এখন আমি বিদেহী। তবে, আমার হৃদয়কুসুম আজও বিকশিত হয়ে আছে ওখানে। ঐ মাটির কৈশিক তরলে মিশে আছে আমার দেহগত খনিজ। ঐ বাতাসের প্রাণবায়ুতে মিশে আছে আমার জৈবিক আত্মীকরণের নিশ্বাস। এমন কি তোমাদের শারীরিক উষ্ণতাতেও লেগে আছে সেই নিশ্বাসের ঢেউ। যে নিশ্বাসে তোমরা শ্বাস নিতে একদিন। আর তোমাদের ভালোবাসার নিশ্বাস গ্রহণ করতাম আমি। তোমাদের কোটি কোটি কোষে মিশে যেতো আমার নিশ্বাসের ধ্বনি তরঙ্গ। ধমনী বাহিত আমার নিশ্বাস বয়ে যেত তোমাদের হৃদয়ে। কিন্তু, সেখানে কোনো কুসুম প্রস্ফুটিত হতে দেখলাম না কখনো! কোনো এক পলাশী বসন্তের মধ্যাহ্ন, হৃদয়ের সবটুকু সৌরভ উজাড় করে সাজাতে চেয়েছিলো তোমাদের লাবডুব ছন্দময়তাকে। প্রতিদানে নগ্ন হলো বাসন্তী হৃৎপিণ্ড। এখন তার ধমনীতে শুধু পক্ষীহীন রক্তহীনতা। আজও ফুটলো না তোমাদের মূল্যবান হৃদয়কুসুম!

আমার শরীর জুড়ে তখন অগণিত হৃৎপিণ্ডের কম্পন! বাতাসের ছন্দে বেজে উঠতো তারা। নাক্ষত্রিক ভাষা পাঠ করে ফুটে উঠতো প্রতিনিয়ত। বুকভরে নিতে তোমরা বাতাসের কম্পনে লেগে থাকা আমার দেহের ছন্দময় সৌরভ।

তোমাদের হৃদয়হীনতার কারণে আজও ওরা অনিকেত। আমার দেহের স্থূলতায়, বক্রতায়, উচ্চতায় লেগে থাকা ওদের পাদস্পর্শ, পালকস্পর্শ আমাকে সজীব করে তোলে অদৃশ্যরূপে! অনুভব করি আমার অনাদি অস্তিত্ব। আমার সুউচ্চ শিখরে নীল সবুজের একাত্মতা, মেঘেদের নৈকট্য আর অমৃতধারার প্রথম পরশে সংঘটিত জৈবনিক তৎপরতার চিত্রপট, সমগ্র বিদেহী সত্তা জুড়ে সমুজ্জ্বল আজও।

আমার নিশ্বাসের শীতল আর্দ্রতায় নিয়ন্ত্রিত হতো তোমাদের হৃৎপিণ্ডের বাড়তি উত্তেজনা। অপসৃত হতো তোমাদের পরিশ্রান্ত দেহের অতিরিক্ত উষ্ণতা। আমি ছিলাম তোমাদের শাব্দিক ভাব বিনিময়ের মূক শ্রোতা। আমার শরীরে কোনো শ্রুতি গ্রাহক ছিল না। ছিল কেবল শাখাযুক্ত অনিয়তাকার বৃহৎ এক হৃৎপিণ্ড। সেটাই ছিল আমার যত রকমের ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয়। যার শাখাগুলো হয়ে উঠতো কখনো শ্রবণেন্দ্রিয় তো কখনো দর্শনেন্দ্রিয়। সর্বদাই ফুল ফুটে থাকতো সেখানে। আমার হৃদয়কুসুম তোমাদের সম্মোহিত করতে পারলো না। তোমাদের যাবতীয় সম্মোহন কেবল ঐন্দ্রজালিক আকাশকুসুমে! তাই তোমাদের হৃদয়কুসুম কোনোদিনই পাঁপড়ি মেললো না। এর সৌরভও পেলে না কখনো। আমার হৃদয়কুসুম উপড়ে রক্তাক্ত করলে আমায়। ভুলে গেলে সকল অনাদি আন্তঃসম্পর্ক। আকাশকুসুমের নেশায় আচ্ছন্ন থেকে গেলো তোমাদের চেতনা!

