সোঁদা মাটির গন্ধে ঋদ্ধ প্রেম ও দ্রোহের কবি রবীন্দ্র গোপ । বাঙালি জাতির নানা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের অসংগতি ও শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর অগ্নিদীপ্ত পঙক্তিমালা বাংলা কবিতায় নির্মাণ করেছে অনন্য কাব্যস্বর। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে তেজোদীপ্ত কবিতা পাঠের মধ্য দিয়েই কবিতাঙ্গনে পা ফেলা। বৈপ্লবিক চেতনায় ভাস্বর এ কবি লেখার জন্য জীবনে বহুবার নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়েছেন। কবিতাকে ভালোবেসে জীবনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত একজন মানুষ। সত্যকে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তিনি এক শব্দসৈনিক।রবীন্দ্র গোপের জন্ম ১৯৫১ সালের ৫ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অরুয়াইলের জয়নগরে। পিতা: শ্রী উপেন্দ্র গোপ, মাতা: শ্রীমতি যামিনী গোপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যে স্নাতক। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ জীবনের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকারের একমাত্র পত্রিকা- ‘জয় বাংলা’য় জীবনের কর্মযজ্ঞের শুরু।পঁচাত্তর পরবর্তী অন্ধকার সময়ে গণমানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লেখা জ্বালাময়ী কবিতা অল্প সময়ের ভেতরেই কবিকে দুই বাংলায় পরিচিতি এনে দেয়। অসাম্প্রদায়িকতা আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর পঙক্তিমালা উচ্চকিত হয়েছে সব সময়। সাধারণ মানুষের জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও উপকরণ বিচিত্র আঙ্গিকে উঠে আসতে দেখা যায় তাঁর কবিতায়। নয় এর দশকের শুরুর দিকেই তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত হতে থাকে কবিতার ভুবন। নব্বইয়ের স্বৈরাচারী আন্দোলনের সময়ও রবীন্দ্র গোপের কলম থেমে থাকেনি। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির শাসনামলেও কবির কবিতা গর্জে উঠেছে বারংবার।কবির প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আশি ছাড়িয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য বই- মুজিব আমার অন্তরে বাহিরে, লোককবিতায় বঙ্গবন্ধু (দুই খণ্ড), তুমিইতো বাংলাদেশ- শেখ হাসিনা, শোনো এক খোকার গল্প, বঙ্গবন্ধু মহাকালের মহামানব, বঙ্গবন্ধু-কবিতায় গানে গানে প্রাণে প্রাণে, শোনো এক রাসেলের গল্প, মানবতার মা-শেখ হাসিনা, রাসেল সোনার গল্প শোনো, মায়ের ভাষার গান, মুক্তিযুদ্ধের গল্পসমগ্র, বঙ্গবন্ধুর জীবনকাব্য, পতাকায় রক্তের দাগ, যুদ্ধ জয়ের গল্প, বত্রিশের সিঁড়ি, মুক্তিযুদ্ধ পথে পথে, জয়বাংলা, ফাগুন দিনের গান, ত্রিশ লক্ষ সূর্যের কবিতা, ছাগলের হাসি ও একটি পাউরুটি, নিষিদ্ধ স্বর্গ, আগুনের ফুল, ভগবান কেমন আছ, পেরেক বিদ্ধ প্রজাপতি, চিবুকে ঈশ্বর, ও সুন্দর একাকি থাকতে নেই।কবি সোনারগাঁও, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে পরিচালক পদে নিয়োজিত হয়ে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কবি কথাশিল্পী সাহিত্য পুরস্কার-স্বর্ণপদক, বিকাশ সাহিত্য পুরস্কার, কবি সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার স্বর্ণপদক, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘রূপসী বাংলা’-২০১০ পুরস্কার ও চয়ন সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তাছাড়া আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট কবিকে ‘ম্যান অব দি ইয়ার- ৯৮’ সম্মানে ভূষিত করে।
