সত্যিই ভালোবাসা-ছোটগল্প

2
1345

                                                             ( ১ )

বাইরে একটানা বৃষ্টি পরেই চলেছে। ঝমঝম, টিনের উপর বৃষ্টি পরার টুপটাপ আওয়াজ সমানে হয়ে চলেছে। জানলার ধারে দাড়িয়ে সব শুনছে, দেখছে বিল্টু। গোল গোল বৃষ্টির ফোঁটাগুলো নিচে নামতে নামতে কান্নার জলের ফোঁটার মত হয়ে যাচ্ছে আর তা প্রাণপণে আছরে পরছে টুপাইদের টালির চালে, মতি জেঠুর পুকুরে, লিলিদের টিনের চালের উপরে। সব দেখছে বিল্টু। বৃষ্টি দেখতে খুব ভালো লাগে বিল্টুর। সমানে একটানা দেখে যেতে পারে , কোনো ক্লান্তি আসেনা ওর মধ্যে। আর শুধুই কি বৃষ্টির ফোঁটা, ওই যে কাকটা পুরো বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে আর নারকোল গাছটার উপরে দাড়িয়ে কাপছে সব দেখে বিল্টু। ওর মা তো মাঝে মাঝে বলে ওকেতুই সেই ছোটই রয়ে গেলি, অমন বাচ্চাদের মতো বৃষ্টি দেখে নাকি কেউসত্যিই বিল্টু যে ফার্স্ট ইয়ার পরে কে বলবে ওকে দেখে তখন। এই টিনের চাল, বৃষ্টির ফোঁটা, ভিজে কাক সবে যখন হারিয়ে গেছে বিল্টু তখন ওর হুস ফিরলো হটাৎওয়েলকাম ওয়েলকামআওয়াজে। ওদের  টিয়া মিতু এটা নতুন শিখেছে। কেউ ঘরে ঢুকলেইওয়েলকাম  ওয়েলকামকরে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে। বিল্টু বুঝলো মা এসেছে হয়তো। ঘড়িতে দেখলো সাড়ে পাঁচটা বাজে। হ্যা মা এসেছে, এমন সময়ে মা আসে রোজ। দোতলার ঘর থেকে নিচে নেমে এসে দেখলো একদম চুপচুপে ভিজে মা দাড়িয়ে আছে। মায়ের অগোছালো ভেজা চুল আর পুরো ভিজে যাওয়া জামাকাপড় দেখে ওর হটাৎ বাইরে নারকোল গাছের উপরে দেখা ওই কাকটার কথা মনে পড়ে গেলো। মনে মনেই হেসে ফেললো বিল্টু। আবার ঠিক পরেই মুখটা গম্ভীর করে বললোতোমায় না কতবার বলেছি ছাতা নিয়ে যেতে, সেইবার বৃষ্টি ভিজে কেমন শরীর খারাপ হলো মনে নেই। নাবিল্টুর মা হেসে ফেললো বললোসব মনে আছে , আসলে এখন স্কুলে ছাত্রদের পরীক্ষা চলছে তো তাই আমাদের টিচারদের একটু চাপ চলছে। কিছুনা আমি এখুনি ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি। তুই আমার চিন্তা না করে পরতে বোস যা মায়ের কথা শেষ হতেইহ্যাঁ যাচ্ছিবলে বিল্টু উপরে উঠে এলো। বাইরের বৃষ্টিটা হালকা হয়ে এসেছে এই খানিকক্ষণের মধ্যেই। বিল্টু দেখলো নারকোল গাছের উপরে বসা ওই কাকটা আর নেই এখন।

                                                              (২)

