চিলেকোঠার ওই ঘরটা যেন বিভীষিকা আমার কাছে। ছোট্টবেলা থেকেই স্কুলের সময়টুকু বাদে সারাদিন বই নিয়ে ওই ঘরে বন্দি করে রাখত মা আমাকে। পড়াশোনা করে দিগগজ হতে হবে। স্কুলের সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে। সব সাবজেক্টে হায়েস্ট মার্কস পেতে হবে। মায়ের আমার চাহিদা অনেক। সেরার সেরা হতে হবে আমায়। তারজন্য চিলেকোঠার ওই ঘরটার থেকে উপযুক্ত জায়গা আর কী-ই বা হতে পারে? স্কুলের টিচাররা, অন্যান্য বন্ধুদের মায়েরা মাকে কত প্রশংসা করতেন আর আমার মা ছেলেকে মানুষ করার ক্রেডিটটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত মুচকি মুচকি হেসে। কোনও সাবজেক্টে একটা নম্বরও কারও থেকে কম পাওয়ার উপায় ছিল না। তাহলে রাতে ওই ঘরে মা আমাকে একা বন্দি করে রাখত। সেও কপালে জুটেছে আমার বার দুয়েক। কত ভয় পেয়েছি একা একা, সিঁটিয়ে থেকেছি সারাটা রাত, অজানা ভয়েরা যেন গিলে খেতে এসেছে আমায়। সে বিভীষিকা ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারি না আমি। তাই ওখানে যাতে একা বন্দি না হতে হয় পড়া করেছি খুব মন দিয়ে। কিন্তু সব সময় কী আর পড়ায় মন বসে? কত সময় একটু ব্রেক নিয়ে খেলতে ইচ্ছে করত কিন্তু মা আমার সঙ্গে সর্বদা সেখানে কড়া পাহারায়। আমায় পড়া দিয়ে মা কোনও গল্পের বই বা পত্রিকা নিয়ে একপাশে রাখা ডিভানটায় শুয়ে পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ত আর আমি পড়ার টেবিলে। তাইবলে এতটুকু ফাঁকি দেবার বা অন্যমনস্ক হবার উপায় ছিল না। মা মাঝেমাঝেই ধড়মড় করে উঠে আমার পড়া ধরত। পড়া দিতে না পারলে রাতে বাবার কাছে নালিশ। আমার মায়ের স্বপ্নরাজ্য বল আর স্বর্গরাজ্য বল তা ঐ চিলেকোঠাটাই।         

