শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে এক নদী, যা দুই অঞ্চলের লোককে আলাদা করে রেখেছে। অবশেষে ঠিক হল একটি সেতু নির্মাণ হবে যা দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সংযোগ ঘটাবে। সব ঠিক হয়ে গেল, কাজ শুরু হবে এবার। একজন ব্যবসায়ী ঠিক করলেন সেখানে একটি রিসোর্ট করবেন। নদীর ধারে মনোরম পরিবেশে সবাই ঘুরতে আসবে। ম্যানেজার বললেন, “যতদিন ব্রিজ না হচ্ছে হোটেল হিসাবে সেল ভালোই হবে। ব্রিজের শ্রমিকদের থাকা খাওয়া হবে, আর ব্রিজ শেষ হতে হতে ততদিনে রিসোর্ট নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে”।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হল আর এদিকে হোটেল। ইঞ্জিনিয়ার সহ সমস্ত শ্রমিকরা সেখানে থাকতে খেতে লাগল। বেশ লাভ হতে লাগল দুপক্ষেরই”। গৌতমবাবু ওই ব্যবসায়ীর খুব বিশ্বস্ত লোক, প্ৰথম থেকেই হোটেলে থাকেন ব্যবসা সামলান। হোটেলের অন্য কর্মচারীরা শ্রমিকদের খাবার পরিবেশন করলেও হেড ইঞ্জিনিয়ারকে গৌতমবাবু নিজে ভাত চা সব পরিবেশন করতেন, আর ‘স্যার’ বলে সম্ভাষণ করতেন।
সেতু নির্মাণের আগেই রিসোর্ট পূর্ণতা পেল, সেতুর কাজও প্রায় শেষের দিকে। হোটেলের পিছনে সুন্দর বাগান, তাতে চেয়ার ছাতা লাগানো গোল টেবিল বিছিয়ে দেয়া, সত্যি মনোরম পরিবেশ। প্রেমিক প্রেমিকারা আসছে দলে দলে সময় কাটাতে, মালিক দেখে বেশ খুশি। মালিক বললেন, “সেতু নির্মাণ হয়ে গেলে লোক আরও বাড়বে”।
অনেক গোল টেবিলের মাঝে একটি সুন্দর টেবিল চেয়ার রাখা হয়েছে। সন্ধ্যায় হেড ইঞ্জিনিয়ার সুশীলবাবু চা পান করতে এসে অবাক হয়ে গেলেন। গৌতমবাবু চা নিয়ে এলে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওই টেবিলটা কিসের জন্য?”
“আজ্ঞে বিশেষ অতিথিদের জন্য ওটা। আজ স্থানীয় এম.এল.এ সাহেব আসছেন। বুঝতেই পারছেন”,
সুশীল হেসে বলল, “ হ্যাঁ বুঝেছি। না বুঝে উপায় আছে?”,
গৌতমবাবু চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে অতিথি এলেন, ওই টেবিলে বসলেন, মালিক নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করলেন তাকে”, বিরাট ব্যাপার একটা। রিসোর্টটা নতুন চালু হয়েছে তাই প্রচারের জন্য এনাদের মতো ব্যক্তিদের আনা এখানে।
দ্বিতীয় দিন আবার সেজে উঠেছে সেই টেবিল, এলেন আর এক অতিথি।
কোটিপতি মালিক ঠিক একই রকম করে তাকেও খাবার পরিবেশন করে দিলেন, গৌতমবাবু গেলেন সুশীলবাবুকে চা দিতে।
সুশীল আবারও প্রশ্ন করল, “আজ যিনি এসেছেন উনি কে?”
