()

     নীচে অরণ্যর ঘর থেকে মাঝরাতে জোর একটা চিৎকার শুনে রাধিকা আর তার বাবা মা ছুটে এলেন দোতলা থেকে। 

“কী হয়েছে অরণ্যদা, আপনি এরকম চিৎকার করলেন?” রাধিকা অরণ্যর দিকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল। 

    খাটের উপর বসে ঘামছে অরণ্য। একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে ও। জলটা খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে আপন মনে বলে, 

“আমি তো বিবাহিত নই। তাহলে আমার মেয়ে কোথা থেকে আসল?”

“মেয়ে? কোথায়? ঘরে তো আমরা আছি শুধু…” রাধিকার বাবা ইন্দ্রনাথ বাবু অবাক হয়ে বলেন।

“স্বপ্নে, আমি স্বপ্ন দেখলাম যেন একটা বাচ্চা মেয়ে ‘পাপা পাপা’ বলে দুহাত বাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ডাকছে…।” 

    রাধিকা আর ওর বাবা মা তিনজনে মুখ চাওয়াচায়ি করলেন। খানিক ক্ষণ চুপ থেকে ইন্দ্রনাথ বাবুই পরামর্শ দিলেন অরণ্যকে দোতলায় একটা ঘরে রাতটা কাটানোর জন্য। অসুস্থ ছেলে, তার ওপর এরকম একটা উদ্ভট স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গেছে, ওনারা ওকে আজ রাতে তাই একা একা নীচের ঘরে শুতে দিতে আর ভরসা পেলেন না। 

    অরণ্য ইন্দ্রনাথ বাবুর স্কুলের ছাত্র ছিল। বহু বছরের পুরোনো ঘটনাটা আজও ভুলতে পারেন না ইন্দ্রনাথ বাবু। সেদিন একটু রাত হয়ে গেছিল ওনার একটা নেমন্তন্ন থেকে ফিরতে। সঙ্গে ছিল ছোট্ট রাধিকা। রাস্তায় কিছু মাতাল অসভ্য লোকের হাত থেকে দশ বছরের রাধিকার সম্ভ্রম বাঁচাতে উনি যখন একা পেরে উঠছিলেন না, তখনই কৃষ্ণের মতো উপস্থিত হয়েছিল অরণ্য। সেদিন ক্যারাটে জানা tuition ফেরত second year college student অরণ্যর জন্যই রাধিকার সম্মান আর প্রাণ বেঁচে গিয়েছিল।

    তাই যখন ঠিক একবছর আগে অরণ্যর একটা major road accident হওয়ায় ওর পুরোনো স্মৃতি পুরোপুরি মুছে যায়, ইন্দ্রনাথ বাবু decide করেছিলেন ওকে নিজের কাছে এনে রাখার, ওর সমস্ত দায়িত্ব নেওয়ার যতদিন না পর্যন্ত অরণ্য completely cure হচ্ছে। উনি জানেন অরণ্যর পুরোনো ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়। তবু কৃতজ্ঞতা আর পুরোনো ছাত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ওনার এই সিদ্ধান্ত। একবছর ধরে ওনাদের, specially রাধিকার সেবা যত্নে অরণ্য physically অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে, যদিও পুরোনো স্মৃতি এখনো ফিরে আসেনি ওর। 

    Doctor সেদিন ইন্দ্রনাথ বাবুকে বলেও দিয়েছিলেন যে স্মৃতি না ফেরার সম্ভাবনাই বেশী আর ফিরলেও সেটা খুব সুখকর হবে না। অরণ্য নাকি ভীষণ রকম mentally depressed ছিল আগে থেকেই, খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে drinks addicted হয়ে পড়েছিল। এর বেশী অরণ্যর past life সম্পর্কে আর কিছুই জানতে পারেননি ইন্দ্রনাথ বাবু। এই একটা বছর অরণ্যর বাড়ির দিক থেকে কোনো খোঁজ আসেনি, newspaper এ নিরুদ্দেশ বিজ্ঞাপনও চোখে পড়েনি ওনাদের। 

