এই মহাবিশ্বে পরম সত্য হলো প্রকৃতির নিয়ম। যা চরম ও নির্দিষ্ট। এই নিয়মের ঊর্ধ্বে কোনো কিছুই নয়। মহাকালের অনুষঙ্গে প্রকৃতি তার আপন নিয়মের খেলাই খেলে চলেছে সৃষ্টিলগ্ন থেকে। প্রকৃতি যেমন অতি বৃহৎ, তেমনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র! মহাবৈশ্বিক প্রকৃতির সর্ববৃহৎ অংশ গ্যালাক্সি ফিলামেণ্ট থেকে শুরু করে অতি ক্ষুদ্র অবপারমাণবিক কণিকা পর্যন্ত প্রকৃতি তার আপন নিয়মের খেলা খেলে চলেছে আপন খেয়ালে। মহাবিশ্বপ্রকৃতির একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ হলো আমাদের বিশ্বপ্রকৃতি। সেখানেও একই নিয়মের অনুশাসন। আমরা এই বিশ্বপ্রকৃতি তথা মহাজাগতিক প্রকৃতির প্রাণ নামক একটি জটিল জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার অংশ বিশেষ। যা এই প্রকৃতি প্রদত্ত চেতনার বিশ্লেষণী ক্ষমতার দ্বারা নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত। যা এই প্রকৃতির রহস্যময়তাকে অনুধাবনে সদা কৌতুহলী, উদগ্রীব ও অদম্য অনুসন্ধিৎসার অধিকারী এক সত্তা। অর্থাৎ আমরাও এই বৃহৎ প্রকৃতির সজীব অংশ যা প্রকৃতি প্রদত্ত চেতনায় ভরপুর হয়ে, প্রকৃতিরই রহস্য উন্মোচনে তৎপর। এ যেন প্রকৃতির নিজেই নিজেকে জানার একটি প্রক্রিয়া মাত্র! মহাবিশ্বের প্রতিটি জ্যোতিপুঞ্জের উত্থান পতন থেকে শুরু করে আমাদের দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু প্রকৃতির সুশৃঙ্খলিত সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পরিচালিত।

আমাদের পার্থিব প্রাকৃতিক পরিবেশে, বিশেষ কিছু প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক শর্তের ঘনীভূত আনুকূল্য লাভ আমাদের সৃষ্টি ও বিকাশের পথ সুগম করে। আমরা শেষ পর্যন্ত চেতনাধারী জীবনের আস্বাদন অনুভব করি। এই প্রাকৃতিক পরিবেশের সহচর্যেই আমাদের জীবন তাৎপর্যপূর্ণ অর্থবহ স্থিতিশীল। পরিবেশের সান্নিধ্য বিনা জীবন অস্তিত্বহীন। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীবনের আন্তঃসম্পর্ক আমাদের জীবিত অনুভূতিশীল চেতন সত্তা রূপে জাগ্রত রেখেছে। হোমো ইরেক্টাস এই পৃথিবীর বুকে কুড়ি লক্ষ বছরের অধিক টিকে ছিল। অস্ট্রালোপিথেকাস, হোমো ইরেক্টাস, নিয়াণ্ডারথ্যাল থেকে হোমো সেপিয়েন্সের সুদীর্ঘ যাত্রা পথের একমাত্র সঙ্গী ছিলো প্রকৃতি। প্রাকৃতির একান্ত প্রশ্রয় ও সহচর্যে মানব বিবর্তনের এই ধারা অগ্রগতি লাভ করে। মানব মস্তিষ্কের বিবর্তন “প্রাকৃতিক নির্বাচন” এ অনুমোদিত হয়। অবশেষে সহস্র কোটি স্নায়ু সমন্বিত একমাত্র চেতনাধারী প্রাণ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে মানুষ।