বাইরে জিয়ান সমানে ডেকে চলেছে। কোনো মতে পাউরুটির টুকরোটা মুখে ঠুসে, সাইকেলের চাবিটা নিয়ে বাইরে এলো বিল্টু। বাইরে এসেই দেখলো জিয়ান হাসি হাসি মুখ করে দাড়িয়ে আছে।চল চল তাড়াতাড়ি চলবলে সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দিল বিল্টু। জিয়ান ওর মোটা শরীরটা নিয়ে প্রাণপণে সাইকেলে ছুটিয়ে বিল্টুর সমানে এসে বললোআগের সপ্তাহে তো তুই যাসনি , আমি একদিন গিয়েছিলাম কলেজ। কে একটা অপ্সরা মতন মেয়ে নাকি এসেছে। আমিও দেখলাম সুন্দর দেখতে, তবে হেব্বি ঘ্যাম ভাই জানিস। সবাই চেষ্টা করছে , তুইও একবার করতেই পারিসকথাগুলো বলেই যেনো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে এমন একটা ভাব নিয়ে হাসলো জিয়ান। বিল্টু ওর কথা শুনেও না শোনার ভান করে রইলো। জিয়ান এমন কথা মাঝে মাঝেই বলে। ওর সব কথায় পাত্তা দেয়না বিল্টু।

বিল্টুর বাড়ি থেকে কলেজ যেতে সাইকেলে ১৫ মিনিট মতন সময় লাগে। আর জিয়ান সেই ক্লাস ফাইভ থেকে বন্ধু। তবে হ্যা ওর আসল নাম কিন্তু জিয়ান না, ওর ভালো নাম যতীন গুহ। সেই ক্লাস টেন পড়ার সময় একটা মেয়েকে ইম্প্রেস করার জন্য একবার গান গেয়েছিলো, ব্যাস ওই গানটাই ওর নামের কারণ। শরীরের সাথে সাথে ওর গলার আওয়াজ ভীষণ রকমের মোটা। মাঝে মাঝে মনে হয় যেনো মাইকে কথা বলছে। তখন ক্লাস টেনে পড়লেও আজকের মতন ফেসবুক তখন অতটাও জনপ্রিয় হয়নি। তাই সকলেই কার্টুন দেখতো, ডোরেমন কার্টুনের জিয়ানের ভয়ানক গানের গলার সাথে সবারই অল্প বিস্তর পরিচয় ছিল। সেই থেকেই ওর নাম জিয়ান হয়ে যায়।সামনের মোড়ে একটু দরাস তো, লক্ষনকাকার দোকানে একটু যাবোবললো জিয়ান। যদিও জিয়ান না বললেও দাড়াতো বিল্টু , কারণ জানে এই লক্ষণকাকা দোকানের কচুরি না খেয়ে জিয়ান তার দিন শুরু করে না। অন্যদিনগুলোতে বিল্টুও ওকে সঙ্গ দেয় তবে আজ আর ওর ইচ্ছে করলো না। প্রায় একটা কচুরি পার সেকেন্ড স্পিডে চারটে কচুরি খেতে বেশিক্ষণ সময় নিলোনা জিয়ান। হাতটা ধুয়ে একটা পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলেচলবলে সাইকেলে চেপে পড়ল জিয়ান। চন্দননগরের যেই জায়গাটায় ওরা থাকে সেই জায়গাটা বেশ সুন্দর। ঠিক যেন একটা শহর আর একটা গ্রামের মিশেল। যেমনি সবুজ ঘাস তেমনি আবার উঁচু উঁচু হাইরাইজ। বিল্টু চুপচাপই যাচ্ছিল তা দেখেন জিয়ান হঠাৎ বলে উঠলকিরে মেয়েটাকে দেখলি না আর এখনই তার চিন্তায় ডুবে গেলিকথাটা বলেই ফিক করে হেসে দিল জিয়ান।রাখতো তোর বাজে কথা, ওই দেখ সামনে অত ভিড় কিসের রে?” জিয়ান বলে উঠলোহ্যা , তাই তো। চল দেখি

                                                                (৩)

