একসময় যে কবিগান,গ্রাম-গঞ্জের আসর মাতিয়ে রাখত, তাঁদের গান শুনতে দূরদূরান্তের লোকেরা ছুটে আসত। তেমন-ই একজন কবির কাহিনি আমার পিতৃদেবের মুখ থেকে শুনেছিলাম। আজ তাঁর-কথাই লিখতে বসেছি।
যাঁর কথা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পাওয়া যায় না।অথচ একদিন যে কবির নাম দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গের লোকের মুখে মুখে ফিরতো!
অষ্টাদশ শতকে প্রখ্যাত কবিয়াল গোঁজলা গুঁই,কেষ্ট মুচি, ভোলা ময়রা, এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি প্রভৃতি কবিয়ালদের মতো তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় কবিয়াল, যার নাম মহেন্দ্র সরকার।
কবির জন্মস্থান ছিল বাংলাদেশের খুলনা জেলায়।এই কবির পদ রচনা অসাধারণ দক্ষতা, উপস্থিত বুদ্ধি, যে কোন ব্যক্তিকে মুগ্ধ না করে পারে না। এহেন কবির জীবনের একটা ঘটনার কথা নিয়েই আমার আজকের গল্প।
এই কবি এপার বাংলা,ওপার বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কবিগান করে বেড়াতেন।
সে সময় ছিল জমিদারি আমল।জমিদারেরা তখন বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করত। নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা পরিশোধ করতে না পারলে জমিদার সেইসব প্রজাদের জমি নিলাম করে দিতেন। একদিকে জমিদারের নায়েব,গোমস্তা,পেয়াদা, অন্যদিকে পুলিশ-দারোগার অত্যাচারে তাদের জীবন ছিল জর্জরিত।পেটে জুটত না ভাত,পরনে জুটত না কাপড়,জুটত শুধু জমিদারের কয়েদ আর নির্যাতন।
তৎকালীন জমিদার হরিনারায়ণ চৌধুরীর শাসনকালে,এমন ভয়ানক অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছিলেনএই কবির পরিবার।
একদিন কবিয়াল মহেন্দ্র বাড়ি ফির দেখেন, তাঁর বাবা,মা,ভাই-বোন,সবাই বিষণ্ণমুখে বসে আছেন। সেদিন ঊনানে হাঁড়ি চড়েনি, মুখে কারো কথা নেই।কবি এসে অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁর মায়ের মুখ থেকে জানতে পারেন যে, জমিদারের গোমস্তা এসে বলে গেছে, তিনদিনের মধ্যে তিনশ’ টাকার বকেয়া খাজনা দিতে না পারলে,তাদের জমি-জায়গা বসত-বাড়ি, নিলাম হয়ে যাবে।এখন কি উপায় হবে তাদের।কেমন করে দেবেন এত টাকা।পর পর দু-বছর খরা গেছে,ফসল হয়নি।সারা বছর চলার মতো চালও মজুত নেই ঘরে। সেই চিন্তা করব,না খাজনার চিন্তা করব।কবিয়াল সব কথা শোনার পর তিনি বললেন, আমি এখন যাচ্ছি জমিদারের বাড়িতে, যা হোক, একটা ব্যবস্থা করে আসবো। কবির বাবা-মা তাঁর কথায় ভরসা পেলেন। পরেরদিন কবিয়াল তাঁর বাবা-মাকে প্রণাম করে জমিদার বাড়িতে এসে পৌঁছালেন। তিনি জমিদারবাবুর বৈঠকখানায় না গিয়ে সোজা জমিদারবাবুর প্রধান ফটকের কাছে সোজা চলে এলেন। আগেই বলেছি, জমিদার হরিনারায়ণবাবু খুব রাশভারী লোক ছিলেন। ফটকের কাছে আসতেই দারোয়ান এসে তাঁর পথ আটকে দিলেন। সে বলল আমি জমিদারবাবুর হুকুম ছাড়া আপনাকে ভিতরে যেতে দিতে পারব না।কবিয়াল তখন পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে কয়েকটি লাইন লিখে দারোয়ানের হাতে দিয়ে বললেন, এই চিঠিটি জমিদারবাবুকে দিয়ে আসবে। দারোয়ান তখন সেই চিঠিখানা জমিদারবাবুকে দিয়ে এলো।
চিঠিটি পড়ে জমিদারবাবু বুঝতে পারলেন যে, তিনি সাধারণ কেউ নন, স্বয়ং মহেন্দ্র কবিয়াল।
তাই তিনি দোতলা থেকে নেমে এসে কবিয়ালকে সঙ্গে নিয়ে বৈঠকখানায় গেলেন। কবিয়ালের নাম শুনে জমিদার গৃহিণী ও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কবিয়াল ওঁনাদের উভয়কে প্রণাম করে নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। জমিদারবাবু তার সংশয় মুক্ত হওয়ার জন্য কবিয়ালকে জিজ্ঞাসা করলেন,তিনি কি সেই কবিয়াল,যিনি গ্রামে গঞ্জে সুবিখ্যাত মহেন্দ্র কবিয়াল নামে পরিচিত!
