি মাসিমাকে ” l সত্যি এটা বোঝা যায় শুধু কিছু ওষুধ দিয়ে ফেলে রেখেছিলো মানুষটাকে , হে ভগবান ..মানুষ অসুস্থ হলে তাকে হসপিটালে রাখা হয় সুস্থ করতে ,ডক্টরের চিকিৎসায় আর নার্সদের পরিচর্যায় …কিন্তু সেখানে যদি কিছু ওষুধ দিয়ে ফেলে রেখে বিল বাড়ানো হয় যার ফলস্বরূপ মানুষটি আরেকটি রোগের শিকার হয় .. বিশেষত যে মানুষের কোন জ্ঞান নেই , যার শরীরের কষ্ট প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই…সুতরাং তার যত্ন নেবার দায় কোথায় ….মানুষের সেবাকে স্বেচ্ছায় পেশা করে নিয়েছে যারা তাদের অমানবিক মুখ আজকের যুগে মনুষ্যত্বের প্রহসন …l
মিতা সব কাজ সেড়ে দুপুরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় …এতদিন তবুও মায়ের সাথে একটু গল্প করা যেত ,…মানুষটার বোধশক্তি কতটা ছিল জানা নেই তবে কিছু বললে তাকিয়ে থাকত আর মাঝে মাঝে একটু আধটু কথা বলতো l কিন্তু এখন যে শুধু নীরবতা …lএটা সেপ্টেম্বর মাস ..আজ রোদটাও যেন মলিন ….কোথাও যেন একটু পুজোর গন্ধ …
হলুদ রোদের আলোয় মাখা ছোট ছোট গাছের রঙিন ফুল তোমার দেখা হলনা আর ..
এই আকাশের নীল যেখানে পৃথিবীর সীমারেখায় মিশে যায় তোমার দেখা হলনা সেই প্রান্তরেখা …
ডুবন্ত সূর্যের রক্তিমতায় রাঙানো আকাশের রূপ তোমার আর দেখা হলনা ….
তোমার বাড়ির শেওলা ধরা প্রাচিল …..
বাগানের গাছগুলির বাড়বাড়ন্ত ….
সুপুরি গাছের ছাদে নুয়ে পড়া পাতা …
তোমার জন্মস্থান ….তোমার মেয়েবেলা …স্মৃতির ভেলায় চড়ে ভেসে বেড়ানো …
কতকিছু যে বাকি রয়ে গেল মা ….
আমাদের আর কিছুই একসাথে দেখা হলনা .ll
ওঁ শান্তি রূপাং ক্ষমা রূপাং স্নেহরূপাং শুভংকরিং
সাক্ষাৎ ভগবতীদেবিং মাতরং ত্বং নম্যাম্যহম …
ডে নাইনটিনথ — সকাল ১১:৩০
আজ শর্মী ও মেজমাসি এসেছে ..মিতা আয়াকে নিয়ে মায়ের স্পঞ্জ করে পোশাক বদলে দিয়ে বাইরের ঘরে এসে বসে , মাসি মায়ের এই অবস্থা দেখে খুব কষ্ট পাচ্ছে .পাওয়াটাই স্বাভাবিক ..l রিনির পরীক্ষা শেষ তাই শর্মী রিনিকে ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছে , মিতাও ভাবলো বাড়িতে মাকে নিয়ে সবসমই ওকে ব্যস্ত থাকতে হয়, একটা আতঙ্কের পরিবেশ …ডক্টর ওষুধ ..এসব থেকে মেয়েটা কদিন হলেও একটু স্বস্তি পাবে তাই মিতা আর বিশেষ আপত্তি করলোনা , রিনির জামাকাপড় গুছিয়ে ওদের রওনা করে দেয় l মেয়েটাকে ছেড়ে থাকতেও ভালো লাগেনা কিন্তু পরিস্থিতির চাপে অনেক কিছুই করতে হয় l