    ওনার স্ত্রী নিরুপমা দেবী যদিও প্রস্তাব দিয়েছিলেন কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কিংবা পুলিশের সাহায্য নেওয়ার, কিন্তু রাধিকা রাজি হয়নি। রাধিকা বলেছিল,

“অরণ্যদার বাড়ির দিক থেকে যখন কেউ খোঁজ খবর করল না, তখন আমাদের তো কোনো দরকার নেই এসবের। ঐ একটা অসুস্থ মানুষের জন্য আমাদের খুব বেশী অসুবিধে তো হচ্ছে না। হয়তো ওনার পরিবারের সঙ্গে কিছু সমস্যা আছে বলেই Mental condition ঠিক ছিল না। তাহলে যে পরিবারের জন্য উনি mentally depressed ছিলেন, যে পরিবার একবারও খোঁজ খবর করার চেষ্টা করল না, সেই পরিবারকে খুঁজে সেখানেই ওনাকে ফিরিয়ে দেওয়াটা কি উচিত আমাদের? ভাগ্যিস সেদিন দুর্ঘটনার সময় তুমি ওখানে ছিলে বাবা, নাহলে…! উনি তো আমাকে ছোটবেলায় বাঁচিয়েছিলেন, তাহলে আমাদের কি উচিত নয় এই বিপদে ওনার পাশে থাকা? ওনার স্মৃতি ফিরলে, উনি সুস্থ হয়ে উঠলে তারপর নাহয় উনিই decide করবেন উনি কী করবেন… এখন উনি এখানেই থাকুন…”

    রাধিকার কথায় যুক্তি ছিল। তাছাড়া, পুরোনো ছাত্রের অতীত না জেনে তাকে অসুস্থ অবস্থায় অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে মন সায় দেয়নি ইন্দ্রনাথ বাবুর। আর তাতে ভালোই হয়েছে অরণ্যর। ক্র্যাচ ছাড়া এখন অনেকটাই হাঁটতে পারে। খুবই চুপচাপ থাকে সারাদিন। ঘরের জানালার ধারে বসে রঙ তুলি নিয়ে ছবি আঁকে। মাঝেমধ্যে রাধিকার কলেজের বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে। আর পছন্দ করে রাধিকার গান শুনতে। 

    একতলায় অরণ্যর ঘরের পাশেই বড় বৈঠকখানায় রাধিকার গানের স্কুল বসে, সপ্তাহে চারদিন। একদিন শুধুমাত্র কচিকাঁচা দের জন্য। আর দুদিন হল teenagers এর জন্য। ওদের ভিড়ই সবথেকে বেশী। বাকি একদিন মাঝবয়সী কাকিমাদের জন্য। রাধিকার গানের গলার মতো ওর মিষ্টি ব্যবহারের জন্যই এলাকায় ওর একটা পরিচিতি ছড়িয়ে গেছে। তাই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে ছাড়াও আরো কিছু মানুষ ওর কাছে গান শিখতে আসেন। 

    সপ্তাহে তাই চারটে দিন বাড়িটা গানে- কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে। অরণ্যর বেশ ভালো লাগে বাচ্চাগুলোর আধো আধো স্বরে গানের সুর। নিজের ঘরে বসেই ও শোনে ওদের কোলাহল। মাঝে মাঝে রাধিকার ধমকানি শুনতে পাওয়া যায়। বেচারা ছাব্বিশ বছরের মেয়েটা নাজেহাল হয়ে যায় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলোকে সামলাতে। 

()

    আজ তোর্সার বাড়িতে রাধিকার নেমন্তন্ন। গতকাল বিকেলে তোর্সাকে গান শেখাতে নিয়ে আসার সময় ওর দাদু রাধিকাকে খবরটা দেওয়ার পাশাপাশি নেমন্তন্ন করে গেছেন। তোর্সাদের স্কুল থেকে রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে যে গানের competition এর আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে ‘ক’ বিভাগে ছয় বছরের মেয়েটা first হয়েছে। রাধিকাও তাই ভীষণ খুশি ওর প্রিয় খুদে ছাত্রীর সাফল্যে। 

