মধ্যরাত্রে সীমান্তে হঠাৎ চলল গুলি । একদল বলল, ও কিছু না, এতই সহজ ? আরেকদল বলল, এর জবাব আমরাও দেবো । কিন্তু যার গেল, তার গেল । পাকা খবর যখন এল, তখন সকাল হয়ে গেছে । দিনের বেলা, কত না স্বজনহারার বুকের মধ্যে রাত ঘনালো ! তেরঙ্গা জাতীয় পতাকায় ঢাকা শহীদ জওয়ান ছেলেটির মৃতদেহ গ্রামে যখন ঢুকলো, তখন দ্বিপ্রহর । প্রায় তিরিশ ঘণ্টা অতিবাহিত । ততক্ষণে, মায়ের চোখের জল শুকিয়ে গেছে । কান্না আসছে না, শুধু দু-পা কেমন কাঁপছে । কিছু না ধরে দাঁড়াতে গেলে মাথা টলছে । মৃত ছেলের মুখটা মনে করতে করতে বুড়ো বাপের চোখের কোলে মোটা পিচুটি পড়ে গেছে । তখন কমলালেবুর খোসা ছাড়ানোর পর হাতে যেমন মৃদু কমলা রসময় স্পর্শ লেগে থাকে, তেমনি স্মৃতিরা আলগা হয়ে ঝুলে ছিল মনের কোণে । গাছেরা তাদের ছায়াগুলো জড়ো করে এনেছিল ঠিক নীচে, যেন নতমুখে একেবারে চুপ করে ছিল । এতটুকু বাতাস নেই কোথাও । রোদে পুড়ে যাচ্ছিল চারপাশ, কিন্তু সেই উত্তাপ দুই বুড়ো-বুড়িকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারছিল না । খোকা ভালো শিস দিত, বুড়ির কানে তখন সেই শিস বাজছিল । বুড়ো খালি চোখে ভালো দেখে না । শিরা ওঠা, কুঞ্চিত চর্মের লম্বা হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে শহীদ ছেলের হাতটা ছোঁয় । বরাবর ছেলেকে বাবা ছুঁলে বড়ো বিরক্ত হতো । সেই ছেলেবেলা থেকে বড্ড তেজি কিনা ! কখনোই পছন্দ করত না, অতিরিক্ত স্নেহ, কোনোরকম আদিখ্যেতা । আজ বহুদিন পরে বাপের আদর উপেক্ষা করার সাধ্য নেই তার । বুড়ো আজ নিশ্চিন্তে ছেলের হাতে হাত বুলোয় । পুত্রবধূর বয়স মাত্র কুড়ি । তার বাম হাতের কনুইয়ের কাছে বারবার একটা মাছি উড়ে উড়ে এসে বসতে চাইছিল । মাছিটার প্রত্যাশা কি, তার জানার কথা নয় । হয়তো সেকথাই সে ভাবছিল, কিন্তু তার প্রত্যাশার খবর কে রাখে ? যুবতীর কপালে কোনো চিন্তার রেখা তৈরি হয়েছিল কিনা, তা বলা মুশকিল । সম্ভবত সে তখন বর্তমান নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল, যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুশ্চিন্তা কতদূর চলতে পারে, সে বিষয়ে সে কিছুটা উদাসীন হয়ে পড়েছিল । দু মাসের পোয়াতি সে, তার কেমন যেন মনে হচ্ছিল, সে ঠকে গেছে । কিন্তু কাকে বলবে সে কথা, কিই বা বলবে, বুঝতে পারছিল না ।
গ্রামের মানুষ ভিড় করে এসেছিল, তাদের টালির চালের, কাঁচা মাটির বাড়ির ছোট্ট উঠোনে, যেখানটায় ক’দিন আগে পর্যন্ত গুটিকতক গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিল আজকের শহীদ ছেলেটি । সূর্য যত পশ্চিমে হেলছিল, ততই কৌতূহলী জনতার ভিড় বাড়ছিল ।
