চেনা কাউকে দেখতে পেলেই মাথা নিচু করছে রমেন্দু । মুখোমুখি হতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে  তার। এই অঞ্চলে অনেকেই চেনে তাকে । কেউ না কেউ ঠিক থেকে যাবে । যার সঙ্গে মুখোমুখি হলেই দুমড়ে মুছড়ে একবারে শেষ হয়ে যাবে সে। পরিচিত জনরা অনেকেই তার জন্যে হা-হুতাশ করে । নানাভাবে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে । কিন্তু তার ভাগ্যটাই খারাপ। সারাটা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে তীব্র লড়াই করে করে, ক্লান্ত । ইদানিং আর কিচ্ছু ভালো লাগে না তার । মরে যেতে ইচ্ছে করে । কিন্তু একটা জায়গায় আটকে যাচ্ছে সে। সীমাকে কোথায় কার কাছে রেখে যাবে ! মাথা নিচু করে  লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ,কিন্তু বুকের মধ্যে এই সব চাপান উতর চলছে রমেন্দুর। আর  ভয়ে  বুক ধুক পুক করছে কেবল। অসম্ভব একটা অস্বস্তি বোধ তাকে ভেতরে ভেতরে তাড়া করে বেড়াচ্ছে এই মুহূর্তে।
প্রথম বার  অনেক ভাবনা চিন্তা করেই লাইনে দাঁড়াবে না ভেবেছিল । কিন্তু সীমার করুণ  ক্ষুধার্ত দৃষ্টি তাকে ধাক্কা দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সেদিন । লাইনে দাঁড়াতে গেলে যে কুপুন কাটতে হয়, তাও জানত না।  হঠাৎ একজন অপরিচিত ছেলে বলল , এই যে দাদা আপনি  কুপন নেন  নি তো । সে তখন ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাকিয়ে ছিল । তখনই ওপাশ থেকে তরুণ ব্যানার্জি ,তার বন্ধু । বিখ্যাত লেখক । সে  বলল এই  পাপ্পু , ওনাকে লাইন থেকে বেরিয়ে আসতে বল । তুমি চলে এসো রমেন্দু। তোমার মত একজন এত বড়ো মাপের শিল্পী । তার কদর যখন বুঝল না কেউ , সেটা আমাদের লজ্জা তোমার নয়। আমি জানি তুমি কি । কিন্তু কি বলব ভাই ?  যাক এখন সে কথা ।পুজো পর্যন্ত প্রতি মাসেই এরা  ত্রাণ দেবে । তুমি এসে নিয়ে যেও রমেন্দু ।
পাপ্পু  খুব বুদ্ধিমান , সেনসেটিভ ছেলে। তাকে  কিছু বলতেই হল না । সেকেন্ডের মধ্যে সমস্ত কিছু একটা বড়ো  প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে , রমেন্দুর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল ।
মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছিল সেদিন ।লজ্জায় অপমানে , নাকি কষ্টে সে জানেনা , বুকের ভেতরটা অদ্ভুত একটা জ্বালা জ্বালা ভাব হচ্ছিল । বাড়ি ফিরে এসে সীমাকে ,সব কিছু দেখিয়ে যখন বলেছিল সমস্ত ঘটনা । সব শুনে সীমা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর স্থির চোখে পলক হীন তাকিয়েছিল তার দিকে । তার পর পর্বতের গহন গভীর কন্দর থেকে , যেমন করে স্বচ্ছ জলের ধারা বেরিয়ে আসে । তেমনি করে তার চোখের জল , অমসৃণ গাল বেয়ে বেয়ে নেমে আসছিল অনবরত। মনে পড়ে যাচ্ছিল পূর্ব জন্মের কত স্মৃতি । হামাগুড়ি দিয়ে চলে বেড়াচ্ছিল তারা । স্থির  দৃষ্টির গভীরে একটা  চলমান ছবি  ভেসে উঠছিল চোখের তারায় । দুধের গ্লাস নিয়ে ছুটছে মা । আর একটা ছোট্ট মেয়ে টুক টুকে লাল ঘটি হাতা ফ্রক পরে সারা বাড়ি ছুটছিল । আমি দুধ খাবো না আ আ আ । কিন্তু মা পিছন পিছন ঘুরছে আর বলছে , দুধ টুকু খেয়ে নে মা । লক্ষ্মী মা আমার । বাবা মার একমাত্র  সন্তান । সে যা খেতে ভালো বাসে , বেছে বেছে তাই রান্না করত  মা ।  আজ দুটো খাবার জন্যে অনাথ অসহায় মানুষদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে ! হায় ঈশ্বর !
