<<পর্ব ২
ফুলশয্যা রাতে নিশিথরঞ্জনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন প্রমিতা দেবী। বউভাতের আচার অনুষ্ঠান ,লোকজনের খাওয়া শেষ হতে হতে সেদিন রাত একটা বেজে গিয়েছিল। ফুলশয্যার ঘরটাতে রজনীগন্ধা আর গোলাপের গন্ধ মিলে একটা ভালবাসার গন্ধ তৈরী করেছিল। ফুলের স্তূপ সরিয়ে খাটের ওপর বসে নিশিথরঞ্জন প্রমিতা দেবীর হাত নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন , ” প্রমিতা, আমার যা কিছু আছে সবই তোমার। তবুও এই বিশেষ রাতে তোমায় কি দেব বল।”
প্রমিতা দেবী চোখ তুলে সদ্য চেনা মানুষটার দিকে তাকিয়ে লাজুক স্বরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ” সিগারেট খাও?” “কি ?” হতচকিত নিশিথরঞ্জন প্রমিতা দেবীর প্রশ্নটা ঠিক খেয়াল করতে পারেননি।
নিশিথরঞ্জনের “কি” শব্দের ধাক্কায় প্রমিতা দেবীকে ঘেরা আবেশের বলয় মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে খান খান হয়ে গেল। বাস্তবের জমি স্বপ্নের মাটিতে আঁছড়ে পড়ল।
“তুমি সিগারেট খাও ?” প্রমিতা দেবীর হাত থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে নিশিথরঞ্জন এমন ভাবে কথা গুলো বললেন যেন তার গলায় কিছু আটকে গেছে।
প্রমিতা দেবী কিছুক্ষণ তার নব্য বিবাহিত স্বামীর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। “আমার খাওয়ার কথা বলিনি। তুমি খাও কিনা জানতে চাইছি।” প্রমিতা দেবীর কথা গুলো শুনে মনে হল নিশিথরঞ্জন কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়েছেন। বললেন , ” আমি তুমি কি চাও জিজ্ঞাসা করেছিলাম। হঠাৎ সিগারেটের কথা বললে তাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। না, আমি সিগারেট খাই না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার।”
প্রমিতা দেবীর চোখের সামনে পৃথিবীটা কেমন আলুনি হয়ে গেল। ফুলশয্যার বিছানাটা মনে হল ভিজে ভিজে ,স্যাঁত স্যাঁতে। আর সামনে বসে থাকা মানুষটা যেন পুরুষ নয় । একটা বেড়াল, ভিজে বেড়াল। ম্যাও করলো এইমাত্র। স্তিমিত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ” কেন খাও না ? সিগারেট খেতে তো ভালো। সিগারেটের গন্ধটাও ভালো। তাহলে ?”
নিশিথরঞ্জন তার নব পরিণীতা স্ত্রীর এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করে আড়ষ্ট গলায় বললেন, “সিগারেট খাওয়া ভালো ! তুমি জান সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয় ? তুমি আমার স্ত্রী হয়ে আমায় সিগারেট খেতে বলছ ? তারপর প্রমিতা দেবীর চোখের দিকে তাকিয়ে মুখের মধ্যে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে বললেন, ” তুমি জানলে কি করে সিগারেট খাওয়া ভালো ? কখনো খেয়েছ নাকি ?”
নিশিথরঞ্জন যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন প্রমিতা দেবী অপলক দৃষ্টিতে তার স্বামীর দিকে চেয়েছিলেন তাই তার গলায় ব্যাঙ্গের সুরটা ধরতে পারেননি। তার মনে হচ্ছিল শুধু একটা সিগারেট অভাব । একটা সিগারেটের একটু ধোঁয়া তার স্বামীকে তার চোখে একজন পুরুষ করে তুলতে পারে। আজকের রাতটা সার্থক করতে পারে। গোঁয়ার্তুমি পেয়ে বসেছিল প্রমিতা দেবীকে। জেদী গলায় বলে উঠলেন , ” আমি কখনো খাইনি। কিন্তু সিগারেটের গন্ধটা জানি। আর একটা করে খেলে কিছু হয় না। বরং পুরুষালি ভাবটা আসে।” সেদিন রাতে নিশিথরঞ্জনের চোখে বিজাতীয় কিছু দেখেছিলেন কি প্রমিতা দেবী ?সেটা কি কেবল ঘৃণা ছিল না তার সঙ্গে আরো কিছু ? তবে সেটা আর যাই হক সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি প্রেম নয়। নিশিথরঞ্জন কেমন যেন গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। মৃদু কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলেছিলেন , ” সম্ভব নয় প্রমিতা। আমাদের পরিবারে সবাই নেশা বস্তুটাকে ঘৃণা করে। আমার বাবা মা আমাকে একটা আদর্শ নিয়ে মানুষ করেছেন। আজ তোমার কথায় আমি তাঁদের সব শিক্ষা দীক্ষাকে জলাঞ্জলি দিতে পারব না। আর তাঁদের আমি বলবই বা কি যে আমার স্ত্রী মনে করে পুরুষালি ভাব আনতে সিগারেট খাওওাটা জরুরি ?” তারপর খাট থেকে নেমে দাঁড়াতে দাঁড়াতে যে মন্তব্যটা করলেন সেটা অনেকদিন পর্যন্ত প্রমিতা দেবীকে অপমানে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ” আচ্ছা শুধু সিগারেটের গন্ধটাই ভালো লাগে ? মদ সম্বন্ধে তো কিছু বললে না ?”
