গল্প লেখার গল্প -শেষ পর্ব

কলমে অদিতি দে

1
612
<< পর্ব ৩

“বিশ্বাস কর দুলকি আমি কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম তোর বাবা আর আমার মধ্যের দুরত্ব ঘোচাতে । কয়েকবার বলার পর যখন দেখলাম মানুষটা ক্রমাগত আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তখন বন্ধ করে দিয়েছিলাম সিগারেট খাওয়ার কথা বলা। কিন্তু কেন জানিনা তোর বাবাই আর আমার সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারলেন না। হয়তো আমাকে খারাপ ভাবতে শুরু করছিলেন। ছেড়ে দিতে পারছিলেন না তাদের আদর্শবাদী পরিবারের পক্ষে সেটা কলঙ্কজনক হবে বলে। প্রমিতা দেবী দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে কথা গুলো বলছিলেন যেন দুলকি নয় ঘরের দেওয়ালকে কথা গুলো শোনাচ্ছেন। “জানি না কথা গুলো বলা তোকে ঠিক হল কিনা । এগুলো শোনার পর তোরও হয়ত তোর বাবার মতো আমাকে বিকৃত মনে হতে পারে। দুলকি বাবার ছবির পাশে ঝোলানো দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত আড়াইটে বাজে। কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো বাবার ছবিটা যেন একটু একটু দুলছে ।ভালো করে দেখলে বোঝা যায় ছবিটা নয়, ছবির গলায় মালাটা দুলছে। মায়ের ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আলো জ্বালানো দেখে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছিল দুলকি। ভেবেছিল মা বোধহয় আলো জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু মা জেগে আছে দেখে তাড়াতাড়ি করে হাতের সিগারেটটা নেভাতে যাবে , মা-ই বারন করল। বলল , ” নেভাতে হবে না। আমি জানি তুই সিগারেট খাস।” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অদ্ভুত স্বরে বললেন, “আমার জীবনের কিছু কথা শুনবি দুলকি ? তুই বলছিলিস না নিজের জীবনের থেকে ঘটনা নিয়ে লিখতে । দ্যাখ তো এই কথা গুলো লেখা যায় কিনা ?” আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দুলকির হাতের সিগারেটের দিকে ইশারা করে একটু হেসে বললেন, ” আমার জীবনের নায়ক বল বা খলনায়ক সবই ওই সিগারেট। তোর বাবা নয় । দুলকি শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল  প্রমিতা দেবী অবশ্য  দুলকির এই হতবাক হওয়াটা লক্ষই করলেননা। তিনি ততক্ষণে হারিয়ে গেছেন তার ফেলে আসা দিনগুলোতে। অতীত দাম্পত্য জীবনের গোপন ব্যার্থতা পরতের পর পরত খুলে পরম নির্লিপ্ত ভাবে তুলে ধরছিলেন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সামনে আর ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন জীবনের ময়নাতদন্ত করতে করতে । নির্লজ্জতা যেন ভর করেছিল প্রমিতা দেবীকে। খেয়াল করেননি দুলকি আধপোড়া নিভে যাওয়া সিগারেটটা কতক্ষণ হাতে ধরে আছে। বলা শেষ হয়ে গেলে প্রমিতা দেবী দুলকির দিকে ফিরে বললেন , ” আমি খুব খারাপ নারে দুলকি ? তোর বাবা জীবনটা আমার জন্যই নষ্ট হয়ে গেল তাই না ? দুলকির হঠাৎই যেন ঘুম ভাঙলো। খেয়াল করল তার হাতের সিগারেটটা অনেকক্ষণ আগে নিভে গেছে। আধপোড়া সিগারেটটা রিডিং টেবিলের পাশে রাখা ডাস্টবিনে ফেলার জন্য উঠতে উঠতে প্রমিতা দেবীকে বলল , ” আমি শুধু একটা কথা ভাবছি । যে সিগারেট তোমার আর বাবার মধ্যে দেওয়াল খাড়া করে দিল সেই সিগারেট তুমি নিজে কি কখন খেয়ে দেখেছ ? মেয়ের কথা শুনে প্রমিতা দেবী এত দুঃখেও হেসে ফেললেন। ” তোর বাবাও এই কথাটা আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন। নারে, আমাদের মতো ছাপোষা পরিবারের মেয়েরা সিগারেট খেলে সমাজ নিন্দামন্দ করবে তো । বলবে নষ্ট মেয়ে । আর তাছাড়া আমার কোনোদিন ইচ্ছেই হয়নি খাওয়ার। শুধু যে মানুষটা আমায় বিয়ে করবে সে মাঝে মাঝে একটা দুটো খাবে ইচ্ছে ছিল।”