একজনের শহীদ হওয়ার তাৎপর্য ঠিক কী, উপস্থিত জনতা তা কতটা অনুধাবন করতে পারছিল, আদৌ পারছিল কি-না, তা বোঝা যাচ্ছিল না । সত্যিই তো, সেবার বামুন পাড়ায় অখিল বাবুর বাড়ি রঙ্ করতে গিয়ে, তিন্নির বাপ যে মাচায় উঠে প্রায় পঁচিশ ফুট উপর থেকে পা ফসকে, পড়ে মারা গেল, সেই মৃত্যুর সাথে আজকের এই বছর সাতাশের ছেলেটার মৃত্যুর ফারাক কোথায়, তিন্নির মা তা কী করেই বা বুঝবে ? তবুও তার বড্ড খারাপ লাগে, সে অনুভব করে প্রতিবেশী মানুষগুলোর যন্ত্রণা। কারণ প্রিয়জন হারানোর কষ্ট কেমন, সেটুকু অন্তত সে জানে ।
*  *  *  *  *
বাবুসোনা পরামানিক স্কুল থেকে ফিরছিল । সে গ্রামের সরকারি স্কুলে সিক্সে পড়ে । ফিরতি পথে রোজ সে ছাগল নিয়ে বাড়ি ফেরে । তার ছাগলটা ভারি লড়াকু । খালি গোত্তা মারতে চায় মাথার শক্ত উঁচু অংশটা দিয়ে, শিং কেটে দেওয়া হয়েছে, তাও । বাবুসোনার বাবা সেলুন চালায় । অথচ তার মাথায় তেল বা, শ্যাম্পু কোনো কালে পড়েছে বলে মনে হয় না ! রুক্ষ চুলের সাথে সাথে রুক্ষ স্বভাব তার । এই বয়সেই মুখে অসম্ভব গালিগালাজ । বাবুসোনা পাড়ার পার্টি অফিসের দাদাদের ইনফর্মার । ওরা তাকে চপ, তেলেভাজা ইত্যাদি খাওয়ায় প্রায়ই, বিনিময়ে তাকে শুধু চোখ-কান খোলা রেখে, এলাকার সব খবর সংগ্রহ করতে হয় ।
বাবুসোনা এগিয়ে গিয়ে শহীদের বাপ-কে জিজ্ঞেস করে, “কখন এলো গো বডি ?”
পাশ থেকে ভ্যানওলা শিবে ধমকায়, “তোর কী বে ? ভাগ্ !”
“ওই শিবে, কেলাবে বক্সি দা-কে বললে না তোমার পিছনে বাটাম লাগাবে !” – বাপের বয়সী ভ্যানওলা-কে শাসিয়ে, দাঁত বার করে হাসে বাবুসোনা ।
“যাঃ যাঃ দাঁত ক্যালাস্ না !”
বাবুসোনা ঘুরে যায়; সূর্যের ক্রমশ হেলে পড়া আলোর দিকে পিছন ঘুরে ঝুঁকে পড়ে বডির উপরে । তার ছায়া পড়ে মৃতের শরীরে । কোনো অজানা আশঙ্কায় যেন শহীদের বাপ শিউরে ওঠে । বাবুসোনা আনমনা হয়ে ভাববার চেষ্টা করে, সীমান্ত এলাকাটা ঠিক কেমন হয় ! যেখানে সকলের হাতে বন্দুক আর একটা দেশের মানুষ মারার জন্য অন্য একটা দেশের সরকার ইনাম আর পদক দুই-ই দেয় ! তার চেয়েও বড়ো কথা, হাতে একটা বন্দুক থাকলে কাউকে সে থোড়াই পরোয়া করবে ? কিন্তু মানুষ মেরে ফেলা – সে কী ভালো কাজ ? সে মৃতের বাবা, মা, ছোটো বোন আর নববধূর মুখের প্রতি চোখ বুলিয়ে সম্ভবত সেটাই বোঝার চেষ্টা করে ।
*  *  *  *  *