মনুষ্য চেতনার ক্রমবিকাশ ক্রমশই মানুষকে প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে দূরে সরিয়েছে। সম্প্রসারিত মেধাকে কাজে লাগিয়ে জীবনধারণের প্রক্রিয়াকে সর্বদাই নতুন রূপ দিয়ে চলেছে। জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শুরু হয়েছে প্রকৃতিকে ব্যাপক ভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যথেচ্ছ ব্যবহার করা। বিনিময়ে সভ্যতার উপজাত দ্বারা নির্বিচারে প্রাকৃতিক পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করা। ফল স্বরূপ বিশ্বপ্রকৃতির বাস্তুতান্ত্রিক সামঞ্জস্যতা বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ণ, ঋতু প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, ভারসাম্য রক্ষায় অণুজীবীয় বিবর্তন, বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষয়ক্ষতির পরিণতিতে অসংখ্য জীব প্রজাতির বিলুপ্তি, উচ্চ মেধার পারস্পরিক হানাহানিতে পরিবেশগত অবক্ষয়ের ফলে মানুষ্য প্রজাতির অস্তিত্ব সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন। যে প্রকৃতি প্রদত্ত চেতনার কল্যানে মানব প্রজাতি নিজ অস্তিত্ব, অবস্থান, একক মহাজীবনের সার্থকতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে, সেই প্রকৃতিকে রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে মনুষ্য প্রজাতি সহ সকল প্রজাতির পরিবেশে সুষ্ঠু সহাবস্থান নিশ্চিতকরণ, পরিবেশ তথা পরিবেশের সকল বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা ও সংরক্ষণ, আগামী প্রজন্মের জন্য প্রকৃতির সরল দূষণহীন আদি রূপ ফিরিয়ে আনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রধান দায়িত্ব, কর্তব্য ও মানবিকতা।

এই বিশ্বের শুভ চেতনা সম্পন্ন মানুষের সম্মিলিত সদিচ্ছা পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার্থে বদ্ধপরিকর। তারা সুনির্দিষ্ট বাৎসরিক পরিবেশ হিতকর কিছু কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে জনসচেতনতা  ও জনসংযোগ গড়ে তুলে মানুষকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে তোলায় উদ্যোগী। এই উদ্দেশ্যে দুটি বিশেষ তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়েছে একটি ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’ এবং অপরটি ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস :

প্রতি বছর ২২ এপ্রিল ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’ বা ‘ওয়ার্ল্ড আর্থ ডে’ উদযাপন করা হয়। দিনটি ‘বসুন্ধরা দিবস’ নামেও পরিচিত। এবছর ২০২১এ, ৫১ তম আর্থ ডে পালন করা হয়। বর্তমান পরিবেশের পরিস্থিতি বিচারে প্রতি বছর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতিগত বিষয়ের উপর এই আন্তর্জাতিক উৎসবের একটি মূলভাব বা থিম গ্রহণ করা হয়। এই ব্যাপারে চলতি বছরের থিম হলো, ‘আমাদের পৃথিবী পুনরুদ্ধার’ বা ‘রিস্টোর আওয়ার আর্থ’। বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আমাদের বর্তমান পৃথিবীর পরিস্থিতি বিচারে। ১৯৬৯ সালে তেল উপচে বেশ বড়সড়ো একটি দূষণ ছড়ালে, অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনা থেকে পৃথিবীর পরিবেশ সচেতন শুভ চেতনা সম্পন্ন মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এমন একটি বিশেষ দিন নির্দিষ্টকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। বসুন্ধরা দিবসের ভাবনার সূত্রপাত সেখান থেকেই। পরবর্তীকালে মার্কিন সেনেটর গেলর্ড নেলসন ও ডেনিস হেইস কর্তৃক ১৯৭০ সালে ২২ এপ্রিল প্রথম ধরিত্রী দিবস উদযাপিত হয়। সে বছর প্রায় দু’কোটি মানুষ পরিবেশ রক্ষার স্লোগান তুলেছিলেন। পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা প্রথমবার মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বসন্তকালে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে ও শরতকালে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলিতে দিনটি পালিত হয়। কারণ ২২ এপ্রিল উত্তর গোলার্ধে বসন্ত প্রকৃতি বিরাজ করে। সমসাময়িক বিপরীত গোলার্ধে তখন শরতপ্রকৃতি আনাগোনা।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস :

আর্থ ডে’র মতো আর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ সচেতনতা সংক্রান্ত দিন হলো ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৫ জুন পালন করা হয় দিনটি। দেড়শোটি দেশ সংযুক্ত ভাবে দিনটি উদযাপন করে। প্রতি বছর এই উদ্দেশ্যে বর্তমান প্রাকৃতিক পরিবেশের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করার জন্য প্রত্যেক বছর একটি করে থিম নির্ধারণ করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো দেশ একক বা সংযুক্ত ভাবে নির্ধারিত কর্মসূচীর আওতায় বিশ্ব ব্যাপী পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে। বিশ্ব পরিবেশ সংক্রান্ত এটাই সবচেয়ে বড়ো মঞ্চ।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচীর তত্ত্বাবধানে এবছর পাকিস্তান বিশেষ ভূমিকা নিতে চলেছে। এবছরের আয়োজক দেশ তারা। এবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনা হলো ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার’। অর্থাৎ, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের হারানো বাস্তুতন্ত্রকে পুনরায় আগের অবস্থানে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। আমরা সকলে এই প্রকৃতির সৃষ্ট উন্নত জীব প্রজাতি। আমরাও এই পরিবেশের অংশ। এই পরিবেশকে রক্ষা করা আমাদের দায়বদ্ধতা। এই পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে, আমাদের একজোট হয়ে বিশেষ কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্রতী হতে হবে। এই বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচাতে পারলে, তবেই আমরা বাঁচবো। প্রকৃতির সাথে আমাদের সঠিক সম্পর্ক স্থাপন একান্ত জরুরি। ‘ইউনাইটেড নেশনস্ এনভারমেণ্ট প্রোগ্রাম’ অর্থাৎ জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচী ২০২১ থেকে ২০৩০ পর্যন্ত এই দশককে বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের কাজে এক উল্লেখযোগ্য দশক রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। যাতে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সুসম্পর্ক আবার পুনর্গঠিত হয়। এই কর্মযজ্ঞে পাকিস্তান এক অগ্রণী ভূমিকা নিতে চলেছে ‘টেন বিলিয়ন ট্রি সুনামি’র মধ্যে দিয়ে। আগামী ক’য়েক বছরের মধ্যে তারা দেশের হারিয়ে যাওয়া বনভূমিকে ফিরে পেতে আগ্রহী। সারা পৃথিবীর কাছে তারা এইভাবে বনভূমি পুনরুদ্ধারের বার্তা দিতে চায়। তাদের এই উদ্যোগ সারা দেশে এক মিলিয়ন হেক্টর অরণ্যভূমিকে অনেক বেশি সবুজ করে তুলবে। এই আগামী অনুষ্ঠানে পাকিস্তান পরিবেশ দূষণ ও বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয়ের ব্যাপারে কিছু জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে।

জাতিসংঘ এই দশকের মধ্যমে একগুচ্ছ সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী। তারা ব্যাপক ভাবে বনসৃজনের মাধ্যমে অরণ্যভূমির বাস্তুতন্ত্রকে মজবুত করতে চায়। বনভূমির সম্প্রসারণ ঘটলে জলবায়ুর মধ্যে একটা স্থিরতা আসবে। বৈশ্বিক উষ্ণতার ঊর্ধ্বগতির উপর কিছুটা লাগাম পড়ানো সম্ভব হবে। বায়ু দুষক ও গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাব কমানো সম্ভব হবে। বাতাসের অক্সিজেন ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির মতো ঘটনা ঘটনা ঘটবে না। ভূমিক্ষয় রোধ, বন্যা প্রতিরোধ সম্ভব হবে। এই অরণ্যভূমি লুপ্তপ্রায় অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ও সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। মানুষ ও অরণ্য প্রকৃতির একাত্মতা, গভীর আন্তঃসম্পর্ক, পারস্পরিক সুদৃঢ় বন্ধন, জন গোষ্ঠীর আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধিতে, খাদ্য সঙ্কট মেটাতে, অর্থনৈতিক উন্নতিতে, দৈহিক অনাক্রমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। অরণ্য ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে সমৃদ্ধ করবে, ফলে পানীয় জলের অভাব পূরণ অনেকাংশে সম্ভব হবে। ঝড় ঝঞ্ঝার মতো প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাব থেকে অরণ্য দেশের অভ্যন্তরকে আগলে রাখবে। প্রাকৃতিক পরিবেশের অবক্ষয় থেকে বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারকরণে জাতিসংঘের এই দশক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সকল মানুষের শুভ চেতনার উন্মেষ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই দশকের লক্ষ্য পূরণের প্রধান ও একমাত্র হাতিয়ার।

প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব :

প্রকৃতির সহচর্যেই আমাদের জীবন, অস্তিত্ব, উদ্বর্তন তথা চেতনাযুক্ত প্রাণের সার্থকতা। প্রাকৃতিক কারণেই আমাদের চেতনার বিকাশ ঘটেছে। সম্পূর্ণ জৈব প্রাকৃতিক ক্রিয়ায়। পঁচিশ লক্ষ বছর আগে যখন লেজবিহীন প্রাইমেট, অস্ট্রালোপিথেকাস পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো, তখন আফ্রিকার পূর্বাংশের ভূ-প্রকৃতিগত পরিবর্তনের ফলে উচ্চ ভূমিটি প্রাকৃতিক ভাবে মাথা তুলে না দাঁড়ালে, আমরা হয়তো সর্বোন্নত জীব রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারতাম না। ভূমিরূপের এই স্বাভাবিক পরিবর্তনে আফ্রিকা যখন বৃষ্টি অরণ্য হারিয়ে ধীরে ধীরে তৃণ ভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছিল তখনই চেতনাধারী ভবিষ্যত পৃথিবীর জীব হিসাবে অস্ট্রালোপিথেকাসের ভাগ্য রচনা করেছিল প্রকৃতি। সেই আদি জীবের উত্তরসূরি হলাম আমরা। এর পর থেকে ক্রমাগত খুলির বিবর্তন ঘটিয়েছে প্রকৃতি। তাকে বোঝার মতো বুদ্ধিবৃত্তি, অভিব্যক্তি অল্প অল্প করে জমা করেছিল খুলির কক্ষে। প্রকৃতি একরকম শখ করেই বানিয়েছিল আমাদের। আমরা সেই ভালোবাসার মূল্য দিইনি। নিজের অস্তিত্ব আর প্রকৃতিকে বোঝার মতো যথেষ্ট চেতনার অধিকারী হলাম বটে। কিন্তু, সৃষ্টিকর্তা সেই প্রকৃতির কথাই ভুলে গেলাম! নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসের প্রতিযোগিতা মূলক খেলায় মেতেছি আমরা। আমাদের স্বার্থপরতা, হিংসা, আত্মকেন্দ্রিকতা, লোভ, অভাব, অশিক্ষা প্রকৃতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে একটু একটু করে। আমরা নিজেদের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে ভাবছি। আমরা এটা ভাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না, যে প্রকৃতি ধ্বংস হলে, আমরাও অস্তিত্বহীন হবো। সামাজিক উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করছি, প্রকৃতির ক্ষতি করে, বিরুদ্ধাচরণ করে, প্রকৃতির কার্যকারণে হস্তক্ষেপ করে। মানুষ যেন প্রকৃতি ধ্বংসের খেলায় মেতেছে! যে চেতনার বিকাশ একদিন প্রকৃতি ঘটিয়েছিল, তা আজ তারই অস্তিত্বহীনতার কারণ হয়ে উঠছে ক্রমশ!

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। প্রকৃতি সর্ব শক্তিমান। তাই প্রকৃতি চাইলে সবকিছু করতে পারে। সৃজন ও ধ্বংস দু’ক্ষেত্রেই প্রকৃতি সমান সিদ্ধহস্ত। তার ধৈর্য্যর অবসান ঘটলে সে বহু লক্ষ বছরের বিবর্তন প্রাপ্ত চেতনাধারী এই মানব প্রজাতিকে সমূলে বিনাশ করতে পারে অবলীলায়। প্রকৃতির উপাদান ধার করে নির্মিত এই প্রাণদেহ। যে উপাদান আলোর ভাষা পাঠ করে একদিন সবুজ মেখেছিল। যার দোসর হয়েছিল প্রাণীকুল। এই প্রকৃতির উপাদান আমরা ব্যবহার করি মাত্র। আজ যে উপাদান সমূহ বর্তমানে কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর দেহ গঠনে বরাদ্দ হয়েছে, অতীতে তা হয়তো প্রাগৈতিহাসিক কোনো প্রাণীর দেহ গঠনে ব্যবহার হয়েছিল, ভবিষ্যতে তা আগামী প্রজন্মের জীবদেহ গঠনে বরাদ্দ হবে। এইভাবে প্রকৃতি ‘জৈব ভূ-রাসায়নিক চক্র’কে সৃষ্টিলগ্ন থেকে সচল রেখেছে। অথচ আমাদের অনেকেই এই প্রকৃতিকে যথাযোগ্য সম্মান ও শ্রদ্ধা করি না! আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে প্রকৃতি আমাদের তার রহস্যময়তাকে উপলব্ধি করার মতো যোগ্য করে গড়ে তুলেছে।