” আচ্ছা মা আমি যে সিগারেট খাই তুমি তো জানো। বারন করনি কেন ? সিগারেটের গন্ধ ভালো লাগে তাই ?”  দুলকির নিজের কানেই প্রশ্নটা কেমন স্বার্থপরের মতো ঠেকলো । প্রমিতা দেবী একটু থমকালেন ।কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বোধহয় কি বলবেন মনে মনে সাজিয়ে নিলেন।তারপর কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন , ” নারে , আমি এতটা স্বার্থপর নই। তোকে বারন করিনি কারন বারন করলেও তুই  শুনতিস না। আমার সামনে হয়ত খেতিস না। আর আমি তোকে মানুষ হয়ে জন্মাবার স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলাম দুলকি। আমি, তোর মাসিরা তো মেয়ে হয়েই রয়ে গেলাম । মানুষ হয়ে উঠতে পারলাম কোথায় ! আর আমি জানি তুই একটা দুটোর বেশি খাস না।” মায়ের উত্তর শুনে দুলকির নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো । মায়ের কাছে সরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” একটা কথা বলব মা ? একটা সিগারেট খেয়ে দেখবে ? হয়তো সিগারেট সম্বন্ধে তোমার অবসেশন চলে যাবে।” দুলকির কথাটা প্রমিতা দেবী দু মিনিট ভাবলেন। তারপর বললেন , ” বিশ্বাস কর দুলকি , আমার নিজের কোনোদিন খাবার ইচ্ছে হয়নি। আর অবসেশন চলে গিয়ে কি হবে অপরাধবোধ তো থেকে যাবে। আর সেটা আমাকে সারা জীবন কুরে কুরে খাবে। তোর বাবার যোগ্য স্ত্রী  হতে না পারার অপরাধ, তাকে বঞ্চিত করার অপরাধ। সিগারেট খেলে যদি এগুলোর থেকে মুক্তি পেতাম তাহলে অবশ্যই খেতাম।“দুলকি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মায়ের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, “তোমরা কেউ কাউকে বঞ্চনা করনি মা।শুধু ছেলেমানুষের মতো জেদাজেদী করেছ।” তারপর উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, “যেটুকু রাত বাকি আছে শুয়ে নাও।আর এইটুকু ভেবে সান্তনা পাও যে তোমার কোনো অপরাধে তোমার বা বাবার জীবন নষ্ট হয়নি। যদি হয়ে থাকে অপঘাতে হয়েছে।” প্রমিতা দেবী মেয়ের যাওয়ার পথে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চাইছেন এভাবে বলে উঠলেন , “তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস দুলকি । খালি এইটুকু বলে যা আমার জীবনের এই কথাগুলো কি  গল্পে লেখা যায় ?”
দুলকি দরজা অবধি পৌঁছে গিয়েছিল।মায়ের কথা শুনে তড়িৎ গতিতে ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল, ” না মাদামমজেল,এগুলো তোমায়  লিখতে হবে না।তুমি যা চেয়েছিলে সেটা কোনো অন্যায় নয়। যদি তোমার দিক দিয়ে কোনো ভুল হয়ে থাকে তাহলে সেটা আপস করতে না পারাটা।তবে বাবাও তো আপস করেননি। নিজের আদর্শ ভেবে একটা তুচ্ছ  জেদকে আঁকড়ে ধরেছিলেন।”  মায়ের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে দুলকি গভীর স্বরে বলল, ” আসলে তোমরা দুজনের কেউই বুঝতে চাওনি জেদের চেয়ে , আদর্শের চেয়ে জীবনটা অনেক বড়। তবুও তোমায় এসব লিখতে হবে না।”
প্রমিতা দেবী ছেলেমানুষের মতো মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আর কোনো কিছুই লিখব না ঠিক করেছি । কি হবে তাড়া তাড়া কাগজ আর পেনের কালি নষ্ট করে ?” দুলকি আরো শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে অনুভব করল তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