ছেলেদের এই একই দোষ, একটু সুন্দরী মেয়ে দেখল কি দেখল না চলে আসলো কথা বলতে,  বিরক্তিকর যতসবকথাটা ঋতুকে বলেই পাশে তাকিয়ে ছেলেটাকে প্রথম দেখল শবনম। এই কলেজে যাবে থেকে এসেছে সকলে ওকে হাঁ করে দেখেছে। প্রত্যেকের ওই বিরক্তিকর দৃষ্টি ছোটবেলা থেকেই দেখতে অভ্যস্ত ও। তার যথেষ্ট কারণও আছে শবনম কে দেখতে খুব সুন্দর। মানে সুন্দরী মেয়ের ডেফিনেশন দিতে গেলে যা যা থাকা চাই তা সবই শবনমের মধ্যে আছে। এই প্রথম কলেজে আসার পর দেখল কোন ছেলে ওর পাশ দিয়ে গেল আর তাকালো না।  অন্য কোন মেয়ে হলে হয়তো তার খারাপ লাগতো কিন্তু শবনমের বেশ ভালো লাগলো। ঋতুকে চটপট ছেলেটাকে দেখিয়ে দিল একবার ও। তারপর ওর কারণেই তৈরি হওয়া ভিড়টা থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে ঋতুকে বললএই ছেলেটা কে রে?” ঋতু বললোওতো বিল্টু, মানে বিপ্লব চৌধুরি। কেন বলতো? পছন্দ হল নাকি?” শবনম এবার একটু এগিয়ে গিয়ে বললোধুর তোর খালি বাজে কথা। আমার খুব খিদে পাচ্ছে চল তো একবার ক্যান্টিন থেকে ঘুরে আসিকথাটা বলেই শবনম ক্যান্টিন এর দিকে এগোতে লাগলো। ঋতুও চললো ওর পিছু পিছু। এই কলেজের বি.কম এর প্রথম বর্ষের ছাত্রী শবনম। ওর বাবা মানে  মি. মৌলানা খুব রাশভারী মানুষ। অনেক বড় ব্যবসা ওনার ব্যবসার কাজে মাঝেমধ্যেই এই শহর সেই শহরে যাওয়াআসা লেগেই থাকে। কয়েক সপ্তাহ হয়েছে ওরা এই জায়গায় নতুন এসেছে তাই ওর কোন নতুন বন্ধু নেই এখানে। শবনম এর মা মারা গেছেন আজ প্রায় সাত বছর হল। শবনমের এখনও স্পষ্ট মনে আছে অতো রাগি মানুষটাকে শবনম সেদিন কাঁদতে দেখেছিল। এই কলেজে আসার পর থেকেই এই কদিনে   প্রপোজ পেয়েছে ও। তবে সেই ছেলেগুলোর দিকে তাকাতেও মন চায় না শবনমের। বাবার টাকায় কেনা গাড়ি করে কলেজে আসা আর চুলে স্পাইক করা ওসব ছেলেগুলোকে বড্ড অসহ্য লাগে শবনমের। তবে আজ প্রথম কাউকে অন্যরকম পেল শবনম।  কথাটা আবার মনে পড়তেই সিঙ্গারা তে কামড় বসাতে বসাতে ফিক করে হেসে ফেললো শবনম।

                                                                                

                                                                (৪)