    অরণ্যর ঘরে দুপুরের খাবারটা দিয়ে টুকটাক কথা সেরে বেরোতে গিয়ে চোখ পড়ল অরণ্যর টেবিলের উপর। আঁকার খাতাটা খোলা পড়ে আছে আর তাতে জলরং এ আঁকা একটা বাচ্চা মেয়ের portrait. কাছে গিয়ে ছবিটা দেখে চমকে উঠল রাধিকা। অরণ্য তো কখনো নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ওর গানের ঘরে আসেনি, বাচ্চাদের দেখেওনি। তাহলে ও তোর্সার portrait আঁকল কী করে?

    ভীষণ আশ্চর্য হয়ে কথাটা অরণ্যকে জিজ্ঞেস করল রাধিকা। অরণ্য খেতে খেতে বলল,

“ওই তো সেই, যাকে সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখলাম… গোলাপী রঙের ফ্রক পরে আমাকে ‘পাপা’ বলে ডাকছে…।” তারপর রাধিকার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “হয়তো ও আমার আগের জন্মের মেয়ে ছিল। আচ্ছা, আপনি কখনো আগের জন্মের স্বপ্ন দেখেছেন?”

    রাধিকা চুপ করে থাকে। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। মানুষ যাকে কখনো দেখেনি, তাকে স্বপ্নে দেখতে পায়? 

“বেশ, আপনি সেদিন নাহয় এই মেয়েটাকে স্বপ্নে দেখলেন। তা ওর ছবিও এঁকে ফেললেন? মানে হঠাৎ আঁকতে ইচ্ছে হল কেন অচেনা একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি?” কৌতুহলী হয়ে রাধিকা জিজ্ঞেস করে অরণ্যকে।

“ওটাই তো interesting ব্যাপার… অচেনা মেয়েটা আমাকে ‘পাপা’ বলে ডাকছে…. জানেন তো রাধিকা, স্বপ্নটা দেখার পরদিন থেকেই কেমন যেন একটা টান অনুভব করছি ওর প্রতি… মনে হচ্ছে ও আমার… হয়তো আগে কোথাও দেখেছি… তাই জন্যই খুব ইচ্ছে হল ছবিটা আঁকতে…” উদাস হয়ে বলল অরণ্য। 

    রাধিকা আর কিছু বলে না। তোর্সার বাড়ি যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। পরে ব্যাপারটা নিয়ে বাবা মার সঙ্গে কথা বলবে। এটা কি নিছকই স্বপ্ন? নাকি অরণ্যর জীবনের সঙ্গে কোনোভাবে এটা জড়িত? অবশ্য আজ তোর্সার বাড়ি গেলে হয়তো জানা যাবে যে অরণ্যর সঙ্গে তোর্সা আর ওর পরিবারের কোনো যোগসূত্র আছে কিনা!

    অরণ্যকে ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নেমন্তন্নে যাওয়ার জন্য ready হয় রাধিকা। 

()

“তোর্সা আপনাদের কাছেই থাকে? ওর বাবা মা কি তাহলে বাইরে কোথাও চাকরি করেন?” খাওয়ার টেবিলে বসে রাধিকা জিজ্ঞেস করে তোর্সার দিদুন শিবানী দেবীকে। 

“জামাই এর কথা জানি না গো, তবে আমার মেয়ে মানে দিদিভাই এর মায়ের দেড়বছর আগে blood cancer ধরা পড়েছিল আর তারপর কটা মাস পরেই…” চুপ করে মুখ নামিয়ে নেন শিবানী দেবী। 

“বুঝলে মা, আমরা হতভাগ্য বাবা মা…” তোর্সার দাদু নীলাঞ্জন বাবু বলেন। 

    রাধিকা কী বলবে বুঝতে পারে না। এত খুশির দিনে এরকম একটা খবর শুনবে ভাবেনি ও। তোর্সার মা নেই? সেই জন্য রাধিকা প্রথম দিন থেকে দেখে এসছে তোর্সা ওর দাদু কিংবা দিদুনের সঙ্গে গানের স্কুলে আসত। কখনো ওর বাবা মাকে দেখেনি। ভেবেছিল ওনারা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত তাই হয়তো সময় পান না। কিন্তু আজ সব পরিষ্কার হয়ে গেল। 

    কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাধিকা জিজ্ঞেস করে, 

“তোর্সার বাবা, বাবা আছেন তো?”

