”একান্নবর্তী পরিবার ” শব্দ টি নিয়ে মনের ক্যানভাসে একটি সিপিয়া কালারে ছবি এঁকে ফেলার চেষ্টা করছি কিছুকাল ধরে। বারবার শব্দটি আমার ছবিতে ভগ্নপ্রায় পরিত্যক্ত একটি বাড়ি হয়ে ফিরে আসছে। পলেস্তরা খসে গেছে, ইট বেরিয়ে এসেছে, শব্দের মধ্যে বর্ণগুলি যেন অন্ধকার নোনাধরা ঘর।ওপর থেকে ঝুলছে লম্বা লম্বা ঝুল ,আর অকার, ইকার গুলো যেন বাড়ির দেওয়াল ভেদ করে ওঠা কিছু বট গাছ ও আগাছা,কল্পনার ছবিটি এঁকে মনের দৃষ্টি চলে গেল কিছু পুরানো বাস্তব ছবিতে, বাবা বিয়ে করে আনলেন মাকে। বাবা কোলকাতার একটি স্কুলে পড়ান আর মায়ের চাকরি স্হল কোলকাতা থেকে বেশ দূরে বারাসত ছাড়িয়ে অনেক ভিতরের একটি গ্রামের হাইস্কুল। এখনকার মতো যাতায়াতের সুবিধা তখন ছিল না তাই মা বেশিরভাগ সময়ই বাপের বাড়ি বারাসত থেকে যাতায়াত করতেন। সপ্তাহের শেষে মা শ্বশুর বাড়ি আসতেন এভাবে কিছু দিন চলার পর মা বাবাকে বললেন কোলকাতা আর বারাসতের মাঝামাঝি যদি থাকা যায় তবে দুজনেরই কাজের জায়গায় যাতায়াতের সুবিধা হবে।বাবা এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না ।ওপার বাংলা থেকে আসা পরিবারটির গা থেকে তখনও ক্ষত সারেনি। একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে পরিবারটি ।বাবা পরিবারের প্রধান আয়ের স্তম্ভ। বৃদ্ধ বাবা মা রয়েছে, তখনও ছোট ভাই বেকার, বড় ভাইয়ের রাজ্য সরকারের সাধারণ একটি চাকরি ।একটি একটি করে বেড়ার ঘর খুলে বাবা পাকা ঘর করার চেষ্টা করছেন।বাবা, মা র এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না বললেন আমি চলে গেলে এই পরিবারটা আর কোন দিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না ।তুমি বরঞ্চ চাকরি ছেড়ে দাও আমি আরও কয়েকটা টিউশন বাড়িয়ে দেবো তাহলে তোমার চাকরির টাকাটা উঠে আসবে ।আমার পক্ষে এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মা কিন্তু বাবার এই প্রস্তাব রাজি হয়ে গিয়েছিলো। বিয়ের আগে থেকে করা এতো দিনের চাকরি এককথায় ছেড়ে দিয়ে ছিল।
এরপর ছোটবেলার আরও কিছু স্মৃতি, কিছু ছবি, যে ছবিতে মিশে আছে অনেক আবেগ, ভালোবাসা স্নেহ ,আদর, শাসন। ছবি গুলি পর পর সাজিয়ে একটি ক্যানভাসে কোলাজ তৈরি করার চেষ্টা করছি। ।