পরদিন দুলকি একটু তাড়াতাড়িই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। মাকে নিয়ে আজ একটু এদিক ওদিক বেড়াতে যাবে ভেবে রেখেছিল। টুকটাক কেনাকাটা করবে , মায়ের ইচ্ছে হলে একটা সিনেমা দেখবে। উদ্দেশ্য মাকে সঙ্গ দেওয়া। কালকের রাতের পর থেকে মা যেন তার সামনে সহজ হতে পারছে না।আজ সকালে মনে হচ্ছিল মায়ের তার সঙ্গে চোখ মেলাতে অসুবিধে হচ্ছে।প্রথমে ভেবেছিল আজ অফিস ডুব মারবে, মায়ের কাছে থাকবে। তারপর মনে হল মাকে একটু সময় দেওয়া দরকার নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাড়ি পৌঁছলে মা দরজা খুলে দিল।দুলকিকে এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতে দেখে প্রমিতা দেবী একটু অবাক হলেন । খুশীও হলেন। মায়ের হাসি মুখ দেখে দুলকির মনের ভার নেমে গেল অনেকখানি। দরজায় দাঁড়িয়েই মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বলো !” তারপর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আবদারের সুরে বলল, “চল না মা আজ একটু বেরিয়ে আসি। প্রমিতা দেবী হেসে বললেন, ” আগে তো জামাকাপড় ছাড়, মুখ হাত ধুয়ে নে।” দুলকি নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “আমি চট করে রেডি হয়ে নিচ্ছি। তুমিও শাড়ি পরে নাও। আজ রাতে বাইরে খাব।” বলতে বলতে দুলকি দেখল সেন্টার টেবিলের ওপর মায়ের লেখার খাতা আর পেন রাখা। কিছু না বলে সে ঘরে চলে গেল। তৈরী হয়ে আধঘন্টা বাদে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল মা তখনো তৈরী হয়নি। সোফায় বসে লেখার খাতাটা উলটে উলটে দেখছে।মেয়েকে দেখে  কুন্ঠিত স্বরে বললেন , ” দুলকি তোর চেনাশোনা কোনো  প্রকাশক আছে রে ? বই ছাপবে ।” দুলকি মায়ের দিকে তাকিয়ে সাবধানী গলায়  জিজ্ঞেস করলো ,” কি করবে ?”
” ভাবছিলাম একটা নাটক লিখলে কেমন হয় ” , প্রমিতা দেবী এমন ভাবে কথাটা বললেন যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মেয়ের পরামর্শ চাইছেন। ” সকাল থেকে ভাবলাম জানিস। দ্যাখ, স্কুল কলেজে ছাড়া নাটক আমি পড়িইনি । তাই মুখস্ত কিছু লিখব সেটা সম্ভব নয়।না হয় একটা ঐতিহাসিক নাটকই লিখব।সেটা তো আর কারুর নকল হবে না। তোর কি মনে হয় ? পারব না ?”
দুলকির যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। কুল কুল করে হেসে ফেলল । তারপর হাসি থামিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “চল মাদামমজেল তোমায় আজ একটা ভালো পেন গিফট করি। ওই পেনটা দিয়ে তুমি নাটক লেখা শুরু কর। তোমার সাহিত্য অ্যাকাডেমি কে আটকায় !”

 

(সমাপ্ত)

কলমে অদিতি দে

1 COMMENT

Leave a Reply to গল্প লেখার গল্প – পর্ব ৩ | মন ও মৌসুমী Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here