রিমি

মাসিক জনপ্রিয় লেখনী প্রতিযোগিতা

0
1189

“ছোটমা! রিমিকে আমায় দেবে?”
কতবার ভেবেছি কথাটা রিমির মাকে বলবো! সাহসই হয়নি। অপেক্ষা করতাম,একটু বড় হয়ে নিজেকে গুছিয়ে তারপর একদিন ছয় বেহারার পাল্কি চড়ে কোন এক চাঁদনী রাতে রিমিকে বউ করে ঘরে আনবো।

অনুভব অনুভূতির শ্বেতশুভ্র চাদরে স্বপ্নগুলো মুড়ে রাখতে না রাখতেই একদিন চেয়ে দেখি, ও পাড়ার ফটিক কখন যেন কলমী-দামের আড়ালে থাকা নিটোল দিঘীর স্বচ্ছজলে চার ফেলে বসে গেছে। টলটলে রিমির হৃদয় মাঝে ফাৎনা আটকানো বড়শীতে টোপ ফেলেছে। সকাল সন্ধ্যায় সে ফাৎনায় টান পড়ে। কলোহাসিতে মেতে ওঠে ওরা।
আমার যে তখন কি হয়! বুকের মাঝে সহস্র আরশোলা কিলবিল করে। অসহ্য যন্ত্রনায় কুঁকড়ে উঠি।

বংশীনদীর পাড়ে কানুগোঁসাইয়ের ঘর। গাঁজায় দম দিয়ে গোঁসাই সটান পড়ে থাকে অভূক্ত শরীরে। সে কোন বিষন্নতায় নিজেকে তিলতিল করে ধ্বংস করার অভিপ্রায় তার, কে জানে! কোন নারীর বিরহ বেদনা কুরে কুরে খায়। বেদনার বিমূর্ততায় ঘোরলাগা তন্দ্রালু চোখে, ভাঙা ভাঙা গলায় গান ধরে “বলবোনা গো আর ভালোবাসি…!”
গানের রেশ শেষ হতে না হতেই হেঁচকি ওঠে । চেয়ে দেখি দু’চোখ জুড়ে তখন তার শ্রাবনের ধারা অবিরল ঝরে পড়ছে।
এমনিভাবে কখন যেন তার ভক্ত হয়ে গেলাম। পাড়ায় তখন বখে যাওয়া ছোকরা হিসাবে নাম ছড়িয়েছে। লজ্জায় ঘৃনায় বিধবা মা আমার, আঁড়কাঠে তাঁর দেহখানা ঝুলিয়ে দিয়েছে। বাবার বৈমাত্রীয় ভাই, কাকু নামের অপদার্থটা তড়িঘড়ি করে মৃত মায়ের আঙ্গুলের ছাঁপ নিয়েছে  ষ্ট্যাম্প পেপারে।  দখল করে নিলো ভিঁটেটুকু।

ঠাঁই দিলো কানুগোঁসাই!
অসহ্য যন্ত্রনায় মন টেকে না। চড়ুইপাখির মত ছটফটানি বুকের ভেতরে।  বিদায় নিলাম গোঁসাইয়ের কাছ থেকে। ঘরের ঝাঁপি খুলে ধুলোমলিন একতারাটা দিয়ে তিনি আমায় আশীর্বাদ করলে।
সেটুকু সম্বল করে পা বাড়ালাম অজানা পথে। পাড়ি দিলাম এবড়োখেবড়ো পথ। উঁচুনীচু বন্ধুর!

বাবা ছোলেমানের দরগা, লালনের আখড়া কিছুই তো বাদ রাখলাম না। তবুও কেন মনে শান্তি আসে না! শুনেছিলাম,সাঁইজ্বীর আখড়ায় এলে মনে প্রশান্তি মেলে। তন্ময় হয়ে শুনি সাঁইজ্বীর গান,”মিলন হবে কতদিনে / আমার মনের মানুষেরও সঅঅনে…! ”
পথের সন্ধানে তো কত পথ পেরিয়ে এলাম ; পথ মেলে কই?

দাঁড়ি-গোঁফের জঙ্গলে আমি এখন নিজের কাছেই অচেনা। মনে পড়ে বংশী নদী। গুরু কানুগোঁসাইয়ের কথা। রিমির কথা। এতদিনে হয়তো রিমি সাজিয়েছে সংসার। হয়তো ছেলেমেয়ে নিয়ে তার পয়মন্ত সংসার।
বেয়াড়া মন আমার! খুব দেখতে ইচ্ছে করে সেই প্রিয় মুখখানা। কেমন আছে সে? ভয় হয়,কোন পরিচয়ে দাঁড়াবো তার সামনে? কোন অজুহাতে?

