অডিশন

1
1117

বিরাটির শম্ভুনাথ লেনের মল্লিক গেস্ট হাউসের সামনে লাইনটা তখন একেবেকে গলি ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে পড়েছ। মল্লিক গেস্ট হাউসে বিয়েবাড়ি-অন্নপ্রাশন- শ্রাদ্ধ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান লেগেই থাকে তবে আজকের ব্যাপারটা একেবারে অন্যরকমের। আজ এখানে জয়বিজয় প্রোডাকশনের অডিশন। নতুন ছবির জন্য অভিনেতা প্রয়োজন তাই উৎসাহী প্রার্থীদের প্রতিভা পরখ করা হবে।

মাইকে পাঁচ হাঁকতেই প্রতাপ বলল আমাদের তো এখনো কিছুটা দেরি আছে চল ওদিকে ছাওয়ায় গিয়ে বসা যাক, তখন বুদ্ধি আর আপত্তি করল না। সকাল থেকে ঝাঁঝাঁ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে এরমধ্যে মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে, এদিকে সমস্যা হল  চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ পড়লে অডিশনে বাতিল হবার সম্ভবনা প্রবল, বুদ্ধির ব্যাগে গ্লুকোজের জল ভরা বোতল রাখাই আছে তাই থেকে দু ঢোঁক গলায় ঢেলে দিল। খিদেটাও ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে। একটা চালাক চালাক চেহারার ছেলে হাঁক দিচ্ছিল ‘কচুরি-তরকারি’ বুদ্ধি হাত তুলে ওকে ডাকল -কতো করে ভাই?     ছেলেটি ঝড়ের বেগে বলল –‘চারটে লুচি আলুর তরকারি, প্লেট চল্লিশ টাকা’ বুদ্ধির ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। সুযোগ বুঝে সবাই লুটে পুটে খাচ্ছে। পেটে আরেকটা ছুঁচোর ডন পড়তেই বুদ্ধি অস্থির হয়ে পড়ল। দুপ্লেট কচুরির অর্ডার দিয়ে রাস্তার ধারে ছাওনির দিকে এগিয়ে গেল।

খবরের কাগজে ফিল্ম কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে বুদ্ধি কোনরকম ঝুঁকি নিতে চায় নি তাই প্রতাপের সঙ্গে ভোর রাত থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিন্তু তাতেও কি রেহাই আছে!  রাত দুপুরে এসেও দ্যাখে জনা পঞ্চাশেক লোক আগে থেকেই চাদর বালিশ নিয়ে হাজির। কি আর করা সেই পঞ্চাশ জনের পিছনেই লাইন দিয়ে বসে থাকতে হল। অনেকেই পয়সা দিয়ে ভাড়া করা লোক বসিয়ে ঘুমাতে চলে গেছিল কিন্তু বুদ্ধি আর প্রতাপ আসছে সেই উত্তরপাড়া থেকে ওরা গেলে আর ফিরত আসার কোন সুযোগ থাকবে না। তাছাড়া নষ্ট করার মতো ফালতু পয়সাও ওদের হাতে নেই।