ভালোবাসা ! কী অদ্ভুত ! বাবা মা আত্মীয় স্বজন ,অগাধ সম্পত্তি সব ছেড়ে দিয়েছে রমেন্দু । সারাটা জীবন কোনো অসততার সঙ্গে আপোস করে নি। শুধু ছবি আঁকবে ইচ্ছে মত এই ছিল তার স্বপ্ন ।
সীমা একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরি পাবার  পরই ঘর ছেড়ে চলে এসেছিল আর কোনো দিন যায় নি।রমেন্দুও না ।নতুন সংসার তাদের। চোখে তখন হাজারো স্বপ্ন ।  রমেন্দু ছবি আঁকবে আর একটা দুষ্টু মিষ্টি কে আগলাবে । সীমা স্কুলে চাকরি করে, যা পাবে তাদের তিনটে পেট চলে যাবে । কিন্তু মানুষের নিজের হাতে কাটা ছকে তার নিজের জীবন চলে না । তাদের সেই স্বপ্নের রেখা চিত্র  কবেই বানভাসি হয়ে গেছে । পর পর দুবার মিস ক্যারেজ হল সীমার । দু বছর পর  ইউম্যারেটিক আর্থরাইটিস এ পঙ্গু হয়ে গেল। একবারে শয্যাশায়ী । তার চাকরি গেল । রমেন্দুকে চাকরি করতে বেরুতে হল । তার পর  থেকে আজকের এই নোঙরহীন নৌকায় ভাসা জীবন তাদের ।
এই যে দাদা আপনি কুপন নিয়েছেন ? সেই পাপ্পু বলে ছেলেটি । বলার পরই বলল ও আপনি। আচ্ছা আপনাকে লাইনে থাকতে হবে না । আপনি  বেরিয়ে এসে এই বেঞ্চে বসুন। আর আপনারা সবাই ডিসটেন্স মেনটেন করুন প্লিজ । প্রত্যেকের হাতে কুপন রাখুন । আমরা ডাকব আপনারা একে একে এসে নিয়ে নেবেন। কথা শেষ হলে রমেন্দুকে ডেকে নিয়ে চলে গেল পাপ্পু । কিছুক্ষণের মধ্যেই রমেন্দু চুপ চাপ ব্যাগ নিয়ে ,মাথা হেঁট করেই বেরিয়ে গেল । লাইনে যারা দাঁড়িয়ে ছিল ভাবল ভিখিরিরও আবার ভি আই পি কোটা !  ধুস শালা । তাজ্জব ব্যাপার ! এমন একটা আর্টিস্টিক চেহারার আঁতেল কেন ভিকিরির দলে এসে পড়ল কে জানে !!
বেরিয়ে আসার সময় কথা গুলো কানে যাচ্ছিল রমেন্দুর । নিজের খুব অপরাধ বোধ হচ্ছিল । সত্যি কথাই বলেছে ওরা । তারও  কুপন নিয়েই লাইন দিয়ে নেওয়া উচিত । আবার তার মনে হল, পরের বার আর আসবে না ।  যেখানেই যাক না কেন ,এই ক্লাবে আর আসবে না।  লজ্জায় অপমানে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছা করে তার । কিন্তু যা শুনেছে তাতে কোনো ভাবেই লোভ সামলানো কষ্টকর। এই ক্লাবের দুর্গা পুজোর বাজেট থাকে সত্তর আশি লাখ টাকা । সেই টাকাটা পুরোটাই এবার দুর্গতদের জন্য বরাদ্দ করেছে পুজো কমিটি । প্রতি মাসে দেবে । পাঁচ কেজি চাল , পাঁচ কেজি আলু। এক ট্রে ডিম ।এক কেজি মুসুরির ডাল । পাঁচশ ছাতু । সাবান ।ডেটল। আটা । যা দিয়েছিল তাতেই প্রায় একমাস চলে গেছে তাদের দুটো প্রাণির।   । নিজের ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার, তবুও আসতে তাকে হবেই । প্রথম দু চার দিন সে বাড়িতে না খেয়েও উপুড় হয়ে পড়েছিল । কিন্তু সীমার কাতরানি তাকে পাগল করে দিচ্ছিল । ঘরের মধ্যে  টিকতে পারছিল না । পেটের জ্বালায় রোগের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তীব্র গভীর করুণ  দৃষ্টিতে তার দিকে যখন তাকাচ্ছিলো সীমা । বুকের ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল তার।  