বৈপ্লবিক চেতনায় ভাস্বর কবি রবীন্দ্র গোপ সত্যকে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এক শব্দসৈনিক। মানুষের জয়ের স্বপ্নের সাথী কবি কবিতাঙ্গনে পা ফেলে প্রেম ও মানবীয় কোলাহলে পাঠককে জাগিয়ে তুলেছেন। শব্দাস্ত্র দিয়ে পৃথিবীর দুঃসহনীয় রক্তাক্ত সময়কে কবিতায় জীবন্ত করে তুলেছেন। শাণিত শব্দে সাজানো রবীন্দ্র গোপের কবিতা মানেই সমুদ্রের গর্জন আর বিভেদের দেয়ালের ভাঙন শব্দ। ‘নক্ষত্রের অভিষেক’ তাঁর একটি অমূল্য কবিতার বই। বইটিতে মোট ১০৪টি কবিতা রয়েছে। অনুভব প্রকাশন থেকে ১৯৯৯ সালে বইমেলাতে বইটি প্রকাশ হয়। বইটি পড়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যে উপলব্ধি জাগ্রত হয়েছে তা লিখে প্রকাশ সম্ভব নয়। তবুও যতটুকু বুঝতে পেরেছি তার আলোকে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
কল্পনাবিলাসী কবি রবীন্দ্র গোপের কল্পনার ভেলায় রকমারি চিন্তার ঢেউ খেলে যায়। বাস্তবতায় থেকে কবি পরজন্মে কি হবে ভাবনাকাতর হন, আবার পূর্বজন্মের স্মৃতি রোমন্থন করে মিষ্ট স্বাদ গ্রহণ করেন। কোন সুন্দরী সোনালি চা চামচে লেগে থাকা চিনি চুম্বনে রত দেখে কল্পনাকাতর হয়ে পরজন্মে হতে চান চামচ। কবির ভাষ্যে,’আহারে জীবন!যাক চলে যাক অনাদরে! পরজন্মে চামচ হয়েই আসবো পৃথিবীর বুকে।'(আমার পূর্বজন্ম পরজন্ম)জীবন যুদ্ধে হার না মানা হতদরিদ্র মানুষগুলো মানবেতর জীবন যাপন করে। তাদের বড় বড় হাইরাইজ প্রাসাদের ঝা ঝকঝক রুমে ঘুমাতে না পারলেও চলে। সুখের জন্য, একটু প্রশান্তির ঘুমের জন্য কবির ভাষায়,’প্রাসাদের পায়ের কাছে এতটুকু জায়গা হলেই হলো।'(কুকুরের জীবন বৃত্তান্ত) অথচ ডিফ ফ্রিজের ফল শাক সবজি মুরগির হাত পা খাওয়া বড় লোকের ছেলেপেলেরা ইচ্ছে হলেই অস্ত্রের মহড়া দেয়, ট্রিগার চাপে যাকে তাকে। কারণ কবির ভাষায়, ‘ওরা জানে বেওয়ারিশ লাশের খবর নিতে কেউ আসে না।’ (কুকুরের জীবন বৃত্তান্ত) মানব হয়ে জন্ম নিয়েছি বলেই মানব শ্রেষ্ঠ তা নয়। আমরা কুকুরের দলের বা তাদের চেয়েও অধম। কি খাচ্ছি না লুটে, চেটে পুটে? কুকুরের বাচ্চা বলে কেউ কেউ গাল দেয়, কবির ভাষায়, ‘লেজ গজাচ্ছে, বড় বড় দাঁত হচ্ছে, ভেতরে বাড়ছে শিং, মানুষ ক্রমেই ভিড়ে যাচ্ছে শুয়োরের দলে।'(কুকুরের জীবন বৃত্তান্ত)আমরা প্রতিনিয়ত মাথা নত করে ফেলছি অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য সাম্প্রদায়িকতার কাছে। বিসর্জন দিচ্ছি বিবেক, বিবেক বর্গাও দিচ্ছি, অর্থের কাছে নত শীর, নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, স্বার্থ হাসিলের জন্য, নিজের চামড়া বাঁচিয়ে চলার জন্য নগ্ন করছি শিক্ষাকে, সমাজকে। ক্ষীণ লাভের জন্য সূর্য-মাথাও পদতলে ফেলছি। কবির ভাষায়,’মাথা নত করতে করতে আমি আর পারছি না। আমার করতলে আমারই সূর্য-মাথা।'(মাথা)সভ্য সমাজের সভ্য মানুষগুলো সুযোগ পেলে অসভ্য হতে সেকেন্ড সময়ও ব্যয় করে না। যুবকের পাশবালিশে যে শূন্যতা কাদে তার ফলস্বরূপ অবলা নারীর স্বাধীন চলার পথে যে কত বড় রোধক তা সমাজ জানে। ফুটন্ত গোলাপে হিংস্র শার্দুল বৃষ্টি হয়ে বসলে বৃষ্টি বোঝে কেমন লাগে। কবির কবিতায় এ বাক্যই তার চিহ্ন বহন করে,’ঢোঁড়াসাপ এখানে ওখানে এক দু’টি মলামাছ ধরে খায়।'