“থাকার তো কথা, জানি না মা” নীলাঞ্জন বাবু বলেন, “মেয়ে চলে যাওয়ার পর জামাই মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছিল। জামাইকে প্রথম দেখেছিলাম ওভাবে ঝরঝর করে কাঁদতে। তারপর ধীরে ধীরে কেমন যেন আচরণ করতে লাগল। দিদিভাই তখন পাঁচ বছরের শিশু। যে দিদিভাই অন্ত প্রাণ ছিল জামাই এর, তাকে সহ্য করতে পারত না, ভাবত ঐ অপয়া মেয়ের জন্যই… আমাদের সঙ্গেও ভালোভাবে কথা বলত না। ভালো অফিসে চাকরি করত জানো মা! সব ছেড়ে দিল। সারাদিন ঘরে বসে থাকত… ওসব ছাঁইপাশ মদ গিলত। আমরা বুড়ো মানুষ। নিজেরা সন্তান শোকে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, আর তার ওপর জামাইয়ের খারাপ ব্যবহার… আমরা তাই দিদিভাইকে নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় ফিরে আসি” নীলাঞ্জন বাবু থামলেন। 

“তারপর উনি আর কখনো খোঁজ নেননি তোর্সার?”

“না মা। আমরা ফোন করতাম। বেজে যেত। কখনো কখনো ধরলেও কীসব জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলত বুঝতে পারতাম না। সারাদিন যে নেশায় মজে থাকত। তারপর একদিন ফোন করে কীসব বলল…’আমি শিলিগুড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি… আপনারা আমার আর খোঁজ করবেন না…’ আমরা বললাম দিদিভাই এর কী হবে… কিন্তু তার আগেই ফোনটা কেটে যায়”একটু থেমে দম নিয়ে বলেন,”নিজেদের শোকে দুঃখে বুক ফেটে যাচ্ছিল… বুড়ো মানুষ… কোথায় কীভাবে খোঁজ-খবর করব বুঝতেও পারছিলাম না। আর কার জন্য খোঁজ করব বলো মা! দিদিভাইকেই তো দূরে সরিয়ে দিল…।” গলাটা ধরে আসে নীলাঞ্জন বাবুর।

“খুব ভালো ছেলে ছিল। ভালো চাকরি করত। সুখের সংসার ছিল। কার অভিশাপে যে মেয়েটা আমার চলে গেল, জানি না মা” ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন শিবানী দেবী। 

    রাধিকার চোখেও জল। তোর্সার মতো এরকম ফুটফুটে নিষ্পাপ একটা বাচ্চা মেয়ের জীবন থেকে ‘বাবা মা’ ডাকটাই হারিয়ে গেছে!

“ওনার আর কেউ ছিল না? মানে ওনার বাবা মা…”

“আমার মেয়ের বিয়ের আগেই বেয়াইমশাই মারা যান। বিয়ের কয়েক বছর পরে বেয়ান heart এর অসুখে চলে যান। ওনারা থাকলে কি আর অরণ্যর মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই জীবনটা এভাবে তছনছ হয়ে যেত!” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন নীলাঞ্জন বাবু। 

    চমকে উঠল রাধিকা।

“কী? কী নাম বললেন?” 