আমার শৈশব বলে কিছু ছিল না, কেবল রাতে খাবার পর দাদু-ঠাকুমার মাঝে শুয়ে একটু গল্প শোনা ছাড়া। আমার সারাদিনের বন্দিদশায় দাদু-ঠাকুমাও কষ্ট পেতেন কিন্তু তাঁদের  করার কিছু ছিল না। বাবা তাঁদের বলে দিয়েছিলেন, “কাকলি (আমার মা) ছেলেকে মানুষ করার জন্য নিজেও কত স্যাক্রিফাইস করছে, ছেলেকে আটকে রাখা নিয়ে তোমরা ওকে কিছু বলবে না”। বাবা মায়ের পক্ষ নিয়ে এমন কথা বলে দেওয়ায় দাদু-ঠাকুমার সাধ্য ছিল না আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলা বা আমাকে সেই চিলেকোঠা থেকে উদ্ধার করা। বাধ্য হয়ে  মুখ বুজেই সব দেখতে হতো তাঁদের। মা আমার শৈশব কেড়ে নিয়েছিল আমার কাছ থেকে, যা আমি হাজার চাইলেও আর ফিরে পাবো না। এ যে আমার কত বড় কষ্ট তা বলে বোঝাতে পারব না। ভেতরে ভেতরে আক্রোশ জমা হতো, কিন্তু ফুঁসে উঠতে পারতাম না। ও বাড়িতে আমায় প্রোটেকশন দেবার কেউ ছিল না যে। দাদু-ঠাকুমা মনে মনে অস্থির হলেও সামনাসামনি কিছু বলার বা বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। আমার সেই আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ হতো না ঠিকই কিন্তু মনে মনে ঐ শিশু বয়স থেকেই মায়ের প্রতি আক্রোশ এতটাই জমা হয়ে উঠেছিল যে মনে হতো বড় হয়ে মাকে ঐ চিলেকোঠায় বন্দি করে রাখবো। আমায় ঐভাবে পড়তে বাধ্য করায় আমি পড়তাম, কারণ আমাকে পড়তেই হতো, আর যে কিছু করার ছিল না আমার ওইটুকু ছোট্ট ঘরে। আর তাই বাবা-মায়ের পছন্দমত রেজাল্টও আমি করতাম। গর্বে আমার মায়ের বুক দশহাত হয়ে যেত কেমন ছেলে মানুষ করেছে ভেবে। বাড়িতে আত্মীয়কুটুম কেউ এলেও আমার তাদের সামনে যাওয়ার পারমিশন ছিল না, পাছে দু’দণ্ড তাদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলে এলে আমার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, পড়ায় মন বসাতে না পারি। সেটুকু সময়ের ক্ষতির পূরণ যে আর হবে না তাহলে। চিলেকোঠা থেকে টের পেতাম ছোট্ট আমি, আর ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠতাম খাঁচায় বন্দি ডানা-ঝাপটানো পাখির মত। কোনোদিন কোনও বিয়েবাড়ি বা কোনও নিমন্ত্রণ বাড়িতেই আমি যাইনি। মা-ও যায়নি অবশ্য। বাবা হয়তো গেছেন ঠাকুমা-দাদুকে নিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। দাদু একদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “বুড়োবয়সে একটু যে নাতিটাকে নিয়ে থাকবো, কোথাও গেলে পাশে বসিয়ে নিয়ে যাব, তা আর আমাদের কপালে নেই”। তার উত্তরে বাবা বলেছিলেন, “তুমি কি চাও না তোমার নাতি মানুষ হোক?”  দাদু উত্তর খুঁজে পাননি। ঠাকুমা অবশ্য সাহস করে বলে ফেলেছিলেন, “তুই কি মানুষ হোসনি খোকা? তোকে তো আমরা এইভাবে মানুষ করিনি।” বাবা বলেছিলেন, “করনি বলেই তো আজ আমি অতটা উঁচুতে উঠতে পারছি না”। ঠাকুমা-দাদু আর কথা বাড়াননি, চুপ করে গিয়েছিলেন। সেই থেকে আর কোনোদিনই তাঁরা আমাকে নিয়ে কোনোরকম আক্ষেপ দেখাননি। সবটাই বুকের মধ্যে চেপে রেখেছিলেন যেমন রেখেছিলাম আমি।         

মাঝে মাঝে বাবা ছুটি পেলে আমাকে ও মাকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন। সেটুকুই ছিল আমার মুক্তি, মানে ঐ চিলেকোঠা থেকে মুক্তি, তবে পড়া থেকে মুক্তি নয়। সঙ্গে অঙ্ক, ইংরাজি বইও যেত। পড়া থেকে রেহাই আমার মেলেনি একদিনের জন্যও। এভাবেই আমি বড় হতে লাগলাম। বোর্ডের পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে স্কুলের মধ্যে ফার্স্ট হলাম। মায়ের চাপে বেড়ে উঠতে উঠতে এই ভাল রেজাল্টের নেশাটা, সেরার সেরা হওয়ার নেশাটা, আমার মধ্যে যেন ইঞ্জেক্টেড হয়ে গিয়েছিল। আমার থেকে কেউ বেশি নম্বর পেয়েছে বা কেউ আমায় টপকে গেছে এ আমিও ভাবতে পারতাম না। তার ফলে ভালো রেজাল্ট করা থেকে কেউ কখনও আমায় আটকাতে পারেনি। স্কুল থেকে বেরিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হোস্টেলে গিয়ে হল আমার চিলেকোঠা থেকে মুক্তি। তবে বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে বাঁধা গরু ছাড়া পাওয়ার মতো লাগামছাড়া আমি হয়ে যাইনি। যার ফলে বেস্ট রেজাল্ট আমার হতেই থাকল। আমি বাড়ি থেকে বেরোবার কয়েকমাসের মধ্যেই দাদুর মৃত্যু হয়। আমার তখন পরীক্ষা চলছিল বলে দাদুর মৃত্যুসংবাদ পেয়েও আমি বাড়ি আসতে পারিনি। মা বলেছিল, “তুমি বাড়ি এলে তো আর দাদু ফিরে আসবেন না! তুমি তোমার পড়াশোনা নিয়ে থাকো, এদিকটা আমি সামলাচ্ছি।” মা আমায় দূরে পাঠিয়েও সেই চিলেকোঠার মতোই বন্দি করে রেখেছে। রিমোটে সবার অলক্ষ্যে সুতোয় টান দিয়ে পুতুলনাচের মতোই আমায় পরিচালনা করে চলেছে তখনও। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমি ইন্ডিয়ার সেরা এমবিএ কলেজে চান্স পেয়ে হায়দ্রাবাদে চলে যাই পড়তে। এসময় আমার ঠাকুমা মারা যান। কিন্তু এবারেও আমি বাড়ি আসতে পারলাম না। আমার দু-দু’জন প্রিয় মানুষ চলে গেল। বাড়ি ফেরার আর কোনও আকর্ষণই আমার রইল না। বাড়ি ফেরার মানেই তো ঐ চিলেকোঠার বিভীষিকা। ক্যাম্পাসিং-এ খুব বড় একটা কোম্পানিতে হাই-প্যাকেজে চাকরি পেলাম মুম্বাইতে। জয়েন করার আগে অল্পদিনের জন্য বাড়ি এসেছিলাম। এই চাকরিটা আমায় চিরকালের জন্য মুক্তি দিল চিলেকোঠা থেকে।           