মনে পড়ে যাচ্ছিল যৌবনের সেই সুন্দর ছবির মতো মুখ চোখ আর  দুষ্টু মিষ্টি হাসি ! ধিক ধিক করে জ্বলতে জ্বলতে কবেই নিভে  গেছে সেই রূপের আগুন ! এখন কঙ্কালসার মুখের মধ্যে সেই মায়াবী চোখের চাহনি, আর কোথাও নেই । অসীম একাকিত্বভরা জীবন তাদের । পৃথিবীতে কোনো মানুষ এইভাবে একেবারে একা ভাসা শ্যাওলার মতো বেঁচে থাকে, এটা কল্পনা করাও  দুঃসাধ্য । তারা দুজন গত হলেই , শেষ হয়ে যাবে তাদের পূর্বপুরুষ থেকে বয়ে আসা আবহমান স্রোত। মাঝে মাঝে এই তীব্র জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নিতে চেয়েছে রমেন্দু ।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেনি। কেননা সীমার সেই শূন্য আদিগন্ত প্রসারিত জীবন তৃষ্ণা, তাকে নাড়া দিয়েছে । সে বেঁচে থাকতে চায়। সে এখনো সুস্থ জীবনে ফিরে আসার স্বপ্ন দেখে । সেই স্বপ্নকে একমাত্র সেই তো এতদিন ধরে পালন করেছে ।  এখন  এই ষাট উত্তীর্ণ জীবনে ,আর  কোনো চাওয়া পাওয়ার হিসেব নিকেশ নেই । অন্তর্জলী যাত্রায়  ধাবিত হচ্ছে তার আয়ু । কোনো  প্রাপ্তির প্রত্যাশা নেই । কিন্তু তার  দায়বদ্ধতা ছিল ভালোবাসার কাছে । তাই সীমাকে একা অকুল দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে , স্বার্থপরের মত নিজের মুক্তি খুঁজে নিতে পারে নি । খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একদিন খেয়ে ,দুদিন না খেয়ে এই ভাবেই চলছে  দীর্ঘদিন । তার মধ্যেই  শুরু হলো এই মহাপ্রলয় । যা তাকে মেরে ফেলতেই পারত । কিন্তু বাঁচিয়ে দিল । আর যাই হোক এই জোড়া মহা প্রলয়ে তার লাভই হল। কতদিন পেট ভরে খাবার জুটত না তাদের । এখন এই বিধ্বস্ত সময়ে চার বেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে । আর নিজের ইচ্ছা মত ছবি আঁকছে । জীবনের শেষ বিন্দুতে এসে মরিয়া হয়ে উঠেছে রমেন্দু। এই তার শেষ ছবি  আঁকা । স্বীকৃতি তাকে পেতেই হবে ।  সীমার ওই বিষন্ন করুন মুখে গোধূলির আলোর ছিটের মত এক ঝলক হাসি তাকে দেখতেই হবে ।
সীমা স্থির দৃষ্টি তে দেখে রমেন্দুকে । ওর মুখের মধ্যে দপ দপ করে, একটা আলো । শিল্পীর মরিয়া জেদ । যা এর আগে কখনো দেখে নি সে। অত বড় একজন শিল্পী ,কেউ চিনল না জানল না ! কত নামি দামী বিজ্ঞাপন সংস্থায়  কাজ পেয়েছে, কিন্তু কোথাও অ্যাডজাস্ট করতে পারে নি । চারদিকে এত দুনাম্বারি  , কোথাও মুখ বুঝে মানিয়ে নিতে পারে নি  রমেন্দু । তাই সংসারের দারিদ্র আর ঘোচে নি তাদের । এই করোনা , আমফুন  তাদের দারুন বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছে । তিন মাস ধরে কোনো চাকরি ছিল না । চারি দিকে ধার দেনা । সবে নতুন চাকরিতে ঢুকেছিল। একমাসের মাইনা পেয়ে আগে হাসপাতালের  ফেয়ার ইন প্রাইস সপ লাইনে দাঁড়িয়ে সীমার ওষুধ গুলো কিনে নিয়েছিল মাস তিনেকের । বাড়িওয়ালা রোজই তাগাদা করতে এসে , সীমার অসুস্থ রুগ্ন শরীর, আর দু-তিন দিন দুপুরে রান্না না হওয়ার গল্প শুনে আর  মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না । তারপর একথা-সেকথা বলে বাড়ি চলে যায়। এই ক ”দিন ঘরে খাবার ওষুধ  সব মজুত আছে । রমেন্দু সারা দিন ধরে শুধু এঁকে চলেছে । সীমা পেট পুরে খাবার আর ওষুধ পেয়ে আবার যেন বেঁচে উঠছে আস্তে আস্তে। রমেন্দু নিজেকে নিংড়ে বার করে আনছে। দিন রাত জ্ঞান নেই তার । একবার শেষ বারের মত মরিয়া চেষ্টা ।