“অরণ্য, অরণ্য বসু।”

()

“পাপা” বলে ছুটে এগিয়ে এসে ওর ছোট দুহাত দিয়ে অরণ্যর গলা জড়িয়ে ধরে তোর্সা। 

    হকচকিয়ে যায় অরণ্য। ওর বুকটা কেঁপে ওঠে। এই ছোঁয়া… এই গন্ধ… এই স্বর… যেন খুব চেনা মনে হয়। একটা অদ্ভুত ভালো লাগা থেকে অরণ্যও নিজের বুকে জড়িয়ে নেয় তোর্সাকে। 

    দরজার ওপারে উপস্থিত তখন সবার চোখে জল। রাধিকার মুখে অনেক দিন পর অরণ্যর খোঁজ পেয়ে আর থাকতে পারেননি শিবানী দেবী আর নীলাঞ্জন বাবু। ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে কাঁদতে তোর্সাকে নিয়ে ছুটে এসেছেন রাধিকার সঙ্গে। 

    রাধিকা নিজেও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অরণ্যর অতীত কাহিনী শুনে। যে মানুষটা দেবদূতের মতো এসে একদিন তার জীবন রক্ষা করেছিল, আজ সেই মানুষটারই নিজের জীবন অন্ধকার হয়ে গেছে! সেই সঙ্গে সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছে এটা দেখে যে ওদের বাড়ি থেকে অল্প কিছু দূরত্বে তোর্সার মামাবাড়ি, অথচ অদৃষ্টের ছলনায় যেন লক্ষ যোজন দূরত্ব ছিল তোর্সা আর অরণ্যর মধ্যে। আর ভাগ্য কি নিষ্ঠুর! নাহলে বাবা হয়ে আজ নিজের মেয়েকে দেখেও চিনতে পারে না অরণ্য! 

“তুমি আমাকে ফেলে কোথায় ছিলে পাপা? জানো পাপা, দিদুন বলেছে মাম্মাম নাকি আকাশে গেছে! ওখানে কী করে যেতে হয়? মাম্মাম কি আর আসবে না, পাপা?”

    তোর্সার কচি গলায় আদুরে কথা শুনতে বেশ ভালো লাগে অরণ্যর। ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে রাধিকার দিকে ফিরে বলে,

“জানেন, আমি ঠিক যেন একেই স্বপ্নে দেখেছিলাম সেদিন রাতে। আপনি একে পেলেন কোথায়? ওর বাবা মা নেই?”

    রাধিকা ভেবেছিল তোর্সা আর সঙ্গে ওর দাদু দিদুনকে দেখে হয়তো অরণ্যর পুরোনো স্মৃতি ফিরে আসবে। কিন্তু তার তো কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। 

“আপনার কিছু মনে পড়ছে না, অরণ্যদা?”

“নাহ! কিন্তু মাথাটা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।”

“থাক অরণ্য” ইন্দ্রনাথ বাবু এগিয়ে এসে বলেন, “যা গেছে, তাকে আর জোর করে মনে করতে হবে না। তুমি বরং তোর্সার বাবা হয়ে যাও। মেয়েটা ভীষণ অসহায়।”

“কিন্তু ও আমাকে ওর বাবা মনে করছে কেন?”

“তুমিই তো ওর বাবা অরণ্য” নীলাঞ্জন বাবু বলেন।

“তা কী করে হয়? আমার তো কই কিছু মনে পড়ছে না! আমি বিবাহিত! আমার মেয়ে আছে! আমার… আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না।” চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে দুহাতে মুখ ঢাকে অরণ্য। 

    রাধিকার খুব কষ্ট হয়। ও এই একটা বছর অরণ্যর সেবা যত্ন করতে করতে ওর মায়ায় পড়ে গেছে। আর আজ অরণ্যর যন্ত্রণা ভরা জীবনের কথা জানতে পেরে কেমন যেন টান অনুভব করে ওর প্রতি। রাধিকা বুঝতে পারে ও মনে মনে যে সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে, তা খুবই কঠিন এবং বড় রকমের একটা পদক্ষেপ। তোর্সা ওর প্রিয় ছাত্রী। ওকে ও খুব ভালোবেসে যত্নে বড় করতে পারবে। কিন্তু অরণ্যকে কি পারবে ভালো রাখতে? রাধিকা ভাবে অরণ্যর স্মৃতি ফিরে না এসে ভালোই হয়েছে। ফিরে আসলে স্বাভাবিক ভাবেই আবার মানসিক কষ্ট বাড়ত। কিন্তু ভবিষ্যতে কখনো স্মৃতি ফিরে আসলে তখন ও কীভাবে react করবে? তখন কি রাধিকা পারবে পরিস্থিতি সামাল দিতে? 