ঝামেলাটা দেখলি ভাই? সব কিন্তু ওই মেয়েটার জন্য। জানিস তো সেকেন্ড ইয়ার এর একটা ছেলে  নাকি একটা গোলাপফুল দিতে গেছিল, তা মেয়েটা নাকি ঠাটিয়ে এক চর মেরে দিল, কি সাংঘাতিক ভাবকথাগুলো বলতে বলতে সাইকেল রাখছিল জিয়ান আর বিল্টু নিঃশব্দে শুনছিল  তো। সাইকেলটা রাখা হতেইচল তো ক্যান্টিন থেকে একবার ঘুরে আসি , কিরকম যেনো খিদে পেয়ে গেলোবললো জিয়ান। এবারের চুপ রইল না বিল্টুএই তো অতগুলো কচুরি খেলি , আবার এর মধ্যেই খিদে পেয়ে গেল। পারিস কি করে এত? একবার ডাক্তার দেখা আমার তো মনে  হয় তিন চারটে পাকস্থলী আছে তোরকথাগুলো বলে সাইকেল রাখার শেড থেকে ভেরি এলো ওরা। জিয়ান বললোআরে লক্ষণ কাকার দোকানের ওই পুঁচকে কচুরিতে কিচ্ছু হয়না, তুই যাবি তো চল নাহলে আমি চললাম ক্যান্টিন এর দিকে জিয়ানকে এগোতে দেখে বিল্টুও চললো পিছু পিছু অগত্যা। দুটো দুটো চারটে সিঙ্গারা আর দুটো চা বলে জিয়ান গিয়ে ঋতুদের টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বিল্টু ঋতুকে চেনে। ওদের পাড়ার পরেই যে পাড়াটা আছে সেখানেই থাকে ঋতু। ওদের দুজনকে হটাৎ সামনে দেখে হকচকিয়ে উঠলো ঋতু তারপরেই হেসে সামনে বসতে বলল। কিন্তু রিতুর বলার আগেই জিয়ান একটা চেয়ার দখল করে বসে পড়েছে। বিল্টু বসতেই ঋতু বললভালোই হলো তোদের সাথে দেখা হয়ে গেল কলেজের ফাস্ট উইকটাই তো তোরা দুজনেই গ্যাপ মেরে দিলি, যাক ওর সাথে আলাপ কর শবনম আমাদের পাড়াতেই ওই যে শ্যাম জেঠুদের দোতলা বাড়িটা ছিল ওটা ওরা কিনেছেঋতুর কথা শেষ হতে না হতেই আচ্ছা আমি যতীনবলেই একটা হাত বাড়িয়ে দিল জিয়ান। শবনম মুখের শুধু একবারহাইবললো। জিয়ান একটু অপ্রস্তুত হয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য এগিয়ে দেওয়া হাতটা পিছনে সরিয়ে আনল। বিল্টু এতক্ষণ চুপ করে একদৃষ্টে শবনম এর দিকে তাকিয়ে ছিল ফর্সা দুটো গাল আর ঠোটের উপর তিল টার দিকে কি একটা অজানা কারণে যেন বিল্টুর চোখ আটকে গিয়েছিল।আচ্ছা আমরা এখন চলি রে আমাদের একটা ক্লাস আছেবলেই উঠে দাঁড়াল ঋতু আর সাথে সাথে শবনমও। ঠিক তখনই একটা হালকা ল্যাভেন্ডার ফুলের গন্ধ পেল বিল্টু। ঠিক ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঘনকালো চুল টা হাত দিয়ে সামান্য পাশে সরিয়ে নরম দুটো চোখ দিয়ে মেয়েটা ওকে দেখল একবার, এটা স্পষ্ট দেখল বিল্টু। এতক্ষণে ওদের সিঙ্গারা আর চাও এসে উপস্থিত হয়েছে। গরম সিঙ্গারায় একটা কামড় দিয়ে খেতে খেতে জিয়ান বললএই সেই মেয়ে যার জন্য আমাদের কলেজ সীতার স্বয়ংবর সভায় পরিণত হয়েছে, সবাই নিজের নিজের মতো পরীক্ষা দিচ্ছে। তবে কি ঘ্যাম দেখলি মেয়েটার হাত পর্যন্ত মেলালো নাকথাটা বলা শেষ করেই একটা শুকনো লঙ্কা হাত দিয়ে তরকারির আলু থেকে সরিয়ে আবার একটা বড় কামড় বসালো সিঙ্গারাটায়।  বিল্টু একবার শুধু ভাবল এই পিছন ফিরে তাকানোর মানে কি সেটাই, যা ভাবছে ?

                                                                (৫)