নিশিথরঞ্জন কি তাকে মানসিক ভাবে বিকৃত বলে মনে করতেন ? এ কথা অনেকবার প্রমিতা দেবী তার স্বামী মারা যাওয়ার পর ভেবেছেন। ফুলশয্যা রাতের সেই কথোপকথনের পর নিশিথরঞ্জন প্রমিতা দেবীর উপস্থিতিতে কেমন যেন আড়ষ্ট বোধ করতেন। কি মানসিক কি শারীরিক কোনোভাবেই আর কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি। বিয়ের প্রথম প্রথম অবশ্য প্রমিতা দেবী নিজেকে এর জন্য দায়ী ভাবতে চাননি । বরং নিশিথরঞ্জনের ওপরই পুরো দায়ভারটা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। আর নিশিথরঞ্জনও যেন সেটা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছিলেন। সিগারেট খেলেই যদি তাদের দাম্পত্য জীবনের শীতলতা কাটে তাহলে অসুবিধে কোথায় ? আর এতই যদি ছুঁতমার্গ থাকে তাহলে খাওয়ারও দরকার নেই। কেবল একটা ধরালেই…………। বিয়ের প্রথম প্রথম কথাগুলো স্বামীকে বলতেন প্রমিতা দেবী। কিন্তু নিশিথরঞ্জনের সেই এক কথা। বাবা মা কি ভাববেন। তাদের পরিবারে একটা আদর্শ আছে। প্রমিতা দেবী বুঝিয়েছেন , ঝগড়া করেছেন। কোনো লাভ হয়নি। নিশিথরঞ্জন প্রতিবার দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখান করেছেন। ক্রমাগত একটু একটু করে দূরে সরে গেছেন স্ত্রীর থেকে।
অথচ তাকে কোনোদিন অবহেলা করেছেন নিশিথরঞ্জন এই অভিযোগ মরে গেলেও করতে পারবেন না প্রমিতা দেবী। ওই একটা বাদে বাকি আর সব চাহিদা , আবদার নির্দ্বিধায় পূরণ করেছেন । কিন্তু যন্ত্রের মতো । এমনকি বিছানাতেও বরফশীতল হয়ে স্বামীর দায়িত্ব পালন করেছেন। উত্তেজনাহীন, উষ্ণতাহীন শারীরিক সম্পর্ক। এতটাই নিখুঁত ভাবে দাম্পত্য কর্তব্য সমাধা করতেন নিশিথরঞ্জন যে মাঝে মাঝে প্রমিতা দেবীর দমবন্ধ হয়ে আসতো। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করত , ” কিছু করতে হবে না আমার জন্য তোমায়। খালি মুক্তি দাও।” এর থেকে যদি প্রমিতা দেবীর স্বামী তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন, তাকে দোষারোপ করতেন , এমনকি মারধরও করতেন তাহলেও প্রমিতা দেবীর মনে হত তিনি একজন মানুষের সঙ্গে ঘর করছেন। কিন্তু এ যেন রক্ত মাংসের গড়া পুতুল। নিশিথরঞ্জন যেন তিলে তিলে শোধ নিচ্ছিলেন প্রতিমা দেবীর ওপর। আদর্শের সঙ্গে আপস করতে বলায় প্রতিশোধ। স্বামীর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে আদর্শ স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে প্রমিতা দেবী যেন পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন।
[…] পর্ব ৩>> […]
[…] << পর্ব ৩ […]