আজকে তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছতে হবে, নতুন এমপ্লয়ি নেওয়ার ইন্টারভিউ আছে; দিয়াকেই প্রধান ইন্টারভিউয়ার হিসেবে থাকতে হবে। কিন্তু রাস্তায় এত ট্রাফিক জ্যাম যে, পনেরো মিনিট গাড়িতে বসে বসেই কেটে গেলো। অধৈর্য্য হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে একটা বড় হোর্ডিংয়ে গিয়ে চোখটা আটকে গেলো, হোর্ডিংটা দু-এক দিনের মধ্যেই লাগানো হয়েছে, নইলে দিয়া তো এই রাস্তা দিয়েই যায়, এর আগে দেখেনি। একটা বিখ্যাত ব্রা কোম্পানির বিজ্ঞাপন, আর সেই অ্যাডের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মেয়েটির সুডৌল শরীরের দিক থেকে, বিশেষ করে তার স্তনের দিক থেকে পুরুষ তো বটেই কোনো মেয়েও চোখ ফেরাতে পারবে না। দিয়া কেমন মোহাবিষ্টের মতো দেখতে থাকলো। জ্যাম ছেড়ে গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো।

দিয়া বছর আঠাশের একটা প্রাণবন্ত মেয়ে, খুব মিষ্টি চেহারা, ওকে এক নজরে দেখলে সবারই আদর করতে ইচ্ছে করবে, কিন্তু সেই মিষ্টি মুখের আড়ালে একটা বিষণ্ণতা যেন ওকে মাঝে মাঝেই গ্রাস করে। আগে কোথাও কোনো মেয়ের সুন্দর বুকের ছবি, বা, ব্লাউজের দোকানে গেলে ব্রা পরা মেয়েদের ছবি দেখলে ওর মনটা ভেতর থেকে কুঁকড়ে যেতো, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতো, সেটা এখন অবশ্য হয় না, তবুও কেমন যেন উদাস হয়ে যায়।

অফিসে পৌঁছতে একটু দেরিই হয়ে গেলো, যেখানে এগারোটা থেকে ইন্টারভিউ শুরু হওয়ার কথা, সেখানে প্রায় বারোটা বেজে গেলো। যাইহোক, সব কাজ মিটিয়ে ফিরতে ফিরতে আবারও দেরি হয়ে গেলো, সন্ধ্যে নেমেছে, তিলোত্তমাও তার অপরূপ সৌন্দর্যে সবাইকে মুড়ে নিয়েছে। চারিদিকের কোলাহলেও আজকে দিয়ার মনটা শান্ত; ফেরার পথে সেই একই জায়গায় ট্রাফিক জ্যাম। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে আবারও সেই ব্রা পরা মেয়েটাকে এক দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো। সন্ধ্যের মায়াবী আলোতে মেয়েটার বুকের ভাঁজ যেন আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। গাড়ি ট্রাফিক জ্যাম থেকে বেরিয়ে ওর গন্তব্যে চলতে লাগলো।

বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হওয়ার জন্য আজকে সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো দিয়া; ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে আনড্রেসড্ হয়ে নিজের শরীরের দিকে তাকালো, আস্তে আস্তে হাত বুলোতে বুলোতে হাত নিয়ে এলো বুকের ওপর,  হঠাৎই জোরে শাওয়ার ছেড়ে কেঁদে উঠলো দিয়া। সারা শরীরের সাথে সমান হয়ে মিশে আছে সেই বিশেষ অংশটা, উঁচু-নিচুর কোনো অনুভূতি যেখানে নেই। অথচ তিন বছর আগেও কত সুন্দর জীবন ছিল ওর, রাজীবের সাথে কাটানো এক একটা ভীষণ ভালোলাগার মুহূর্ত…সব শেষ হয়ে গেছে। বিয়েটা ওরা বাড়ির অমতেই করেছিলো, যদিও পরে সবাই মেনেও নিয়েছিলো। কিন্তু সুখ বেশিদিন ওর কপালে সহ্য হল না, শ্বশুরবাড়িতে পা দেওয়ার এক মাসের মাথায় ওর শ্বশুরমশাই মারা যান, আর ঠিক তিন মাস পরেই ওর ব্রেস্টের পাশে পুঁজ, ব্যথা হওয়ায় ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারে মারণব্যাধির শিকার ও, ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেই মুহূর্তে তাড়াতাড়ি অপারেশন না করলে বিপদ হয়ে যেত, হয়তো বা প্রাণেই বাঁচত না। রাজীব ওকে ওর মনোবল বাড়াতে নিজের মাথা ন্যাড়া করেছে, প্রত্যেকটা মিনিটে ওর মানসিক শক্তি যুগিয়েছে, সারাজীবন পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু সেই ভরসা দেওয়ার মানুষটাও কখন যেন ভরসার কাঁধ আস্তে আস্তে সরিয়ে নিয়েছে, জানতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল দিয়ার। আজ তিন বছর পরে সেইসব পুরোনো কথা মনে পড়ে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না।