সেকেন্ড ইয়ারের ফার্স্ট ক্লাস আজ। এই এক বছরে অনেক কিছু হয়ে গেছে, পাল্টে গেছে অনেক কিছু। ঋতু ওর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ইতিমধ্যেই তিনবার পাল্টেছে। কি একটা কারণে জিয়ান এখন রোগা হতে চায় তাই খাওয়াদাওয়া তে অদ্ভুত একটা লাগাম লাগিয়েছে। বিল্টুর এখনো বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে তবে আর একা নয়, এখন শবনমের সাথে। ওদের দুজনের মাঝে সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। চুপচাপ থাকা বিল্টু আর ছেলেদের ছোটবেলা থেকেই এড়িয়ে চলা শবনম এখন দুজনের চোখের তারায় দুজনকে দেখতে শিখেছে। সেই এক বছর আগে প্রথম ক্যান্টিনে দেখা, ল্যাভেন্ডার ফুলের হালকা গন্ধ আর চুল সরিয়ে নরম চোখে দেখা সেই সবের যা মানে বুঝেছিল বিল্টু সেটাই এখন সত্যি হয়ে গিয়েছে। তবে এই এক বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেলেও যেটা একটুও পাল্টায়নি সেটা ওদের বন্ধুত্ব। একসাথে কলেজ, টিউশন, আড্ডা সব চলে ওদের। তবে এখনো বিল্টুর মাঝে মাঝে সব টাকে  সত্যি বলে মানতে ইচ্ছে করে না। প্রথম দেখায় প্রেম বলে পৃথিবীতে কিছু একটা আছে সেটা সে জানতো কিন্তু তার জীবনে এমন কখনো হয়নি। কখন যে বন্ধুত্ব থাকে একে অপরের প্রায়োরিটি তে পরিণত হয়েছে ওরা দুজনেই কেউ বুঝতে পারেনি তা। প্রেমে দুজন এর মাঝের দূরত্ব অনেকটা চকলেটের মতো যত কমতে থাকে ততই বেশি মিষ্টি লাগে। আর এই এক বছরে ওদের দুজনের মাঝে দূরত্ব কমতে কমতেতুই আজ কলেজে না গেলে আমিও যাবনাআরতোর কাঁধে মাথা রাখলেই কেমন সব কষ্ট ভুলে যাইতে গিয়ে ঠেকেছে। কিভাবে মা মারা যাবার পর রাতগুলোতে একা কেঁদে কাটিয়েছে শবনম তার সব সে বিল্টু কে বলেছে। এটা ভেবে অবাক হয়েছে শবনম কিভাবে নিজের মনের কথা আর একজনকে বলে এতোটা শান্তি পায় ও। এরই মধ্যে কয়েক বার ওরা দুজন দুজনের বাড়িতে গিয়েছে। বিল্টুর মা স্কুলের টিচার হলেও মোটেও রাগী নন এটা বুঝেছে শবনম। এমনকি বিল্টুর মা একদিন ভুল করে বলেও ফেলেছিলতোদের দুজনকে একসাথে কি মিষ্টি লাগে রে বিল্টু তখন স্পষ্ট দেখেছিল শবনমের লাল হয়ে যাওয়া গাল আর মুখ নামিয়ে ছোট্ট হাসিটা। বিল্টুও কয়েকবার শবনমের বাড়িতে গেছে, তবে ওর বাবার সাথে সেরকম কথা হয়নি। বা ওর বাবাই বলেননি। ওরা দুজন আলাদা ধর্মের বলে ওদের দুজনের মাঝে যে কখনো দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে সেটা ভাবেনি বিল্টু কখনো। তবে ওদের বাড়িতে গিয়ে এটা স্পষ্ট বুঝেছে বিল্টু যে ওর বাবা ওদের এই মেলামেশা খুব একটা পছন্দ করেননা। কিন্তু ওসব ধর্মের বেড়াজালে আজ পর্যন্ত কটা প্রেমের গল্প থেমেছে শুনি। তখনও বিল্টু জানেনা ওদের ধর্মের বেড়াজাল না মানা এই প্রেম শেষে কি পরিনতি পাবে।

                                                                (৬)

আচ্ছা তাহলে আজকেই পার্টিটা দিচ্ছিস, বেশ বেশ। কখন বলতো?…. ছটা , আচ্ছা। হ্যা হ্যা আমি চলে যাবো, আর জিয়ান আর আমি একসাথেই যাবো। আচ্ছা রাখি এখন। কথাগুলো বলেই ফোনটা রাখলো বিল্টু। আজ ঋতুর জন্মদিন। সকালেই ফোন করে উইশ করেছে ও। আর আজকেই পার্টিটা দিচ্ছে ঋতু।  স্টাডি টেবিল থেকে উঠে জানলা দিয়ে একবার বাইরে তাকালো বিল্টু। বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারলে হয়। ওদের পছন্দের একটা রেস্তোরায় পার্টিটা হচ্ছে আর সময়টা যে ছটা সেটা জিয়ানকে ফোন করে জানাতে আরো পাঁচ মিনিট লাগলো বিল্টুর। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ জিয়ান আসবে ওদের বাড়ি তারপর একসাথেই রওনা দেবে ওরা। বিল্টু দের বাড়ি থেকে সাইকেলে কুড়ি মিনিট মতন লাগে ওখানে যেতে। জানলার সামনে থেকে সরে এসে ঘড়িতে একবার সময়টা দেখলো বিল্টু, পৌনে পাঁচটা বাজে না আর দেরি করা ঠিক হবেনা। বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো বিল্টু।