রবিবার  ভোরে উঠে রমেন্দু বেরিয়ে পড়ল ঝুলি ঝালা নিয়ে ।কোথায় যাচ্ছে কি করছে কিছু জানালো না সীমাকে ।শুধু বলে গেল ফিরতে দেরি হতে পারে । হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছলো চেতলা অগ্রণী সংঘের মাঠে । সুন্দরবনের আমফুন দুর্গতদের জন্যে  ত্রাণ  তহবিলে অর্থ সংগ্রহে পথে নামবে তারা । মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এই পদ যাত্রায় থাকবেন । সেখানে তার সব ছবি নিলাম করবে রমেন্দু। সেই টাকা দান করবে সুন্দরবনের দুর্গতদের তহবিলে। কিন্তু ক্লাবের সেক্রেটারি রাজি হচ্ছেন না । ততক্ষণে বেশ কটা ছবি ঘাসের উপর সাজিয়ে রাখা হয়ে গেছে তার । রমেন্দু অনেক অনুরোধ করল। তাতেও যখন রাজি হল না , তার মাথায় জেদ চেপে গেল। বলল আমি ছবি তুলব না । আপনি যা পারেন করুন ।বলার সঙ্গে সঙ্গে উনি ঠেলে ফেলে দিলেন রমেন্দুকে। তার পরই মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি ঢুকতেই ধস্তাধস্তি করে তাকে সরিয়ে দিয়ে , হুটপুট তার ছবি খুলে জড়ো করে দিল। লণ্ডভণ্ড হয়ে  পড়ে থাকল তার আঁকা ছবি। রমেন্দু ছবি গুলো বুকের কাছে নিয়ে করুন তীক্ষ্ম রুক্ষ চোখে চেয়ে থাকল নির্নিমেষ । চোখে তখন  ছলাৎ ছলাৎ উত্তাল পদ্মার ঢেউ। পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা মা ।স্টিমার এগিয়ে আসছে কলকাতার দিকে ।এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে ছেলেকে কলকাতা পাঠাচ্ছে বাবা মা । একদিকে স্বপ্ন ময় আগামির হাতছানি আর একদিকে বুকের পাঁজর ভাঙার শব্দে উত্তাল পদ্মার সেই ভাটিয়ালি । আস্তে আস্তে সেই সুর তার সমগ্র চেতনার উপর প্রলেপ দিতে থাকে । রমেন্দু ভুলে যায় তার ব্যথা বেদনায় ভরা বঞ্চিত জীবনের মহাকাব্য। তার কানে তখন সেই নদীর কান্না । আস্তে আস্তে অবচেতনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে । রমেন্দু ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে সেই সুরে ।চরাচর ব্যাপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সেই সুরের জাদু । রমেন্দু বুকের কাছে ছবিগুলো আগলে নিয়ে নিথর শুয়ে আছে বেহুঁশ।বহুদূর থেকে ভেসে আসছে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আর দাঁড়ের ঝুপ ঝুপ শব্দ। সুরে সুরে ভেসে যাচ্ছে তার পারমার্থিক আয়ু – – –
মাঝি তুমি কোন গাঙে নাও বাইয়া যাও
যাইতে যাইতে কার পানে ফিইরা তাকাও
মা – — ,ঝি – – – – ই ই ই ই

 

কলমে শ্যামলী রক্ষিত, কলকাতা

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here