পুজো মানেই রোজকার সেই বন্দি দশা থেকে মুক্তি,টিউশন যাওয়া,কলেজ যাওয়া সব কিছু থেকে একরাশ মুক্তির অনন্ত আশা।প্রতিবার প্রেয়সী এই সময়টার জন্য মুখিয়ে থাকে।ওর কলকাতায় হাতিবাগানে বাড়ী ঠিক।কাছে অনেক বড় বড় পুজো।কিন্ত ওরা সেসব ফেলে সপ্তমীর দিন প্রতিবার চলে যায় ওদের দেশের বাড়ির মানে নিজের বাড়ির পুজোতে।ওরা বাবা কাকারা সাত ভাই।ছোট কাকুর ব্যবসা কিন্ত বাকি সবাই থাকে বাইরে চাকরী সূত্রে।সবাই মিলে পুজোর সময় দেশে ফেরা।বাড়িতে জ্বলে উঠে আনন্দ-উৎসবের রোশনাই।সব ভাই-বোন,কাকা-কাকিমারা সব মিলে এক অনাবিল আনন্দে সবাই মেতে উঠে কিন্তু সবার মধ্যে আছে একটাই হার্ট থ্রব-আদরের ঠাম্মি, যার কাছে গেলে একটা অদ্ভুত স্নেহমাখা ভালোবাসা পাওয়া যায়,কোলে ঘুমোলে পরম মমতাময়ী হাতটা যেন শত দুশ্চিন্তাকে দূরে ফেলে দেয়, যেন এক নিশ্চিন্ত আশ্রয় পাওয়া যায়।বন্ধুরা বলে প্রেয়সীকে,’তুই নর্থ কলকাতার ঠাকুর না দেখে কি করে গ্রামে কাটাতে পারিস রে?’ হাতিবাগান সার্বজনীন, নলীন সরকার স্ট্রিট, শোভাবাজার রাজবাড়ী,বাগবাজার, আহিরী টোলা,কুমোর টুলি পার্ক ছেড়ে শেষে কিনা গ্রামের পুজো! প্রেয়সী বলে,’ওটা আমার বাড়ির পুজো, প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো পুজো।বাড়ির সব অনুষ্ঠানে থাকা সকাল থেকে কলা বউ আনা,স্নান করানো থেকে শুরু করে বিজয়া দশমী যে কোন দিকে হৈ হৈ করে কেটে যায় তা বলে বোঝানো যাবে না।প্রিয়ার বলতে বলতে আনন্দে বুক ভরে যায়। তবে বন্ধুদের কথা রাখতে ষষ্ঠীর দিনটা ওরা সারা রাত ঠাকুর দেখে পরের দিন ভোর বেলায় চলে যায় বাঁকুড়ার নিজের দেশের বাড়িতে।
এ কদিন ও শাড়ি পড়বে ঠিক করে নিয়েছে।কলেজের প্রথম বর্ষ আর তো ও স্কুলে পড়ে না।বাবা একটা অষ্টমীর অঞ্জলীর জন্য লাল শাড়ি কিনে দিয়েছে বলেছে,তোকে খুব মানাবে। বহু প্রতীক্ষিত সেই দিন এসে গেল।ওরা গেল দেশের বাড়ি।এখন সম্প্রতি ট্রেন চালু হয়েছে।তাই ওরা ট্রেনেই যায় খুব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য।বাঁকুড়ার খুব সুন্দর ঢালু পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ট্রেন চলে যায় এঁকে বেঁকে।দূর থেকে ট্রেনের ধোঁয়া উড়ে,হুইসেল বাজে আর সবাই শশব্যস্ত হয়ে যায় ওঠার জন্য। উঠার পর একটা জানালার ধার পেয়ে যায়।যদিও বোনের সাথে অল্টারনেট করতে হয়।একের পর এক ঝুড়ি ভাজা,গজা,ঘুগনী, বেলিয়াতোড়ের মেচা সন্দেশ উঠে আর স্বাদ উপভোগ করে নেমে আসে তাদের ছোট্ট স্টেশন ইন্দাস।নামার সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুত আনন্দে মন টা ভরে যায়।তার পর টোটো করে যাওয়া।আগে ছিল ছাউনি দেওয়া ছোটরি ভ্যান গাড়ি।সেটাতে যাওয়ার আনন্দই আলাদা।এই জায়গায় না গেলে বোঝানো যায় না মাটির টান কাকে বলে।পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই ঠাম্মির আনন্দাশ্রু,কাকিমাদের ভালোবাসা আর ভাই-বোনদের খুনসুটিতে দেশের বাড়ি যেন আনন্দে গম গম করে।ওই দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় পুজোর পর্ব।অষ্টমীর দিন হল সেই দিন যেখানে সবাই সব থেকে সুন্দর জামা পড়ে অঞ্জলি দেয়  বা ঠাকুর দেখতে যায়।প্রেয়সী বাবার দেওয়া লাল শাড়ী পরে ভাই বোনদের সাথে যায় ওদের মণ্ডপে।আজ মা দুর্গা কে অনন্য সুন্দর লাগছে।চোখ ফেরানো যাচ্ছে না।আর এবার প্রিয়া প্রথম শাড়ী পরেছে।সবার থেকে প্রশংসা আর কাকিমাদের থেকে ইয়ার্কি মূলক মন্তব্য পেয়ে বেশ ভালো লাগছে।এখানে এলে ওরা দশ ভাই বোন একসাথে।পাত্তা পাওয়া যায় না।সবাই মিলে মণ্ডপে গেছে।আজ অবশ্য বাইরে থেকেও কিছু নিমন্ত্রিত লোকজন আসে।এসেছে বাইরের লোকজন।