হ্যা হ্যা , ডোন্ট ওরি পৌঁছে যাবো আমি ঠিক সময়ে। কোনো চিন্তা নেই তোর। আচ্ছা ওই রেস্তোরাঁতে, ঠিকাছে। এখন রাখি রেডি হতে হবে।ফোন টা রেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো শবনম। বিছানার সামনের বড়ো আয়নায় একবার নিজেকে দেখলো ও। বিকেলের মিষ্টি এক টুকরো আলো জানলা দিয়ে এসে ওর মুখে পড়েছে আর তাতে আরো মিষ্টি লাগছে ওকে। আজ একেবারে চমকে দেবে বিল্টুকে আজ। বিল্টুর প্রিয় রঙ নীল। এই কিছুদিন আগেই নীল রঙের একটা চুড়িদার কিনেছে , আজ সেটা পরেই যাবে আর বিল্টু এক মুহুর্তও চোখ সরাতে পারবে না। হটাৎ বিল্টুর চোখের কথা মনে পড়ে গেলো শবনমের , অজান্তেই হেসে ফেললো ও। নাহ আর দেরি করা ঠিক হবে না, বিল্টুর আগেই পৌঁছতে হবে। কথা গুলো ভাবতে ভাবে রেডি হতে চলে গেলো ও।

বাইরে সাইকেলের বেলটা শুনতে পেরেই ঘড়ির দিকে একবার দেখলো বিল্টু। পাঁচটা পঁচিশ বাজে, নাহ ঠিক সময়েই এসেছে জিয়ান তাহলে। বাইরে বেরিয়ে এসে বিল্টু দেখলো জিয়ান বারবার ঘড়ি দেখছে। মেইন গেট থেকে সাইকেলে বার করতে করতে বিল্টু বললোআরে চিন্তা নেই , ঠিক সময়েই পৌঁছে যাবোজিয়ান এবারে বললোপাঁচ মিনিট ধরে বেল দিচ্ছি , অত মেকাপ করার আর সাজার কি আছে রে তোর একটা হিল্লে তো হয়েই গেছে তোর একটু হেসে সাইকেলের প্যাডেলে চাও দিল বিল্টু। যাওয়ার পথে একটা গোলাপ কিনে নেবে ভাবছে ও। শবনমের গোলাপ খুব পছন্দের। যেকোনো ছোট উপহার সেটা ফুল হোক বা চকোলেট সেটা পেয়ে শবনমের মুখে একটা সারল্যের হাসিতে ভরে যায় এটা  দেখেছে বিল্টু। আজও নিশ্চই তাই হবে, ওর মুখের ওই হাসিটা দেখার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছেনা বিল্টু। খানিকক্ষণ আগেই ভালোমতন বৃষ্টি হয়েছে , রাস্তাঘাট এখনও ভিজে। চারপাশের গাছগুলো এখনও যেনো কেপে উঠছে মাঝে মাঝে। হালকা ঠান্ডা একটা হাওয়া জানান দিচ্ছে দূরে কোথাও এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য বিল্টুর মনে হলো সব কিছু যেনো কত ভালো, ঠিক যেমনটা চেয়েছিল ঠিক তেমনটাই। ওর এই চিন্তায় ছেদ পরলো একটা ক্রিং ক্রিং আওয়াজে। ফোনের আওয়াজ। জিয়ানের ফোনটা বাজছে। সাইকেলে থামিয়ে জিয়ান ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওর মুখটা নিমেষে কালো হয়ে গেলো। ওপাশ থেকে ভেসে আসা কথাগুলো শুনতে না পারলেও বিল্টু এটুকু বুঝলো যে সিরিয়াস কিছু একটা হয়েছে।