দুপুরে মাকে খাবার ওষুধ সব খাইয়ে নিজে খেয়ে একটু বিশ্রাম নেবে ভাবে , বিছানায় শুয়ে মোবাইল ফোনে হোয়াটস্যাপ এ আসা মেসেজ দেখতে থাকে ..একটা মেসেজ ….রিনির বাবার …বিকেলে রিনির সাথে দেখা করতে চায় , মিতা রিপ্লাই করে জানায় রিনি শর্মীদের বাড়িতে গিয়েছে ..কয়েক সেকেন্ড পরেই রিপ্লাই এল …” তুমি ইচ্ছে করে পাঠিয়েছ , তুমি চাওনা রিনি আমার সাথে দেখা করুক …ওকে তুমি আমার থেকে দুরে সরিয়ে নিতে চাও …” ইত্যাদি l মিতা মাথা ঠান্ডা রেখে ভালোভাবে জানায় রিনির পরীক্ষা শেষ তাই ও নিজেই যেতে চেয়েছে l বাড়ির পরিস্থিতি মিতা কিছুই জানায়নি নিজে মুখে , কারণ সবকিছু জানিয়ে সে কোর্টে এপ্লিকেশন জমা করে এসেছে
সুতরাং সে সবকিছুই জানে তাসত্ত্বেও সে এপর্যন্ত রিনির কাছেও মায়ের ব্যাপারে কোনোকিছুই জানতে চায়নি , এইসব মানুষের মুখোশ পরা অমানুষকে জানানোর বা তার থেকে কিছু প্রত্যাশা কোন কিছুই নেই l যাইহোক রিনির ব্যাপারে জানানোর পরে সে যে ভাষায় রিপ্লাই করলো সেসব পড়ার পরে মিতার আর একটা অক্ষর লিখে পাঠাতে রুচিতে বাধলো …সে নাম্বারটা ব্লক করে দিয়ে নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলো l
ডে টোয়েন্টি — দুপুর ১:১৫
আজ রবিবার …সকালে উঠে মিতা দ্যাখে মায়ের পেট কেমন ফোলা মনে হচ্ছে , আয়া মেয়েটিও আসার পরে বলে পেট সত্যি খুব ফোলা লাগছে ,আয়া সেন্টারের যিনি মালকিন উনি নিজে ট্রেনড নার্স ..মিতা ওনাকে দেখে পাঠায় l ওই দিদি এসে মায়ের রাইস টিউব এ সিরিঞ্জ লাগিয়ে কন্ডিশন দেখে বললেন টিউব দিয়ে পেটে হাওয়া ঢুকেছে তাই পেট ফুলে আছে l হসপিটাল থেকে রাইস টিউব ঠিকমতো ঢোকায়নি আর খাওয়ানোর পদ্ধতিও ঠিক ছিলোনা l যাইহোক উনি ওনার বুদ্ধিমতো যা করলেন তাতে এখন কিছু স্বাভাবিক লাগছে ..ফোলা ভাবটা অনেকটা কমেছে l
কিছুদিন আগে রিনির স্কুলের একজনের থেকে মিতা জানতে পারে খুব ভালো একজন অনকোলজিস্ট এর ব্যাপারে …ওনার নিজের নার্সিংহোম পার্ক স্ট্রিট এ …ক্যান্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউট , ওনার রাত দিন ওখানেই কাটে ..l
মিতা ঠিক করে আগামীকাল সব ডকুমেন্টস নিয়ে ওনার সাথে দেখা করবেl টুম্পাকে ফোনে জানায় সে যদি এসে কিছুক্ষন থাকতে পারে কারণ শুধু আয়ার কাছে রেখে বেশিক্ষণের জন্য বেরোতে সাহস হয়না l টুম্পা জানায় অরুন অফিসে বেরিয়ে গেলেই ও চলে আসবে l মিতার স্বস্তি পায় l
ডে টোয়েন্টি ফার্স্ট —- সকাল ১১:৩০
টুম্পা চলে এসেছে , রিনি মাকে ফ্রেশ করে খাইয়ে দিয়েছে আর বাকি যা ওষুধ দিতে হবে আয়াকে বুঝিয়ে দেয় l এরপর নিজে রেডি হয়ে বেরিয়ে পরে l বাস মেট্রো তারপর হেটে পৌঁছতে মোটামুটি এক ঘন্টা লেগে গেল , তারপর নার্সিংহোম খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লাগল l এদিকে মিতা কখনো আসেনি ..পুরোনো গলি ঘুজি ….সেখানে ততোধিক পুরোনো নার্সিংহোম , মেইন বিল্ডিং এর বাইরে বসার জায়গা সেখানে কাউন্টারে ফর্ম ফিলাপ করিয়ে টোকেন দেওয়া হচ্ছে ..l মিতা টোকেন নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে , মনটা খুব উদ্বিগ্ন ..