(বৃষ্টি)জল স্রোতধারা ঐক্যবদ্ধ কোলাকুলি বিদ্রোহী তরঙ্গ তুলে বিদ্রোহী সেজে, ফণা তুলে, আঁকাবাঁকা লেজ তুলে গোখরা সাপ ন্যায় সভ্যতা ধ্বংসে মাতে। উন্মাদিনী নদী জল্লাদ সন্তান সেজে সবকিছু শেষ করে দেয় সোনালি শস্য কেড়ে নেয়, সঞ্চিত ধন, সামান্য বসতি, গোয়ালের গরু, বুকের অবোধ শিশু সব কিছু রাক্ষুসী নদী কেড়ে নেয়। রাক্ষুসীর উন্মত্ত ছোবলে ভীষণ বিপন্ন মানবতা। কিন্তু সময় কালে এই বৃষ্টি থাকে না, জল থাকে না, খরায় খা খা করে ধূধূ প্রান্তর। কবির ভাষায়, ‘দেশ যখন খরায় পুড়ে যায়, চাতক যখন মেঘ দে মেঘ দে বলে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে তখন মেঘের চোখে তখন মেঘের চোখে এত বৃষ্টি কোথায় ছিলো?(নদী ফিরে যাও)
বর্ষার রূপ দিয়ে বাংলাদেশের পরী, গার্মেন্টস শিল্পের পদ্য গার্মেন্টস কর্মীদের কবি উত্তম রূপে বর্ণনা করেছেন। ভোরের পাখি ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে যায়, ক্ষুধার রাজ্যের রানী তারা, তবুও তারা কোমল কদম্ব বর্ষার বালিকা। ওদের দ্বারা দেশের উন্নয়ন হয়, তবুও ওরা ধূসর বালিকা। কবির ভাষায়, ‘খবরের পাতা জুড়ে ওরা খাদ্যের অভাবে মরে।'(বর্ষার ধারাপাত)প্রেম রাগের রাগে রচিত ‘চাঁদের বাসর ‘ কবিতাটিতে কবি চন্দ্রভুক কবিকে নিয়ে কল্পনাবিভোর। পূর্ণিমা রাতের প্রেম হাহাকারে হরিণী হৃদয় নেচে চলে। কবির ভাষ্যে,’অগ্নিময় বিশ্বে পূর্ণিমা চাঁদের বাসর সাজাবো’।(চাঁদের বাসর)শাদাটে পা আর তামাটে কালো পা দুই পা ভাইয়ের প্রাণখোলা কথোপকথনে সাজানো পা-ভাই কবিতাটি। হতে পারে পা দুটি একটি কৃষ্ণ পক্ষ অন্যটি শুল্ক পক্ষের মূর্ত প্রতীক। হতে পারে শাদাটে পা কোন নারী, তামাটে পা কোন পুরুষের প্রতীক। হতে পারে কোমল কমলা পাটি ভোগের বস্তু, অন্যটি বিপরীত। কবির ভাষায়,’একটি পা আলতা পরা, নূপুরের রিনিঝিনি বাজে, হোটেলে ক্যাবারে নৈশক্লাবে’।(পা-ভাই)ভাঙনের সুর শেষে, করুণ আর্তনাদ শেষে মানুষ আবার জেগে উঠে। নদী এক তীর ভেঙে আনন্দ পায়, অন্য তীর গড়েও আনন্দ পায়। মানুষের স্বপ্ন ভাঙে, আবার পলি বুকে জন্মে ফসলের বন্যা। কবির কথায়,’বন্যা শেষে এবার পলিমাখা উর্বর মাঠের বুক, উঠবে ভরে নদীর ঘরে সোনা সোনা ধান’।( জেগে উঠে মানুষ)নাসির আহমেদকে নিয়ে ও তাঁকে উৎসর্গীকৃত কবিতা ‘অন্তরে সুর বাঁশির’। লাল টিপে সজ্জিত আশালতার প্রেমমগ্ন নাসির কবিতা লেখেন হয়ত একাগ্রচিত্তে। কবির কলমে,’রমনীর কল কল ছল ছল শুধুই হাসির, প্রেমেরই কবিতা জলে সাঁতার কাটেন কলির নাসির’।(অন্তরে সুর বাঁশির)বেলা যায়, সময় যায়, প্রিয় যায়, প্রজাপতি যায়, বিরহ সঙ্গীতে যায়, কারুকার্যময়ে যায়। প্রত্যক্ষ থেকে পরোক্ষে বা একেবারে পরলোকে যায়। থেমে থাকে না কিছু, নদী বয়ে যায়, স্রোত বয়ে যায়, নির্বাসিত হয় কেউ, স্বপ্নগুলো ডাকে, স্মৃতিগুলো ডাকে। থাকার যে থাকবে, যাবার যে যাবে। কবির ভাষ্যে,’যাবার যেজন একাকী অাঁধারে ঢেউ ভেঙে যায়’।(দিন যায়)কবিতায় কবি কোন এক ফুলের দিকে চেয়ে বিভোর হয়ে যান। স্বপ্নবিলাসে প্রতিনিয়ত প্রকট হয়ে রাতের ঘুমকে ক্ষয় করে সে ফুল, ফুলকে ভুলতে পারেন না। জীবনে নামে নানা অসংগতি, বিষণ্নতা, উদাসীনতা, কিন্তু কোন অপরাধে, সুন্দরীর চোখে চোখ পড়ার কারণে? কবির ছত্রে,’এখন আমার কষ্ট লাগে, পাথর পাহাড় দাঁড়ায় বুকের মাঝে’।(হে ঈশ্বর আমার কী অপরাধ ছিলো)ঝিনুকের বুকে মুক্তোর খবর থাকে, মানব মনেও থাকে স্বপ্ন আশা, বাসনা। সাগর তলে সুখের প্রাসাদ থাকে, আকাশের বুকে থাকে স্বপ্নের খামার। কবির কাব্যে,’ঝিনুক ঝিনুক জীবন আমার বাড়ছে শুধুই বাড়ছে, বুকের ভেতর গোপন মুক্তোর খবর’।