                                                             ( ৭)

তোকে সারপ্রাইজ দেবে বলে তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিল। তোর আগে পৌঁছে যাবে বলেই অত তাড়াতাড়ি করছিল। মীনুদিদের বাড়ির সামনের গলিটা থেকে একটু এগিয়ে যে অটো স্ট্যান্ড আছে ওখান থেকে অটো ধরবে বলে এগোচ্ছিল। রাস্তার উল্টোদিক থেকে একটা বাইক আসছিল। বৃষ্টির কারণে রাস্তা পিছলা হয়েছিল তাই ঠিক সময়ে ব্রেক মারলেও……. ‘ ঋতুর কথা শেষ হওয়ার আগেই চোখে জল চলে এলো বিল্টুর। কি অদ্ভুত না, একটু আগেই সব ঠিকঠাক মনে হচ্ছিল আর এখন এক মুহূর্তে কেমন সব পাল্টে গেলো। জিয়ান পাশ থেকে বিল্টুর কাধে হাত রেখে বললচিন্তা করিসনা , সব ঠিক হয়ে যাবে চোখের জলটা হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছে বিল্টু বললোডাক্তাররা কি বলছেন?” ঋতু কিছু বলার আগেই ওরা দেখলো হন্তদন্ত হয়ে শবনমের বাবা এলো। কোনো একটা কাজে ব্যস্ত থাকায় উনি ওনার পি. কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ঘটনাটা শোনা মাত্রই। আর এখন নিজে এসে উপস্থিত হলেন। ইমার্জেন্সী ওয়ার্ড এর  সমানেই ওনার পি. দাড়িয়ে ছিলেন। অফিসিয়াল সমস্ত ফর্মালিটি এতক্ষন উনিই পূরণ করছিলেন। শবনমের বাবা হন্তদন্ত হয়ে এসে ওদের দিকে বিশেষ করে বিল্টুর দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে পি. লোকটির সাথে কথা বলতে লাগলেন। প্রায় সাথেই সাথেই নার্স মতন একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন। ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনি বললেনপেশেন্টের অবস্থা এখন বেশ স্টেবল, তবে রক্তক্ষয় হয়েছে অনেকটা   ইমিডিয়েটলি . বি নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত চাই আর আমাদের হসপিটালে এই মুহূর্তে ওই গ্রুপের রক্ত নেই, তাই যত তাড়াতাড়ি পারেন বাইরে থেকে আনানোর ব্যবস্থা করুন।ওনার কথা বলা শেষ হতেই হসপিটালের শান্ত করিডোর টা কাপিয়ে একটু নড়বরে গলায় প্রায় চিৎকার করে বিল্টু বললোআমি , আমি দেবো রক্ত। আমারও ওই গ্রুপ ঠিক প্রদীপ নেভার আগে যেমন একবার দপ করে জ্বলে ওঠে , বিল্টুর মধ্যেও তেমনি একটা আশার আলো জ্বলে উঠলো। তার মনে হলো আরো একবার সব ঠিক হয়ে যেতে পারে।

                                                             (৮)