গতকাল মায়ের পেটের ফোলা ভাবটা খুব ভাবাচ্ছে , যাইহোক যথাসময়ে ডাক এল এতক্ষনে বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢোকার সুযোগ পাওয়া গেল , ভিতরটা খুব আটপৌরে ধরনের কোথাও কোন আধুনিকতার ছোয়া নেই l মিতা ডক্টরের চেম্বার এ ঢোকে , ভদ্রলোকের বয়স খুব বেশি নয় ..বড়োজোর বাহান্ন তিপ্পান্ন l মায়ের রিপোর্ট সব দেখলেন তারপর বললেন ” আপনি একবার ভর্তি করান দু থেকে তিনদিনের জন্য আমি চেষ্টা করবো কিছুটা হলেও সুস্থ করতে” মিতার মনে যেন হাজার পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে উঠল ..”তাহলেকি এখনো আশা আছে ” মিতা একটু জোরেই বলে ওঠে …ডক্টর বলেন ” দেখুন আশা নেই এরকম কেন ভাবছেন , লাস্ট স্টেজ এর রুগিকেও আমি সুস্থ করেছি ..আপনি একটু ভরসা রাখুন ..” l ডক্টর বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বললেন l মিতা ওনার আশ্বাস পেয়ে মনে মনে খুব আনন্দ পেল l
নার্সিংহোম থেকে বেড়িয়ে মিতা সন্দীপকে ফোন করে সবটা জানাল ..ডক্টর দুতিনদিনের জন্য ভর্তি করতে বলেছেন খরচ বেশি হবেনা ইত্যাদি…
একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক , সন্দীপ সায় দেয় l মিতা এই অন্ধকারেও একটা আলোর রেখা দেখতে পায় …আনন্দে ওর চোখ দুটি ভিজে আসে ..যদি কোন মিরাক্যাল হয় ..যদি ..l
বাড়ি ফিরতে প্রায় সন্ধে , আয়া মেয়েটি চলে যাবার পরে টুম্পাও রওনা দেয় l মিতা দরজা বন্ধ করে ঘরে এসে ভাবে মাকে একটু জল খাওয়াতে হবে , রাইস টিউব এ সিরিঞ্জ লাগিয়ে টানে …কিন্তু একি! এরকম কালচে তরল বেরিয়ে এল ..এটা কি আবার ..মিতা তরল ফেলে দিয়ে আবার সিরিং সিরিঞ্জ টিউব এ লাগিয়ে টানে …আবারও একভাবে কালচে রঙের …এবার মিতা একটু ঘাবড়ে গেল ..টুম্পাকে ফোন করে ওকে ফিরে আসতে বলে l টুম্পা সবে বাসে উঠেছিল l
এরপর হাউস ফিজিসিয়ান ডক্টর রায়কে ফোন করে …উনি সবটা শুনে বলেন ওটা রক্ত ..পেটে রক্ত জমছে …তাইজন্য পেট ফুলেছে l
এবার মিতার মনে ভয় চেপে বসছে যেন ..টুম্পার সাথে কথা বলে ঠিক করে পরদিন ক্যান্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউট এ ভর্তি করবে , এভাবে আর বাড়িতে রাখা যাবেনা l মিতা নার্সিংহোমে ফোন করে ভর্তির ব্যাপারে জানাল এরপর অ্যাম্বুলেন্স ও ঠিক করে নিলl আয়া মেয়েটিকেও জানিয়ে দিল আগামীকাল থেকে না আসতে ..মা বাড়ি ফিরলে সে জানিয়ে দেবে l
সারারাত মিতার উৎকণ্ঠায় কাটলো ….তাহলেকি আর আর আশা নেই …শেষ সময় এসে গেল …ঘুমন্ত মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে …নিজের মনেই বলছে …তুমিওকি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে …তোমাকে ছেড়ে কিকরে মা ….তোমার মনে আছে তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসতোনা ….তাহলেতো তুমি চলে গেলে আমাকে জেগেই কাটাতে হবে …..রাতের পর রাত …l