(ঝিনুক) জীর্ণতার বিদায় সজীবতার আগমনের গান গেয়েছেন কবি। হতাশা দুরাশার বিদায়ে সামনে সমাগত নতুনত্ব। নতুন বছরে একটি কুঁড়িতে নতুন ফুল ফুঁটবে, হাসবে ধরণী নতুন করে। পুরাতনের বিদায় আর নতুনের জয়গানের কবিতা ‘একটি বছর আগে’। কবির কথায়,’শেষ হলো বেলা যত ছিলো অবহেলা ছিলো যত খেলা যায় বেলা নতুন খেলায় বাজবে নতুন বাঁশি’।(একটি বছর আগে)বাঙালির মুক্তিদাতা গুরু বাঙালির শ্রেষ্ঠ বীর বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের গুণস্তুতি বর্ণিত হয়েছে ‘তোমার নামে যাত্রা শুরু’ কবিতায়। তাঁর নামেই কবি যাত্রা শুরু করতে চান। কবির ভাষ্যে,’তোমার নামে নাও ভাসানো তোমার নামে শস্য বোনা’।(তোমার নামে যাত্রা শুরু)
ত্যাগ তিতিক্ষা, আন্দোলন, রক্তগঙ্গা, সম্ভ্রমের বিনিময়ে পেয়েছি একটি শিশুপুত্র গণতন্ত্র। কবি এই শিশু পুত্রটিকে যত্নে রাখার আহ্বান গেয়েছেন এভাবে,’মাগো শিশুটির যত্ন নিও, ঠিক সময়ে পোলিও টিকা দিও, বড় অভাগা আমরা, শিশুটি অকালে যেন না হারায় প্রাণ’।(গণতন্ত্রের পুত্রসন্তান) ক্রান্তিকাল আমাদের সম্মুখে। দেশ যেন দুর্বিপাকে, চৌ আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। কেউ আর সহনশীল নেই। যেন ধেয়ে আসছে নিকষকৃষ্ণ অমানিশা আঁধার। কবির কলমে,’আজ হাসছে মানুষ মানুষের রক্তে স্নান সেরে’।(উলঙ্গ আঁধার)অরণ্য ভ্রমণে কবি বের হন। প্রকৃতির চমৎকার বর্ণনা করেছেন। সমুদ্রের জলকে তিনি প্রেয়সী ভেবে চুম্বন দেন। কবির কাব্যে,’সমুদ্র নাচতে নাচতে আমাদেরই সাথী হলো, আমার খুব ইচ্ছে হয় ওকে চুম্বনের’।(এক গ্লাস সমুদ্র)আকাশ নীল শাড়ি পরে, সাজে; কবির প্রেমিকারও একই অভ্যাস।কাব্যে,’মাঝে মাঝে আমি মেঘ হয়ে যাই, কখনো চিল হয়ে উড়ে যাই অনন্ত যাত্রায়’।(আকাশ)একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার কথা রূপকাচ্ছলে অনন্য হয়ে উঠেছে। বাংলার সমস্ত আকাশ জুড়ে আজ রক্তিম সূর্য। স্বাধীনতা অতি যত্নে লালিত একটি স্বপ্ন। কবির কাব্যে,’তোমার টবে একটি গাছ হয়ে বেঁচে আছি আমি স্বাধীনতা’।(জন্মের কথা)নেড়িকুত্তার ঘেউ ঘেউ আর শকুনের উড়াউড়িতে বাংলার আকাশ আজো বিশৃঙ্খল। আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকা যারা মলের পোকা খুঁজে খায় তারাই আজ কামড় দেয়। কবির কাব্যে,’ সে এখন মুক্তিযোদ্ধার চোখের তারা তুলে নিতে চায়’।(নেড়িকুত্তা) ভালোবাসার রঙিন চোখে প্রেয়সীকে কত রঙেই না সাজানো হয়, কত নাম দেয়া হয়, কত উপমায় না তাকে বর্ণনা করা হয়। কবিতাটি একটি প্রেমময় কবিতা। প্রেয়সীকে কবি ছায়াজয়ী পাখি বলে সম্ভোধন করেছেন। আরো লেখেন,’যেই তুমি বললে আমার পছন্দের কোনো ঋতু, বললাম তুমি’।(ভালোবাসা ঋতুর নাম কী)রূপকথার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের ছবি আঁকেন। ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গে জড়ো হলে পুলিশ হিংস্রতার রূপ নেয়। যাকে কবি বর্ণনা করেছেন এভাবে,’কুকুরেরা বেরিয়ে পড়েছে শহরের পথে’।(দুঃখের মাতৃভাষা) যৌবনকে যে লুকিয়ে রাখে তার মনে জন্মে শ্যাওলা, ও মনে উড়ে না শঙ্খচিল, ও মনে সাঁতার কাটে না মাছ, ও মনে বাস করে সাপ কেঁচো। কবি লড়াকু জীবন পছন্দ করেন, গোবর মেখে থাকাতে ঘৃণা করেন। ফুলকে ভালোবেসে কবি বেঁচে থাকতে চান। কবির কথায়,’আমি যদি একদিনও বেশি বেঁচে থাকি, তা ফুলের জন্যে তা কবিতার জন্যে’।(ফুলের জন্যে কবিতার জন্যে)কুসুমের জন্য কবির মনে হাহাকার। কবির যত স্বপ্ন তা কুসুমকে ঘিরে। কবির কথায়,’কুসুমের কান্না হাসি আমার বুকের মাঝে চুপিচুপি বাজে’।