গৌতমবাবু বললেন, “উনি ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। এই রিসোর্ট বানানোর জন্য মালিককে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে”।
“ও আচ্ছা”, গৌতমবাবু চলে গেলেন।
তার পরদিন আবার একই ঘটনা আর মালিকের একই আচরন লক্ষ্য করল সুশীল।
গৌতমবাবু  চা দিতে গেলে, সুশীল একই প্রশ্ন করল তাকে।
“উনি আমাদের এখনকার একজন বড় ডাক্তার। স্যারের মায়ের চিকিৎসা করতেন। প্রচন্ড ভিড় হয় চেম্বারে। স্যারের মা তো ওনার জন্যই টিকে ছিলেন বলতে গেলে”।
ঠিক পরদিন একই ঘটনা একই প্রশ্ন সুশীলের।
গৌতমবাবু বললেন, “আজ্ঞে উনি একজন উকিল।  এনাদের বাধা বলতে গেলে পরিবারেরই একজন হয়ে গেছেন এখন। বড়লোকের ব্যাপার বুঝতেই পারছেন একটা না একটা ঝামেলা লেগেই থাকে তাই সব উনি সামলান”।
একদিন এলেন এক পুলিশকর্মী, মালিক খুব করে তেলিয়ে তাকে খাবার পরিবেশন করলেন।
গৌতমবাবু চা দিতে গেলে সুশীল জিজ্ঞাসা করার আগেই তিনি বললেন, “উনি এখনকার থানার ওসি। এই জমি পাইয়ে দিতে বিশেষ সাহায্য করেছেন। বুঝতেই পারছেন এত কৃষক সবাইকে রাজী করিয়ে জমি পাওয়া”,
“হুম বুঝলাম”, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল সুশীল,
“ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলে এনাদের একটু তেল মেরে রাখা বুঝতেই পারছেন”,
“হুম হুম খুব বুঝেছি আর বলতে হবেনা”, সুশীলের কথা শেষ হবার পর গৌতমবাবু চলে গেলেন।
আজ সুশীলের শেষ দিন এই রিসোর্টে, কাজ শেষ। কাল সকালেই মন্ত্রী আসছেন সেতু উদ্বোধন করতে। এই রিসোর্টে কিছু সময় কাটিয়ে যাবেন তিনি।
সেদিন এসেছেন এক বিশেষ অতিথি, গৌতমবাবু এলেন সুশীলকে চা দিতে।
গৌতমবাবু বললেন, “উনি আমাদের এখানকার কলেজের প্রিন্সিপাল। খুব নামী শিক্ষক, ব্যাচে জায়গা হয়না। স্যারের মেয়েকে তো উনিই মানুষ করেছেন। তবে কী জানেন মানুষ হিসাবে একদম ভালো নন উনি”,
চায়ে প্রথম চুমুক দিয়ে সুশীল বলল, “কেন?”,
“জানেন উনি খুব অর্থলোভী মানুষ। আমার মেয়েকে পড়ানোর জন্য বলেছিলাম, কিছুতেই ফিস কমালেননা। বলুন তো এত ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে একজন ফ্রি তে পড়লে কি বিশাল অভাব নেমে আসত?”
সুশীল হাসল আর বলল, “ওদেরই বেশি অভাব গো। আমরা উদার, যার পয়সা যত বেশি সে তত অভাবী এ সমাজে”।
মাথা নিচু করে চলে গেলেন গৌতমবাবু, চা খেয়ে উঠে পড়ল সুশীল।
মনে মনে ভাবল পুলিশ এল,উকিল এল, ডাক্তার এল, শিক্ষক এল, এমনকি রাজনৈতিক নেতাও এল কিন্তু একদিনও সে দেখলনা যে একজন ইঞ্জিনিয়ারকে এনে মালিক ওইরকম সম্মান দিয়েছেন। ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে গেল বাইরের দিকে। মালিক আর শিক্ষক মহাশয়ের একসাথে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া চলছে এক টেবিলে।
শিক্ষক মহাশয় বললেন, “যাই বলুন না কেন এই ব্রিজের হেড ইঞ্জিনিয়ারকে আপনার একটা ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ”,
“কেন বলুন তো ? উনি তো কোম্পানি থেকে বেতন পাবেন যথেষ্ট”, মালিক জিজ্ঞাসা করলেন।
“তবুও। এখানে ব্রিজ বানানো কি চারটি খানি কথা ? বেতন তো আমিও নিয়েছি, আপনার মেয়েকে পড়িয়েছি তা আপনি আজ আমাকে ডাকলেন না?”