ডে টোয়েন্টি সেকেন্ড — সকাল ৮:৩০
মিতা সকালে মাকে ফ্রেশ করে দিয়ে একটি ভাল ম্যাক্সসি পরিয়ে রেডি করে দিয়েছে , বাকি প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিল l এবার হয়ত মা কিছুটা হলেও সুস্থ হয়ে ফিরবে l মিতার মনে আশার আলোর প্রদীপ জ্বলে আছে , শত ঝড়েও সে আলো নিভে যেতে দেবেনা ….কিছুতেই না …l
নার্সিংহোম পৌছে সব ফর্মালিটি শেষ করার পরে মাকে নির্ধারিত কেবিনে নিয়ে যায় , ডক্টর এসে মায়ের রাইস টিউব দিয়ে আরও রক্ত বের করতে থাকেন ..মিতা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দেখে ওকে নিচে অপেক্ষা করতে বলে দিলেন l এই দৃশ্য দেখে মিতার মনে তোলপাড় চলছে l
যথাসময়ে ডক্টরের সাথে কথা বলতে ওনার চেম্বারে ডাক পড়ল , ভিতরে ঢুকে ওনার মুখ দেখে মনে হলনা খুব ভাল কিছু বলবেন l যাইহোক উনি সংক্ষেপে জানালেন কিছু প্রয়োজনীয় টেস্ট করা হবে এবং সেই রিপোর্ট অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু হবে l
এখানে নির্দিষ্ট ভিসিটিং আওয়ার নেই আর রুগীর দেখাশোনার জন্য আয়া রাখার ব্যবস্থা আছে তবে আজ সেরকম কাউকে পাওয়া গেলনা তাই মিতা নার্সকেই রিকোয়েস্ট করে ঠিকমতো দেখাশোনা করার জন্য l যদিও একটি অচেতন মানুষের দেখাশোনার তেমন কিছু নেই তবে স্যালাইনের বোতল কখন শেষ হবে লক্ষ্য রাখা , শেষ হলে নতুন বোতল লাগিয়ে দেওয়া এসবের লোকের অভাব l
এখানে যে নার্স ইনচার্জ তার আবভাব দেখে মনে হল সরকারি হসপিটালের কর্মী , বিনে পয়সায় পরিষেবা দিচ্ছে l ওষুধের লিস্ট নিয়ে নিচে ওদের নিজস্ব ওষুধের কাউন্টার থেকে নিয়ে এসে দিয়েছে l চারটের দিকে আর একবার মায়ের কেবিনে গেল সেখানে কিছুক্ষন থেকে তারপর রওনা l
আজ মিতা সম্পূর্ণ একা ..রাতে ঘুম আসেনা একটা অস্বস্তি ..সকালের সেই দৃশ্য বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে …তাহলেকি শেষ রক্ষা হবেনা ..মিতা আর ভাবতে পারছেনা …l
ডে টোয়েন্টি থার্ড — সকাল ১০:৩০
আজ মিতা সকাল সকাল রওনা দিয়ে চলে এসেছে , মায়ের কেবিনে এসে দেখে মা এক ভাবেই শুয়ে l একজন নার্স এসে কি কি ওষুধ এনে দিতে হবে সেই লিস্ট এঁর ধরিয়ে দিল আর জানালো আজ সব আয়া যারা ছুটিতে ছিল তারা এসেছে আমি যেন দিন রাতের দুজনকে ঠিক করি l এদের এখানে মেডিক্লেমের কার্ড নেওয়া হয়না l যাইহোক মিতা একজন আয়ার সাথে কথা বলে ঠিক করে তারপর নিচে মেডিসিন কর্নার এ যায় l মায়ের কেবিনে আর একটি বেড আছে ওখানে যেই ভদ্রনহিলা ওনার আর ওনার বাড়ির লোকের সাথে গতকাল আলাপ হয়েছে , উনি এখন বেশ সুস্থ আজ ওনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে l ওনারা ডক্টরের খুব প্রশংসা করেন l আজ বেলার দিকে নির্দিষ্ট সময়ে ডক্টরের চেম্বারে গিয়ে ওনার সাথে মিতা কথা বলে , উনি জানালেন মায়ের ক্যান্সার এর প্রাইমারি সোর্স বা প্রাথমিক উৎস লাংস ,.সেখান থেকে ব্রেইনে ছড়িয়েছে , ওনারা চেষ্টা করছেন যদি কিছুটা সুস্থ করে তোলা যায় l