আজকাল বড় দুঃস্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নে আমায় ডাকে বংশীনদী। ডাকে কানুগোঁসাই! স্বপ্নের মাঝে চমকে উঠি ঘোরলাগা অন্ধকারে।

চৈত্রের খরায় খাঁড়ুজল হয়ে গেছে প্রমত্তা বংশীনদী। গোঁসাইয়ের ঘরটা বড়বেশী জ্বরাজীর্ন। কিছুদিন আগেই গত হয়েছেন গোঁসাই! অস্পৃশ্য বলে কেউ তাঁর খোঁজ রাখতো না। তাই মুখাগ্নি হয়নি তাঁর।
হাটকরে খোলা দরজা দিয়ে দু’দিনের মরা দেহটাকে টেনে নিয়ে নদীর পাড়ে সদ্গতি করেছে শেয়াল আর কুকুরে। আহা রে জীবন!

    উঠতি বয়সী ছেলে-ছোকড়ার দল এদিকে আসে, নির্জনতায় কল্কে টানতে। যাদেরকে চিনিও না তেমন। তারাও চেনে না আমায়। ওদের কাছেই শুনেছি,দূরের কোন গাঁয়ে রিমির বিয়ে হয়ে গেছে। সেখানে সে সুখে নেই!
দেহলোভী ফটিক তাকে ছুঁড়ে দিয়েছিলো শরীরটা লুট করে। সেই থেকে ফটিকও নিরুদ্দেশ।

বসে থাকি অলস সময়ে বড়গাঙ্গের ধারে অশ্বথের নীচে। অলস জীবন আর কতকাল টিকবে বলো! গেঁয়ো যোগী,ভিখ্ মেগে সংসার।

বর্ষায় নদী ভাসে। ধেঁয়ে আসে কোষা-না’ও। ব্যস্ততা বাড়ে নদীর পাড়ে। মহাজনী না’ও,বজরা অথবা পানসী। খোলাম-কূচির মতই দুলতে থাকে বেদেনীদের সংসার। তন্ময় হয়ে চেয়ে চেয়ে মুখগুলো দেখি! যদি ভেসে ওঠে কোন পরিচিত মুখোবয়ব!
শরতের কাশে নরম হয়ে আসে হলুদ বিকেল। নদীজলে ছলাৎচ্ছল! দূরের বাঁশীতে কারো নতুন সুর। ভেসে যাই সে সুর-দরিয়ায়।
আমার একতারাটার তার ছিঁড়ে গেছে সেই কবে। তবু গুনগুন করে ওঠে মন,”দয়াল বান্ধব রে…  একবার দেখা দাও আমারে! “

পুজোর আগমনী গানে পাড়ায় পাড়ায় ধাঁই কূঁড়কূঁড়। কত বজরা না’য়ে নায়রে আসছে গ্রামের ঝিয়ারীরা।
তেমনি এক বিষন্ন বিকেলে সোনারোদ গায়ে মেখে ঘাটে এসে ভিড়ল দূর গাঁয়ের কোষা-না’ও। ছৈ-য়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আলুথালু শ্বেতবসনা একজনা। আমায় ভিখেরী ভেবে, শাঁখাবিহীন সূডৌল হাত তার বাড়িয়ে ধরে ভিক্ষে দেয়ার অভিপ্রায়ে। পলকে চমকে উঠে প্রশ্ন করি কে গো তুমি?

“তারে দাও কাঁটার আঘাত / ফুলের আঘাত যার সয় না/ দয়ার তোর দীলে কি একটু দয়া হয় না…! ” ভাঙা হৃদয়ে বড় বেশী ব্যথা।
জানলাম,দু’দিন আগে শ্মশানে পুড়িয়ে স্বামী দেবতার দেহখানা, ফিরছে আজ বহুদিন পর মায়ের কোলে!
ছোটমায়ের মেয়ে, আমার প্রিয় সেই রিমি!

সাঁঝের আকাশে ঝুঁপ করে নেমে আসে কালোরাত। ভাঁটিজলের কোন বেঁদেবহরে, বেঁদেনীর না’ও থেকে ভেসে আসে সুরঃ,”একজনমে মিটলো না সাধ, ভালোবাসিয়া…!”

ছোটমা! আমি যে তোমার মেয়ে  রিমিকে সত্যিই ভালোবাসতাম!

লেখক পরিচিতি: সিরাজুল ইসলাম

বিঃ দ্রঃ লেখাটি জানুয়ারি,২০২০, “মাসিক জনপ্রিয় লেখনী” প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।

SOURCEসিরাজুল ইসলাম
Previous articleউঁচু গলা
Next articleআপোষ
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here