দাঁড়িয়ে সব শুনল সুশীল, তারপর মনে মনে হাসতে হাসতে এগিয়ে চলল ব্রিজের দিকে। মনে মনে ভাবল কেউ তো অন্তত তার কথা ভেবেছে। তাকিয়ে দেখল ব্রিজের দিকে, তার এতদিনের পরিকল্পনা শ্রম যেন সার্থক হল আজ। একটা সিগারেট ধরিয়ে উঠল ব্রিজে তখনও যান চলাচল শুরু হয়নি সেতুর উপর। সিগারেট ধরিয়ে চলতে চলতে একসময় নজর পড়ল সেই কাপড়ে ঢাকা সেই শিলাটির দিকে, কাল মন্ত্রী এসে উদ্বোধন করবেন। খুলে দেখল মন্ত্রীর নাম কবে স্থাপিত আরও দুএকজন নেতার নাম রয়েছে কিন্তু তার নাম নেই। কী আর করা যাবে এটাই তো নিয়ম ইঞ্জিনিয়ারের নাম আর কোথায় থাকে, তারা তো বেতন নেবে। বেতন নিলেই সব সম্পর্ক যেন শেষ।
পিছন থেকে একজন ডাকল তাকে, ঘুরে তাকিয়ে সুশীল দেখল আর কেউ নন উনি রিসোর্টের মালিক।
“আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এলাম”, তিনি বললেন,
“কিসের জন্য?” সিগারেটটা ফেলে দিয়ে প্রশ্ন করল সুশীল,
“এই এত ব্রিজ নির্মাণ করার জন্য। আপনার জন্য আমার এই রিসোর্টও ভালো চলবে আরো”,
“তাই নাকি?”, হেসে বলল সুশীল,
“হ্যাঁ” মালিক বললেন।
“সত্যিই কি তাই? নাকি ওই মাস্টারমশাই বললেন বলে?”
মালিক ভ্রু কুঁচকে বললেন, “মানে?”
“আসল কথাটা কী জানেন। আমরা ইঞ্জিনিয়াররা বেশিরভাগ কাজই  করি মানুষের জন্য তথা সর্বোপরি রাষ্ট্রের জন্য। ব্যক্তিগত উপকারে তেমন লাগিনা। তাই আপনার মত মানুষরা আমাদের চেনেন না। নইলে এতদিন হল আমরা এসেছি একদিন ও আপনি আলাপ করতে এলেননা আমাদের সাথে, আজ উনি বললেন বলে এলেন নইলে হয়ত আসতেননা। আমাদের কাজকে সবাই দেখে গুনগান করে কিন্তু আমাদের নয়। আমাদের খ্যাতি ওই অফিসের চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
পুলিশ বাজারে গেলে তাকে সবাই স্যার বলে, ডাক্তার গেলে বলে আসুন ডাক্তারবাবু, শিক্ষক গেলে বলে মাস্টারমশাই। কিন্তু আমরা গেলে ও দাদা, ও ভাই ব্যাস। আমাদের কেউ চেনেইনা তো বলবে কী?”
মলিকের মাথা নিচু হয়ে গেল, কী বলবেন খুঁজে পেলেননা।
পরদিন সুশীল স্নান সেরে সুন্দর পোশাকে বেরিয়ে এল রিসোর্ট থেকে। রিসেপশন আসতেই দেখে, মালিক গৌতমবাবু আর একজন ফটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে আছেন ক্যামেরা নিয়ে।
“কোন টাকা পয়সা বা বিল বাকী আছে নাকি?” সুশীল জিজ্ঞাসা করল,
“আপনার সমস্ত বিল কোম্পনি দিয়ে দিয়েছে স্যার। কিন্তু আমাদের স্যার তা পুনরায় ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন”,
“কেন?” সুশীল বলল,
মালিক সুশীলের হাত দুটো ধরে বলল, “আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন স্যার।  চারদিকে এত টেকনোলজি স্থাপত্য নির্মাণ হয়েছে তা দুচোখ ভরে আমরা দেখি উপভোগ করি কিন্তু যারা বানলো সেই বিশ্বকর্মাদের আমার ভুলে যাই, যোগ্য সম্মান দিনা আমরা। আপনার একটা ছবি তুলতে পারি স্যার?”