(কুসুম)প্রেম পিপাসাকাতর মন প্রেয়সীর কাছে হাজারো প্রার্থনা নিবেদন করে। নিঃসঙ্গতায় সঙ্গী হতে তাকে যেমন আকাঙ্ক্ষা করা হয় তেমনি সুখোজ্জ্বল মুহূর্তেও তাকে সন্নিকটে কামনা করা হয়। কবির কথায়,’গোপন হৃদয় জাগলো যখন কাছে তুমি টানতে পারতে’।(জীবন জলে আঁধার রাতে)মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। স্বপ্ন দেখে মন মানবীর, ভাল ভাবে বাঁচার, ক্যারিয়ারের। কবি ঘুমন্ত স্বপ্নে অবিশ্বাসী। তাঁর কাব্যে,’জীবিত স্বপ্নের খেলা ভালো লাগে, মৃত স্বপ্ন বড় কষ্ট দেয়’।(স্বপ্ন)জয়নগর বা তিতাসের বুকে কবি থেকে যেতে চান আর কোথাও যাবেন না। বৃক্ষ ছেড়ে, পাখি ছেড়ে, পূর্ণিমার চাঁদ ছেড়ে, নদী ছেড়ে কোথাও যাবেন না কবি। কবির ভাষায়,’অনন্তকাল ওর বুকে জলের সন্ন্যাসী আমি থেকে যাবো, আমার শৈশব, আমার মা, তিতাসের বুকে’।(আমাকে ডাকে আমার জয়নগর)স্পর্শ কবিতাটি নিখাঁদ প্রেমের। প্রেয়সীর প্রতি রয়েছে অনুনয় স্পর্শ করার। স্পর্শাকাঙ্ক্ষা আকুল কবি বলেন,’তুমি আমাকে স্পর্শ করো, দেখবে আমি প্রজাপতি হয়ে বসবো তোমার খোঁপায়’।(স্পর্শ)হানাদার বাহিনীকে নেকড়ের সাথে তুলনা করে কবি যুদ্ধ বিধ্বস্ত কালীন সময়কে বর্ননা করেছেন আপন তুলি দিয়ে। আগুনজ্বলা টগবগে লাল সূর্যের জন্য বাঙালির শৌর্য বীর্যের বর্ণনা আছে কবিতায়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে বর্ণনা করতে গিয়ে কবির কণ্ঠে, ‘কাঁধে ঝোলানো রাইফেল দিগন্ত বিস্তৃত একটি হাত ছুঁয়ে আছে রক্তিম ফুটন্ত সূর্যকে’।(সূর্যোদয়ের গল্প)যে গেছে এখানে যে কে কবি তা জানেন না। সবার মনে তুমি বলে একটা মানবী বসত করে। কবি তেমন কোন মানবীকে মনে লালন করেন। কবির কাব্যে,’কী তার নামটি, মাঝে মাঝে আমায় যে মনে পড়ে, তোমার কি এমন কাউকে মনে পড়ে?'(যে গেছে সে গেছে)
আমরা অতি সাধারণ মানুষেরা যাদেরকে কবি ইঁদুর বলছেন, প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছি বিড়াল সদৃশ কিছু অপশাসক দ্বারা। কবির ভাষায়, ‘বেড়ালের পায়ের নিচেই আমরা ইঁদুর-মানবেরা আছি বেঁচে’।(ইঁদুর-মানবেরা)ঘূর্ণিবায়ু সমুদ্রের জলকে আকাশে তোলে, প্রেয়সীও তেমনি আপন মাধুরী দিয়ে প্রিয়কে আকাশে তোলে, এমনি ভাবাপন্নের অতি প্রেমের কবিতা ঘূর্ণিবায়ু। কবির কলমে,’আমার সকল স্বপ্নকে মুহূর্তে তোমার আকাশে তুলে নিয়েছো’।(ঘূর্ণিবায়ু) পুষ্পিত বাগানে মায়াময় সন্ধ্যায় রজনীগন্ধা খোঁপায় কোন এক সুন্দরী এসে কবির চিন্তার সাগরে উত্তাল তরঙ্গ দিয়ে যায়। কবির ভাষায়,’তুমি আমার প্রিয় সখী রণে দিও না ভঙ্গ’।(কে আসে চুপিচুপি)মৃত্যু সন্নিকটে এলে সব মানুষ কত বড় একা হয়ে যায় তা কবিতায় উঠে এসেছে। কবির কথায়, ‘উজাড় উদাস মানুষগুলো মৃত্যুর কাছে খেলার পুতুল, যাবার বেলা চুপিচুপি কেউ জানে না’।(যাবার বেলা)মনের ভেতর প্রিয় মানুষটি নেই আর তাই বুক পিঞ্জরটা যেন পতিত স্টেশন। কবির কলমে,’তুমি নেই অথচ এই মানব জীবন পতিত স্টেশনে, দূরের ট্রেন শুধু হুইশেল বাজিয়ে বাজিয়ে যায় ‘।(দূরের ট্রেন যায়)মানুষ থাকে পথে প্রান্তরে শুয়ে যেখানে ষাঁড়ের মূল্য লক্ষ টাকা, মানুষের মূল্য নেই। কবির কথায়,’কুকুরকেও কুকুর বলি না কারণ কুকুরই আজ কাল বেশি, মানুষ দেখি না সে যে লাজে মরে’।