মাথার ভিতর ক্রমাগত পিন ফোটানোর মত একটা যন্ত্রণা হয়ে চলেছে শবনমের। চোখটা ধীরে ধীরে খুললো ও। একটা হসপিটালের বেডে শুয়ে রয়েছে সে এটুকু বুঝলো। তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অটো ধরতে যাচ্ছিল তারপরেই কিছুতে একটা ধাক্কা খায়, হ্যা বাইক মনে পড়েছে। মাথায় এখনও একটা ব্যথা আছে। মনে মনে শবনম ভাবলো আজকের বিকেলটা কেমন কাটাবে ভেবেছিল আর কেমন কাটছে। মাথাটা সামান্য তুলে বসার চেষ্টা করতেই একজন নার্স মতন মহিলা বলে উঠলেননা না , এখনও অনেক দুর্বল আছ। শুয়ে থাকোসত্যিই শরীরটা খুব দূর্বল লাগছে ওর এটুকু বুঝলো ও। শুয়ে থেকেই চারপাশে মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই বা দিকের বেডে দেখলো বিল্টু শুয়ে আছে। আর একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। তবে গোল গোল শান্ত চোখ দুটোয় কেমন একটা ক্লান্তির নরম ভাব দেখলো শবনম। ওকে দেখেই অজান্তে মুখে একটু হাসি আর চোখের কোনায় এক ফোঁটা জল চলে এলো। আরো দেখলো বিল্টুর বেডের পাশেই জিয়ান আর ঋতুও দাড়িয়ে। জিয়ান ওর দিকে একটু এগিয়ে এসে বললএখন কেমন লাগছেমাথাটা সামান্য নড়িয়ে ভালো বোঝানোর চেষ্টা করলো শবনম। জিয়ান তখনই বললো জানিসতোর আর বিল্টুর রক্তের গ্রুপ এক, হসপিটালে ছিলনা রেয়ার গ্রুপ বলে। বিল্টু তোকে রক্ত দিয়েছে।এই খানিকক্ষণের যদিও সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিল শবনম। হটাৎ সব কিছু ভুলে শবনমের সেই প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে গেলো। সেই  ক্যান্টিন , সেই শান্ত চোখ। কত কিছু পাল্টে গেছে এই কথা ভাবতে ভাবতে চোখের কোনার বিন্দু বিন্দু জলটা কখন  সরু রেখায় পরিণত হয়েছে  বুঝতেও পারলনা শবনম। এই সময়েই শবনমের বাবা ঘরে ঢুকলেন। মেয়ের জ্ঞান ফেরার খবর শুনে উনি কতটা খুশি হয়েছেন সেটা ওনার চোখের জল আর মুখের হাসি দেখলে তখন বোঝা যায়। শবনম স্পষ্ট দেখে ওর বাবার চোখের জল। যে মানুষটাকে মা মারা যাওয়ার পর আর কোথাও কাঁদতে দেখেননি তাকেও আজ কাঁদতে দেখলে শবনম। হালকা গলায় একটু যেনো কষ্ট করেই এবার শবনম ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলোএবার কি হবে বাবা, আমার শরীরেও যে এখন হিন্দু রক্ত বইছে। প্রত্যেক শিরা উপশিরায়। দেখো আজ সব কেমন মিশে এক হয়ে গেলো। আর তো আলাদা করা যাবেনা।

শেষচোখটা রুমাল দিয়ে মুছে উঠে দাড়ালো শাহানা। সোফা ছেড়ে উঠে মাকে গিয়ে একবার জড়িয়ে ধরলো ও। বি.এস সি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী শাহানা। বড্ড বেশি প্র্যাকটিক্যাল, তাই ওসব প্রেম টেমে তেমন একটা বিশ্বাস ছিলনা শাহানার। টেস্ট টিউব নানা অ্যাসিডের কটু গন্ধে ডুবে থাকা শাহানা কখনো প্রেমের মিষ্টি গন্ধ পায়নি। জানতো যে ওর মা বাবার ভালোবেসে বিয়ে তবে ওদের দুজনের ভালোবাসার পিছনের ইতিহাস বা গল্পগুলো কখনো শোনা হয়ে ওঠেনি ওর। আজ শুনলো ও। আর। আজ শাহানা বুঝেছে প্রেম আছে, সত্যিই আছে। আর তা আমাদের থেকে অনেক আলোকবর্ষ দূরে নয়, আমাদের মাঝেই আছে শুধু খুঁজে নেওয়ার অপেক্ষা। মায়ের বলিরেখা পরা মুখটায় এখন যে দীপ্তি আর ঠোঁটে যে সারল্যের হাসি দেখতে পাচ্ছে তা কেবল সত্যি ভালোবাসাই আনতে পারে।

 

 

Rohit Dutta

লেখক পরিচিতি : রোহিত দত্ত , অন্যান্য আর পাঁচটা বাঙালির মত শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসি। চন্দননগরে থাকি। বয়স ১৮। টুকটাক লেখার শুরু বছর দুয়েক আগে থেকে।

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here