অনামিকা বনফুলের বর্ণে-গন্ধে মাতোয়ারা বানজারা মন, বেপথু হতে ভালোবাসে চিরটাকাল৷ উত্তরবঙ্গ ডুয়ার্স-অরণ্যের নিবিড় নৈকট্যে, কংক্রিটের জঙ্গলে উপজাত নাগরিক ক্লান্তিরা, প্রাণোচ্ছ্বল প্রবহমানতায় ঝরা পাতার মত নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দেয় আর প্রকৃতিপ্রেমীরা জীবনীশক্তির নবীন কিশলয়’কে সাথে নিয়ে ফিরে যায় কর্মব্যস্ত নাগরিক জীবনে৷
      আত্মমগ্ন সেই অরণ্য যে কেবল অগণিত বন্যপ্রাণের মাতৃক্রোড়, তা-ই নয়, বহু সংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকাও আবর্তিত হয়, সেই উদার সবুজের স্বর্গরাজ্য’কে ঘিরে৷ বন্যপ্রাণের সংরক্ষণের সাথে যেমন বহু সংখ্যক মানুষের রুটিরুজি অবিচ্ছেদ্য ভাবে সংযুক্ত রয়েছে, তেমনই অরণ্যের ভয়ালসুন্দর রূপে মুগ্ধ পর্যটকদের ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি পর্যটনশিল্পের আধার৷ অরণ্য অকৃপণ হাতে উপজাত সামগ্রী দান করেছে আরণ্যক ভূমিপুত্রদের; তারাও সে’সব গ্রহণ করেছে সসম্ভ্রমে৷ তাদের জীবনযুদ্ধের পরিসরে বনদেবীর স্নিগ্ধ এবং উগ্র দ্বৈত রূপই সমানভাবে ধ্রুবক৷ তাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে যে , প্রকৃতির রঙ-রস-রূপের ব্যপকতা পর্যটকদের চেয়ে অনেকটাই বেশী—তা বলাই বাহুল্য৷
সেবক রোড ধরে মহানন্দা অভয়ারণ্যকে আড়াআড়ি পেরোতেই তিস্তা, মাল, শঙ্খি ঝোরা, গণেশ, সুখা ঝোরা, চেল আরো কত শত বিচিত্র নাম না জানা স্রোতস্বিনীর নির্লিপ্ত প্রবহমানতা,  অরণ্যের গহীন শ্যামলিমার সমান্তরাল হয়ে উঠেছে৷ পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের আরো একটি অন্যতম অর্থনৈতিক বুনিয়াদের অবলম্বন রূপে ছোট বড়  নানা বিস্তৃতির নয়নাভিরাম  চা-বাগান পথের দুই প্রান্ত জুড়ে৷ পরম্পরায় মূলত পাহাড়ী মহিলারাই “দুটি পাতা একটি কুঁড়ি”-র যোগ্যতম নির্বাচক রূপে সেখানে কর্মরত৷
         লাটাগুড়ি থেকে রওনা হয়ে চুকচুকিয়া ওয়াচ টাওয়ারের  দ্বারে পৌঁছানো মাত্রই, বর্ণাঢ্য পেখম মেলে পক্ষীরাজ রাজকীয় অভ্যর্থনা করলেন!  শাল, সেগুন, খয়ের গাছে ঘেরা আরণ্যক সেই পরিবেশ, নেশা ধরানো বুনো গন্ধ এবং পাখপাখালির কলতানে ভরপুর৷ ময়ূর ছাড়াও কাঠঠোকরা, বুলবুলি, ইন্ডিয়ান হর্ণবিল, ফ্লাই ক্যাচার, ব্রাহ্মণী হাঁস, পাহাড়ী ময়না আরো কত শত দেশী এবং পরিযায়ী পাখির মুক্তাঞ্চল সেই অরণ্য৷শেষ বিকেলের রঙিন আলো ডানায় মেখে তারা নিঃসীম মুক্তির সন্ধানী৷
      চাপড়ামারির বুক চিড়ে স্বকীয় গতিময়তায় বয়ে চলেছে মূর্তি নদী৷ অর্জুন, শাল, সেগুন, লালি গাছে ঘেরা ছায়াচ্ছন্ন  গা ছমছমে আরণ্যক পরিবেশে,  চাপড়ামারি বনবাংলোয় রাত্রিবাস, এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে মণিকোঠায় চিরকালীন স্হান করে নেবেই৷যদিও বনদপ্তরের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষেই তা সম্ভব৷ বাংলোর সামনেই বিস্তীর্ণ চারণভূমি;  বাংলোটি ইলেকট্রিক ফেন্সিং এর দ্বারা সুরক্ষিত৷নিকটেই অহরহ ময়ূরের ঝাঁক ঘুরে বেড়ায়৷ কত রকমের পাখির কূজনে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে৷ইন্ডিয়ান বাইসন বা গউরের দল চরে বেড়াতে দেখা যায় প্রায়সই৷ আর দেখা যায় হাতির দঙ্গল৷ বাংলো সম্মুখের উন্মুক্ত অরণ্যানীর মধ্যে দিয়ে এই চাপড়ামারির অন্যতম এলিফ্যান্ট করিডর৷ সাধারণত বাইসন বা হাতির দল শান্তিপূর্ণ আচরণ করলেও দলছুট  বাইসন বা “মূলজারিয়া”  আর দলবিচ্ছিন্ন দাঁতাল হাতি কখনো কখনো রণং দেহি মূর্তি ধারণ করে বিধ্বংসী হয়ে ওঠে৷আবার মিলনকালীন উন্মত্ততাতেও তারা ভয়ঙ্কর৷ বেশ কিছুটা দূরে থাকা “সল্ট লিকে” লবণ আস্বাদনে আসা সম্বর, চিতল ইত্যাদি নানা জাতের হরিণের দেখাও মেলে৷ তবে “সল্টলিক” -এর অমোঘ আকর্ষণে কেবল প্রথম শ্রেণীর খাদকরাই নয়, ভয়াল সুন্দর শ্বাপদেরাও সাড়া দেয়৷