(ষাঁড়)কল্পনাবিভোর কবি তাঁর ট্রাংকে রক্ষিত শার্ট প্যান্টের মধ্য দিয়ে কল্পনা করেন কোনটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, কোনটা কাজী নজরুল ইসলামের, আবার কোনটা অপশক্তির। যেমন তাঁর কাব্যে,’কোনোটা হয়তো খুনি তার পোশাক বদল করে রাজপথে ফেলে গেছে, তারপর স্বল্প মূল্যে সরাসরি উঠে এসেছে আমারই কালো ট্রাংকে’।(পুরনো পোশাকের জীবন যাপন)লম্পটরা যখন শাসিয়ে যান তখন কবি যৌবনের শক্তির কথা স্মরণ করেন। সে শক্তি কবির এখন নেই। মায়ের মুখের কথা টেনে কবি বলেন,’ছোটবেলা চুল ছিলো খাড়া, মা বলতেন, ছেলেটি আমার খুব রাগী হবে’।(অন্যের বল)বা-পায়ে গুলিবিদ্ধ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা একাত্তর সাল থেকে হাটছেন। কবি তাঁর স্বপক্ষে স্তুতি করে বলেছেন,’আমি কাউকে আমার রক্তে হোলি খেলতে দেবো না’।(লোকটা হাটছে)মানুষ একে অন্যের হাত ধরে এগিয়ে যায় এমনি ভাবাপন্নের কবিতা ‘মানুষ একে অন্যের কাছে’। মানুষ স্মৃতি কাতর। সময় চলে যায়। বয়স বেড়ে যায়। দেয়ালে ফাটল পড়ে। মরিচা ধরে শক্তিশালী পেরেকেও। এমনি ভাবের কবিতা ‘বিষণ্ন পেরেকের গান’। এক শ্রেণির শাসক শ্রেণি যারা শাসনকে আপন শক্তি ভেবে অপশাসন করে। কবি তাদের গণতন্ত্রের গরু আখ্যায়িত করেছেন ‘গ’তে গরু গ’তে গণতন্ত্র’ কবিতায়। মুখে গণতন্ত্র আর মনে অন্য চর্চা এমনি ভাবের কবিতা ‘গণতন্ত্রের শিং’। যে শিং গণ মানুষের দিকেই তেড়ে আসছে। কবি যুদ্ধ করেছেন একাত্তরের রণাঙ্গনে। দেশ যে স্বপ্নে স্বাধীন হয়েছিলো তা পূরণ না হওয়ায় ‘তোমাকে পাবার স্বপ্নে’ কবিতায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। নক্ষত্র অর্থাৎ নতুনের অভিযাত্রিকরাই মহাবিশ্বের দেখার ভার কাঁধে নেবে। অন্যরা হাল ধরলে ধরণীতে নামবে অমানিশা। সূর্যের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীত্ব কেড়ে নিলে লোডশেডিং তো হবেই। এমনি ভাবের কবিতা ‘নক্ষত্রের অভিষেক’। যে যে কাজে দক্ষ, যোগ্য তাকে সে কাজেই দিলে ফল আসবে আশানুরূপ। লেবুর রস কাটা ঘায়ে দিলে যন্ত্রণা বাড়বে, তাকে যদি ডাল ভাতে দেয়া যায় তবে খেতে স্বাদ হবে। এমনি অন্তর্নিহিত ভাব আছে ‘ডাল-ভাতে লেবু রস’ কবিতায়। শরৎকালের দুর্গা পুজার বর্ণনা আছে ‘শারদীয় সনেট’ কবিতায়। শরতের রূপের পাশাপাশি সরস্বতী, লক্ষ্মী ও কার্তিকের গুণকীর্তনও করেছেন কবিতাটিতে। স্রষ্টা থেকে সৃষ্টি, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষের বর্ণনা আছে ‘অসীমের কাছে’ কবিতায়। টানাপোড়েনের জীবনে স্বপ্নরা আহত হয়, শখ যতও আইন শাসনে বাঁধা পড়ে, ভালোবাসাও সময়ে হেরে যায়, থেমে যাই আমরা। এমনি কথা কাব্য ‘সময় দাঁড়ায়’ কবিতাটি। কুকুরি ডাকলে কবি ভয় পান, কুকুরিও ডাকা বন্ধ করে না, কবির ভয়ও কমে না, কুকুরি কবে ডাকা বন্ধ কবরে যেদিন শকুনেরা তুলে নেবে সভ্যতার চোখ সেদিন নাকি। এমনি ভাব গাড়ত্বের কবিতা ‘কুকুরির মরাকান্না’ কবিতা। বন উজাড় করে ঘর বাঁধি, তারপর সে ঘরেই করব বসত, নিজেকে নিজেরাই বন্দি জীবনে নিয়ে চলি। যা ‘খাঁচা’ কবিতার মূল ভাব। বিশ্ব মোড়লরা (যাদেরকে কবি শিকারি বেড়াল বলেছেন) ক্ষেপণাস্ত্রের যেমন ঝনঝনানি প্রদর্শন করে চড়ুইয়ের চেয়ে দুর্বল মানুষগুলোকে মারতে উদ্যত করি তা মানতে পারছেন না ‘পাখির অকালমৃত্যু মানবো না ‘ কবিতায়। ‘ভালোবাসা’ কবিতায় কবি দেখিয়েছেন ভালোবাসা বিরল জিনিস এখন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোর জন্য কবির মন ফুঁপিয়ে কাদে। তাঁদের দেখার কেউ নেই।’আকাশের প্রতিভা’ কবিতায় কবি আকাশের প্রতিভা, তার উদারতা দেখেছেন। আকাশ উদার হতে শেখায়, বৃষ্টি দেয়, ঊষর প্রাণে সজীবতা দেয়।