যে তোমরা নিজেদের উৎস সন্ধানে খোঁজ চালাও। মারিয়ানা থেকে মাউন্ট এভারেস্ট! মঙ্গলপৃষ্ঠ থেকে মহাশূন্যে! যে তোমরা এল এইচ সি তে সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করো! কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেণ্ট নিয়ে ভাবো! সেই তোমরাই হৃদয়কুসুম ছিড়ে ফেলে আকৃষ্ট হও আকাশকুসুমে!

আজীবন শীতল করলাম তোমাদের। নিজের হৃদয়কুসুম উজাড় করে দিলাম তোমাদের মনে প্রাণে সংবহনে। তোমরা শীতলা খুঁজলে! নির্বিচারে হত্যা করলে আমায়! আকাশকুসুমের সম্মোহনে রোগমুক্তির আনুগত্য খুঁজলে! সজীবতার মাঝে তোমরা প্রাণের ধ্বনি শুনতে পেলে না! দেখতে পেলে না আমার আজন্ম মাতৃত্বের হৃদয়কুসুম! হৃদয় মন একতন্ত্রে বেঁধে গগনচুম্বী ইঁট পাথর গাঁথলে আমার ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত দেহখণ্ড অপসারণ করে। আমার জন্মস্থানে। এখন তো ওটা আমার সমাধিস্থলও। যে তোমরা নাকি কোষীয় দ্বিতন্ত্রের বিশ্লেষণ করো রোগমুক্তির গভীর এষণা নিয়ে।

অনাহার ও অপুষ্টির শীর্ণতাকে উপেক্ষা করে প্রবল উদ্দীপনায় তৎপরতার সাথে বহুমূল্যর ইঁট পাথর লোহা গাঁথলে। মনে পরে? কতদিন পেটপুরে সপরিবারে দ্বিপ্রাহরিক আহার গলাধঃকরণ হয়নি। সন্তানদের বাধ্য করেছো প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় জৈবিক তাড়নার মুক্তি খুঁজতে! মনে আছে? সেবার আকাশকুসুমের সম্মোহনে সাত বছরের মেয়েটাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে দেরি করে ফেললে! মনে পরে? যখন শেষ সম্বলটা হারিয়েও মায়ের দ্বিতীয় কেমোর খরচটা আর কিছুতেই জোগার করে উঠতে পারলে না! ভাঙা টালিগুলো আজও কি পাল্টাতে পেরেছো? জীবন যখন আমার দেহে শক্তির খেলা খেলতো তখন আমার হৃদয়কুসুম বিস্তৃত করে রক্ষা করার চেষ্টা করতাম উঁই ধরা মাথাগোঁজার কাঠামোটাকে। রৌদ্রস্নাত ঘর্মসিক্ত শরীরে আকাশকুসুমের আনুগত্যে জীবন সমর্পণ করে প্রস্তর প্রাসাদ নির্মাণের সময় পেয়েছিলে বিশুদ্ধ পানীয় জল? আলু চাষের লোকসানে যেদিন বাবা কীটনাশকের বোতলটা খালি করে ফেলেছিলো! মনে আছে তো? ফাটল ধরা বেদীটার উপর লিখে রাখতে তোমাদের দারিদ্র যাপনের ইতিবৃত্ত। সেদিন আমার হৃদয়কুসুম রক্তাক্ত হতো তোমাদের অসহায়তার কথা ভেবে। খুব অবাক হতাম তোমাদের সমগ্র মনোরাজ্য জুড়ে অধিষ্ঠিত আকাশকুসুম শীতলতার ব্যাপ্তি দেখে!

যেদিন আমার খণ্ডিত দেহগুলো বিক্ষিপ্ত ছিলো তোমাদের নব নির্মিত সাধের সুসজ্জিত সৌধের তলায়। আমার দেহের অমৃতধারা মেঘ রাজ্যের আকর্ষণে ঊর্ধ্বমুখীতা লাভ করছিল ধীরে ধীরে। সেদিন আমার হৃদয়কুসুমকে বাঁচিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা করেছিলাম। তখনও মাটির সাথে আমার আজন্ম সংযুক্তিটা বিচ্ছিন্ন হয়নি। মৃত্তিকা দেহে আবদ্ধ আমার শিরা ধমনী তখনও দেহহীনতার খবরটা পায়নি। তখনও তারা প্রাণরসের আদান প্রদানে ব্যস্ত। তারপর একদিন আমার সুপ্রাচীন দেহজাত ইন্ধন পুষ্ট যন্ত্রের যান্ত্রিক ক্ষমতা ব্যবহার করে শতাব্দী প্রাচীন মৃত্তিকা বন্ধনীর অবশিষ্ট টুকু ছিন্ন করে দিলে! সুদূর অতীতের সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যায়। যেদিন প্রথম আকাশ ও মাটির অন্তঃবর্তী ব্যবধানে নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্ব সার্থকতা উপলব্ধি করতে শিখেছিলাম। মাতৃ গর্ভের পুষ্টি নিয়ে দুহাত তুলে অপরিণত হাতে নক্ষত্রের বর্ণ মেখেছিলাম! সেই আজন্ম মাতৃস্পর্শ থেকে আমাকে দূর করে দিলে তোমরা!