আমার উন্নতিতে, খ্যাতিতে, গর্বে মায়ের আমার মাটিতে পা পড়ে না তখন। কিন্তু সেই শৈশবে পড়ার যে চাপ মা তৈরি করে দিয়েছিল আমার ওপর, সেই চাপ থেকে আর আমার মুক্তি মিলল না। সেই থেকে আজও আমায় সেই চাপ বহন করতে হচ্ছে। আগে ছিল পড়ার চাপ আর এখন বড় পজিশনে চাকরির চাপ। তাই চিরকাল ফার্স্ট হয়ে বড় চাকরিতে ঢুকেও মনে আমার আনন্দ নেই আর মায়ের ওপর আক্রোশ আমার একটুও কমেনি। কতসময় মনে হয়েছে কী হতো যদি সেরার সেরা না হতে পারতাম, কী হতো যদি এত বড় চাকরি না করে একটু কম ওজনের চাকরি করতাম। একটাই তো জীবন, সে জীবনটাই তো উপভোগ করতে পারলাম না। আর চাকরি করতে করতে উচ্চতার শিখরে উঠতে গিয়ে উপভোগ করা কাকে বলে তাই জানলাম না। চাপই আমার চাপ, সেই শৈশবে যার শুরু, তা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাকে। ছোট থেকে আমার মনে হতো বড় হয়ে মাকে ওই ঘরে বন্দি করে রাখবো। এত বড় হয়ে চাকরি করেও মায়ের ওপর থেকে সে আক্রোশ আমার যায়নি। এরমধ্যে মা আমার বিয়ে দিতে চাইলেন। আমি উপযুক্ত পাত্র, তার জন্য পাত্রীও চাই তেমন। মা খোঁজ করতে লাগল। এতদিন একা বাইরে রয়েছি, কত মেয়েদের সংস্পর্শে এসেছি কিন্তু কারোও প্রতি কখনও প্রেম জাগেনি আমার মনে। শৈশবের সে চাপ থেকে সবার মাঝে থেকেও আমি যেন বাস করতাম বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপে। বিয়ের কথায় মনে হল, বউকে আমি ভালোবাসতে পারব তো? সব সংশয় পার করে আমি বিয়ে করলাম আর বউকে খুব ভালোবেসে ফেললাম। হয়তো মাকে তেমনভাবে ভালবাসতে পারিনি বলে সবটুকু ভালোবাসাই আমার তোলা ছিল। তাই ভালোবাসার মানুষ পেয়ে তাকে আমি উজাড় করে দিলাম।          