ইতিমধ্যে কখন সূর্য পাটে বসেছে । আরো একটা ঘটনা ঘটে চলেছে বহুক্ষণ ধরে । শিল্পী নিত্যানন্দ খান পড়ন্ত আলোয় শহীদের ছবি আঁকছেন । আঁকা প্রায় শেষ । সত্যি বলতে তাঁর ছবিতে শহীদ উপলক্ষ মাত্র । প্রমত্ত ভ্রমরের কাছে ফুল যেমন নিমিত্ত মাত্র, ফুলের সৌন্দর্যে তার কোনো বাসনা চরিতার্থ হয় না, মধু আহরণই তার মূল উদ্দেশ্য । ঠিক তেমনি, নিত্যানন্দ বাবুর আঁকা-ও ।  সেই আঁকায় ধূলি-ধূসর সীমান্ত-নিসর্গ আছে, কাঁটাতার ও আছে, মায়ের চোখে আছে বেদনা, মৃতের বউয়ের চোখে জল, বাবা সেখানে বুক চাপড়াচ্ছে । একটু নাটকীয় করে না তুললে আর কীসের ছবি ! নিত্যানন্দ বাবু এককালে খুবই নাম করেছিলেন । তিনি-ই সেই ষোলো ফুট বাই বারো ফুটের বিখ্যাত তৈল চিত্র ‘ফুটপ্রিন্টস্’-এর চিত্রকর । বাংলায় বললে, ‘পদাঙ্ক’ বলা যায় বোধহয় । সেই ছবিতে তিনি একশো আট জন ভিন্ন শ্রেণি, ভিন্ন বৃত্তি, ভিন্ন পেশা, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন বয়স, ভিন্ন লিঙ্গ, ভিন্ন স্বভাব, ভিন্ন মেধার মানুষের সত্যিকার পায়ের ছাপ তেল রঙের উপর ধরেছিলেন । নীচে লেখা ছিল, “পায়ের ছাপে যায় না চেনা, কেবা কাছের কে অচেনা !” কিন্তু নিত্যানন্দ বাবুর জীবনটাই বদলে গেল, একবার পুরীর সমুদ্রে পরীক্ষামূলক বালির ভাস্কর্য বানাতে গিয়ে । তিনি প্রায় সবটা কাজ সাড়ে তিন ঘন্টার চেষ্টায় গুটিয়ে এনে ডাবের জল কিনতে গেসলেন । আর ফিরে এসে দেখলেন, কিস্যু নেই কোত্থাও । সমুদ্রের ঢেউ সব ধুয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে । তিনি সেদিন বুঝেছিলেন, জগতে সকলি অনিত্য । তারপর থেকে তিনি গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ান । ঘরে তাঁর মন টেকে না, আর ঘরে কেই বা আছে তার জন্য অপেক্ষা করে ? এখন কেবল সাধারণ, খেটে-খাওয়া মানুষের দুঃখ-কষ্টের চিত্র-রূপ দেন । কিন্তু ওই নাটকীয়তাটুকু তাঁর স্বভাব, ওটাকে আর ছাড়তে পারেন নি ।
*  *  *  *  *
লোকাল ক্লাবের ছেলেরা বাইকে চেপে চলে এসেছিল ঘটনাস্থলে । কোন্ বিধায়ক নাকি রাত আটটায় আসবেন । ততক্ষণ বডি সরানো যাবে না ! এদিকে আকাশে মেঘ জমছিল । বাতাসে ধুলো উড়ছিল এলোমেলো । মৃতের বাবা একবার ব্যস্ত শিল্পীর দিকে, একবার বাবুসোনার দিকে তাকান । তারপর আকাশের দিকে চাইতেই একফোঁটা জল তাঁর নাকের ডগায় টপ করে এসে পড়ে । ব্যান্ড পার্টি চলে এসেছে । কিন্তু উদ্বিগ্ন পিতা, ক্লাবের ক্ষমতাবান দাদা বক্সি দা-কে জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারে না, “বৃষ্টি এসে পড়ল যে… বাবুদের কি আসতে অনেকটা দেরি হবে ?”
“হ্যাঁ… হবে । এনি প্রবলেম ?”
হতবুদ্ধি পিতার কপালে ভাঁজ পড়ে । বলে, “ছেলেটা ভিজবে যে !”