মিতা সন্দীপকে সবকিছু জানিয়ে বলে ও যদি পারে যেন চলে আসে l সেইমতো অফিসে কথা বলে নিয়ে ও রাতে ট্রেন ধরবে l
বাড়ি ফিরে মিতা ফ্রেশ হয়ে শর্মীকে ফোন করে বলে রিনিকে যদি আগামীকাল পৌঁছে দিতে পারে কারন ওর স্কুল আছে এভাবে আর কদিন চলবে l এরপর বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকে বিগত এত বছর ধরে প্রতি মাসে রক্ত পরীক্ষা হয়েছে এছাড়া লাংস এর টেস্ট ,এক্স রে কোনোকিছুতেই কিছু ধরা পড়েনি l অথচ এই রোগ একদিনের নয় , রিনি হওয়ার আগে মায়ের একবার খুব কাশি হয়েছিল কোনোভাবেই সাড়ানো যাচ্ছিলোনা সেসময় ই এস আর অস্বাভাবিক বেশি ছিল ওজন কমে গিয়েছিলো , এখন বোঝা যাচ্ছে সেটাই সূচনা l
ডে টোয়েন্টি ফোর্থ —সকাল ৯:৩০
সন্দীপ এসে পৌঁছলো , ট্রেনে জেনারেল কপার্টমেন্টে এসেছে বসার সিট্ পায়নি বেচারা টয়লেটের পাশে নিচে বসে এসেছে l মিতা সকালে ভাত করে নিয়েছে ,সন্দীপ ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়ে রওনা হয় নার্সিংহোমে l মেজমাসি রিনিকে নিয়ে একটার দিকে এসে পৌছলো l বিকেলে মাসি ফিরে যাবে , সন্দীপ ডক্টরের সাথে কথা বলে মিতাকে ফোন করে জানাল মা আজ চোখ খুলে তাকিয়েছে , আর দুদিন রেখে ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে , এই খবর শুনে রিনির খুব আনন্দ ..l সন্দীপকে মিতা বলে দিয়েছে ওষুধ কিনে দিয়ে ও যেন ফিরে আসে , শুধু শুধু ওখানে থাকার দরকার নেই l মেজমাসি বিকেলেই ফিরে যায়, সন্দীপ ওখান থেকে বেরিয়ে ফোন করে জানিয়েছে যে সেও ফিরছে l রিনি নিজেই পড়াশুনো নিয়ে বসেছে …সন্ধে হয়ে এল সন্দীপ এখনো এসে পৌঁছোলনা , মিতা ফোন করে ..রিং হয়ে কেটে গেল ধরলোনা …মিতা ভাবলো হয়তো রাস্তায় আওয়াজে শুনতে পায়নি l একটু পরে আবার ফোন করে মিতা এবার ফোন ধরে সন্দীপ জানালো ও মেট্রোতে উঠবে , যাক এবার নিশ্চিন্ত l
মিতা রিনির পাশে এসে বসে ..রাতে শুধু ভাত আর ডিম সেদ্ধ করে নেবে ..l বেশ কিছুক্ষন পরে রিনি বলে “মা মামু কখন আসবে ” মিতা ঘড়িতে দেখে সাতটা বেজে গেছে ..এখন এলনা তাইতো ..ফোন করে সন্দীপকে …নট রিচেবল ….এতক্ষন হয়ে গেল এখনো মেট্রোতে ..ব্যাপার কি , মিতা শর্মীকে ফোন করে জানায় , শর্মিও বার কয়েক ফোন করে কিন্তু কোনভাবে ফোন লাগেনা l প্রায় একঘন্টা পরে ফোন ধরে জানাল এখনো রাস্তায় ..l সন্দীপ যখন ফিরলো খুব বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছিল ওকে l ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসে বলে নার্সিংহোম থেকে বেরোনোর পরে শরীরটা খারাপ লাগছিলো , তারপর হেঁটে মেট্রো স্টেশনের কাছে এসে শরীর খুব খারাপ লাগে , একটি চায়ের দোকানের বাইরে টুলে বসে পরে , দোকানের লোকটি জল দেয় …জল চোখে মুখে দিয়ে অনেক্ষন ওখানে বসে থাকে তারপর রওনা দেয় l