বউ নিয়ে খুব আনন্দে আছি আমি। মুম্বাইতে আমার কোনো বন্ধু নেই, যারা আছে তারা কলিগ। তেমনভাবে মেলামেশাও নেই আমার কারও সঙ্গে। ইনফ্যাক্ট স্কুল-কলেজে পড়ার সময় যারা ছিল সহপাঠী, তারা আমার বন্ধু হয়নি কোনোদিনও। কারণ স্কুলের পর তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখা সম্ভব হতো না ওই পড়া পড়া করে। দোষটা তাদের নয়, দোষ আমারও নয়, পরিস্থিতির চাপই দায়ী এরজন্য। এখন বউই আমার একমাত্র বন্ধু কিন্তু সময় আর কতটুকুই বা পাই একসঙ্গে কাটাবার। আমার বউ তৃষিতা আবার খুব মিশুকে। আমার মত না হলেও পড়াশোনায় ও ও খুব ভাল ছিল। ছোট থেকেই ও খুব বন্ধুবৎসল, তাতে ওর ক্যারিয়ারে কোনও ক্ষতি তো হয়নি। আর তাই ওর সব বন্ধুদের সঙ্গে ওর যোগাযোগও রয়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে। তারা কেউ কেউ মুম্বাইতেও রয়েছে। ওর মাধ্যমে তারাই এখন হয়ে উঠেছে আমার বন্ধু। আমি এখন বেশ ভালো আছি। মানসিকভাবে অনেক সুস্থ, স্বাভাবিক, চাপমুক্ত। ইতিমধ্যে মুম্বাইতে আমি একটা থ্রি-বেডরুম ফ্ল্যাটও কিনে ফেলেছি, পাকাপাকি ব্যবস্থা। বাড়িতে ফেরার আর গল্প নেই।         

এমন এক সময় বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। আগে কোনও উপসর্গ ছিল না, তাই কিছুই বোঝা যায়নি। এখন তো আর না গেলে চলে না। দু’জনে আমরা বাড়ি গেলাম, বলতে গেলে কর্তব্য করতে। এই পড়া পড়া করে বাবা-মায়ের ওপর আমার আন্তরিক টানটাই তৈরি হয়নি কোনোদিন। মা আমাকে কলের পুতুলের মত ব্যবহার করত আর বাবার তাতে সায় ছিল, প্রশ্রয় ছিল, সেখানে যেন আন্তরিকতার অভাব ছিল। আন্তরিকতা যা ছিল তা আমার দাদু-ঠাকুমার সঙ্গে, প্রাণের টান ছিল তাদের প্রতি। কিন্তু এবারে বাড়ি গিয়ে মাকে দেখলাম কেমন বিধ্বস্ত। খুব মায়া হল দেখে। মনে মনে আক্রোশে ফুঁসেছি চিরকাল। মাকে চিলেকোঠায় বন্দি করার কথা ভেবেছি। মা শাস্তি পাক এমনটাই চেয়েছি। কিন্তু এই মাকে দেখে আমার এবার আর সেসব কথা একবারও মনে হল না। অতবড় বাড়িতে মাকে একা ফেলে রেখে কী করে যাব সেটাই মাথায় ঘুরতে লাগল। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, মায়ের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে তা আমি অস্বীকার করি কেমন করে? মাকে বললাম, “এখানে একা কি করে থাকবে? চলো আমাদের সঙ্গে আমাদের কাছে থাকবে”। মা বলল, “না বাবু, আমি তোর পিছটান হতে চাই না, তুই মন দিয়ে তোর কাজকর্ম কর, অনেক উঁচুতে ওঠ, সেটুকু দেখেই আমার শান্তি। আমি তোর উন্নতির পথে বাধা হতে চাই না।” মায়ের কথাগুলো আমার বুকে গিয়ে বিঁধল। মা চিরকাল শুধু আমার কথাই ভেবেছে তাহলে! আজও বিন্দুমাত্র নিজের কথা না ভেবে কেবল আমার কথাই ভেবে চলেছে। এই মায়ের ওপর আমার কত আক্রোশ জমেছিল ভেতরে। মা সেদিনও যা চেয়েছিল আজও তাই চায়। আমাকে উন্নতির শিখরে দেখতে চাওয়ার, আমাকে তৈরি করার পদ্ধতিতে হয়তো মায়ের ভুল ছিল আর সেই বয়সে মায়ের উদ্দেশ্যটুকু বুঝতে না পারাটা ছিল আমার ভুল। মাকে জড়িয়ে ধরলাম। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অজস্র জলধারা। মায়ের আর আমার চোখের জলে হল মাখামাখি, হল মিলমিশ।

কলমে মানসী গাঙ্গুলী,  রায়বাগান, হুগলী

6 COMMENTS

  1. “চিলেকোঠা” এটি গল্প না ঘটে যাওয়া সত্যি ঘটনা।লেখার প্রতিটি লাইনে যেন একটা ঘটে যাওয়া একটা ঘটনাকে দেখতে পেলাম। আমার দেখা একটি পরিবারের ঘটনাকে আবার নতুন করে জানলাম।তবে এই গল্পের শেষ লাইনটা মনকে নাড়া দেয়। সাধু এই গল্প লেখিকাকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here