অডিশন শুরু হল,  নির্ধারিত সময়ের একঘন্টা পরে প্রায় দশটায়। এদিকে লাইনে প্রায় দুশো উমেদার দাঁড়িয়ে গেছে। কোম্পানির তরফ থেকে সবাইকে একটা করে স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে একটা নম্বর লেখা।  বুদ্ধি আর প্রতাপের ভাগে পড়েছে আটচল্লিশ-উনপঞ্চাশ। ডাক এলে নম্বরধারী ভিতরে গিয়ে নিজের যোগ্যতা আর ভাগ্য পরিক্ষার সুযোগ পাবে। বুদ্ধি দূর থেকেই হলের গেটের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে ছিল, হঠাৎ একটা হৈচৈ পরে গেল এক নম্বর প্রতিযোগী বেড়িয়ে আসতেই সবাই পড়িমরি করে তাকে ঘিরে ধরল, দুখি আর প্রতাপও ছুট লাগাল সেই ভিড় লক্ষ্য করে। একনম্বর ক্যান্ডিডেটের দিকে হাজার প্রশ্ন ধেয়ে গেল ‘কি বুঝলেন দাদা? লাগার চান্স আছে? কি করতে বলল? ছেলেটি হতাশ ভাবে বলল     -‘বেকার রাত জেগে লাইন দিলাম, প্রথমে বলল জয়কুমারের মতো কাঁদতে?  কাদলাম, দিলরুখের মতো তোতলাতে বলল? তোতলালাম! এতকিছুর পর বলল হবে না বাড়ি যাও’। লোকটি আর কথা না বাড়িয়ে বোধহয় নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যেই হাটা লাগাল। ভিরে মৃদু গুঞ্জন উঠল। অনেকেই তোতলামো আর কান্নাকাটি ঝালিয়ে নিতে শুরু করল। বুদ্ধির মাথায় একটা চিন্তা ঘুরছিল প্রতাপকে উদ্দেশ্য করে বলল –‘আমরা বরঞ্চ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি তাহলে যাদের অডিশন শেষ হবে তাদের থেকে ভিতরের ব্যাপার-স্যাপার গুলো বুঝে নিতে পারব’। প্রতাপ বুদ্ধির কথায় সায় দিল। খানিক অপেক্ষা করার পর দুনম্বর প্রতিযোগীর দেখা মিলল। সবাই মিলে আবার প্রশ্নের ছররা ছুড়ে মারল। -‘কেমন হল দাদা? কি মনে হল’। মাঝবয়েসী লোকটি মাথা নেড়ে বলল –‘কি আবার হবে বলল অ্যাকশন মুভি রাগ দেখাতে হবে,  তা হানি গেওলের কায়দায় বেশ একচোট রাগারাগি করলাম, তারপরে শালারা বলে কি তোমার মধ্যে সেই জিনিসটাই নেই! ওরিজিনাল এক্সপ্রেশনের অভাব’। বুদ্ধি প্রতাপের দিকে চেয়ে বলল –‘বুঝলি এদের সবকিছু অরিজিনাল চাই, ঠিক গোয়ালা যেমন দুধ থেকে মাখন ছেঁকে তোলে অনেকটা সেরকম’। প্রতাপ দাম্ভিকভাবে মাথা নেড়ে বলল –‘মনে হয় এরা আমার কাছে অরিজিনাল দুধ আর মাখন দুটোই পেয়ে যাবে ঠিক যেমনটি চাইছে আর কি! তবে তুই টেনশন নিস না, ধরে পাকরে হিরোর বন্ধু বা চামচা, কিছু একটা রোল তোকে পাইয়ে দেবোই’। বুদ্ধি মনে মনে গালাগালি করে বলল –‘হুহু বাবা! স্বপ্ন দেখো, বাকসিদ্ধ জ্যোতিষী বগলাচরন বাগচিকে আমি লাগিয়েই এসেছি, ভোর পাঁচটা থেকে উনি নগ্নদেহে পুকুরের জলে ডুব সাতার দিয়ে সর্বসিদ্ধি মন্ত্র জপ করে যাচ্ছেন আর করে যাবেন যতক্ষন না কার্যসিদ্ধি হচ্ছে, একবার অডিশন হয়ে যাক তারপর কে হিরো হবে আর কে চামচা সেটা নিজের চোখেই দেখতে পাবে বাছাধন’!

লাইন এগোতে থাকল শম্বুক গতিতে, রুটিনমাফিক একেকজন প্রতিযোগী বেড়িয়ে আসে আর সবাই তাদের ছেঁকে ধরে, প্রত্যেকেই খুঁটিনাটি জেনে নিতে চায় যাতে নিজের বাধাটা সহজেই টপকে ফেলা যায়। থলথলে চেহারার বিশাল ভুরিওয়ালা একজন প্রতিযোগী মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বেড়িয়ে এলো। কেউ কিছু জিগ্যেস করার আগেই গলা উঁচিয়ে বলল –‘ভাইসব এই অডিশন একটা ভাওতাবাজী ছাড়া আর কিছু নয় শুধু-শুধু আমাদের সময় নষ্ট করার ঘৃণ্য  চক্রান্ত’। ভিড়ের মধ্যে কেউ জিগ্যেস করল –‘এমন চক্রান্ত করে কার কি লাভ’?