একটি দোতলা বাড়ি ,বাড়িতে রয়েছে বাবা মা জেঠু কাকুরা ,বড়মা ,কাকিমারা আর আমার খুব কাছের মানুষ দাদা দিদি রা । একান্নবর্তী পরিবার, বড়মার উপর দায়িত্ব ছিল পুরো সংসারের, মা, কাকিমারা সবকাজে সাহায্য করতেন। রাত্রিবেলা সব ভাই বোনেরা একসাথে খেতে বসতাম ।বড়মা সবাইকে নাম ধরে এক সুরে ডাকতেন খেতে ।সেই সুর আজও কানে বাজে।এইসময় টা ছিল আমাদের ভাই বোনদের কাছে নানা হাসি মজা সারাদিনের জমানো গল্পের আসর। এছাড়া স্মৃতির পাতায় এসে ভিড় করছে সেই , রাতে পড়াশোনা হয়ে যাবার পর বাড়ির নানা কোনে লুকোচুরি খেলা, বিকেল হলে দাদার সাথে চুপিচুপি ছিপ নিয়ে সামনের পুকুরে মাছ ধরতে যেতাম আর অন্ধকার হয়ে গেলে দুজনে আবার ফিরে আসতাম ঝুড়ি তে করে কোনদিন দু একটা মাছ নিয়ে ,আবার কোনদিন একেবারেই খালি হাতে ভয়েভয়ে , কত দিন যে বকা খেয়েছি বাড়িতে কিন্তু একটা কেমন নেশায় পেয়ে বসে ছিল আমাদের ।
স্মৃতির ধূসর পাতায় এসে ভিড় করে জেঠুর খেতে বসার সময়টা । গ্যাসট্রিকের রুগী ছিলেন, তাই ডাক্তারের নির্দেশে রাত নয়টার সময় খেতে বসতেন প্রথমে কাঁচাহলুদ বাটা দিয়ে কিছুটা ভাত খেতেন তারপর বাকি ভাত দুধ দিয়ে খেতেন ।আমারা ভাই বোনেরা জেঠুর পাশে রোজ গোল করে বসে থাকতাম জেঠুর হাতে মেখে দেওয়া ঐ একগ্রাস করে হলুদ মাখা ভাত খাবার জন্য।সে এক অপূর্ব স্বাদ ।এরপর অনেক ভাল ভাল খাবার খেয়েছি বা এখনও খাই কিন্ত সেই ভালোবাসা মাখানো হাতের খাবারের স্বাদ আজও পেলাম না।
মা সন্ধ্যাবেলা দাদা আর আমাকে নিয়ে পড়াতে বসাতেন। কিংবা পরীক্ষার সময় অনেক রাত পর্যন্ত বসে পড়ছি পাশে রাত জেগে বসে আছেন নিঃসন্তান কাকু কাকীমা। কি অপত্য স্নেহ!!! বাবার স্কুল ছুটির পর টিউশন সেরে ফিরতে অনেক রাত হতো সবাই ঘুমিয়ে পড়তাম, বাবার জন্য না খেয়ে বসে থাকতেন মা আর কাকু দিনের পর দিন । কি অসম্ভব ভালোবাসা যা আজও আমায় ভাবায়।
এসব টুকরো টুকরো ছবি গুলো মধ্যে জড়িয়ে আছে কত সুন্দর স্মৃতি কত স্নেহ কত ভালবাসা কত বন্ধন।
আজ আমরা বেশীরভাগ মানুষ যখন নিজেদের নিয়ে ভাবনা চিন্তায় মগ্ন, নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সবসময় সচেষ্ট ।তখন এইসব মানুষগুলোর কথা মনে হয় যারা নিজেদের সুখ স্বার্থের থেকে অনেক বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন একটি বড়ো সংসার কে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় আর সংসারের প্রতিটি মানুষ কে কিভাবে সুখী রাখা যায়।
আমার কাছের মানুষ অনেকে চলে গেছেন এ পৃথিবী ছেড়ে কিন্তু তাঁদের স্নেহ ভালোবাসা আজও প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করতে পারি ।আর যারা আজও আছেন বারবার ফিরে যাই তাঁদের কাছে তাঁদের ছুঁয়ে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে পুরানো দিনগুলিকে ।
আজও আমি প্রতিনিয়ত মনের ক্যানভাসে একটি একান্নবর্তী পরিবারের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার ছবি এঁকে চলেছি ।।।
লেখিকা পরিচিতি : শুভশ্রী সান্যাল