ওদিকে এতক্ষণ ধরে দরজা বন্ধ দেখে মা এসে টোকা দিয়ে গিয়েছে। ওপাশ থেকেই বললেন, “আর কতক্ষণ থাকবি বল্ তো, এবার তো ঠাণ্ডা লেগে জ্বর চলে আসবে”। মায়ের আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেয়ে দিয়া “আসছি” বলে তাড়াতাড়ি মুখ, হাত ধুয়ে ড্রেস পরে বেরিয়ে আসে। “কী রে, অফিসে কিছু হয়েছে? তোর চোখটা কেমন লাল লাল লাগছে, শরীর ঠিক আছে তো? “আমার কিছু হয়নি মা, চোখে একটা কিছু পড়েছিলো, তাই চুলকিয়ে হয়তো লাল লাগছে। আমি এখন খাবো না, খিদে নেই”, বলেই নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগালো দিয়া। মেয়ের এরকম হঠাৎ আচরণে নির্মলাদেবী একটু অবাকই হলেন, কিন্তু আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না ভেবে দরজায় নক করলেন না। ডিভোর্সী মেয়ের মা হয়ে পাড়া, প্রতিবেশী থেকে শুরু করে আত্মীয় পরিচিত সবার কাছে কথা শুনে শুনে প্রথমে একটু ভেঙে পড়েছিলেন; দিয়ার ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ার পর কাউকে পাশে পাননি, তিনি আর তাঁর স্বামী বিমলবাবু একা হাতে সবটা সামলেছেন। ওদের সম্পর্কটা জানার পর দিয়াকে প্রথমে ওর শ্বশুরবাড়িতে মেনে নিচ্ছিল না, রাজীব ওর বাবা, মা-কে বোঝানোয় উনারা ব্যাপারটা নিয়ে আর ঝামেলা করেননি। রাজীবকে নির্মলাদেবী আর বিমলবাবু নিজের ছেলে হিসেবেই ভালোবেসেছিলেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে দু’জনেই একা হয়ে গিয়েছিলেন, রাজীব আর দিয়া সপ্তাহে একদিন করে এসে দেখা করে যেত। কিন্তু সব কিছুই যেন কেমন ওলট-পালোট হয়ে গেলো, মেয়েটাও মনমরা হয়েই থাকতো, তারপর এই চাকরিটা পেয়ে প্রমোশন হয়ে এখন ঠিক আছে ও। তবুও নির্মলদেবী দিয়াকে মাঝে মধ্যেই বলেন, একটা বিয়ে করতে। মেয়েকে একটা সংসারে দেখতে সব মা-ই চান; লোকের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়া যাবে, যারা বলে, এই মেয়ের তো বুকই নেই, ওইজন্যই তো ওর বর ছেড়ে গেলো, আর কোন ছেলে এমন মেয়েকে বিয়ে করবে? মা হয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কীই বা করার আছে তাঁর! দিয়াকে বললেও ও সেটাই বলে, মেয়েদের শরীরের প্রধান আকর্ষণ হলো স্তন যেটা ওর আর নেই, কোন্‌ ছেলে ওকে বিয়ে করবে? একবার বিশ্বাস ভেঙে গিয়ে ওর দুর্বল হৃদয় আবার নতুন করে ভাঙতে চায় না, আর নতুন কোনো সম্পর্কে ও জড়াবে না।

রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়লো দিয়া, ফেলে আসা অতীতে অনিচ্ছাকৃতভাবেই পাড়ি দিলো। সেই প্রথম দেখা, রাজীবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আবার নিজেই গিয়ে হাঁটু গেড়ে প্রোপোজ্ করেছিলো দিয়া, সেটা নিয়ে ওদের বন্ধুমহলে সবাই মজা করত। রাজীবের বাড়ি থেকে দিয়াকে মেনে না নেওয়া, তারপর রাজীবের বাবা, মায়ের একরকম অসম্মতিতে দিয়াকে ওদের বাড়িতে নিয়ে আসা, বিয়ের এক মাসের মাথায় রাজীবের বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ায় দিয়াকে শাশুড়ির অপয়া অপবাদ, তবুও রাজীব ওর পাশে ছিলো, সব মনে পড়ে যেতে লাগলো। এরপর বাঁ দিকের ব্রেস্টে একটু ব্যথা হতে শুরু করলো, তারপর ডান দিকেরটায়, ডাক্তারবাবু ইমিডিয়েট অপারেট করবার জন্য বললেন, নাহলে পুরো শরীরে ছড়িয়ে যেতো। অপারেশনের পরে ধীরে ধীরে দিয়া সুস্থ হয়ে উঠেছিলো, কিন্তু একদিন বন্ধ ঘরে আয়নার সামনে নিজের স্তনহীন উলঙ্গ শরীর দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো। নির্মলাদেবী আর বিমলবাবু এটাই দিয়াকে বুঝিয়েছিলেন যে, ও প্রাণে বেঁচে গেছে এটাই পরম পাওয়া ঈশ্বরের কাছে। কিন্তু ও মনে মনে বুঝতে পেরেছিল, রাজীবকে আগের মতো সেই খুশি দিতে পারবে না; একজন পুরুষের একটা নারী শরীরের প্রতি যে চাহিদা থাকে, সেটা আর ও কোনোদিনই পূরণ করতে পারবে না, তাই সিদ্ধান্ত নেয় রাজীবের জীবন থেকে সরে যাওয়ার। রাজীব যদিও দিয়ার এই সিদ্ধান্তে একমত হয়নি, তবুও কোথাও যেন দিয়ার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছিলো। জোর করেই তাই দিয়া ডিভোর্স পেপার রাজীবকে পাঠায়, রাজীবের মা তো পারলে ওর অপারেশনের দিনই রাজীবকে দিয়ার থেকে আলাদা হওয়ার জন্য বলেছিলেন।

তবুও দিয়া একটা ক্ষীণ আশা রেখেছিলো যে, রাজীব হয়তো ওকে আগের মতো বকবে, ডিভোর্স পেপার ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বলবে, তুমি যেমন আছো তেমনই থেকো, তোমার এই নতুন রূপেই আমি তোমাকে আগের থেকেও আরো বেশি ভালবাসবো, বাইকে করে আগের মতই ঘুরতে যাবো, যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেরকমই বাকি জীবনটা একসাথে হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলব। কিন্তু না, সব গল্প বোধহয় রূপকথার মতো হয় না। শুধু সিনেমা আর বইতেই তাদের অস্তিত্ব, জীবন বড় কঠিন, যেরকম স্বপ্ন আমরা দেখি তা বাস্তবে সত্যি হতে দেখি না, হঠাৎই কোথা থেকে দমকা হাওয়া এসে সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো করে দিয়ে চলে যায়। দু’বছর আগে রাজীবও এক নতুন জীবনে প্রবেশ করেছে। চারপাশে সবাই কত খুশি, হাসির ফোয়ারা উপচে পড়ছে। শুধু হাসতে ভুলে গেছে দিয়া; ওর ‘ভালোবাসা’ নামের বাড়িটা কবেই টুকরো টুকরো হয়ে গুঁড়িয়ে গেছে, ‘বিশ্বাস’ নামের সেতুটাও আর নেই। এখন ও মুক্ত, নতুন করে শুরু করেছে ওর একলা ‘আমি’-কে নিয়ে। মেয়েদের সৌন্দর্য ঠিক কোন্ জায়গায় আজও ও বুঝে উঠতে পারেনি।

কলমে সুপ্রিয়া মণ্ডল, চুনাপুর, মুর্শিদাবাদ

লিখতে খুব ভালবাসি; এছাড়াও কবিতা আবৃত্তি, গল্প পাঠ ইত্যাদিও অন্তরের অনুভূতি দিয়ে করি। লেখালেখির যাত্রাপথ সবে শুরু, আপনাদের সকলের আশীর্বাদ ও সমর্থন নিয়ে অনেক দূর চলতে চাই।



লেখিকার আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন

অগ্নিকন্যা ননীবালা দেবী                   শতাব্দী, ভালো থাকিস


        

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here