প্রকৃতির নিয়ম ও আমাদের চেতনা দু’ইই রহস্যময়! আমাদের চেতনাও প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতির নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। তাই একদিকে, আমাদের চিন্তন তথা ভাবনাও প্রকৃতির ভাবনা। ভালো মন্দ সকল ভাবনাই প্রকৃতির দ্বারা ভাবিত হয়। তাই এক শ্রেণীর মানুষ প্রকৃতির ক্ষতি করে অর্থ লাভের চেষ্টা করলেও, শুভ চেতনার মানুষ তার প্রতিকার করার চেষ্টা করে। প্রকৃতি একটি স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম। প্রকৃতির সকল ক্রিয়া সর্বদা সাম্যাবস্থাকে অনুসরণ করতে চায়। এই সাম্যাবস্থা বিঘ্নিত হলেই প্রাকৃতিক উপায়ে তা পূর্বাবস্থানে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে প্রকৃতি। পৃথিবীর কোনো প্রজাতি যখনই মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, অর্থাৎ বিঘ্নিত হয়েছে বাস্ততন্ত্র তথা প্রকৃতির নিয়ম, তখনই প্রকৃতি সেই প্রজাতির মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে আপন কৌশলে। বর্তমান পৃথিবীর জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে চলেছে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে, আমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে মানব প্রজাতি প্রকৃতির উপর অনুশাসন চালিয়েছে বিগত ক’য়েক শতাব্দী ধরে। বিগত একশো বছরে তা অধিক ভয়ঙ্কর রূপে পরিলক্ষিত। চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষের গড় আয়ু অনেকটা বৃদ্ধি করেছে। শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ও যথাযথ প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হওয়ায়, মারণ রোগের প্রকোপ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। টিকাকরণের মাধ্যমে কৃত্রিম ভাবে অ্যাণ্টিবডি উৎপন্ন করে, অনাক্রমতাকে  প্রসারিত করার চেষ্টা করেছে মানুষের গভীর চেতনা উৎসারিত জ্ঞান। খাদ্য বাসস্থানের অপ্রতুলতা না থাকায় বিগত একশো বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পৃথিবীর জনসংখ্য বাস্তুতান্ত্রিক ধারণক্ষমতার অধিক। এই লাগামহীন জনসংখ্যার কারণে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, দারিদ্র্য, খাদসংকট, অরণ্য ধ্বংস, প্রাকৃতিক সম্পদের অত্যধিক ব্যবহার এর ফলে পরিবেশ দূষণ, গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাব বৃদ্ধির ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ণ, সবমিলিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ এক চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির স্বীকার! প্রকৃতির সাম্যাবস্থা ভীষণ ভাবে বিঘ্নিত। প্রকৃতির কাছে বেমানান, অবাঞ্ছিত কিছু ঘটলে প্রকৃতির নিয়মে সেই সিস্টেমে একটা পরিবর্তন অবশ্যই আসবে, যাতে সেই পরিবর্তনের কারণ অপসারিত হয়। তখন প্রকৃতির তন্ত্রে এমন একটি পরিবর্তন ঘটবে যাতে এই অব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনে’ মানুষের বুদ্ধিমত্তা জয়ী হলেও মানুষ ক্রমেই প্রকৃতিকে দূরে সরিয়েছে। ততই যান্ত্রিকতার স্বীকার হয়েছে। ফলে মানুষের অনাক্রমতাও কমেছে বহুলাংশে। প্রকৃতি বারবার আপন প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে এই জনবিস্ফোরণকে প্রতিহত করতে চেয়েছে। সে অণুজীবের বিবর্তনে সহায়ক হয়েছে। সে আরো জটিল অণুজীবীয় বিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে, যাতে জনসংখ্যার ঊর্ধ্ব গতির উপর নিয়ন্ত্রণ ঘটাতে পারে। ফলে বর্তমানে ভাইরাস সৃষ্ট মহামারী পৃথিবী ব্যাপী এক অতিমারীতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রকৃতি এমন অণুজীবীয় বিবর্তন ঘটাবে, যার কাছে মানব প্রযুক্তিও একদিন হার মানতে বাধ্য হবে।

বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একান্ত জরুরি। যাতে জনসংখ্যা ও সম্পদের মধ্যে কাঙ্খিত অনুপাত বজায় থাকে। প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করে তার সান্নিধ্য নিলে, প্রকৃতি আমাদের রক্ষা করবে। যেমনটা সে করে এসছে প্রাণ সৃষ্টির পর থেকে। প্রকৃতি চেয়েছিল বলেই আজও আমরা আছি। প্রাকৃতিকে রক্ষা করে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের দিন এসেছে আজ। প্রকৃতি বাঁচলে তবেই আমরা বাঁচবো। না হলে প্রকৃতি আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে।

পরিবেশ রক্ষার্থে আমাদের কর্তব্য :

প্রকৃতির কল্যানে আমরা যে জীবন ও চেতনা পেয়েছি, তা কতগুলি ঘটনা বিন্যাসের ক্রমান্বয়ে প্রাপ্ত। পাঁচশো কোটি বছরের আগে কোনো এক সুপারনোভা বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষে নিহিত ছিল আমাদের অস্তিত্বে আসা। এর পর গ্র্যাভিটির প্রভাবে সূর্য ও অন্যান্য গ্রহের সংঘবদ্ধ হওয়া। গোল্ডিলক জোনে পৃথিবীর অবস্থান নেওয়া। যে জোনে জীবনের প্রথম শর্ত, জলকে প্রবাহী রূপে পাওয়া যায়। পৃথিবীর জীবন রসায়নের সংযুক্তিতে চন্দ্র কর্তৃক সৃষ্ট জোয়ার ভাটার প্রভাব। চন্দ্র ও পৃথিবীর দ্বৈত মহাকর্ষীয় সাম্যাবস্থান। নিজের অক্ষে পৃথিবীর আবর্তন, এর ফলে সৃষ্ট চুম্বকীয় ক্ষেত্র দ্বারা মহাজাগতিক রশ্মি ও সৌর ঝঞ্ঝার প্রভাব থেকে পার্থিব জীবন রক্ষা পাওয়া। ওজোন স্তরের পরত কর্তৃক প্রাণঘাতী তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ প্রতিহত হওয়া। জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌল সমূহের সহজলভ্যতা। এই সবকটি কারণ জীবন বিক্রিয়া শুরু করার জন্য অপরিহার্য ছিল। এর একটিরও ব্যাতিক্রম হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকতো না। পৃথিবীর প্রথম জীবিত কোষ ‘লুকা’ অর্থাৎ ‘লাস্ট ইউনিভার্সাল কমন অ্যানসেস্টর’ সৌর শক্তিকে রসায়নের মধ্যে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় গৃহীত হতো কার্বন ডাই অক্সাইড, উপজাত হলো অক্সিজেন। সেই আদি পৃথিবীতে অক্সিজেনের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি এমন একটি বিপরীত প্রক্রিয়াকে অনিবার্য করে তুলেছিল যা অক্সিজেনকে পুনরায় কার্বন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত করে কার্বন ডাই অক্সাইডে রূপান্তরিত করবে। এই সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে প্রাণী কোষ সৃষ্টির প্রয়োজন ছিলো। যেটির বহু বিবর্তিত রূপ হলো মানুষ। একটি জীবনকে একবারই প্রকৃতি নির্মাণ করে। তাই এই রহস্যময় প্রকৃতিকে বোঝার জন্য মানব চেতনায় তার সৌন্দর্যকে অবলোকন করার জন্য একক জীবনে এক বারই সুযোগ মেলে। প্রকৃতির রহস্যময়তার সামান্যতম পাঠোদ্ধার করতে পারলে, সেই ছান্দিকতাকে অনুধাবন করতে পারলে, মনুষ্য জীবন একটি মহাজীবনের আস্বাদন পেতে পারে। তখনই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা উপলব্ধি করা যায়। প্রকৃতিকে না জানলে তার কিছু যায় আসে না। এই অমূল্য জীবন সার্থকতা হারায়। তাই ভালোবেসে প্রকৃতিকে রক্ষা করা আমাদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। আগামী প্রজন্মের জন্য এই প্রকৃতিকে অকৃত্রিম ভাবে আরো বেশি বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।

আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না, এই প্রকৃতিতে সকল প্রকার প্রাণের বেঁচে থাকার সমান অধিকার আছে। আমারা বুদ্ধি ও ক্ষমতার অধিকারী বলে কেবল নিজেদের জন্য ভবিষ্যত সুরক্ষিত করবো, এমনটা খুবই অনভিপ্রেত। একটি প্রজাতি অবলুপ্ত হয়ে গেলে, তাকে আর ফেরানো সম্ভব না। বিপন্ন লুপ্তপ্রায় প্রজাতিকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। যথেষ্ট সবুজায়ন করতে পারলে অনেক প্রজাতিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। অরণ্য ও বন্য প্রাণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ স্থান নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি দেশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সম্পদ ও জনসংখ্যার মধ্যে আদর্শ অনুপাত বজায় না থাকলে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষয় ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অবশ্য কর্তব্য। শিল্পক্ষেত্র থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য যাতে জলাশয় বা কৃষিক্ষেত্রের সংস্পর্শে কোনোভাবেই না আসে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া বিশেষ জরুরী। সেই সকল বর্জ্য ও পলিথিন জাতীয় পদার্থ রিসাইকেল অর্থাৎ পুনর্নবীকরণ করে পরিবেশ সুরক্ষিত করা বাঞ্ছনীয়। কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর দ্বারা অপর প্রাণীকূল যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। শহর এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণ বৃক্ষ রোপণ, কিছুটা হলেও বাতাসকে পরিস্রুত করবে। ব্যাপক হারে বৃক্ষ রোপনই এই পরিবেশ দূষণ ঠেকানোর এক এবং একমাত্র উপায়। বৃক্ষ রোপনের পর সেটি যথেষ্ট বড়ো না হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজন। অরণ্যে, রাস্তার দুধারে বা পরিবেশের অন্যত্র বড়ো বড়ো বৃক্ষের উপর নিয়মিত নজরদারি রাখা প্রয়োজন, যাতে অসাধু কোনো মানুষ কাষ্ঠ সংগ্রহের লোভে কপার সালফেটের বিষক্রিয়া ঘটিয়ে বড়ো বৃক্ষকে হত্যা করতে না পারে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী। তাপবিদ্যুতের পরিবর্তে বেশি করে জলবিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ, ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ, জোয়ার-ভাটার শক্তি থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর জোর দেওয়া উচিত। যাতে পরিবেশ দুষণ মুক্ত থাকে। পারমাণবিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যাতে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য কোনোভাবেই প্রকৃতিতে মুক্ত হতে না পারে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয় আনা প্রয়োজন। গ্রীন হাউস গ্যাসের ব্যবহার সম্পূর্ণ কমিয়ে ফেলতে হবে। বিশ্ব উষ্ণায়ণের প্রভাবে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতি হয়েছে ক’য়েক দশকে। সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র একটি বৃহৎ বাস্তুতন্ত্র। এই বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে এই গ্রহের অবশিষ্ট জীবকূলের উপর।

জীবকূলের বেঁচে থাকার জন্য জলাভূমি অপরিহার্য। উন্মুক্ত তৃণ ভূমি, অরণ্য ভূমি, জলাভূমি বৃষ্টির জলকে শিলাস্তরে প্রবেশ করতে দেয়। এর ফলে ভৌম জলাধার সমৃদ্ধ হয়। কৃষিক্ষেত্রে ও পানীয় হিসাবে এই জল অপরিহার্য। তাই পরিবেশ রক্ষার্থে জলাভূমি সংরক্ষণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শহরাঞ্চলে মাটিতে ভৌম জল সঞ্চয়ের পরিমাণ কম। ভূমিকে যথা সম্ভব উন্মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। শহর কেন্দ্রিক বৃক্ষগুলির গোড়া বাঁধাতে হলে যথেষ্ট পরিসর রেখে তা করা উচিত। যাতে মূল ও মাটির বন্ধন সুরক্ষিত করার যথেষ্ট অবকাশ থাকে। প্রায়শই শহরাঞ্চলে ছোট বড় মূল্যবান বৃক্ষ উপড়ে পড়তে দেখা যায়। এটি একটি বড় ক্ষতি। জীন প্রযুক্তির ব্যাপক প্রযোগ থেকে বিরত থাকা উচিত। সেক্ষেত্রে প্রজাতিটির জীনের মধ্যে প্রকৃতিগত প্রকরণ কম থাকায়, প্রজাতিটি প্রাকৃতিক পরিবেশের যে কোনো রকম পরিবর্তনে অবলুপ্ত হতে পারে। প্রাকৃতিক জীনের মধ্যে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত পরিবর্তন না আনাই শ্রেয়।