একথা শুনে কবি বললেন,আপনি ঠিকই ধরেছেন,তবে আমাকে কবিয়াল বলে লজ্জা দেবেন না।তবে,আমি দক্ষিণ-বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কবিগান করে থাকি। জমিদারবাবু বললেন,আপনি যে একজন অসাধারণ কবিয়াল তা আপনার লেখা থেকেই বুঝতে পেরেছি। কবি তখন বলেন, আমি আপনার ছেলের বয়সী, আমাকে আপনি না বলে, তুমি বললে বেশি খুশি হব।
জমিদারবাবু মহেন্দ্রের কথায় খুশি হয়ে বললেন, তোমার কবিগান শোনার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। একবার যখন কাছে পেয়েছি, তোমার গান না শুনে ছাড়ছিনে বাবা। সঙ্গে সঙ্গে জমিদার গৃহিণী ও কবিকে এক-ই অনুরোধ জানালেন। কবি বললেন,আমি আপনাদের গান শোনাব,
কিন্তু আমার আরেকজন প্রতিবাদী দরকার। এককভাবে কবির লড়াই জমে না।
জমিদারবাবু একথা শুনে, সঙ্গে সঙ্গে লোক পাঠালেন কবিয়ালের খোঁজে। কিন্তু কবিয়ালগণ কবি মহেন্দ্রের সঙ্গে গাইতে হবে শুনে কেউ আর সাহস দেখায় না তার সঙ্গে গাইতে ।শেষে অনেক টাকা পুরস্কারের কথা বলে একজনকে রাজি করানো হয়।
পরের দিন শুরু হলো যথারীতি কবির-লড়াই। দেব-বন্দনা,আসর-বন্দনার পর জমিদার হরিনারায়ণ চৌধুরীর বন্দনা শুরু করলেন কবিয়াল মহেন্দ্র। জমিদার থেকে শুরু করে সমস্ত শ্রোতারা কবির ছন্দ গানে মোহিত হয়ে পড়লেন। এরপর তিনি তার প্রতিপক্ষ কবিকে তাঁরএক-একটিপ্রশ্নের জবাব দিতে বললেন। কিন্তু কবিয়াল মহেন্দ্রকে তারা সঠিক জবাব দিতে না পেরে উল্টোপাল্টা জবাব দিলেন। কবিয়াল মহেন্দ্র সেই উল্টোপাল্টা জবাব শুনে যেভাবে তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেছিলেন তার দু- একটা নমুনা আমি এখানে তুলে ধরলাম:
১)”লাফিয়ে উঠে লাঠি মারে,
কোথায় মারে ভেবে পায় না।
বাঘ ডেকেছে সুন্দরবনে,
মানুষ মরে বাঁশ-বাগানে।
দুএকজন তার শব্দশুনে
উদোতেলির দম সরে না।
কোথায় মারে ভেবে পায় না।।”
অনুরূপভাবে, তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে না পারায়, তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে যেভাবে জবাব দিয়েছিলেন তার একটি নমুনা:
২)আগুন লাগলে ঘুঘুডাঙায়
যতীন বাবু চক্ষু রাঙায়
জল ঢালে সে বাঁশের চোঙায়
আগুন নেভায় নন্দ জানা।”
এরপর তাঁর প্রতিপক্ষ কবিয়াল যখন তাকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে গান ধরলেন, কবি মহেন্দ্র সেই গানের শেষে তাকে যে চরম জবাব দিয়েছিলেন, তার একটি নমুনা:
তোমায় আমায় তফাৎ কত ভেবে দেখো না,
যেমন বন্দুক কার কামান,
আমি দিচ্ছি তার প্রমাণ
বাঁশবাগানের পেত্নী হয় কি
মা কালীর সমান?
যেমন তৈল আর ঘৃত, লেবু নিম তেতো,
যেমন ধারা মাথার মণি,আর পায়ের জুতো!
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এমন শব্দচয়নে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।
এমন অসংখ্য গানের মাধ্যমে কবিয়াল মহেন্দ্র তাঁর বিদায় পালার ধুয়ো ধরলেন। সেখানে কবি জমিদারকে দেবাদিদেব মহাদেব,আর জমিদার গৃহিণীকে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করলেন।আর তাঁর নায়েব গোমস্তা!
প্রজাদের ওপর তাঁদের নির্মম অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরলেন,অসুরের সঙ্গে তুলনা করে।
সে অত্যাচারের কাহিনী শুনে ওই আসরে এমন কোন শ্রোতা ছিলেন না,যাঁরা চোখের জল ফেলেননি। জমিদার গৃহিণী তাঁর দুঃখের বর্ণনা শুনে আর স্থির থাকতে না পেরে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সেই আসরে উঠে বললেন, বাবা আমাকে আর কাঁদাসনে। আজ থেকে তোকে আমার পুত্রের অধিকার দিলাম। এরপর জমিদারবাবু সেই আসরে উঠে ঘোষণা করলেন, যতদিন আমার জমিদারি থাকবে, ততদিন এই কবি নিষ্কর জমি ভোগ করবেন। এরপর তিনি কবি মহেন্দ্রকে এক হাজার টাকা পুরস্কৃত করে, নায়েবমশাইকে হুকুম দিলেন কবিকে যেন পাল্কি করে তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়।
কলমে নিতাই মৃধা,পাটুলি, কলকাতা