‘থ্যালাসেমিয়া’ শব্দটির সাথে আমাদের প্রত্যেকেরই কম বেশি পরিচয় আছে। এটি একটি জিন-ঘটিত রোগ যা বংশানুক্রমে বাহিত। এই রোগ এবং এই রোগে আক্রান্ত দের লড়াই-এর কথা মাথায় রেখে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৮-ই মে , সারা বিশ্বে ‘বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া  দিবস’ পালন করা হয়।

প্রতি বছরের মত এই বছরও একটি নতুন থিম রাখা হয়েছে। এই বছরের থিম হল “Addressing Health Inequalities. Across the Global Thalassemia Community”

থ্যালাসেমিয়া দিবস পালনের প্রধান উদ্দেশ্য হল  মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং তার সাথে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ও তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কোন অবস্থায় কি করণীয় তার সঠিক জ্ঞান বিস্তার করা। 

 রক্তের গঠনমূলক প্রধান অংশ হল লৌহঘটিত রঞ্জক হিম এবং প্রোটিন অংশ গ্লোবিন, যা আলফা ও বিটা দুই প্রকার।  নয়টি বিভিন্ন জিন এই লৌহঘটিত রঞ্জক হিম-এর গঠন এবং সংশ্লেষণে সহায়তা করে। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তের শরীরে এই জিন গুলি আক্রান্ত হয় , ফলে যথেষ্ট পরিমাণে হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষণ বাধাপ্রাপ্ত হয়।

থ্যালাসেমিয়া প্রধানত লক্ষণের উপর ভিত্তি করে মুখ্য এবং গৌণ , এই দুই ভাগে বিভক্ত। অত্যধিক সমস্যাযুক্ত থ্যালাসেমিয়ার অপর নাম ‘কুলি অ্যানিমিয়া’ অপর দিকে তুলনামূলক অনেকটা কম সমস্যাজনিত থ্যালাসেমিয়া-র অন্তর্গত, ‘বিটা থ্যালাসেমিয়া’ । বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে শরীর বিটা-গ্লোবিন প্রোটিন  সংশ্লেষণে অক্ষম হয়ে পড়ে। পিতা ও মাতা প্রত্যেকের শরীর থেকে একটি করে জিন বংশানুক্রমে অপত্যে বাহিত হয়। দুটি প্রকারে এই থ্যালাসেমিয়া প্রকট হয়, কুলি’স অ্যানিমিয়া এবং থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমিডিয়া। একজন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন শুধুমাত্র সঠিক সময়ে রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে, যা এই রোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। মেজর বা মুখ্য থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে  হৃদপিণ্ডের সমস্যা দেখা যায়, যা ৩০ বছর বয়সের পূর্বে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।

ট্রান্সফিউশন ডিপেন্ডেন্ট থ্যালাসেমিয়া মেজর বা সংক্ষেপে TDTM সংক্রমিত রা অনেক বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে এবং বিবাহ, সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রেও কোনোরকম বাধা থাকেনা। থ্যালাসেমিয়া বহুক্ষেত্রে অন্য রোগের  বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়, যেমন হজকিন ডিজিস, লিম্ফোমা সেমিনোমা, লিউকেমিয়া। সবগুলিই রক্ত সংক্রান্ত ক্যানসারের প্রকারভেদ। থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে লিভার , হৃদপিন্ড, প্লিহা-তে সমস্যা সৃষ্টি হয়, যেহেতু এগুলি সরাসরি রক্তের সাথে সম্পর্কিত। সংক্রমণ ও হৃদযন্ত্র বিকল হওয়া, শিশুদের মধ্যে একটি অতি পরিচিত সমস্যা। প্রখর বা সিভিয়র থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে বোন ম্যারো ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে হাড় পাতলা এবং ভঙ্গুর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রচুর পরিমাণে লোহিত রক্ত কণিকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে প্লিহা আকারে বৃদ্ধি পায় ও এর কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। অ্যানিমিয়া অনেকাংশে শিশুদের বৃদ্ধি-তে বাধা দেয় এবং থ্যালাসেমিয়ার প্রভাবে  কৈশোর ও যৌবনে পৌঁছানোতেও তুলনামূলক অনেক বেশি সময় লাগে। সংকোচনের ফলে হৃদযন্ত্র বিকল বা কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা অ্যারিথমিয়া-র লক্ষণ প্রকাশ পায়।

হেপাটাইটিস -বি লিভারের কঠিন অসুখগুলির মধ্যে প্রধান হলেও থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের মধ্যে হেপাটোশেলুলার কার্সিনোমা-র ফলে শারিরীক অসুস্থতার মাত্রা উন্নত দেশগুলিতে ঊর্দ্ধমুখী। 