আসলে রাতে যেভাবে ট্রেনে এসেছে তারপর আবার অতদূরে নার্সিংহোমে ছুটতে হয়েছে , ওর শরীরে আর দেয়নি l যাইহোক মিতা জানতে চায় ডক্টর আজ কি বলেছেন , সন্দীপ বলে মা আজ চোখ খুলেছে তবে ডাকলে সাড়া দিচ্ছেনা ডক্টর বলেছে দুদিন রেখে ডিসচার্জ করে দেবেন l তারমানে মা এখন কিছুটা ভাল রিনি আনন্দে লাফিয়ে ওঠে ” মা দিদুন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে আমরা আবার আগের মতো সবাই একসাথে অনেক গল্প করব …” l মিতার মনটাও আনন্দে ভরে উঠল ..তাহলে মাকে আবার ফিরে পাওয়া যাবে ..তাইতো ভগবান এতো নিষ্ঠুর হয় কখনো …সবকিছুইতো কেড়ে নিয়েছে ….মাকে অন্তত ..l
ডে টোয়েন্টি ফিফ্থ — সকাল ১১:00
আজ রিনিকে স্কুলে পাঠিয়ে মিতা কোর্টে এসেছে কিছু ইম্পরট্যান্ট ডকুমেন্টস জমা দেওয়ার আছে , ওদিকে সন্দীপ নার্সিংহোম রওনা হয়েছে l মিতা কোর্টের কাজ শেষ করে বেরোবে এই সময় সন্দীপের ফোন ..ধরতেই বললো ” দিদি রক্ত লাগবে আমাদের জোগাড় করতে হবে ” , মিতা বলে “আমি এখুনি আসছি ” বলে ফোন কেটে এবার অমিতদাকে ফোন করে , ওর একই গ্রূপের রক্ত ..দাদা জানাতে বলে কখন আসতে হবে l মিতা ততই আস্বস্ত হয় , এই সময় নীতার সাথে দেখা , ও একজন উকিল ওর ছেলে রিনিদের স্কুলে পরে ,মিতাকে এখানে দেখে ও জানতে চায় মায়ের ব্যাপারে , মিতা সবকিছু বলে ..নীতা সব শুনে বলে “তোমার মায়ের এই অবস্থা আর তুমি এখানে দৌড়োদৌড়ি করছো , জজ সাহেবকে ডাইরেক্ট বলো এভাবে কিকরে একজনকে কি করে হ্যারাস করতে পারে …তোমার হাসব্যান্ড কি মানুষ ..”l
মিতা আর দেরি না করে রওনা হয় , বাস এ টুম্পাকে একবার ফোন করে যদি ও রিনিকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে পারে কারন মিতাদের ফিরতে কত দেরি হবে বুঝতে পারছেনা , কিন্তু টুম্পাকে ফোনে পায়না l নার্সিংহোম পৌঁছে জানতে পারে আজকের মতো ওরা ব্যবস্থা করেছে আগামীকালের জন্য এনে দিয়ে যেতে হবে l মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্ক এ পাওয়া যাবে ,ওরা দুজনে সেখানে এসে রিকুইজিশন জমা করে ..কিন্তু অনেক্ষন অপেক্ষা করার পরে জানানো হল এখন স্টক নেই পাঁচটার সময় আবার দেওয়া হবেl এদিকে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে রিনির ছুটির সময় এগিয়ে আসছে ,নেট থেকে আর একটি ব্লাড ব্যাঙ্ক এর নাম পাওয়া যায় চাঁদনী এলাকায় , বড়দির অফিসও ঐ দিকে মিতা বড়দিকে একবার ফোন করে জানায় আর অমিতদাকেও জানিয়ে দেয় আসতে হবে l বড়দি একটু পরেই ফোনে জানালো হা ওর অফিসের কাছে ব্লাড ব্যাঙ্ক আছে সন্দীপ যেন চাঁদনী মেট্রো স্টেশনে চলে আসে দিদিও ওখানে আসবেl ওরা দুজনে মেট্রো করে রওনা দেয় , সন্দীপ চাদঁনীতে নেমে গেল l মিতা রিনিকে নিয়ে বাড়ি ফিরেই সন্দীপকে ফোন করে জানতে পারে সেখানেও ওই গ্রূপের রক্ত নেই lসন্দীপ আবার মানিকতলায় গিয়েছে ..