সুমনার অনেকদিনের সুপ্ত বাসনা তার ছেলের বৌকে সে নিজের মেয়ের মতো করেই রাখবে। সাংসারিক কর্তব্য , নিয়ম-শৃঙ্খলাতে সুমনা তাকে জড়াবেনা। তার স্থির বিশ্বাস নিয়ম মানুষের জন্য, মানুষ নিয়মের জন্য নয়। আজকালকার ছেলেমেয়েদের দেখলে সুমনার বেশ ভালোই লাগে। এখনকার ছেলেমেয়েরা কি স্মার্ট, কতকিছু জানে। সে তো মনে মনে ঠিক করে রেখেছে ছেলের বৌকে সে নিজে শপিং মলে গিয়ে আধুনিক পোশাক কিনে দেবে। শাশুড়ির কড়া অনুশাসনে সে নিজে থাকলেও বৌমার সঙ্গে বন্ধুত্বই করবে। দুজনে মিলে পুজো-অর্চনার বদলে বরং মোবাইলে গেম খেলবে।
       

শাশুড়ি গত হবার পর বিজ্ঞানের ছাত্রী সুমনা এখন নিজের মত করেই  সংসার করে। পূজা অর্চনায় বিশেষ মন না থাকায় এত দিনকার অভ্যাসের বশে যেটুকু করার সেটুকুই করে। সরকারী কর্মচারী স্বামী সৈকতও সংসারের ব্যাপারে বরাবরই নির্বিকার, সুমনার কোনো কাজেই বাধা দেয়না। তবে তিনি বাইরের কাজগুলো নিষ্ঠা সহকারেই করেন। স্বামী ও স্ত্রীর সাংসারিক বোঝাপড়াটা ভালোই। ছেলে শুভও  এখন একটা ভালো কম্পানীতে চাকরি পেয়েছে, তাই দুজনে অফিসে বেরিয়ে গেলে সুমনার অনেকটা সময় মোবাইল নিয়েই কাটে। পাশের বাড়ির বোস গিন্নি ঘোষ গিন্নিদের সাথে গল্প করার চেয়ে মোবাইলে গল্প পড়তেই সুমনার বেশি ভালো লাগে। এখন তো মোবাইলের খুটিনাটি সে নিজে নিজেই জানার চেষ্টা করে।

গতকাল পাশের বাড়ির ঘোষবাবুর মেয়ের বিয়ে ছিল। সুমনাদের তিন দিন ধরেই নিমন্ত্রণ। কিন্তু সৈকতবাবু ও শুভর অফিসের জন্য এবেলা আর যাবেনা বরং ওবেলা একবার গিয়ে দেখা করে আসবে বলে মনে মনে ঠিক করল। কাল রাতে গুরুপাক খাওয়া হয়েছে তাই সুমনা আজ পাতলা মাছের ঝোল আর ভাতই রাঁধল। শুভ আর ওর বাবা বেরিয়ে যেতেই শাঁখের আওয়াজ আর  উলুধনি শুনে সুমনা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ঘোষবাবুদের উঠোনটা সুমনাদের বারান্দা থেকে ভালোই দেখা যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুমনা দেখছিল মৌ মানে ঘোষবাবুর মেয়ে কনকাঞ্জলি দিচ্ছে মায়ের আঁচলে আর ঘোষ গিন্নি হাপুস নয়নে কাঁদছে। সুমনার মনটাও ভারী হয়ে আসে– সত্যিই কি বাবা-মায়ের ঋন শোধ করা যায় ! আজকালকার দিনে অনেকেই অবশ্য এই নিয়ম মানেনা। মেয়েদের বিয়ে মানেতো অনুকূল জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা চারাগাছকে তুলে নিয়ে অন্য জল-হাওয়ায় পুঁতে দেওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে না থাকে সূর্যের আলো না থাকে সঠিক পরিচর্যা। অবশ্য ব্যতিক্রম যেমন আগেও ছিল তেমন এখনও আছে। হঠাৎ করে মোবাইল বেজে ওঠায় সুমনার ভাবনায় ছেদ পড়ে। মাসতুতো দেওর ফোন করেছে, বড় মাসি শাশুড়ির শরীর ভালো নেই, তিনি সুমনাকে একবার দেখতে চেয়েছেন। ফোন রেখে সুমনা ঘরের কাজ সারতে সারতে ঠিক করে সামনের রবিবার শুভকে নিয়ে মাসি শাশুড়ির ওখানে যাবে। এই বড় মাসি শাশুড়ির প্রতি সুমনার মনের টানটা বেশ জোড়ালো। বিয়ের পর সৈকতের সঙ্গে ওনার বাড়ি গিয়ে প্রনাম করতে গেলে উনি নেননি বরং বুক টেনে নিয়ে ছিলেন। পরে সৈকত বলেছিল বড় মাসি নাকি বরাবরই পা ছুঁয়ে প্রনাম নেন না। পরে যখন সুমনা জানতে চেয়েছিল বলেছিলেন -মাথা তার কাছেই নত করবি যাকে তুই বিশ্বাস করিস্ শ্রদ্ধা করিস্। হাত জোড় করে প্রনাম করেও তো সম্মান জানানো যায়। কথাটা শুনে সুমনার বেশ মনে ধরেছিল। যদিও সে এতকাল বড়দের পা ছুঁয়ে প্রনামই করে এসেছে। কিন্তু ছেলের বৌকে সে মাসিশাশুড়ির কথাটাই বলবে বলে মনে মনে ঠিক করে। 
             