ভোটের সময় জনগণের গুরুত্ব, ভোট কেন্দ্র দখল, বা বিরুদ্ধ দলের কথাবার্তা আছে ‘ভোটের সময়’ কবিতায়। মানুষের অপকর্মের স্বাক্ষী বৃক্ষ।বৃক্ষ সব দেখে, কি ভালো, কি মন্দ। বৃক্ষের প্রতি অনুরক্ত প্রকাশ পেয়েছে ‘সভ্যতার সুপ্রভাত’ কবিতায়। নিরন্ন ভাগ্যহত মানুষের জয়স্তুতি করেছেন ‘তোমাদের জন্য’ কবিতায়। স্বর্গ সুখ চান না কবি, নরক জ্বালা হলেও মায়ের কাছে থাকতে চান। কিন্তু মা মারা গেছেন, দিদিও বিধবা হয়েছেন। ঘাতকের ফাঁসি না হলে বাড়ি ফিরবেন না কবি। যা ‘মাকে চিঠি’ কবিতার মূল উপজীব্য। মানুষ অতীত স্মৃতি কাতর। অতীত ও অতীতের নানা কিছু হারানোর বেদনা বুকে জমিয়ে মিনার বানায় মানুষ, যা ‘স্মৃতির মিনার’ কবিতার মূলভাব। বাদামের দুটি দানা একটি গরীবের, অন্যটি ধনীর প্রতীক। যাদের হাতে বাদাম তারা বিশ্বকে পিষে মারছে। যা ‘বাদাম ভাই’ কবিতার মূলভাব। প্রিয় মানুষ, মনের কাছের মানুষ নীলাঞ্জনাকে ‘নীলাঞ্জনা’ কবিতায় নানা উপমায় সাজিয়েছেন কবি, কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতায় স্তবস্তুতি গেয়েছেন। ‘দাঁত’ কবিতা কবির রাজনৈতিক কবিতা। স্বাধীন মানব জীবন কীভাবে আর কেন গোলাকার কৌটায় বন্দি তা ‘নির্বাসিত’ কবিতার উপজীব্য। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মানুষ মঙ্গল গ্রহে বাড়ি করে ছাদ দেয়, এরা তো এক প্রকার চিন্তাশূন্য মরা মানুষই। (মরা মানুষের খবর)
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘রক্তমাখা বল’। ‘শিশুর অকাল মৃত্যু’ কবিতার মূলভাব যুদ্ধ ফেরত বা স্বাধীন যে ভূমি উভয়ই শিশু যারা কেউ ভালো নেই। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ, অন্ধকারে যাদের বাস কবি তাদের তেলাপোকা, ছারপোকা আর আরশোলা উপাধি দিয়েছেন ‘আরশোলাদের গল্প’ কবিতায়। ‘কবির রক্তে’ কবিতায় যারা কবিকে হত্যার হুমকি দেয়, কবির রক্তে যারা স্নান করতে চায়, কবিকে খুঁজতে যারা অস্ত্রের উল্লাস করে কবি তাদের ঘৃণা করেন। ‘দেবী বিসর্জন’ কবিতায় কবি কালী দেবীকে আহ্বান করেছেন পুনরায়, কারণ দেবী কালীই পারেন অপশক্তি আর অন্যায়ের রক্তপানে উন্মত্ত হতে, নরহত্যা করে নরমুণ্ড গলাতে রেখে নৃত্য করতে। ‘রণেশদা’ কবিতায় কবি রণেশদার ভূমিকা স্মরণ করেছেন তাঁর স্খলনে। ‘মধ্যরাতে’ কবিতায় কবি মধ্যরাতের বর্ণনা করেছেন, করেছেন স্মরণ জীবনের মধ্যাহ্নকেও। ‘শিউলি’ কবিতায় কবি দীর্ঘ রজনী জেগে শিউলি ফুল ফুঁটাতে চান, কারণ শিউলি ফুল ফুঁটলে পৃথিবী উজ্জ্বল হবে। ‘নগ্নযাত্রা’ আর ‘অন্যের বল’ কবিতা দুটির ভাবার্থ এক। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কবির যে প্রতিবাদী সত্তা ছিলো তা মারা যাবার কাহিনী আছে কবিতা দুটিতে। ‘একলা রাতে’ কবিতায় কবি প্রতিমাকে বকুল মালা পরাতে চেয়েছেন৷ ‘সাবান’ কবিতায় কবি সাবান উন্মুক্তকে প্রেয়সীর বস্ত্রহরণের সাথে তুলনা করে শব্দের মালা গেঁথেছেন। ‘স্বপ্ন আর্তনাদ করে’ কবিতার ভাবার্থ- যে হাত ট্রিগার চেপে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, যে মুষ্টিবদ্ধ হাতের ঐক্যে স্বেরাচারীর পতন হয় সে হাত আজ কিছু করতে পারে না। কবির স্বপ্নরা তাই কাদে। ‘তিতাসপারের বন্ধুরা’ কবিতায় কবি তিতাস পাড়ের স্মৃতিকে রোমন্থন করেছেন। ‘চিম্বুকে চুম্বনে’ কবিতায় কবি শস্যময় ভূমিকে আপন করে পাওয়ার ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছেন। ‘জুতো খুলে আসুন’ কবিতায় কবি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শুধু জুতো খুলেই দুঃশাসনের সৌন্দর্যমণ্ডিত ঘরে গেলে হবে না, হাত খুলে যেতে হবে কেননা সে হাত আজ বজ্রমুষ্ঠি হয়ে প্রতিবাদ করে না, মস্তিষ্ক খুলে যেতে হবে কেননা মগজ আজ চিংড়ির মগজের মতো বিক্রি হয়ে গেছে। ‘আগ্নেয়গিরি’ কবিতায় কবি যাকে কামনা করেছিলেন তার শব্দহীন আত্মাহুতি, যে পাখিটি পৃথিবীর বুকে বসবে তার বিঁধেছে বিষের ধারালো বাণ, যাকে সারারাত সাজিয়েছেন তার অকাল বিদায়ে কবির বুকে আগ্নেয়গিরি জেগেছে। ‘চোখের দরজা জানালা’ কবিতার বিষয়বস্তু পরাধীন দেশের বর্ণনা, মুক্তিযুদ্ধ, সে যুদ্ধে হতাহত, তারপর বিজয়োল্লাস, মুক্ত স্বদেশ, একটি লাল সূর্য। অপশক্তি, অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলনকে কবি চোখের দরজা জানালা খোলার সাথে তুলনা করেছেন। ‘চাঁদ’ কবিতায় জীবনের দুটি দিক বর্ণনা করেছেন, চন্দ্রালোকিত পরিবেশকে জীবনের সুখময় প্রতীক আর শীতের প্রগাঢ় কুয়াশায় ঢাকা চাঁদকে বিষণ্নতার বহিঃপ্রকাশ। ‘অগ্নিময় ভূভাগ’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা আছে। শকুনদের অত্যাচারের বর্ণনা আছে। আছে হানাদার বাহিনীর নির্মমতার, নিষ্ঠুরতার প্রকাশ। ‘আমি তোমারই’ কবিতায় প্রিয়ার নিপুণ চুম্বনে শরীরে বিদ্যুৎ চমকে যায় কবির। প্রেয়সীর মুখশ্রীতে কবি বিভোর, খোঁপায় গেঁথে দেন রক্তিম গোলাপ। প্রেমময়তায় ভরা কবিতাটি। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ কবিতায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা আছে। আছে জন্ম ইতিহাসের কথা। রক্ত দিয়ে স্বাধীন করা একটি দেশের ত্যাগের কথা আছে। আছে রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনার গল্প। ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিনীত নিবেদন’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রবীন্দ্র টুকু কবি রবীন্দ্র গোপের নামের সাথে থাকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন। এবং ‘শতাব্দীর শেষ বসন্তের দিনে’ কবিতায় কবি অতীত স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। বসন্ততেই আসে একুশে ফেব্রুয়ারি। তার কথাও আছে কবিতাটিতে। এছাড়াও অন্তর্গত নীলিমায়, স্বপ্ন আর স্মৃতির যুদ্ধ, নদী নাচে, স্মৃতির বেদনা, আঙুলে নক্ষত্র, তোমার জন্য, বৃক্ষকে ভালোবেসে, নদী, পেরেকে বিদ্ধ স্মৃতি, বেদনার ভাত, ভোরের গান, এপিটাফ, আঁধারে একা, চন্দন কলম, তোমাকে পাবার স্বপ্নে, রহস্যজনক রাতের আত্মা কবিতায় আছে বিচিত্র ভাবনার প্রকাশ। রবীন্দ্র গোপের তেজদ্বীপ্ত কবিতার কতটুকুই ক্ষুদ্র পাঠক হয়ে আমি আর বুঝতে পারি? ভিন্ন আঙ্গিকের ভাষাশৈলী দিয়ে কবি কবিতাগুলি লিখেছেন। কবির কবিতা পড়ে কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাবোধ বেড়েছে। কি নান্দনিক ভাষা প্রকাশ আর বর্ণনা কৌশল। কবিতায় ৫২, ৭১ কি দারুন ভাবে বিন্যস্ত। সৌন্দর্যময়তা, স্নিগ্ধচিন্তা, আধ্যাত্মচিন্তা, প্রেম, জীবনবোধ, চেতনাবোধ, প্রকৃতিপ্রেম, ভ্রামণিক চিন্তা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। ‘নক্ষত্রের অভিষেক’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে যে জ্ঞান অর্জন করেছি, সৌন্দর্যের যে ছোঁয়া পেয়েছি, আর যতটুকু পুলকিত হয়েছি তা লিখে প্রকাশ অসম্ভব। দীর্ঘজীবী হোক কবি, বেঁচে থাকুন কবিতায়, কবিতার মত স্নিগ্ধ হয়ে।
কলমে সৌমেন দেবনাথ, নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