“ছেলে আবার কী ? শহীদ ।” – বাপের ভুল শুধরে দিয়ে বক্সি দা বলে ওঠে, “শহীদের গায়ে জল আমরা এক ফোঁটাও লাগতে দেবো না ! আমরা আছি তো । ও এখন সকলের ।” বলতে বলতে মালাগুলো সাজিয়ে দেয় ।
তারপর একটু শ্লোগান ওঠে, একটু জয়ধ্বনি ! অন্যদিকে ছবি শেষ করে শিল্পী উঠে দাঁড়ান । এবার বাবুসোনা ঝুঁকে পড়ে ছবির উপরে আর অবাক হয়ে যায় তুলির আশ্চর্য টান দেখে । শহীদ তো নয়, যেন রাজা ! তাকে ঘিরেই সব কিছু । গোলা-গুলি, চোখের জল, দেশ – সঅঅব !
নিত্যানন্দ খান তখন জর্জ ওরওয়েলের একটা উদ্ধৃতি ভাবছিলেন, “The War is not meant to be Won, it is meant to be continuous… In principle the war effort is always planned to keep society on the brink of starvation.” সত্যি গাঁয়ের লোকগুলোর চেহারা দেখো না ! গায়ে কিস্যু নেই । ঘরে ঘরে এসময় পর পর শাঁখ বেজে ওঠে । নিত্যানন্দ বাবুর সহসা মনে হয়, তাঁর চেয়ে অনেক বড়ো শিল্পী এই শহীদ ছেলেটি… এই তো এত ঘটনা ঘটছে চারপাশে, সে কেমন নির্বিকার ! কেমন চরম ঔদাসীন্যে সে মুখের ঢাকাটুকু পর্যন্ত সরিয়ে দেখছে না । দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে, সে সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে, ফিরেও চাইবে না ! জীবনের পরোয়াও করে নি সে ! কতই বা বয়স ? নিত্যানন্দ বাবু কোথায় যেন শুনেছিলেন, সীমান্তে জওয়ানদের স্মৃতি হতে হয় হাতির মতো । শত্রুপক্ষের প্রত্যেকটি গুলির জবাব দেওয়ার জন্য তীব্র জেদ তাদের বুকের মধ্যে লালন করতে হয় । একটা চরম কিছুর জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয় । এসব ভাবতে ভাবতেই শিল্পী অনুভব করেন, কখন বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে ! আর তাঁর এত পরিশ্রমের আঁকা ধুয়ে যাচ্ছে । যাক্ গে… এই সব মিথ্যে । সত্যি হল, এই নির্বিকার অপরাজেয়তা । একটা বিরাট লাল ত্রিপল টেনে এনে মেলে ধরা হচ্ছে শহীদের বডির উপরে । বারবার বলা সত্ত্বেও ছেলের মৃতদেহটি সরানো হয় নি বলে, বুড়ো বাপ আক্ষেপ করছে । মা ঘরের খুঁটি ধরে অনড় । বউ-টা কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে, দাওয়ায় বসে । বাবুসোনা আর ক্লাবের ছেলেদের সাথে দুজন কনস্টেবল ত্রিপল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে । বৃষ্টি যেমন হঠাৎ করে আসে, তেমনি হঠাৎ চলে যায় । আর শিল্পী নিত্যানন্দ খান অবাক হয়ে দেখেন, তাঁর শিল্প বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় মারা পড়েছে বটে, কিন্তু নির্মিত হয়েছে এক আনকোরা শিল্প । মরে গিয়ে ফের বেঁচে উঠেছে তাঁর ছবি ! নিত্যানন্দ বাবুর চোখে জল চলে আসে । কৃতজ্ঞ বোধ করেন তিনি; কিন্তু কার কাছে – বুঝে উঠতে পারেন না ।

কলমে অভিষেক ঘোষ ,কসবা, কোলকাতা 

পেশায় স্কুল শিক্ষক, নেশায় কবি, গল্পকার প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক । বিগত দশ বছরে আনন্দবাজার পত্রিকা সহ নানা পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে । প্রকাশিত হয়েছে ‘শব্দের অভিযান’ কবিতা সংকলন ।

6 COMMENTS

  1. দারুণ গল্প।অসাধারণ উপস্থাপনা।
    আমি অভিষেকবাবুর একজন গুণমুগ্ধ পাঠক।ওঁর আরও শ্রী ও সমৃদ্ধি কামনা করি।

  2. অদ্ভুত অনুভূতি আর ভালোলাগা । খুব সুন্দর ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here