-‘লাভটা বুঝলেন না ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া’। ভুরিওয়ালা সবজান্তার মতো বলল।

-‘ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া’! কয়েকটা বোকার মতো তাকিয়ে থাকা মুখের দিকে চেয়ে মেদবিশিষ্ট লোকটা বলল –‘অডিশনের নাম করে গবর্মেন্টের ন্যায্য প্রাপ্য মারার চাল! হুহু বাবা পাবলিকের সঙ্গে চালাকি’! ভিড়ের ভিতর থেকে লুকিয়ে কেউ ব্যাঙ্গোক্তি করল  -‘ট্যালেন্ট না থাকলে এই হয়! যতো সব ছুতনা’। কথাটা বিশালবপুর কানে গেছে সে এবার অগ্নিশর্মা হয়ে বলল –‘কতো সব প্রতিভাধর এসেছে রে! ঠিক আছে আমিও কোথাও যাচ্ছি না এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব দিনভর, শেষমেশ দেখে যাব কেউ চান্স পায় কিনা তবে বলে রাখছি সবাই পরে মিলিয়ে নিও একজনও সুযোগ পাবে না’! ভিড়টা পাতলা হয়ে এলো, একজন প্রতিদ্বন্দ্বী বিদায় হয়েছে, আপদ চুকেছে, সবাই আবার হাঁসি কান্নার মহড়ায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। পেটমোটা রাগে গজগজ করতে করতে পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে বসে পড়ল।

লাঞ্চ ব্রেক হল। প্রায় দুটো বাজে। মাঝ আকাশে সূর্যের তেজ যেন শরির জ্বালিয়ে দিচ্ছে।  অনেকেই ছায়ার সন্ধানে এদিক ওদিক সরে গেছে। তবে সবারই নজর রয়েছে গেটের সামনে যেখান থেকে ফের ডাক আসবে। বুদ্ধি দুরু দুরু বুকে গেটের সামনেই  দাঁড়িয়ে রয়েছে। লাঞ্চের ঠিক আগে আটচল্লিশ নম্বরের কাজ মিটেছে, অতএব এরপর হিসেব মতো তার পালা আসতে চলেছে। প্রতাপ একটু হালকা হতে গেল, এই সুযোগে বুদ্ধি পকেট থেকে মোবাইল বের করে নম্বরটা টিপে বসল।

জ্যোতিষী বগলাচরণ মোটা চালের ভাত আর মুর্গির ঝোল দিয়ে বেশ জমিয়ে আহার শেষ করে সবে মাত্র দিবানিদ্রার আয়োজন করতে চলেছেন, বিকেলের দিকে আবার দোকান খুলে বসতে হবে তার আগে একটু গড়িয়ে নিলে মেজাজটা ফুরফুরে থাকে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল, স্ক্রীনে নম্বরটার দিকে চেয়ে জ্যোতিষীর মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। ফোনের শব্দে বিরক্ত হয়ে বগলা গিন্নী মুখ ঝামটা লাগালেন       –‘যদি নাই তুলবে কেটেই দাও না দেখি’।

বগলা দোনোমনো করে বলল –‘সেটা কি ঠিক হবে? কালকেই যে ছোড়াটা তিন হাজার টাকা দিয়ে গেছে, কিন্তু ফোন ধরলেও ফ্যাচাং! খামোকা মাথা চেটে খাবে, কি যে বলব তাই ভাবছি? বগলা গিন্নী ফ্যানের রেগুলেটরটা ঘুরিয়ে স্পীড বাড়িয়ে বললেন                        –‘ওই সেই আধ-পাগলা গোছের ছোড়াটা যে সিনেমার হিরো হতে চায়’?