প্রিয়া মণ্ডপে দাঁড়িয়ে ফুল হাতে নিয়ে দেখে একটি সুঠাম চেহারার যুবক ওর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।প্রিয়া তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিল।অঞ্জলী দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ওর দিকে চেয়ে আছে আর চোখ মিলতেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।প্রিয়ার ব্যাপারটা খারাপ লাগছে না।ওর বোন রিয়া বলছে, দিদিভাই এই দাদাটা তোর দিকে কেমন করে চাইছে।একটু ধমক দিয়ে বোনকে বললো ছাড় তো,পাত্তা না দিলেই হল।যাই হোক অঞ্জলী পর্বের পর হল প্রসাদ পর্ব।প্রসাদ বিতরণের পর ওরা মণ্ডপেই বসে রইল আড্ডা দেওয়ার জন্য।ওই ছেলেটিও তার এক ভাই বা বন্ধুর সাথে বসে আড্ডা  মারছিল।সেই বারবার তাকানো বা চোখা চোখি পর্ব আড়ালে চলতেই থাকলো।এরপর ওরা বাড়িতে চলে এলো।অষ্টমী,নবমী,দশমী তে অনেক লোক নিমন্ত্রিত থাকে।এবার আবার খাবার সময় ও দেখা।এবার কাকু আবার ভাই বোনদের সাথে ছেলেটার শুধু না তার বাবা-মা সবার পরিচয় করে দিল।ওরা প্রিয়াদের খুব দু:সম্পর্কের আত্মীয় দিল্লীতে থাকে।পুজোর সময় আসে চার পাঁচ বছর পর পর।কাকু বলল,এই তো রিভু আমাদের,এবার এইমেস মেডিক্যালে পেয়েছে।স্কলার ছেলে।সাথে ভাইঝিদের পরিচয় দিল।সাথে আবার এটা ও বলতে ভুলল না, আমার ভাইঝি এবার উচ্চ মাধ্যমিকে জেলাতে প্রথম হয়েছে।খাবার পর বসলো আমাদের ভাই-বোনদের নাচ-গানের আসর।রিভু আর ওর ভাই নীল ও ছিল।এখানে প্রথম থেকেই শুরু হল-দো দিল মিল রাহা হেয়,নজর চুপকে চুপকে।অস্তে আস্তে কথা হল দুজনের মধ্যে।নবমীর দিন প্রেয়সী মা র একটা শাড়ি পড়ল।ওই দিন রিভু একটা কথা বলল যে, ,’শাড়িতে তোমাকে কিন্ত বেশি সুন্দর লাগে।’
একটু লজ্জা পেয়েও থ্যাংক ইউ বলতে ভুলল না।দশমীর দিন রিভু বলল,’কাল তো চলে যাবো আমরা সকালেই।যদি তোমাদের ফোন নম্বর কিছু থাকে দেবে প্লিস।কথা হতে পারে।’প্রিয়াদের বাড়ির ল্যান্ড নম্বর দিল।মোবাইল তখন ও ওদের আসেনি।দশমীর দিনে ঠাকুর বরণ হল আর ঠাকুর জলে ফেলে শুরু হয় সিঁদুর খেলা।সিঁদুর খেলার সময় রিভু চুপি চুপি এসে বলে গেছিল কোনোদিন যদি তোমাকে সিঁদুর পরাতে পারি সেদিন আমি সব থেকে বেশি খুশি হব।রিভুর প্রিয়ার মুখ লজ্জা আর সিঁদুরের আভায় রক্তিম হয়ে গেছিল।বাড়ি ফিরে দশমীর দিন সবাইকে বিজয়ার প্রণাম আর ঠাকুমার তৈরি আরশে,নারকেল নাড়ু,সিরির নাড়ু,সেমাইয়ের পায়েসের স্বাদ লেগে থাকে মুখে।সেদিন সারা রাত প্রিয়া ঘুমোতে পারেনি।রিভুর ভালোবাসা মাখানো কথা গুলো মনে পড়ছে।কারণ এর আগে সেরকম ভাবে প্রেম আসেনি ওর জীবনে।রিভুরা চলে গেল।মন খারাপ লাগছে এবার ।ওদের ও কলকাতার সেই যান্ত্রিক জীবনের রোজ নামচায় ফিরে যেতে হবে।আসার সময় ঠাম্মি,কাকিমারা গলা জড়িয়ে খুব কাঁদছিল।সত্যি ফিরে যেতে মন চায় না তবু যে যেতে হবে।আজ একবছর হয়ে গেল ঠাম্মি ওদের ছেড়ে চলে গেছে।আর কেউ কথা রাখে না।রিভুর সাথেও আর কোন সম্পর্ক নেই।ফোনও করে না।প্রথম প্রেম ছিল তো স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল।কিন্ত এই এক বছরে প্রেয়সী আর কল্পনায় ভাসে না বাস্তবের মাটিতে পা দিয়েই চলে।সামনে একটাই লক্ষ ভালো রেজাল্ট করে দেখিয়ে দিতে হবে সবাইকে।এ বছর পুজোয় আর যাওয়া হচ্ছে না।তাই বোনের সাথে স্মৃতি মেদুরতায় আজ হঠাৎ ভেসে গেছিল প্রিয়া।বোনকে এটাই বলল ভালো স্মৃতি যেন স্মৃতিকণা হয়ে বেঁচে থাকে।স্মৃতি সততই সুখের হোক।

কলমে সুনন্দা দিকপতি যশ

পেশায় রিসার্চ স্কলার, নেশায় আর ভাবনায় লেখা আর ভালো বইয়ের পোঁকা।শিখতে আর পড়তে ভালো লাগে।


 

4 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here