ওখানেও এই গ্রূপের রক্ত আজ নেই l এদিকে এসব করতে অমিতদাও বাড়ি চলে গিয়েছে , মিতা দাদাকে জানিয়ে দেয় যদি কোনোভাবে না পাওয়া যায় তাহলে কাল সকালে জানাবে l মিতা এবার সুপর্ণাকে ফোন করে সবটা জানায় ও স্বাস্থ দপ্তরে আছে তাই ও যদি কিছু করতে পারে l রাতের দিকে সুপর্ণা জানালো কলকাতার সব ব্লাড ব্যাঙ্ক এর যিনি ইনচার্জ ডক্টর ঘোষ ওনার সাথে কথা হয়েছে মিতা যেন কথা বলে নেয় , ওনার ফোন নম্বর সুপর্ণা টেক্সট করে দেয় l মিতা ডঃ ঘোষের সাথে কথা বলে উনি মেডিক্যাল কলেজের একজনের নম্বর লিখে নিতে বলেন এবং সেখানে গিয়ে বলতে বলেন ডঃ ঘোষ পাঠিয়েছেন l এবার মিতা নিশ্চিন্ত ..l
মিতা মায়ের কেবিনে যায় , মা অপলক তাকিয়ে আছে , মা মা করে দুবার ডাকে কিন্তু কোন সাড়া নেই , স্থবির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ..l রাতের আয়ার টাকা মিটিয়ে আর দেরি করেনা ..কেবিন থেকে বেরোনোর সময় দেখলো পাশের বেডে একজন মহিলা শুয়ে অচৈতন্য …পাশে একজন ভদ্রলোক ও দুটি ছোট ছেলে মেয়ে l
ডে টোয়েন্টি সিক্সথ — সকাল ১০:১০
আজ শনিবার বিশ্বকর্মা পূজো ..সন্দীপের জন্মদিন আজ ,রিনির স্কুল এমনিতেও ছুটি ঘুম থেকে উঠেই সে মামুর জন্য কার্ড বানাতে ব্যাস্ত l সন্দীপ রক্ত জোগাড় করতে বেরিয়ে পড়ল , মিতা এবার পায়েস করতে রান্নাঘরে ঢোকে মা সুস্থ থাকলে মা করত ..এখন সেসব ভাবার সময় নেই l
সন্দীপ মেডিক্যাল কলেজ থেকে রক্ত নিয়ে নার্সিংহোমে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে , মিতা আজ আর যাবেনা ঠিক করে গতকাল এত ছোটাছুটিতে শরীরটাও ভালো লাগছেনা আর তাছাড়া তানিকে কোথাও রেখে যাওয়া সমস্যা , গতবার একদিন টুম্পার বাড়িতে ছিল কিন্তু সেইসময়ে হসপিটাল থেকে ওর বাড়ি যাওয়া সহজ ছিল l
সন্দীপ ফিরে এসে জানাল মা আজ আর তাকায়নি , পাশের বেড এর মহিলা কাল রাতে মারা গেছে ..শুনে মিতার মনটা খারাপ হয়ে গেল অত ছোট বাচ্চাদুটোকে রেখে চলে গেল , কে দেখবে ওদের ..l
মিতার ওদের কথা ভেবে চো…
লেখিকা পরিচিতি : জয়িতা সুর সরকার, উত্তরবঙ্গ,শিলিগুড়ি (M Sc in Botany and B.Ed.from NBU)। একজন ফ্রিল্যান্স রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট এবং “সমর্পন- Samarpan the joy of sharing” NGO এর সাথে যুক্ত।লেখালেখির সূত্রপাত ২০১৪ সাল থেকে , তবে লেখালেখি নিয়ে বিশেষ ভাবে ভাবনাচিন্তা ২০১৮ সাল থেকে। লেখালেখি এখন আবেগের অনেকটা অংশ জুড়ে আছে।
[…] << দ্বিতীয় পর্ব শেষ পর্ব >> […]