বগলা একটা অস্পষ্ট হ্যা বলতে গিন্নী বললেন –‘মিনুকে ডেকে বলছি সামলে দিক’। প্রস্তাবটা বগলার অবশ্য মনে ধরল, মিনু গিন্নীর বোনঝি বেশ ডাকাবুকো ধরনের, ছুটিতে মাসীর বাড়ি এসেছে, বুদ্ধির মতো খান চারেক ছেলে ছোকরাকে তুড়ির টুসকিতে উড়িয়ে দেওয়াটা ওর কাছে যে ছেলেখেলা সে বিষয়ে বগলা একপ্রকার নিশ্চিত।

ওপার থেকে নারীকন্ঠ ভেসে এলো –‘হ্যালো’।

বুদ্ধি –‘বগলাবাবু আছেন’?

-‘হ্যা’।

-‘একটু ডেকে দিন’।

মিনু বগলার শেখানো বুলি আউড়ে বলল –‘উনি এখন জলে গলা ডুবিয়ে রয়েছেন ডাকা যাবে না’।                                                                                  বুদ্ধি উৎসাহিত হয়ে বলল –‘মানে ঈশান কোনেই আছেন তো’?

-‘হবে হয়ত ঈশান কোনেই’।

-‘আর সর্বসিদ্ধি মহামন্ত্র জপ করছেন তো’?

-‘করছেন হবে, এখান থেকে ঠিক শোনা যাচ্ছে না’।

-‘আচ্ছা উনি কি খালি গায়ে রয়েছেন’।

–‘হ্যা আর কিছু’? মিনুর স্বরে এবারে বিরক্তির আভাস।

বুদ্ধি সোৎসাহে বলল –‘জলের মধ্যে একটু উকি মেরে যদি দ্যখেন, উনি পুরো ন্যাংটা? সরি মানে উলঙ্গ দেহে রয়েছেন কি-না’? কথার মানে হৃদয়ঙ্গম করতে মিনুর একমুহুর্ত সময় লেগেছিল তার পরেই হুংকার ছেড়ে বলল –‘ওরে শয়তান সুন্দরী যুবতী পেয়ে তুই বদমাইশি জুড়েছিস’?

বুদ্ধি থতমত খেয়ে বলল –‘কই না তো তেমন কোন ইচ্ছে তো ছিল না’।

মিনু ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার জুড়ল –‘হারামী কোথাকার তোর মতলব আমি ভালোই বুঝেছি, জুতোপেটা করে তোর মুখ ছিড়ে দেব’।

বুদ্ধি আত্মরক্ষার চেষ্টা করল –‘মুখ সামলে কথা বলুন, হাতের আংটি বেচে টাকা দিয়ে এসেছি এ কাজের জন্য। আমার পুরো রাইট আছে জানবার’!  মিনু বাঘিনীর মতন গর্জন করে বলল –‘টাকা দিয়ে তুই মেয়ে-মানুষের রাইট কিনবি! শুঁয়ার, শুওরের বাচ্চা, একবার তোকে হাতের মুঠোয় পাই পাড়ার ছেলেদের দিয়ে যদি তোর নলি না ভেঙ্গেছি’। বুদ্ধির আর নেবার ক্ষমতা ছিল না, কাঁপুনি ধরা হাত থেকে মোবাইলটা সশব্দে ফুটপাথের ওপর পরে গেল। প্রতাপ কাছাকাছির মধ্যে এসে পরেছিল বুদ্ধির দিকে তাকিয়ে বলল –‘কি হল, মুখ ঝুলে গেল কেন’? বুদ্ধি হাসার চেষ্টা করল কিন্তু ঘাবড়ে যাওয়া মুখে হাসি ফুটলনা, ঢোঁক গিলে বলল –‘এমনিই’।

লাঞ্চ ব্রেক শেষ হল। দরজা খুলে গেল লিস্ট হাতে দারোয়ান হাঁক পাড়ল ‘উনপঞ্চাশ কে আছো চলে এসো’। বুদ্ধি তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে পেন্নাম ঠুকে অডিশন রুমে ঢুকে পড়ল।