যে নক্ষত্র ধূলি থেকে এই পৃথিবী তথা সমগ্র জীবকূলের সৃষ্টি, এই সবকিছু একদিন আবার সেই মহাজাগতিক ধূলিরূপ নেবে। এটাই হলো প্রকৃতি। কালস্রোতে প্রকৃতি সদা পরিবর্তনশীল। প্রকৃতিকে যদি আমরা ধ্বংস করে না ফেলি, প্রকৃতির প্রতি একটু যত্নবান হই, তবে নিকট ভবিষ্যতে আমাদের অস্তিত্ব সংকটের কোনো কারণ নেই। তবে একটি সমস্যা আছে। তা হলো মেধার বিকাশ। এটাও প্রকৃতির একরকম খেলা। হোমো ইরেক্টাস পৃথিবীর ইতিহাসে কুড়ি লক্ষ বছরের অধিক সময় ধরে টিকে ছিল। এটি যথেষ্ট দীর্ঘ সময়। এর একটি অন্যতম কারণ অবিকশিত মেধা। প্রকৃতির সান্নিধ্য ও সহাবস্থান। কিন্তু, সর্বোচ্চ মেধার অধিকারী আমাদের অস্তিত্ব আগামী এক হাজার বছরে কোন পর্যায় পৌঁছাবে তা বলা অত্যন্ত সুকঠিন। আপন অধিকার, কর্তৃত্ব, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে একে অপরের জন্য সংকটের কারণ হয়ে উঠছে মানুষ। মানবতাকে যেন কোণঠাসা করে ফেলতে চাইছে তারা। তবু আমরা আশাবাদী! হয়তো শুভ চেতনায় সম্পৃক্ত হয়ে উঠবে একদিন সবার অন্তর।

মানুষের শুভ চেতনাই তাদের নিজেদের আর এই পরিবেশকে রক্ষা করতে পারে। ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’ বা ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ এর ভাবনা কেবল একটি দিবসের কর্মসূচীতে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। প্রতিটি পৃথিবীবাসীকে দেহ মন প্রাণ দিয়ে এই সকল পরিবেশ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। নয়তো প্রকৃতি ‘কোভিড-১৯’ এর মতো অণুজীবের বিবর্তন বার বার ঘটাবে, যাতে জনসংখ্যা হ্রাস পেয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে স্থিতাবস্থা আসতে পারে। মৃত্যুর মিছিল গুনতে হবে পৃথিবীর জনজাতিকে। ব্যাপক হারে সারা পৃথিবী জুড়ে যেভাবে অরণ্য সাফাইয়ের অভিযান চলছে তাতে, নিকট ভবিষ্যতে মানুষের মধ্যে ফুসফুসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশ অথবা সুদূরের আমাজন, সর্বত্র একই প্রতিচ্ছবি। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে প্রকৃতি সর্ব শক্তিমান। আমাদের মেধাশক্তি তার কাছে সম্পূর্ণ অকেজো। অত্যধিক বৃক্ষচ্ছেদন বাস্তুতন্ত্রকে সমূলে বিনাশ করছে। আমাদের শ্বাসবায়ুর কুড়ি শতাংশ অক্সিজেন যা, আমাজনের বৃষ্টি অরণ্য নির্গত করে। তা গত পঞ্চাশ বছরে সতেরো শতাংশ নির্মূল করা হয়েছে। ফলস্বরূপ বিশ্ব জুড়ে ঋতু প্রকৃতির আমূল রূপান্তর ক্রমশই প্রকট হচ্ছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে গ্রীষ্ম, প্রাক বর্ষা, বর্ষা ও শীত মূলত এই চারটি ঋতুর প্রভাব উল্লেখযোগ্য। শরত, বসন্ত বা হেমন্ত সেইভাবে অনুভূত হয় না। বিশ্ব উষ্ণায়ণের প্রভাবে সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত হওয়া নিম্নচাপ তথা ঘূর্ণাবর্ত পূর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হয়ে দানা বাঁধছে। পরিবেশ দিবসের কর্মসূচীর প্রকৃত রূপায়ণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বর্তমান পরিস্থিতিতে। আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করাই এখন একমাত্র লক্ষ্য।

কলমে অভিজিৎ মুখার্জী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here