সুশীল মাথা নিচু করে থাকল বলল, “কেন হঠাৎ ছবি?”
“আমাদের এই রিসেপশনে রাখব স্যার। আজ রাতটা অন্তত থেকে যান স্যার। আজকের বিশেষ অতিথি আপনি স্যার”,
“সেকি আজ মন্ত্রী আসছেন। ওনাকে বাদ দিয়ে আমি?”, হেসে বলল সুশীল,
“উনি তো সন্ধ্যার আগেই চলে যাবেন স্যার। আমাকে এই সেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেননা স্যার”।
“আমার মতো লাখ লাখ ইঞ্জিনিয়ার আছে, আমার থেকেও দক্ষ তারা। পারবেন সবাইকে বিশেষ অতিথি করতে? পারবেননা। তবু ভালো লাগল আপনার চিন্তা বদলেছে দেখে,নিজে বদলালে তবেই বদলাবে দেশ।”
“নিন দাদা তুলুন ছবি”, ফটোগ্রাফারকে বলল সুশীল, ছবিও উঠল।
মালিক বললেন, “আজ থেকে আজ রিসোর্টের নাম সুশীল রিসোর্ট”,
“না।আমার আপত্তি আছে”, সুশীল বলল
“আপত্তি? কেন স্যার?”, মালিক বললেন
“যদি রাখতেই হয় তাহলে নাম দিন দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স রিসোর্ট। সম্মান দিতে হলে শুধু আমাকে  নয় সমগ্ৰ শ্রেণীকে সম্মান দিন”
“তাই হবে। এরপর যদি কোন ইঞ্জিনিয়ার এখানে আসেন তিনি হবেন আমাদের বিশেষ অতিথি”,
“এই শেষ কথাটা শুনে মন ভরে গেল”, সুশীল বলল।
একবছর পর সুশীল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুটি কাটাতে গেল ওই রিসোর্টে। ঘর বুকিং আগেই করা ছিল তাই সবাই জানত সে আসবে। মালিক বিশেষ সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করেছিলেন, তাকে স্বাগতম জানাল সবাই। ভিতরে ঢুকে দেখল রিসেপশণে আজ বাঁধানো আছে তার ছবি। আজও মালিক কথামতো নামটাও দিয়েছেন দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স রিসোর্ট”।
এখন লোক সংখ্যাও বেড়েছে নদীর দুই পরের লোকই আসছেন এখানে, সবার সুবিধা হয়েছে এই রিসোর্ট হয়ে।

কলমে অনীশ ব্যানার্জ্জী, বর্ধমান


লেখালেখি আমার একটা নেশা যেটা ছোটবেলা থেকেই চেপে বসে আছে। কখনও বাড়ে কখনও কমে। প্রথম কবিতা লেখা ২০০৫ সালে বয়স তখন মাত্র সাত। অনেক লেখকের বই পড়েছি তবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটু বেশিই টানেন আমাকে কারন ওনার লেখা সহজ সরল অথচ বাস্তবসম্মত। সাহিত্যে জ্ঞান কম তাই সহজ ভাষাতেই লিখতে হয়, যা ভাবনা তাই ফুটে ওঠে কলমে। বর্তমানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরির সন্ধানে আছি আর অবসরে এই লেখা। বর্তমানে ইন্টারনেট সোশ্যাল মিডিয়ায় যুগে বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় লেখা পাঠাই অধিকাংশই নির্বাচিত হয়। প্রশংসা সম্মান পাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থ চাইনা শুধু মানপত্রগুলো রেখেদি দেওয়াল পত্রিকার মত করে আটকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here