অডিশন রুমে একটা বড়সড় টেবিলের ওদিকে তিনজন বসে নিজেদের মধ্যে তীব্র আলোচনায় মগ্ন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা একজন ভদ্রলোক বসে রয়েছেন যার এক দিকে মাঝবয়েসি কাঁচাপাকা চুলের রোগাসোগা একটা লোক অন্যদিকে বছর পঁচিশের স্মার্ট চেহারার একটি তরুণী। বুদ্ধি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, এদের কারো যেন কোন হুঁশ নেই যে ওদের ডাকে বুদ্ধি অডিশন দিতে হাজির হয়েছে। ওদের কথার কিছু কিছু বুদ্ধির কানে আসতে লাগল। রোগা লোকটা বলছে –‘তেমন ভালো ঘোড়া যোগার না হলে কালকের শ্যুটটা পোস্টপোন করতে হবে’। ফ্রেঞ্চকাট তীব্র আপত্তি করে বলল –‘এসব কথা আমি শুনতে চাই না ঘোড়া আমার চাই আর সেটা কালকের মধ্যেই, বিমলকে বলো যেখান থেকে পারুক যোগার করুক’। হঠাৎ ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধির ওপর তিনজনের নজর পড়ল। মেয়েটা অবজ্ঞার স্বরে বলল –‘সুমিতদা সকাল থেকে একটা সিঙ্গল ইন্টারেস্টিং মুখও আসছে না আমার কিন্তু এবারে টায়ার্ড লাগতে শুরু করেছে’। ফ্রেঞ্চকাট স্বর উঁচিয়ে বলল –‘দেখি আই ডি কি আছে’?       বুদ্ধি নিজের পরিচয়পত্র ফ্রেঞ্চকাটের হাতে তুলে দিল। রোগা লোকটা জিগ্যেস করল –‘নাম বলুন’?

-‘হিরঞ্জিত স্যার’।

-‘হরিণজিত’!

-‘হরিণ নয় স্যার, হিরণ! মানে পুরোটা হচ্ছে হিরণ+জিত = হিরঞ্জিত’।

ফ্রেঞ্চকাট বুদ্ধির কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল ভ্রু কুঁচকে বলল –‘কিন্তু আপনার ভোটার কার্ডে তো লেখা আছে বুদ্ধিনাথ সরখেল’?

বুদ্ধি তেল দেওয়া হাঁসি হেঁসে বলল –‘ওই নাম কি ফিলম্‌ লাইনে চলে স্যার, এটা আমার স্ক্রীন নেম’।

-‘কি জানা আছে শুনি? নাচ গান অভিনয়’!

-‘স্যার আমি নাচও পারি গানও জানি আর অভিনয়! সে তো আমার রক্তে’।

-‘কিরকম’?

-‘আমার বাবা স্যার, নাম শুনে থাকবেন সিদ্ধিনাথ সরখেল, যাত্রার নামি অ্যাক্টর ছিলেন, নরকের দ্বারে পিতাপুত্র পালায় একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছিল’। ফ্রেঞ্চকাট গলায়  বিরক্তি ঢেলে বলল –‘নিজের কথা বলুন, এখন একটা ইমোশনাল সিন করে দেখাতে পারবেন’?  বুদ্ধি বুক ভর্তি অক্সিজেন টেনে শুরু করে দিল। প্রিয় নায়ক যুধাজিত অভিনীত ছবি বনের মানুষের চোখে জল এনে দেওয়া একটা দৃশ্য। আবেগ যেন বন্যার জলের মতো বাধ ভেঙে বুদ্ধির ছাতি ফেটে বেড়িয়ে আসতে লাগল। সংলাপের তোড়ে অডিশন হলের ভিতরটা একেবারে গমগম করতে লাগল।

হঠাৎ ফ্রেঞ্চকাট বুদ্ধির আওয়াজের ওপর বাজখাই চেচিয়ে বলল          –‘হয়েছে হয়েছে আর দরকার নেই, অভিনয় যাহোক চলে যাবে কিন্তু আপনার থোবড়াটা বড়োই বেয়াড়া গোছের কেমন যেন ঘোড়ামুখো হিরো আপনাকে মানাবে না’। বুদ্ধির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল –‘একটু দয়া করুন স্যার দু বছর টালিগঞ্জ পাড়ায় ঘুরছি একটা চান্সের জন্য যে কোন রোল পেলেই ফাটিয়ে দেব’। ফ্রেঞ্চকাট আপত্তিসূচক মাথা নেড়ে বলল –‘বললাম তো হবে না জায়গা খালি করুন,  বাইরে আরও অনেকে অপেক্ষা করছে’। বুদ্ধি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যাচ্ছিল হঠাৎ কি মনে হতে পিছন ফিরে বলল –‘স্যার একটা কথা বলব’?