বিটা থ্যালাসেমিয়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে, উত্তর আমেরিকা, মধ্য ,দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে অতি পরিচিত। 

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে কলা, মিস্টি আলু, এবং বিট অনেকাংশে উপকারী। এগুলি থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণগুলিকে অনেকাংশে কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এই খাদ্যগুলিতে থাকা ফলিক অ্যাসিড এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলিক অ্যাসিড নতুন লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়তা করে।  অ্যালকোহল অনেকাংশে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। মদ্যপান রক্তে উপস্থিত লৌহঘটিত রঞ্জকের জারণ ঘটিয়ে এবং হেপাটাইটিস – বি এবং সি এর বৃদ্ধি ঘটিয়ে লিভারের তুমুল ক্ষতিসাধন করে।

এই কারণে যেসকল আক্রান্ত রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে চিকিৎসা করান, তাদের শস্য জাতীয় খাদ্য, রেড মিট, সবুজ শাকসব্জি এবং ভিটামিন-সি যুক্ত খাদ্য খুব উপকারী।

থ্যালাসেমিয়া একটি জিন-বাহিত রোগ । যদি পিতা-মাতা উভয়েই থ্যালাসেমিক ক্যারিয়ার বা বাহক  হন, তাহলে প্রত্যেক মাতৃত্বের ক্ষেত্রে ২৫% ঝুঁকি থাকে তার সন্তানের অটোসোমাল ক্রোমোজোমের বিস্তারের মাধ্যমে  থ্যালাসেমিক হওয়ার ২৫% সম্ভাবনা থাকে সুস্থ সন্তান হওয়ার এবং ৫০% সম্ভাবনা থাকে একটি অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন জিন-এর বাহক হওয়ার। আলফা এবং বিটা থ্যালাসেমিয়ার প্রমাণ বেশী মেলে। ভারতবর্ষে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার স্ক্রিনিং অতি গুরুত্বপূর্ণ , যার মাধ্যমে পিতা-মাতার থেকে তাদের শিশুর মধ্যে থ্যালাসেমিয়া ছড়ানোর আশঙ্কা পূর্ব নির্ধারণ করে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। 

থ্যালাসেমিয়ার সিঙ্গেল জেনেরিক ভ্যারিয়েন্ট ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর। বিটা থ্যালাসেমিয়ার  হেটারোজাইগাস (বাহক) করোনারি হার্ট ডিজিস-এর বিরুদ্ধে কিছু সুরক্ষা প্রদান করে।

থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা হিসাবে নিয়ম করে রক্ত পরিসঞ্চালন, আয়রন চিলেশন থেরাপি, সঠিক ওষুধ, অপারেশনের মাধ্যমে প্লিহা ও গলব্লাডার বহিঃকরণ, প্রত্যহ ফলিক অ্যাসিড যুক্ত ওষুধ বা খাবার খাওয়া, লিভার এবং হৃদযন্ত্রের পরীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন, স্টেম সেল প্রতিস্থাপন ও জিন থেরাপি। স্টেম সেল  প্রতিস্থাপন একমাত্র চিকিৎসা , যার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া সম্পূর্ণ নির্মূল করে সুস্থ করা সম্ভব। জিন থেরাপি-র মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তের রক্ত থেকে হিমাটোপোয়েটিক স্টেম সেল ( HSCs) সংগ্রহ করা হয় এবং তা অন্য আক্রান্তের শরীরে প্রবেশ করিয়ে উন্নত পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়। 

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের বেঁচে থাকার এই কঠিন লড়াইকে সম্মান জানানোর এবং তাদের সাহস যোগানোর জন্য, প্রতিবছর ৮-ই মে , বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস হিসাবে পালন করা হয়। বিগত ২০১৮ ও ২০২০ সালের থ্যালাসেমিয়া দিবসের থিম ছিল যথাক্রমে “Thalassemia past, present & future- Documenting progress and patient needs worldwide” এবং “The dawning of a new era for Thalassemia” যার প্রধান বক্তব্য ছিল এটাই সারা বিশ্বের নতুন কিছু চিকিৎসা এবং থেরাপির ধারণা আনার সঠিক সময় যা একই সাথে সহজলভ্য এবং স্বল্প ব্যয়বহুল হয়। আমরা অঙ্গীকার বদ্ধ, এই রোগের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য। হয়ত একদিন আমরা  থ্যালাসেমিয়া মুক্ত পৃথিবী উপহার দিতে পারবো ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে।

কলমে হিমবন্ত দত্ত, কলকাতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here