আমার জৈব ঘরের লক্ষ কোটি জীবন থেমে গেলো ধীরে ধীরে। জড়ত্বের শাশ্বত নিয়ম অধিকার বুঝে নিয়েছে। তোমাদের নিপুণ হাতের অপূর্ব শিল্প প্রতিভার প্রদর্শনী হয়ে স্থান পাচ্ছে আমার শতাব্দী প্রাচীন দেহটি তোমাদের আকাশকুসুম রাজ্যে। তাতে উজ্জ্বল বার্নিশ লেগেছে সৌন্দর্য বর্ধনে। আমার মৃতদেহের এমন পরিণতির কথা ভাবিনি কখনো! হৃদয়কুসুমের অবশিষ্ট পাঁপড়ি গুলোও ছিঁড়ে ফেললে তোমরা! আমার দেহের জড়ত্বকে কাজে লাগালে তোমরা এভাবে বহুমূল্য সিংহাসন রচনায়! আকাশকুসুমের সুখবাসনায়!

আকাশকুসুমের সম্মোহনে অবরুদ্ধ তোমাদের চেতনার বিকল স্নায়ু সন্নিধি এক বারের জন্যও মুক্তির ঝড় তুললো না। প্রয়োজনের কথা ভাবলে না। ভাবলে না তোমাদের অধিকারের কথা। আমার হৃদয়কুসুম আজও ফুটে থাকতো, যদি তোমরা এই একক মহাজীবনে মহাচেতনার জয়গান করতে পারতে। পারলে না আকাশকুসুম ও হৃদয়কুসুমের পার্থক্য অনুধাবন করতে। আকাশকুসুম ভাবনায় মোহিত হয়ে সিংহাসন স্থাপনের উদ্দেশ্যে আমাকে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করলে না তোমরা! পরিসরের অভাবহীনতা থাকার সত্ত্বেও বাঁচতে দিলে না! কেন? প্রাণ কি এতটাই মূল্যহীন হয়ে যায় আকাশকুসুমের সংক্রমণে! আমার জন্মস্থানে আমার দেহের বিনিময়ে তোমরা শুধু আকাশকুসুম দেখলে! কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো না? অন্তত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা তো ভাবতে পারতে? অথবা কোনো কৃষি গবেষণার উদ্দেশ্যে দেওয়াল নির্মাণের কথা? হৃদয়কুসুম কি একটিবারের জন্য চোখে পড়লো না? আমার মৃত দেহের সেলুলোজ কাঠামোর অপব্যবহার করলে তোমরা। চাইলে আমার মৃত দেহের উপর অসংখ্য হৃদয়কুসুম ফোটাতে পারতে তোমরা। স্থাপন করলে আকাশকুসুমকে!

হে চেতনাধারী জীব মহাজীবনের সার্থকতা উপলব্ধি করো! ছিন্ন কোরো না আমাদের আদি আন্তঃসম্পর্ক। আকাশকুসুমের অন্ধকূপ থেকে মুক্ত করো অবরুদ্ধ চেতনা! আকাশের দিকে তাকিয়ে মহাচেতনার ব্যাপ্তি খোঁজো। হৃদয়কুসুমের সৌরভ পাবে তখনই।

কলমে অভিজিৎ মুখার্জী, হুগলী

বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী। মহাকাশ বিজ্ঞান ও বাংলা সাহিত্য সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। কুসংস্কার তথা অযৌক্তিক প্রথার ঘোর বিরোধী। মহাবৈশ্বিক প্রকৃতির রহস্যময়তা অনুধাবনের প্রচেষ্টা, লেখালেখি, শেখা ও শেখানোর মধ্যে দিয়ে জীবন আনন্দের অনুসন্ধানী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here