-‘আবার কি চাই’?

-‘মানে ওই আপনি বললেন না আমার মুখটা ঘোড়ার মতো আর তখন কানে এলো ভালো ঘোড়া আপনাদের এখনো যোগার হয়নি মানে স্যার যদি ওই ঘোড়ার পার্টটা আমি পেতাম’। ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে আঙুল বুলিয়ে বলল –‘দ্যাটস্‌ নট অ্যা ব্যাড আইডিয়া সেটা হতেই পারে’। পাশে বসা রোগা লোকটা যার নাম অনিরুদ্ধ, বলল –‘আচ্ছা ভাই, ঘোড়া যে হবে বলছ তা এখন আমাদের পিঠে করে একচক্কর ঘুরিয়ে আনতে পারবে’? বুদ্ধির বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠল হয়েছে আর কি! দাড়ি ওয়ালাটার যা দশাসই গতর আর ওই  অনিরুদ্ধই বা কম কিসে? দুটো মিলে দেড়শ কিলোর কমে কিছুতেই হবেনা। তবে সুন্দরী মেয়েটি যদি ঘাড়ে উঠতে চায় তবে একটা চেষ্টা করে দ্যাখা যেতেই পারে।  ঢোক গিলে বুদ্ধি বলল       –‘মানে স্যার কয়েকদিন হল ঘাড়ে একটা ব্যাথা বড় ভোগাচ্ছে, মানে’! অনিরুদ্ধ হাত তুলে বুদ্ধিকে থামিয়ে বলল –‘হয়েছে তোমার দৌড় আমার বোঝা হয়ে গেছে এবারে ঘোড়ার মতো ছুটে বাইরে চলে যাও দেখি’। মেয়েটি হঠাৎ ফিচেল হাঁসি হেঁসে বলল –‘অবশ্য গাধার একটা পার্ট আছে করবে ভাই, তবে এখন কিন্তু একবার গাধার মতো নর্তন কুর্দন করে দেখাতে হবে এই যা’। বুদ্ধি অনেক আগে একবার গাধা দেখেছিল, মনে মনে গাধার হাবভাব আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল তখুনি অনিরুদ্ধ বলে উঠল –‘কি হল এতো ভাবার কি আছে, ডেমো না দেখলে বুঝব কি করে তোমাকে দিয়ে হবে কিনা’। অনিরুদ্ধের গলার সুরটা হঠাৎ কেমন যেন ঠেকল, বুদ্ধি ভালো করে তাকিয়ে দেখল ফ্রেঞ্চকাট অনিরুদ্ধ আর মেয়েটি প্রত্যেকেই যেন হাঁসি চাপার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সবটাই মস্করা! বুদ্ধির গা জ্বলে গেল। সংযম হারিয়ে চেঁচিয়ে উঠল –‘চালাকি! অ্যা মস্করা যত্তসব’! ফ্রেঞ্চকাট মাছি তাড়াবার মতো করে বলল –‘বাইরে, বাইরে। গেট আউট আই সে’। বুদ্ধি তেড়েমেরে কিছু বলতে যাচ্ছিল, ফ্রেঞ্চকাট হাঁক দিল –‘অর্জুন সিং ইসকো বাহার নিকালো’। পালোয়ানের মতো চেহারার অর্জুন সিং এসে হাজির হতেই বুদ্ধি আর দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ মনে করল না। একরাশ অপমান মাথায় নিয়ে বুদ্ধি ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলো। সাথে সাথে প্রতাপের ডাক পড়ল।