— কিরে তুই যে অনীশের বিয়ের দিন গেলিনা, ও রাগ করেনি ?
— ধুরর্ আমার ওসব ভালো লাগেনা। সে আমি ওকে আগেই বলেছিলাম যাবোনা।
— কেন, ভালো না লাগার কি আছে
— তুমি জানো, বিয়ের আগের দিন থেকে ওদের বাড়িতে নাচ-গান হৈ-হুল্লোড় চলেছে আর বরযাত্রীরা সব নাচতে নাচতে বিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে। এখন ওই সঙ্গীত-টঙ্গীতের ফ্যাশন হয়েছে। ভিডিও গুলোও তো সিনেমার মত করে শ্যুট করা হয়।
— তা বিয়ের অনুষ্ঠানে সবাই একটু নাচ গান করবে না ? বাঙালির রীতিনীতির সঙ্গে যদি একটু অন্য সংস্কৃতি মিশেই যায়, তাতে ক্ষতি কি ! মূল কথা তো আনন্দের বহি:প্রকাশ তা সে যেভাবেই হোক না কেন।
— ওই সব আমার অসহ্য লাগে।
— তুই দিন দিন সেকেলে্ হয়ে যাচ্ছিস্।
— ছাড়োতো
— তোর বিয়েতে কিন্তু বরযাত্রীর সঙ্গে যাব দেখে নিস্।
— ক্ষেপেছো?
— কেন?- গেলে ক্ষতি কি, এখন তো অনেকেই যায়।
শোন্, সময়ের সাথে সাথে নিজেকে পাল্টাতে শেখ।
প্রেম ভালোবাসা যখন এতো খোলাখুলি হচ্ছে, তখন
মায়ে-দের বিয়ে দেখায় দোষ কোথায়।
— তুমি এখন যাওতো, আমায় এখন অফিসের কিছু
জরুরি কাজ করতে হবে।

কয়েকদিন ধরেই সুমনা শুভকে বলছে দিতিপ্রিয়া মানে শুভর বান্ধবীর সাথে সে আলাপ করতে চায়। আজ রাতে খাবার টেবিলে সুমনা শুভকে একরকম জোরই করল দিতিপ্রিয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। শুভ দিতিপ্রিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানাবে বলল। শুভ যেদিন বাড়িতে জানালো দিতিপ্রিয়ার কথা, সেদিন সুমনা মনে মনে খুশিই হয়েছিল। নিজেরা দেখে শুনে পচ্ছন্দ মত বিয়ে করাই ভালো। একদিন দুদিন তো নয় সারা জীবনের ব্যাপার, পরে যেন আফশোস না থাকে। 