    মনের মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা কাজ করে। বাবা মার দিক থেকে নিশ্চয়ই support পাবে। অরণ্যর জন্যই তো আজ এই ছাব্বিশটা বসন্ত কাটাতে পারছে রাধিকা। নাহলে তো দশ বছরেই ওর জীবন শেষ হয়ে যেত। সেই ভগবান তুল্য মানুষটাকে ও অন্ধকারে আর তলিয়ে যেতে দিতে পারে না। আর তোর্সা তো কোনো দোষ করেনি। ঐটুকু ফুলের মতো মেয়ের বাবা থাকা সত্ত্বেও কেন ও পিতৃহীন পরিচয়ে বড় হবে? কিন্তু অরণ্য কি রাজি হবে তোর্সাকে নিয়ে ওর সঙ্গে নতুন করে জীবনের আলো দেখতে?

    বুকের ভেতর পাথর সমান চিন্তা আর ভয় নিয়ে রাধিকা এগিয়ে আসে অরণ্যর কাছে। তোর্সাকে কোলে তুলে নিয়ে উপস্থিত সকল গুরুজনের সামনে দৃঢ় ভাবে বলে,

“অতীতকে ভুলেই গেছেন যখন, তখন তাকে জোর করে সামনে না টেনে নিয়ে এসে এই ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে একটা নতুন জীবন গড়ার কথা ভাবতে পারি না আমরা, অরণ্যদা?”

    অরণ্য ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রাধিকা আর তোর্সার দিকে। ছোট্ট মেয়েটা যখন আদুরে গলায় ‘পাপা’ বলে জড়িয়ে ধরেছিল, তখন সত্যিই বুকের ভেতরটা খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। ও তো এই মেয়েটার portrait এঁকেছিল ভীষণ যত্ন নিয়ে। হয়তো সত্যিই ও নিজেই মেয়েটার বাবা, যেটা দুর্ঘটনার কবলে পরে মন থেকে মুছে গেছে। রাধিকা তো ঠিকই বলল, যা গেছে তাকে জোর করে ফিরিয়ে আনার তো দরকার নেই। আর রাধিকা এবং তার পরিবারের জন্যই তো ও নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। সেই নতুন জীবনে রাধিকাকে নিয়ে পথ চলতে অরণ্য চায়, অন্তত সুপ্ত মন সেটাই জানান দিচ্ছে। 

“কিন্তু আমি আপনাদের দায়িত্ব নেব কী করে? আমি তো বেকার। পুরোপুরি সুস্থ হয়েও উঠতে পারিনি…।”

“আমি দায়িত্ব নেব” অরণ্যকে থামিয়ে বলে রাধিকা, “আর আপনি এত ভালো ছবি আঁকেন, সুস্থ হয়ে উঠলে আপনিও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের drawing শেখাবেন। আপনারও ভালো লাগবে আর আমাদের পথ চলাও আরো সহজ হবে।” 

    ঘরের মধ্যে উপস্থিত চার বয়স্ক মানুষের চোখের জল যেন আশীর্বাদ স্বরূপ ঝরে পড়ছে চোখ দিয়ে। পাশের কোনো এক বাড়ি থেকে ভেসে আসছে লোপামুদ্রার গাওয়া সেই hit গানের মাঝের কটা লাইন,

“জীবন মানে ওঠা পড়া, জীবন ভাঙা গড়া/ ভাঙতে গড়তে উঠতে পড়তে সময় চলে যায়/ মন্দ ভালো সাদা কালোয় জীবন বয়ে যায়…।”

কলমে চন্দ্রলেখা মুখার্জী, বারাসাত, কলকাতা

16 COMMENTS

  1. গল্পটা খুব সুন্দর । চরিত্র গুলো যেন জিবন্ত ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here