বুদ্ধির প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল, ইচ্ছে করছিল এখুনি চলে যেতে কিন্তু প্রতাপের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে তাই নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

প্রতাপ ঢুকেছিল উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে ফুটতে আর মিনিট পনের পর যখন বেড়িয়ে এলো তখন তার অবস্থা যেন চুপসে যাওয়া একটা বেলুনের মতো, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল –‘ঢুকতেই মেয়েটা বলল, -অ্যাক্টিং দেখে দেখে ভীষণ টায়ার্ড লাগছে ভাই, তুমি বরং বেশ কড়া করে ডান্স লাগাও দেখি, তো ওদের খুশি করার জন্য ঢিমেতালে সবে শুরু করেছি আস্তে আস্তে স্পীডও নিশ্চয়ই বাড়াতাম কিন্তু তার আগেই দাড়িওয়ালাটা অসভ্যের মতো চেচিয়ে উঠল, এমন পোয়াতি মেয়েদের মতো কোমর দোলাচ্ছিস কেন রে? জোরসে লাগা! বাধ্য হয়েই জান-প্রান ঢেলে বেদম নাচ লাগালাম আর ওরা তিনজন টেবিলে তাল ঠুকতে লাগল, নাচতে নাচতে একসময় মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল, গলা শুকিয়ে কাঠের মতো লাগছিল, মনে হচ্ছিল এবার বোধহয় অজ্ঞান হয়েই পরব, এমন সময়  দাড়িওয়ালার ফোন বেজে উঠল, লোকটা কার সঙ্গে মোবাইলে কথা শুরু করল, কানে যা  ঢুকল প্রোডিউসারের ভাগ্নে হিরো হবে ঠিক হয়েছে, তাই অডিশন ক্যান্সেল। ওরা আমাকে বলল ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে’।  প্রতাপের শেষের কথাগুলোয় ভিড়ের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল, অনেকেই মেনে নিতে নারাজ এই অডিশন এখন প্রহসনে পর্যবসিত হয়েছে।

এমন সময়ে চোঙ্গা হাতে অর্জুন সিং এসে ঘোষণা করল বিশেষ কারনে আজকের অডিশন এখানেই বাতিল করা হল, যারা এখনো ডাকের অপেক্ষায় বসে আছেন তারা সবাই বাড়ি যেতে পারেন। পেটমোটা লোকটা আবার ফেরত এসেছে চিৎকার করে বলল –‘বলেছিলাম না ভাইসব এই অডিশন লোক দেখানো ভাওতাবাজি ছাড়া অন্য কিছু নয় আমাদের সময় আর পয়সা নিয়ে ছেলেখেলা, আমাদের বোকা বানিয়ে কিছু লোক নিজেদের কাজ হাসিল করে নিল আর আমরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে তামাশা দেখছি’। বুদ্ধি হতাশ ভাবে মাথা নেড়ে বলল –‘কিন্তু আমরা কিবা করতে পারি? একটু দূরে দাড়িয়ে অর্জুন খৈনি ডলছিল, হাতের তেলোতে চাপড় মেরে ভিড়ের দিকে চেয়ে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে উঠল         –‘শো খতম চলো ভাগো সব ইহাসে’। এবার যেন আগুনে ঘি পড়ল। ভিড়ের মধ্যে থেকে চিৎকার উঠল –‘মার শালাকে পেদিয়ে সর্ষেফুল দেখিয়ে দে’। ভুড়িওয়ালার তাগাদা দেখা গেল অন্য সবার থেকে বেশি। লোকটা থপথপ করে ছুটে গিয়ে অর্জুন সিংএর গালে সশব্দে একটা চড় কষিয়ে দিল।  ভ্যাবাচাকা খাওয়া অর্জুন সিংএর হাত থেকে খৈনী ছিটকে পড়ে গেল, তবে একমুহুর্ত পরেই সামলে উঠে অশ্রাব্য গালাগালী দিতে দিতে মারমুখী ভঙ্গিতে ভুড়িওয়ালার দিকে এগোতেই লোকটা কুঁকড়ে একসা হয়ে পিছন ফিরল জমায়েতের দিকে চাইল, ভাবখানা এমন তাড়াতাড়ি এসো ভাইসব আর দেরি কোর না। অর্জুন সিং দারুন জিঘাংসায় মোটা মোটা আঙুল দিয়ে লোকটির ভুঁড়ি খামচে ধরতেই সে এবার ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার শুরু করল। বুদ্ধির ভিতর একটা প্রচন্ড রাগ এতক্ষণ তোলপাড় করছিল। আজকের এই হেনস্থার জন্য সে এবার অর্জুন সিংকেই দায়ী করল। তিরবেগে ছুটে গিয়ে অর্জুনের নাকের গোঁড়ায় একটা ঘুষি বসিয়ে দিতেই অর্জুন নাক ধরে ‘মর্‌ গ্যায়া রে’ বলে মেঝে নিল। একমুহুর্ত আগে কাতরানো মোটা লোকটি এবারে হঠাৎ সিংহের মতো গর্জন করে ধরাশায়ী অর্জুনের ওপর চেপে কাঁধের পাশে নরম জায়গায় কামড়ে ধরল। আরও দুতিন জন এসে সমবেত ভাবে কিল চড় চালাতে লাগল।