            গতকাল রাতে শুভ জানিয়েছে আজ বিকেলবেলা সে দিতিপ্রিয়াকে নিয়ে এ বাড়িতে আসবে।  সুমনার মনটা তাই আজ বেশ  ফুরফুরে – তার এতদিনের সুপ্ত বাসনাগুলো একে একে পূরণ করতে পারবে। সর্বোপরি সেও একটা বন্ধু পাবে। শাশুড়ি -বৌমা প্রতিদ্বন্দ্বী নাহয়ে বরং তারা যে একে অপরের পরিপূরক হতে পারে সে সেটা সবাইকে দেখিয়ে দেবে। সারা দিন ধরে সুমনা মাছ মাংসের পছন্দের পদগুলো রান্না করলো। দিতিপ্রিয়া এলে তাকে সে রাতের খাবার না খাইয়ে ছাড়বে না।

বিকেলবেলা ফ্রেশ হয়ে সৈকতবাবুকে ঘরে চা দিয়ে সুমনা নিজের চা নিয়ে বারান্দায় আসতেই কলিং বেলের আওয়াজ। সুমনা তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুললো —
…. মা আমরা এসে গেছি। রুমি বাইরে দাড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে এসো।
…. সুমনা দেখলো শাড়ি পরা ফর্সা দোহারা চেহারার একটি মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে তার সামনে এসে দাড়ালো। মুখখানি বেশ মিষ্টি। মাথার একঢাল চুল আলতো্ খোঁপা করা। গলায় সরু চেন, হাতে সোনার বালা। পাত্রপক্ষ দেখতে এলে মেয়েরা চিরকাল যেভাবে সাজে আরকি।
…. তোমার ডাকনাম রুমি বুঝি ?
…. হুমম্
…. দাঁড়িয়ে কেন চলো বসবে এসো।
…. রুমি এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে প্রনাম করতে গেলে সুমনা হাতটা ধরে ফেলে। কিন্তু মাসি শাশুড়ির কথাগুলো আর বলতে পারেনা। তার আগেই রুমি বলে ওঠে_
…. আপনি আমার প্রনাম না নিলে যে অমঙ্গল হবে। মা বার বার বলে দিয়েছে বড়দের সবাইকে প্রথমে গিয়েই প্রনাম করতে।
…. মা জানো তো রুমি এখনকার মেয়েদের মত না, একদম ঘরোয়া। এখন তো আবার পুজোটুজোও করে
…. হ্যা, শুক্রবার আমি সন্তোষীমাতার উপোস করি। আর দীক্ষা নেওয়ার পর থেকে আমি মঙ্গল ও শনিবার নিরামিষ খাই।
…. তোমার পুজো করতে ভালো লাগে ?
…. খুউব্, শিবরাত্রিতে তো আমি নির্জলা উপোস করি।
…. সুমনার একটা চাপা অস্বস্তি হতে শুরু করলো। অন্য দিকে কথা ঘোরাবার জন্য বলল, আমি নিজের হাতে রান্না করেছি খেয়ে যাবে কিন্তু।
…. রুমি আমতা আমতা করে বলল – আসলে বিয়ের আগেই শশুরবাড়িতে আসাটা এমনিতেই শোভনীয় নয় তার ওপর শুভক্ষন অশুভক্ষনের ব্যাপার আছে তো তাই মা বলে দিয়েছেন সন্ধ্যে সাতটার আগেই বাড়ি ফিরতে।
…. আমি রুমিকে বলেছি আমাদের বাড়িতে এসবের চল নেই, ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর মা আর এসব মানে না। তবে এও বলেছি তুমি মানলে মা কিছু বলবে না, মা খুব ভালো মানুষ।
…. হ্যা, সেতো বটেই ! তোরা দুজন সুখে থাকলেই হলো,……আমার আর কি চাই বল্।

আমি একটু আসছি বলে সুমনা রান্না ঘরে চলে যায়। কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এতো দিনকার লালিত পালিত স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে যেতে যেতে তাকে যে জানান দিয়ে যাচ্ছে – শাশুড়ি মা থেকে মা হওয়া তার আর হলো না। দিতিপ্রিয়ার সঙ্গে যে তার মনমানসিকতার লক্ষ যোজন দূরত্ব। একই সংসারে একই ছাদের তলায় থেকেও এক জীবনে সে দূরত্ব যে ঘোচার নয় ।।।

কলমে আদৃতা শেঠ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here