      চাপড়ামারির ত্রিতল বিশিষ্ট ওয়াচ টাওয়ার “ঈগল” থেকে সংলগ্ন জলাশয়ে নানা জাতের পক্ষীসমাগম বড়ই উপভোগ্য৷ প্রায়সই জল পান করতে আসা নানা জাতের হরিণ আর গাউরদেরও দেখতে পাওয়া যায়৷
        অরণ্যের পরিসরে রাত নামে বড় তাড়াতাড়ি৷ দিগন্তবিস্তৃত শ্যামলিমাকে সাক্ষী রেখে রক্তিম আভা ছড়িয়ে সূর্যদেব পাটে নামামাত্রই, অরণ্যে নিঃসীম প্রহেলিকা মাখা অন্ধকার ঘন হয়৷ দিনমানের কলকাকলি তখন স্তব্ধ! একঘেয়ে ঝিঁঝিঁর ডাক বিজন অরণ্যের নৈঃশব্দ্যকে গাঢ়তর করে তোলে৷নিশাচর পাখির ডাক কখনো রোমাঞ্চিত করে, কখনো বা শ্বাপদের গর্জনে শিহরিত হতে হয়৷ আবার প্রায়সই নিশীথ অরণ্যের বিজনতা খান খান করে বৃংহন শোনা যায়৷
      আদিবাসী বাদ্যের মাতাল ছন্দে ডুয়ার্স-অরণ্যের রোমাঞ্চ প্রাণ ভরে উপভোগ করতে “টেন্ট ক্যাম্প” এর আয়োজন রয়েছে খয়েরবাড়িতে৷ আরণ্যক পরিবেশে তাঁবুতে রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা, অমূল্য স্মৃতিকণা হয়ে থেকে যাবে আজীবন৷ খয়েরবাড়ির আরো একটি অন্যতম রোমাঞ্চকর আকর্ষণ ব্যাটারীচালিত বিশেষ যানে লেপার্ড সাফারি৷
    গাছ ও কাঠের গুড়ির মাচার উপর মাটি থেকে নিরাপদ উচ্চতায় গড়ে তোলা টোটোপাড়ার ঘরগুলো দেখে, প্রকৃতি ও মানুষের নিবিড় নৈকট্য অনুভব করা যায়৷ জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের হলং-এ বনদপ্তরের কুনকি হাতির পিঠে চেপে, জলে-জঙ্গলে ভ্রমণের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা লাভ, এক অনন্য প্রাপ্তি৷ বিশালদেহী কিন্তু নির্লিপ্ত একশৃঙ্গী গণ্ডার ও তার পিঠে বসে থাকা সাদা বকগুলোকে দেখে প্রকৃতির সনাতন মিথোজীবিতা উপলব্ধি করা যায়৷
   প্রকৃতির অনির্বচনীয় রূপের সুধারস আকণ্ঠ পান করার জন্য, মানবজীবনের ক্ষুদ্র পরিসর বড়ই অপ্রতুল! ডুয়ার্সের মোহময়ী অরণ্যের অপার সৌন্দর্য, নাগরিক জীবনের তমিস্রার মাঝেও, ধ্রুবতারার মত উজ্জ্বল৷ নির্মল নীলিমা আর স্নিগ্ধ শ্যামলিমার অন্তরাত্মা, প্রাণোছ্বল নদীর মত একাত্ম হয়ে, নৈসর্গিক স্পন্দনে, মহাজাগতিক পরমচেতনার মিলনসাগরের প্রতি ধাবমান৷ ব্যক্তিমানসের ক্ষুদ্রচেতনাও সেই স্বর্গীয় সুধার সন্ধানে চঞ্চল হয়ে ওঠে৷ বিদায় জানাবার ফরমান নিয়ে নিষ্ঠুর সময় সমাগত৷ তারই লঘু পদসঞ্চারে অব্যক্ত বেদনায় কেঁপে ওঠে অবুঝ হৃদয়৷ অনুচ্চারিত অধিকার-বাক্য স্পন্দিত হয় অন্তরে,
“যেতে নাহি দিব’…”
“হায়! তবু যেতে দিতে হয়৷”
আবারো ফিরে আসার আশ্বাসবাণী সহযোগে কাটাতে হয় সমস্ত মায়া!

কলমে উৎস ভট্টাচার্যকাঁকিনাড়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা

IIT Bombay থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর৷ IISc তে গবেষণার কাজ এবং বাসুদেবামূর্তি সুন্দরারাজন পুরস্কার প্রাপ্তি৷ বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রপত্রিকা ও সংকলনে নিয়মিত লেখালেখি৷ সহসম্পাদনায়  “আতঙ্কের অমানিশা” শীর্ষক বহুল সমাদৃৃৃৃত সংকলনটি  তুহিনা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পেয়েছে৷

4 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here