গোলমালের শব্দ পেয়ে অনিরুদ্ধ বাইরে বেড়িয়ে এসেছে। পরিস্থিতি আঁচ করতে বেশি সময় লাগল না কিন্তু ততক্ষনে সুযোগ-প্রার্থী কয়েকজন তার পিছনে পড়ে গেছে। প্রান হাতে নিয়ে ছুট লাগিয়ে অনিরুদ্ধ কোনরকমে ভিতরে ঢুকে গেট বন্ধ করে দিল। বন্ধ দরজার ওপর দমাদ্দম লাথি পড়তে লাগল। বুদ্ধির ইচ্ছে করছিল অনিরুদ্ধ আর ওই ফ্রেঞ্চকাট দুজনকেই ঘা-কতক কষিয়ে দ্যায়। সেও এবার বন্ধ দরজা ভাঙার কাজে হাত লাগাল, কাঠের দরজা আর কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে? একসময় ঘা খাওয়া  দরজাটা হুরমুরিয়ে ঘরের মেঝেতে আছড়ে পরল। ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বিজয় উল্লাস উঠল এবারে ফ্রেঞ্চকাট আর শুটকোকে গুছিয়ে ধোলাই করা যাবে, অনেকেই ঘরের মধ্যে ছুটে ঢুঁকে গেল, বুদ্ধিও সে দলে ভিড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু পিছন থেকে কেউ তার জামা চেপে ধরল, প্রতাপ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল –‘গলির মুখে পুলিস এসে গেছে, চল এক্ষুনি পালাতে হবে’। পুলিসের নাম শুনেই অবশ্য বুদ্ধির রাগ জল হয়ে যেতে দেরি হল না, গলির অন্য প্রান্ত থেকে ততোক্ষণে সাদা উর্দির ঝলক দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধি আর প্রতাপ বা-পাশের সরু গলিটা দিয়ে পাইপাই ছুট লাগাল, দুটো বাঁক খেয়ে বড়রাস্তায় এসে হাঁপ ছাড়ল।

হাওড়া স্টেশন থেকে ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনটা যখন ছাড়ল, বুদ্ধি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল –‘জানতাম কিছুই হবে না, মাঝখান থেকে সোনার আংটিটা গেল, ওই জ্যোতিষীটা আমাকে ঠকিয়েছে’। পাশে বসে প্রতাপ ম্রিয়মান স্বরে বলল –‘আমারও তো সাইকেলটা গেছে, অডিশন দেবো বলে জিনস্‌ আর টি-শার্ট কিনতে ফালতু টাকা খরচ হয়ে গেল। দুই বন্ধুর হতাশ চোখের সামনে ট্রেনটা এবারে বালি ষ্টেশনে এসে পৌঁছল।

 

লেখক পরিচিতি : সঞ্জয় ভট্ট্যাচার্য

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here