আত্ম কথন
লেখার স্থান:লেট শহীদ এক্সপ্রেস (১২ই অক্টোবর ,১৮)
পুজোর ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে আজ অফিসের শেষ দিন ছিল। কদিন থেকে সহধর্মিনী
আমার কিছু পোষাক ,”কবে কিনবো, কবে কিনবো” বলে অস্থির হয়ে শেষে “বুঝে করো গে যাও”বলে চুপ করেছে ।ওই কিনছি কিনবো বলে কোনো হেলদোল দেখাতে সত্যিই ইচ্ছা করে নি,আর তাছাড়া প্রয়োজন হলেই তো কিনি।
আজ শেষ দিনের অফিসে একটা উড়ু উড়ু কাজের পরিবেশ ছিল আর কিছু টেবিলে বেশ ব্যস্ততা।আমার তো ছিলই,যেখানে যা কিছু পেন্ডিং কাজ এমনকি আমার এল আই সি প্রিমিয়াম টাও জমা দেবার ব্যবস্থা করে এলাম এক ফাঁকে। গিন্নি ফোন করে রিমাইন্ডার দিলো,আজ কি জলদি আসবে,কবে কিনবে তুমি? যখন পরিচিত কেউ আমায় ফোন করে,আমি কল্পনায় দেখতে ভালোবাসি সে কেমন করে কথা বলছে। কখনো ছবি ভাসে তার চোখ পাকিয়ে বলার ভঙ্গি,কখনো ঘুরতে ঘুরতে তার কথা বলা।স্বাভাবিক ভাবেই কোনো সদুত্তর না পেয়ে আমার উনি তো কল কাটলেন।
সত্যি বলতে কি মনের কোনে ইচ্ছা ছিল,একটু জলদি ফিরে সারপ্রাইজ দেবো, কিন্তু ওই যে “যাহা ভাবি তাহা হয় না” খবর পেলাম সাড়ে চারটে থেকে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছটা পর্যন্ত রেল লাইনে ব্লক থাকবে! ব্যস হয়ে গেল আর কি ,আমার উৎসাহের দফা রফা! অফিস ছুটি হলো, সবাই গল্প করতে করতে এই পুজোর কদিনের প্লান বলতে বলতে এক এক করে বিদেয় নিলো।আর আমি সারপ্রাইজ রচয়িতা হয়ে আমার অফিস চেয়ারে বসে মোবাইল নিয়ে গুলতানি।
ঝির ঝির বৃষ্টি,একটু আধটু সকালে ভিজে, শরীর টা যেন আর চলছিল না! বুঝতে পারছি ভেতরে জ্বর অল্প হলেও থাবা বসিয়ে উদ্যমতা কেড়েছে।চোখের পাতা গুলো ক্লান্তিতে ভারি হয়ে আসছিলো। আলো ঝলমল একটা একটা করে প্যান্ডেল পার হচ্ছিল আর আমি পুজোয় সেজে ওঠা একটা মফস্বল শহরের আনন্দ ঘন রূপ রস পান করছিলাম। কিছু পরিবার শেষ মুহূর্তের কেনাকাটার ফিনিসিং টাচ দিচ্ছিল।আর এই সব দেখতে দেখতে স্টেশন হাজির।
লাইন ব্লক ওঠার আরো বেশ কিছুটা সময় বাকি।বাতাসে গরম চপ ভাজার গন্ধ পেয়ে ঘাড় ঘোরাতেই ভেতর টা বলে বসলো “খাবো খাবো”। চপ মুড়ি,পেঁয়াজ শসা কুচি আর লঙ্কা সহযোগে বিট নুন ছেটানো গরম চপ খেতে উদগ্রীব হলাম। ঠোঙা ভরে দোকানি অল্প বয়সী ছেলে টা,”এই নিন বাবু’ বলতেই ইচ্ছা হলো বলি,”বাবু কেনো রে, কে বাবু,দাদা বল,নিজেকে ছোট করিস না,না হয় পড়াশোনা করে চাকরি পাস নি,তেলে ভাজা দোকান দিয়েছিস।” দেখলাম দুটো পরিবার ঝক ঝকে পূজার ড্রেস আজ থেকেই পড়ে আর হাতে এত্ত বাজারের প্যাকেট নিয়ে চপ কিনছে!
দোকানি ছেলেটি ফাটা জামাটা আড়াল করতে করতে আর · গরম গরম চপ ভাজার তেলের কড়াই নাড়ছে এক মনে। মনে হচ্ছিল এক সময় পুজো নিয়ে ওর মনেও এমন গন গনে উত্তাপ হয়তো ছিল,আজ অস্তমিত।
স্টেশনের ভেতরে আলো আঁধারী তে বসে ভাবছিলাম এই পুজোতে কতো আনন্দ,মজার স্রোত,কত অর্থ ব্যয় তবুও পুজো ঘিরে কত মানুষের রুটি রুজিও। চপের তেল টা মুছতে মুছতে ট্রেন আসছে খবরের সাথে পা মেলাতে উঠে দাঁড়ালাম। মন বললো ,”আসুক ট্রেন,চল আলো ঝলমল শহর তো দেখলি,একবার সাধারণ প্রতিক্ষালয়ের অনাথ ভবঘুরে বয়স্কা ভিখারি গুলো কি করছে দেখে আসি।”সেখানে ঢুকতেই বুক টা ছ্যাঁত করে উঠলো, বড়ো বাল্ব টা কেটে গিয়ে কেমন একটা ভুতুড়ে অন্ধকার আর টিম টিম করে একটা পাঁচ ওয়াটের আলো জ্বলছে। মনে পড়লো কালকের পেপারে পড়ছিলাম,রেল ৭৮ দিনের বোনাস ঘোষণা করেছে উৎসবের দিনগুলোর আনন্দ কে মাথায় রেখে।আর মোবাইল টর্চ জ্বেলে অভাগী মুখ গুলোকে দেখার আর চেষ্টা করলাম না,মনে মনে বললাম,দুগ্গা মা গো, দুবেলা এদের খাবার টা জুটিয়ে দিও মা।”
—রাণা চ্যাটার্জী
পরিচিতি: ছোটবেলা থেকেই কবিতা,ছড়া, সৃজনশীলতার ওপর আত্মিক টান বর্ধমান শহর নিবাসী রাণা চ্যাটার্জীর।প্রতিভা,সারল্যের মেলবন্ধন ও অনুভূতিপ্রবণতায় অবিরাম সৃষ্টি করে চলেছেন কবিতা,ছোটগল্প,বাচ্ছাদের জন্য ছড়া, নিবন্ধ,কার্টুন। নক্ষত্রানি সম্মান,কবির “মেঘ বালিকা তোমায়”,”ছন্দ ছড়ায় জীবন” কাব্যগ্রন্থ ও নিয়মিত পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশ রাণা চ্যাটার্জী’র আগামী উজ্জ্বল করুক।
লেখকের আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন "দুর্ভোগের-লুপ-লাইন" "বনধ-অবরোধ" "পরকীয়া" "শ্রীমতির গল্প" "অথঃ-যাত্রী-কথা"
[…] আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন "পুজোর-গন্ধ" "দুর্ভোগের-লুপ-লাইন" "বনধ-অবরোধ" […]
[…] আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন "ধূসর-পৃথিবী" "পুজোর-গন্ধ" "দুর্ভোগের-লুপ-লাইন" "বনধ-অবরোধ" […]